বাংলা ভাষা যেন কিছুটা অশ্লীল, ইংরেজিটা শালীন। আমার কথা শুনে কেউ কেউ চমকে উঠতে পারেন কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলে। আমরা আজকাল বেশ স্বতঃস্ফূর্তভাবেই ইংরেজি ‘ন্যুড’ শব্দটা উচ্চারণ করতে পারি কিন্তু বাংলা ‘নগ্ন’ শব্দে আমাদের কোথায় যেন আপত্তি! আর একটা উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। যেমন, ইংরেজি ‘প্রস্টিটিউট’ শব্দটা আমরা যত সহজে উচ্চারণ করতে পারি, বাংলা ‘যৌনকর্মী’ ততটা সাবলীলভাবে ব্যবহার করতে পারি না। এই শব্দে আমাদের এক ধরনের জড়তা আছে, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। আচ্ছা প্রস্টিটিউট আর যৌনকর্মী শব্দ দুটি যদি একই অর্থ বহন করে, তাহলে যেটা ইংরেজিতে বলতে পারি, সেটা মাতৃভাষায় বলতে এত অনাগ্রহ কেন? আমার তো ভয় হয় প্রস্টিটিউট, ন্যুডের মতো শব্দগুলোই না অদূর ভবিষ্যতে আবার আমাদের মাতৃভাষা হয়ে ওঠে!
এ নিয়ে মিনিট দুয়েক ভাবতেই একটা ব্যাপার আমাকে খুব ভাবিয়ে তুললো। আমরা যেন কিছুটা নিজেদের নিম্নবিত্ত, খেটে খাওয়া মানুষদের থেকে মার্জিত দাবি করতেই এই শব্দগুলোর ইংরেজি রূপ বেছে নিচ্ছি। কারণ একজন দিনমজুর, রিকশাচালক কিংবা অন্য কোনো নীচুস্তরের মানুষ এই শব্দগুলো সচরাচর ব্যবহার করে থাকে। তাহলে ব্যাপারটা কি এই দাঁড়াচ্ছে না, বাংলা যেন নিম্নশ্রেণীর মানুষের মুখের ভাষা?
কেউ কেউ আমার এই বক্তব্যের প্রতিবাদ করে বলতেই পারেন, বিশ্বায়নের এই যুগে বিভিন্ন জাতি,ভাষা, প্রথা, সামাজিকতা ও সংস্কৃতির মিথস্ক্রিয়ায় কিছু শব্দ, শব্দের মার্জিত রূপ অন্য একটি ভাষায় জায়গা করে নিতেই পারে। আমার ভয়টা মূলত সেখানেই। এ প্রসঙ্গে একটা কথা আগে বলে নিতে চাই। এতে করে আমি যে ব্যাপারটি বলতে চাই, সেটি ব্যাখ্যা করতে সুবিধা হবে।
আমার একজন বন্ধু সম্প্রতি আইনশাস্ত্রে ডিগ্রি নিয়ে নামের আগে অ্যাডভোকেট বসিয়েছেন। সেদিন মজা করে জিজ্ঞেস করেছিলাম, অ্যাডভোকেট শব্দের বাংলা কী? বন্ধুর উত্তর, উকিল। আমি বললাম উকিল তো আরবি শব্দ। বাংলায় কী হবে? বন্ধু আমার কিছুটা দমে গেল। ব্যাখ্যা দিচ্ছি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বেশ কিছু বিদেশি শব্দের বাংলা অর্থ করেছিলেন তার মধ্যে উকিলও একটা শব্দ। এই শব্দের তিনি চমৎকার একটা বাংলা করেছিলেন আর তা হলো অধিবক্তা। কিন্তু আমরা আজকাল অধিবক্তা শব্দে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি কিংবা অ্যাডভোকেট বা উকিল শব্দগুলোতে হতে পারে শ্রুতিমধুর হওয়ার কারণে কিংবা অন্য যেকোনো কারণে আগ্রহী হয়ে পড়েছি।
অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই যে, পৃথিবীতে এমন কিছু ভাষা আছে, যা ঔপনিবেশিক বা অন্য যেকোনো কারণে অন্যভাষার সংস্পর্শে এসে ধীরে ধীরে সেই ভাষায় বিলীন হয়ে গেছে। এ নিয়ে ভাষা গবেষকরা আরও বিস্তারিত বলতে পারবেন। আমার শুধু ভয় এটুকু নিয়ে, যে ভাষার জন্য আমরা জীবন দিয়েছি, সেই ভাষার প্রতি এত অবহেলা আমাদের সইবে তো?
আমি অবহেলা শব্দটিই উচ্চারণ করলাম এবং বেশ দায়িত্ব নিয়েই উচ্চারণ করলাম। হতে পারে আইনশাস্ত্র বা চিকিৎসা শাস্ত্রের মতো কিছু বিষয়ে কিছু শব্দের যুতসই বাংলা করা যায় না, ক্ষেত্রবিশেষে খুঁজেও পাওয়া যায় না এটা ঠিক। তাই বলে যেসব শব্দের বাংলা রূপ রয়েছে, সেগুলো সম্পর্কে আমরা সচেতন হব না? ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই ব্যাপারটা হরহামেশাই দেখতে হচ্ছে যে, দুই লাইন বাংলা লিখতে গেলেও দুটো ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করা ছাড়া আমরা লিখতে পারছি না। বিষয়টা উদ্বেগজনক। একইসঙ্গে মজারও। মজার বলছি এ কারণে, আমরা ইংরেজিতে যদি এত দক্ষ, বাংলাটা ঠিক আসে না কেন? আর বাংলা-ইংরেজি মিশিয়ে ফেলছি কেন? কাজেই আমার কাছে মনে হয়েছে, আমরা ইংরেজি ভাষার জন্যেও বিপজ্জনক!
শেষ কথাটা হলো, আমরা কিছুটা সচেতন হলেই ইংরেজি বা অন্য কোএনা বিদেশি শব্দ পরিহার করে শুদ্ধ বাংলায় লিখতে পারি বা বলতে পারি। এজন্য শুধু বাংলা ভাষায় আমাদের সীমাবদ্ধতাকেই দায়ী করা চলে না, অবশ্যই আমাদের সচেতনতারও অভাব রয়েছে।
আজ বলতেই হয়, যে ভাষার জন্য আমরা জীবন দিয়েছি, যে ভাষার জন্য আমরা প্রতিনিয়ত গর্ব করি, সে ভাষাভাষীদের এতই দুদর্শা যে, একপাতা শুদ্ধ বাংলা লিখতে বললে, হাত কাঁপে, দুই মিনিট বাংলায় কথা বলতে বললে ফটাফট ইংরেজি চলে আসে! জাতি হিসেবে আমাদের লজ্জিত হওয়া উচিত। দিনশেষে একে ওকে অকৃতজ্ঞ না বলে বরং আমার মনে হয় আমাদের যার যার নিজের দিকেই তাকানো উচিত।