বিনয় মজুমদার—নামটি কবিযশপ্রার্থী সবার কাছেই ঈর্ষণীয়। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘গায়েত্রীকে’। এরপর ‘ফিরে এসো, চাকা’, ‘আমার ঈশ্বরীকে’, ‘নক্ষত্রের আলোয়’, ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’, ‘বাল্মীকির কবিতা’ ইত্যাদি। গায়েত্রীকে বা আমার ঈশ্বরীকে এবং ফিরে এসো, চাকা মূলত একটিই কাব্যগ্রন্থ। আর কবি বিনয় মজুমদার নামটি বলতেই, মনের পর্দায় উঁকি দিয়ে ওঠে ‘ফিরে এসো, চাকা’ কাব্যগ্রন্থটি। বাংলা কবিতার ইতিহাসেই কবির নামের পাশাপাশি তার একটি কাব্যগ্রন্থের নাম উচ্চারিত হওয়ার ঘটনা খুবই কম। জীবনানন্দ দাশ বলতেই—যেমন সাধারণের মনে উঁকি দেয় রূপসী বাংলা তেমনি বিনয় মজুমদারের ক্ষেত্রে ফিরে এসো, চাকা। এই কাব্যগ্রন্থটি ছাড়া আরও কয়েকটি কবিতার বইয়ের সঙ্গে তার নাম জড়িয়ে থাকলেও বিনয় মজুমদারের কবি স্বীকৃতির পেছনে এই একটি কাব্যগ্রন্থই অনন্য ভূমিকা পালন করছে। এর সঙ্গে ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ কাব্যগ্রন্থটিও কবিকে বিশিষ্টতা দিয়েছে। মূলত বিনয় মজুমদারের এই কাব্যগ্রন্থ দুটি নিয়েই আলোচক-সমালোচক এবং পাঠকের আগ্রহ। এই দুটি কাব্যগ্রন্থই তাকে দিয়েছে কবিখ্যাতি। তাকে করে তুলেছে কবিযশপ্রার্থীদের কাছে ঈর্ষণীয়।
বাংলা কবিতায় নানান সময়ে আবির্ভূত কবিদের কাব্যগুণ বিচারে আলোচক-সমালোচকরা তাদের নানা ভূষণে চিহ্নিত করেছেন। সেইসব অভিধা কারও কারও নামের সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে গেছে যে, তাদের ওই পরিচয়ের বাইরে অন্য পরিচয় সাধারণের অজানা। এমনকি পরবর্তীকালের সমালোচক-আলোচকরা নতুন করে আলোচনার সময়েও পূর্ববর্তীদের আলোচনার রেশ ধরেই এগুতে থাকেন। ফলে কবির গায়ে লেগে যাওয়া তকমা আর সরে না। জীবনানন্দ দাশকে যেমন বলা হয়েছিল রূপসী বাংলার কবি, এর পরে জীবনানন্দ দাশের কবিতায় এতো এতো দিক আবিস্কৃত হয়েছে, আলোচিত হয়েছে, কিন্তু সেই রূপসী বাংলার কবি অথবা ধূসর পাণ্ডুলিপির কবির তকমা সরিয়ে ফেলা যায়নি। বিনয় মজুমদারকেও কোন কোন সমালোচক নানান অভিধায় অভিহিত করতে চেয়েছেন। তবে সকল অভিধার বাইরে এসে বিনয় মজুমদার তার কবিতার স্বতন্ত্রতা দিয়ে নিজেকে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ করে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। কবিতার বিচারে মাত্র একটি কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে কবিদের কবি হয়ে ওঠা বিনয় মজুমদারের স্বাতন্ত্র্য তার অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ কাব্যগ্রন্থ ফিরে এসো, চাকা।
বিনয় মজুমদার তার কবিতায় অভিজ্ঞতার বর্ণনা করেছেন। দর্শনের চর্চা করেছেন। খুঁজে ফিরেছেন বিজ্ঞানীর মতো, ধ্যানীর মতো সব কিছু থেকে উদ্ধারের পথ। তিনি কবিতায় সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, আবার প্রশ্নের উত্তরও খুঁজে ফিরেছেন। একইসঙ্গে তিনি প্রশ্নকর্তা এবং উত্তরদাতার ভূমিকা নিয়েছেন। তাই সচেতন ভাবেই তিনি বলতে পেরেছেন—‘আমিই তো চিকিৎসক—ভ্রান্তিপূর্ণ চিকিৎসায় তার/মৃত্যু হলে কি প্রকার ব্যাহত, আড়ষ্ট হয়ে থাকি।’ এই চিকিৎসক ও চিকিৎসা ব্যাহত হলে আড়ষ্ট হয়ে থাকার মধ্যই দিয়ে বিনয় মজুমদার তার কবিতায় তুলে ধরেছেন আশ্চর্যরকম সব পঙ্ক্তিমালা। আর সেইসব পঙ্ক্তির ভেতর দিয়ে তিনি তুলে ধরেছেন প্রকৃতিকে। কারণ তিনি জানতেন, ‘বৃক্ষ ও প্রাণীরা মিলে বায়ুমণ্ডলকে সুস্থ, স্বাস্থ্যকর রাখে।’ আর এজন্য প্রয়োজন ভালোবাসা। তাও তিনি ফুটিয়ে তোলেন, প্রকৃতির বর্ণনার ভেতরে দিয়ে—‘…ভালোবাসা দিতে পারি আমি।/শাশ্বত, সহজতম এই দান-শুধু অঙ্কুরের/উদ্গমে বাধা না দেওয়া, নিষ্পেষিত অনালোকে রেখে/ফ্যাকাশে হলুদবর্ণ না ক’রে শ্যামল হতে দেওয়া।’ (৬৫ : ফিরে এসো, চাকা)।
বিনয় মজুমদার তার দুইটি কাব্যগ্রন্থ ‘ফিরে এসো, চাকা’ ও অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’র ভেতরেই প্রকৃতির নিখুঁত বর্ণনা করেছেন। গাছ, ফুল, পাখিকে তুলে এনেছেন। আর এই তুলে আনার ভেতরে দিয়ে তিনি সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেছেন ফুলের। ফুল দিয়েই তিনি নানা উপমায় বর্ণনা করেছেন অনুভূতিমালা। আর ফুলের ক্ষেত্রে তার প্রিয় ‘বকুল’। শুধু অঘ্রাণের অনুভূতিমালা কাব্যগ্রন্থেই নয়, তিনি ফিরে এসো, চাকা কাব্যগ্রন্থেও নানাভাবে ফুলের বর্ণনা দিয়েছেন। আর সেক্ষেত্রে নাম ধরে বার বার বলেছেন বকুলের কথা। ফুলের বর্ণনার মধ্য দিয়ে তিনি যেমন নারীকে প্রকাশ করেছেন, প্রেমের প্রকাশ করেছেন, তেমনি যৌনতাকেও স্পষ্ট করে তুলেছেন ফুলের মধ্যে দিয়ে। বকুলের রূপের মধ্য দিয়েও তিনি নারী, প্রেম এবং যৌনতাকেই স্পষ্ট করেছেন। ফুল এবং বকুলের পরপর কয়েকটি উদাহরণ, আলোচ্য দুইটি কাব্যগ্রন্থ থেকে।
শিশুকালে শুনেছি যে কতিপয় পতঙ্গশিকারী ফুল আছে।
অথচ তাদের আমি এত অনুসন্ধানেও এখনো দেখিনি।
(৩ : ফিরে এসো, চাকা)সকল ফুলের কাছে এতো মোহময় মনে যাবার পরেও
মানুষেরা কিন্তু মাংসরন্ধনকালীন ঘ্রাণ সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে।
(৬: ফিরে এসো, চাকা)ফুলের কাঁটার মতো কিংবা অতি দূর নক্ষত্রের
পরিধির মতো তীক্ষ্ণ, নাগালের অনেক বাহিরে।
(১৩: ফিরে এসো, চাকা)
…বকুলের মতো শেষে
শুকিয়ে খয়েরি হয়ে, দীর্ঘস্থায়ী হয়ে মালিকায়
কোনোদিন আসবে কি,
(২২: ফিরে এসো, চাকা)… কুক্কুপিন্ট ফুলের ভিতরে
জ্বরাক্রান্ত মানুষের মতো তাপ; সেই ফুল খুঁজি।
(৩৭: ফিরে এসো, চাকা)…ফুলের সহিত আলোচনা
করা তো সম্ভব নয়, যেতে হবে পিতার সকাশে।
(৪৪: ফিরে এসো, চাকা)ব্যথিত আগ্রহে দেখি: এত ফুল, কোনটি বুঝি না।
(৫৯: ফিরে এসো, চাকা)আমার আশ্চর্য ফুল, যেন চকোলেট, নিমেষেই
গলধঃকরণ তাকে না-ক’রে ক্রমশ রশ নিয়ে
তৃপ্ত হই,
(৭০: ফিরে এসো, চাকা)ক্রিসেনথেমাম ফুল-ফুলে ফুলে একাকার ভোরের কেয়ারি;
একটি নিটোল গোল পরিধিতে প’ড়ে আছে শীতের রোদ্দুরে।
(অঘ্রাণের অনুভূতিমালা)সকল বকুল ফুল শীতকালে ফোটে, ফোটে শীতাতুর রাতে
যদিও বছরভর, আষাঢ়ে-আশ্বিনে, চৈত্রে বকুলের নাম শোনা যায়,
(অঘ্রাণের অনুভূতিমালা)শুনি বকুলের খ্যাতি, বকুলের প্রিয়তার সকল কাহিনী
তবু খুব অন্তরঙ্গ মহলেই শুধুমাত্র আলোচিত হয়
তাও ঢাকাঢাকি করে এ-সব নরম আর গোপন বিষয়
বকুল ফুলের ওই গোলাকার ফাঁকটিতে কোমর অবধি
ঢুকে গিয়ে শেষমেষ বেরোতে না-পেরে তুমি আটকে গিয়েছো।
(অঘ্রাণের অনুভূতিমালা)বলি, ও বকুল, তুমি বোঝো নাকি কুঁড়িগুলি খুব বেশী ছোটো,
আরো ঢের বড়ো-বড়ো নরম-নরম গোল হবার কথা না?
(অঘ্রাণের অনুভূতিমালা)বকুলের আকারের মতো এক নারী আছে—শঙ্খমালা আছে।
(অঘ্রাণের অনুভূতিমালা)তুমি কি ভেবেছো আমি এই মেয়েটির দেহে-শরীরের ফাঁকে
ফুটে থাকা ফুল শুধু
(অঘ্রাণের অনুভূতিমালা)হেসে ফেললেই এই ঠোঁট-দুটি এত বেশী ফাঁক হয়ে যায়!
গোলটুকু এত বেশী ফাঁক হয়ে যায় কেন বকুল, বকুল,
(অঘ্রাণের অনুভূতিমালা)বন্ধ্যা বলে বকুলের রূপ এতো আঁটোসাঁটো, ঢলঢলে নয়।
(অঘ্রাণের অনুভূতিমালা)দু-পাতার ফাঁকে থাকা একটি বকুল ফুল হাতের মুঠোয়
চেপে ধরে চুপচাপ-চুপি চুপি চা দিয়ে চলেছি এখন।
(অঘ্রাণের অনুভূতিমালা)
জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন—’সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’। সেই কেউ কেউ কবিদেরই একজন বিনয় মজুমদার। কবিদের কবি বলেও যে কথা প্রচলিত রয়েছে, বিনয় মজুমদার নামটি সেই সত্যেরও ধারক।
বিনয় মজুমদার একজন ধ্যানীর মতো প্রকৃতিকে পর্যবেক্ষণ করেছেন, একজন নিখুঁত দ্রষ্টার মতো আগামীর সন্ধান করেছেন, একজন দার্শনিকের মতো সিদ্ধান্ত দিয়েছেন তার কবিতায়। ফলে তার কবিতা পাঠকের কাছে হয়ে উঠেছে এক বকুল শোভিত আশ্রয়। ফুলের প্রতীকে তিনি যেভাবে জীবনকে খুলে দেখার আগ্রহ ব্যক্ত করেছিলেন, যে চেনাজানা জগতের বর্ণনায় বারবার পাঠককে নিয়ে গেছেন আন্তরিক অভিজ্ঞতার কাছে। যে আবেগে তিনি বলেছেন, ‘আমি তো চাঁদ নই, পারি না আলো দিতে/ পানি না জলধিকে আকাশে তুলতে।/ পাখির কাকলির আকুল আকুতিতে/ পারবো কি তোমার পাপড়ি খুলতে?’ (নক্ষত্রের আলোয়)। সেই আবেগ, সেই অভিজ্ঞতা আর বর্ণনার মাধুর্যই তাকে দিয়েছে অক্ষয় আসন। যে পাপড়ি খোলার ব্যাকুলতায় তিনি গায়েত্রীকে খুঁজেছেন, তাই তার পঙ্ক্তিমালকে বাংলা কবিতার অমূল্য সম্পদে পরিণত করেছে। তাই বিনয়ের কবিতা ‘তরুমর্মরের মধ্যে অথবা আড়ালে’ নয় পাঠকের হৃদয়ে আর কবিযশপ্রার্থীদের ঈর্ষায় থেকে যাবে।