কথাশিল্পী বিশ্বজিৎ চৌধুরীর ‘রক্ত’ গল্পটি একাধিকবার পড়েছি। প্রতিবারই গল্পের শেষে স্থানুর মতো বসে থেকেছি। হয়তো আশির দশকের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার অতিচেনা রাজনৈতিক চিত্রটি চোখের সামনে এসে পড়ে বলে! পাঠান্তে বর্তমানের কাল মঞ্চে এসে দাঁড়ান ১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্টের ৩২ নম্বর বাড়ির সিঁড়িতে বঙ্গবন্ধু, মনে হয় এক পুনর্জাত জনকের গুলিবিদ্ধ ঝাঁঝরা শরীর লুটিয়ে পড়েছে কানাডার টরেন্টো শহরের সবচেয়ে বড় মিলনায়তনটিতে। ‘শেষ দৃশ্যটা ছিল গুলিবিদ্ধ শেখ মুজিব লুটিয়ে পড়ছেন তাঁর বাড়ির সিঁড়ির ওপর। পুরো মঞ্চে তখন লাল আলো, রক্তের রঙ। ‘
নাটক শেষে দর্শকের অশ্রুসজল মুহুর্মুহু করতালিতে পর্দা নেমে আসার কালে নাট্যনির্দেশক ও স্ক্রিপ্টের বাইরে এসে বঙ্গবন্ধুবেশী তরুণ অভিনেতা ঋজু চিৎকার করে ওঠে, ‘স্টপ! নট নাউ, ডোন্ট ড্র দ্য কার্টেন এট দ্য মোমেন্ট। এখনই পর্দা নামাবেন না। এই দৃশ্য এখানে শেষ হতে পারে না।’
পর্দা খুলে গেলো আবার, দর্শকরা স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে পড়লো যে যার জায়গায়। আমার শেখ মুজিব, আমার লাজুক মুখচোরা ছেলেটা তখন দৃপ্তকণ্ঠে দীপ্ত ভঙ্গিমায় বলছে: ‘সুধীমণ্ডলী, প্লিজ ডোন্ট লিভ দ্য থিয়েটার হল নাও। এই দৃশ্য এভাবে শেষ হতে পারে না। শেখ মুজিব ক্যান নট ডাই ইন দিস ওয়ে। শেখ মুজিব উইল লিভ অ্যাজ লং অ্যাজ বাংগালিজ ড্রিম, বাংলা ল্যাগোয়েজ সারভাইবস। বে অব বেঙ্গলের জলের কোলাহল যতদিন থাকবে, ঢেউয়ের উচ্ছ্বাস যতদিন থাকবে, ততদিন বেঁচে থাকবেন শেখ মুজিব।’
এমন একজন তরুণ এই কথাগুলো বলছে যে শিশু বয়সে এই বাংলাদেশ ছেড়ে সুদূর কানাডায় চলে গেছে, শুধু তাই নয়,তাকে তার মা প্রীতি শঙ্কা ও সতর্কতার সঙ্গে তার বাবার রাজনৈতিক পরিচয় জানানো থেকে বিরত থেকেছে। কেননা তার ভালো মানুষ দেশপ্রেমিক বাবাটি রাজনৈতিক কারণে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার ও পরবর্তী সময়ে ৯১-এর নির্বাচনে জয়লাভকারী বিএনপি সরকারের হাতে চরমভাবে নির্যাতিত হয়েছে। প্রীতির বাবাও বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার চেয়ে গুম হয়ে গিয়েছিলেন। তাই স্বামীর শারীরিক নির্যাতনের পরে, দেশ ছেড়ে পালানোর জন্য গল্পের নায়িকা প্রীতি রজতকে অর্থাৎ রিজুর বাবাকে কোনোভাবেই রাজি করাতে পারলো না। তখন মা হিসেবে সন্তানকে বাঁচানোর জন্য সুদূর কানাডায় পাড়ি জমানো ছাড়া আর কোনো পথ খোলা ছিল না। গল্পটি একটি চিঠি অথবা ডায়েরির মতো বিবৃত হয়েছে প্রীতির জবানিতে।
নাটকের শেষে সেই একুশ বাইশ বছরের ছেলেটি দর্শকের কাছে অনুনয়ে ভেঙে পড়ে,
মুহুর্মুহু করতালিতে মুখর তখন মিলনায়তন। টানা কয়েকমিনিট ধরে চলল বাংলার বর্ষনমুখর দিনের অবিরল বৃষ্টিধ্বনির মতো করতালির শব্দ।
দর্শক যেন ততক্ষণে অভিনেতার নির্দেশের কাছে সমর্পিত। ঋজু বলল—‘আই আর্জ ইউ অল টু সে ওয়ানস—বঙ্গবন্ধু মরে নাই।
সে এক অভাবিত ঘটনা! বাঙলা, ইংরেজি, স্প্যানিশ, হিন্দি, উর্দু তামিল—নানা ভাষাভাষী কয়েকশ দর্শক তখন শুদ্ধ-অশুদ্ধ উচ্চারণে প্রকম্পিত করে তুলল মিলনায়তন—‘বঙ্গবন্ধু মরে নাই।’
গল্পটিতে যে সময়কালটি ধরা হয়েছে, তার মনস্তত্ত্ব, ইতিহাস, রাজনীতি, কদর্যতা, হিংস্রতা, মানুষের অসহায়ত্ব—বিচিত্র জীবনচিত্রে ধরা পড়েছে। প্রতিটি গল্পের একটি দেহ ও একটি প্রাণ থাকে। এই দ্বৈরথকে মিলিয়ে যে পাঠক আত্মাকে আত্মস্থ করবে তাই তার এবং লেখকের বড় প্রাপ্তি। সেই প্রাপ্তির চিহ্নায়নেই আমার এই লেখা।একটি দেশের দেহ কেবলই নয়, তার মনন রাজনীতি অর্থনীতি সমাজতত্ত্ব ইত্যাকার ব্যক্তিকেন্দ্রিক বিষয়গুলো একজন লেখকের কাছে স্পষ্ট না হলে, এত অল্পে এমন গভীর বোধ তিনি নির্মাণ করতে পারেন না। বলা হয়ে থাকে, বাংলা ছোটগল্প বৃত্তায়িত। বিশ্বযুদ্ধ যেমন লাতিন আমেরিকা, ব্রিটেন এরকম বিভিন্ন দেশের গল্পের মধ্যে বহুবৈচিত্র্য ও থিম এনে দিয়েছে,বাংলা গল্পে তা অপ্রতুল।কিন্তু গল্প বলায় বিশ্বজিৎ চৌধুরী দারুণ পারঙ্গম। তিনি পাঠককে ছাত্র মনে করেন না। এটি একটি রাষ্ট্র ও ব্যক্তির অসম দ্বৈরথের আখ্যান। যে-কোনো গল্পে যখনই লেখক ঘটনার বিশ্লেষণে চলে যান, তখনই গল্পটি তার ঋজুত্ব হারায়। ঘটনা বলতে গিয়ে আগ বাড়িয়ে বিশ্লেষণ গল্পটিকে খেলো করে তোলে। সেক্ষেত্রে বিশ্বজিৎ চৌধুরী খুবই বিচক্ষণ। দেশকে ভালোবাসা সত্ত্বেও এ দেশের রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের শিকার ভিনদেশে আশ্রয়কামী মানুষের জীবনের করুণ আখ্যানে তিনি সিদ্ধহস্ত।
এখানে একজন স্ত্রী বা প্রেমিকা জীবনের শেষ সময়ে এসে খুন হয়ে যাওয়া রাজনীতিক বাবা অথবা প্রায়পঙ্গু স্বামীর চেতনার মশালটি সন্তানের আত্মায় প্রজ্বলিত দেখতে পায়,সেখান থেকেই এই গল্পের শুরু। একটা গ্লানির ভেতর থেকে বহুদিন পর নায়িকা প্রীতি আবারও ফিরে আসতে চায় তার সন্তানকে নিয়ে, সন্তানের বাবা ও দেশের কাছে।একদিন সীমাহীন ক্ষমতার রক্তলোলুপতায়, প্রতিযোগিতায় আমাদের নিরাপত্তা মানবিক প্রত্যয়গুলো যখন লুপ্তপ্রায় কোনঠাসা, তখন সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে গুম হওয়া রাজনীতিক আবু মাহমুদের সন্তানের আর কীইবা করার ছিলো? কামরুল হাসান রজতকে সে ভালোবাসেছে ঠিকই কিন্তু রাজনীতিকে ভয় পেতে শিখেছে,শ্রদ্ধা করতেও। রজতের বিশুদ্ধ রাজনীতি আর সাংস্কৃতিক মন তাকে মুগ্ধ করেছে।রজত এইসব প্রেমে সময় কাটাবার পাত্র নয়,পুরোদস্তুর রাজনৈতিক কর্মী।কিন্তু প্রীতির সাথে পরিচয় পর্বে সে বিস্মিত হয়।
‘কিন্তু আমার বাবার নাম শুনে চমকে উঠেছিলে! বলা যায়, তখন থেকেই আমার জন্য আলাদা করে জায়গা তৈরি হলো তোমার মধ্যে। তুমি আমাকে সেদিন জিজ্ঞেস করেছিলে, ‘আবু মাহমুদ আপনার বাবা?’
‘জি।’
‘মৌলভী সৈয়দের নেতৃত্বে গেরিলা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন আবু মাহমুদ, তিনি আপনার বাবা?’
‘জি, তিনিই।’
‘আচ্ছা, পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর আপনার বাবারা কিছু একটা করতে চেয়েছিলেন…।’
‘জি, প্রতিরোধ যুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র দখল করতে চেয়েছিলেন।”
একদিন তাদের সংসার হলো, সন্তান হলো কিন্তু লাগামহীন সহিংসতা অত্যাচার ধূর্তামি, সুবিধাবাদ, হত্যা-গুম প্রীতিকে একটা ট্রমার মধ্যে ফেলে দিল। অপহরণের পরে নির্যাতিত রজত ফিরে এলে প্রীতি সপরিবার পালাতে চাইল।
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পরে বাংলাদেশের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ সময়কে তুলে আনা হয়েছে এই গল্পে। সেই সময়ের সামাজিক রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক কাঠামোকে বিশ্বজিৎ যেভাবে উপস্থাপন করেছেন—তা উপলব্ধি করা অত্যন্ত জরুরী ।
আয়নায় ভালো করে দেখতে হলে যেমন একটু দূরে যেতে হয়, প্রকৃত ইতিহাস রচনার জন্য যেমন সময় থেকে একটু দূরে যেতে হয়, তেমনি দেশ থেকে দূরে থেকেও কোনদিন যে তরুণেরা প্রকৃত ইতিহাস নির্মাণ করতে পারবে না—কথাটি হয়তো সঠিক নয়।মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অথবা তার ক্ষত নিয়ে এখনই আমাদের সব সিদ্ধান্ত শেষ হবে না। বহু বছরের উপলব্ধিসঞ্জাত আমাদের সন্তানেরা একদিন সেই সত্যের দলিলটি লিখবে। গল্পটি সেই উপলব্ধিই এনে দেয়।
অগ্রসর চিন্তার এই তরুণটি যদি তার মাতৃভূমির সত্যিকার ইতিহাস না-ই জানত, তাহলে সে নাটকের শেষে স্ক্রিপ্টের বাইরে এই কথাগুলো কী করে বললো! বিস্মিত আবেগাপ্লুত নাট্য নির্দেশক সালেক খান তখন প্রীতির হাত ধরে বললেন—এই আগুন কোথা থেকে পেলো ছেলেটা!
তীক্ষ্ণ সমাজচেতনা ও ইতিহাসবোধ বিশ্বজিৎ চৌধুরীর গল্পের একটি অনন্য দিক। তিনি যে কবি, তা পাঠক বুঝে নেবেন গল্প বলার মনমুগ্ধকর ভাষা, ভঙ্গি ও বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনায়। ‘বাংলা ছোট গল্প কি মরে যাচ্ছে?’ আশির দশকে তুমুল আলোড়িত কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের এই প্রশ্নটি আজ অবান্তর হয়ে উঠেছে । গভীর সমাজ সমীক্ষণের কাহিনী বয়ানে আঙ্গিক হিসেবে ফ্ল্যাশব্যাকের বিস্তৃতি অনেকটা নাটকীয়তা এনে দিয়েছে। তাতে গল্পের গাঁথুনি ক্ষুণ্ন হয়নি। গল্পের ধারাভাষ্য— মূলত এদেশের ঐতিহাসিক একটি প্রেক্ষাপটের, ছাত্র রাজনীতির ক্ষতি ও ক্ষতের শিকারের অজস্র মানুষেরই প্রতিনিধিত্ব করে। এই আত্ম অনুসন্ধান অত্যন্ত শক্তিশালী। একটি সুস্থ ধারার দেশ ও রাজনীতি বিনির্মাণের রাজনৈতিক বার্তাটি গল্পের ভেতর সচেতন পাঠক পড়ে নিতে পারবেন। গল্পের রজতকে হয়তো সংসারের প্রতি উদাসীন মনে হতে পারে।
নায়িকা প্রীতিকে মনে হতে পারে আত্মপর।কিন্তু আমরা যখন দেশকে গভীরতায় ভাববো,যেমন ভেবেছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা,রজতের কাছে পারিবারিক অস্তিত্বের চেয়ে রাজনৈতিক অস্তিত্ব ছিলো গুরুত্বপূর্ণ। অন্যপক্ষে নিরাপত্তা, অধিকার এসব প্রশ্নে দেশের রাজনৈতিক অত্যাচার, ধূর্তামো, সুবিধাবাদ,ডাক্তার মিলন, নূর হোসেনসহ অসংখ্য হত্যাকাণ্ডের পরবর্তীতে মানবতাবিরোধী অপরাধীদেরে নিয়ে গঠিত নতুন সরকার প্রীতির মাতৃত্বকে ভীত করে তোলে। সে তাই শিশু সন্তানটিকে নিয়ে দেশত্যাগে বাধ্য হয়। রজতকে ভুলে যায় না। ভালোবাসে। কানাডার অনিশ্চিত ডুবে যাওয়া জীবনে দেবতাতুল্য শামীম তাদের আশ্রয় দিয়ে সহযোগিতা করে বাঁচিয়ে রাখে। এভাবেই নতুন জীবনে বাংলাদেশ থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে উঠলো প্রীতি। এতদিন সন্তানকে তার বাবার রাজনৈতিক গল্প এড়িয়ে অন্য গল্প বলে ভুলিয়ে রেখেছে। কিন্তু আজ হাজার দর্শকের সামনে যে দাবি জানালো ঋজু, তা কেবল অন্তর্গত রক্তেরই স্বর—এ কথা উপলব্ধি করতে সময় লাগলো না তার। ইতিহাসের অভিজ্ঞান খোলা এই গল্পটি ভালো লাগবে পাঠকের। আমি মনে করি, এ রকম একটি গল্প আমাদের তরুণ প্রজন্মের পাঠ্যসূচিতে সংযুক্ত হওয়া অত্যন্ত জরুরি।