প্রথমে ভেবেছিলাম আমাদের প্রয়োজনেই নজরুল চর্চা উচিত—এই শিরোনামে কাজী নজরুল ইসলাম বিষয়ক একটি গদ্য লিখব। সেক্ষেত্রে লেখার শিরোনামটি আপ্তবাক্যের মতো হয়ে যেতে পারে। এ রকম ভেবেও বাক্যটি পাল্টানোর পক্ষে ছিলাম না। কারণ,কাজী নজরুল ইসলামের লেখা কবিতা আমাদের পাঠ করা অবশ্য কতর্ব্যের মাঝেই পড়ে। সেই পাঠ যতটা সাধারণের জন্য,তার চেয়ে বেশি আমাদের কবিতা লিখিয়েদের জন্য।
আমরা যারা কবিতা লেখার জন্য হাত মকশো করছি,তাদের জন্যই জরুরি কাজী নজরুল ইসলাম পাঠ করা। এ ক্ষেত্রে সেই জরুরির ব্যাপারটাই পরিষ্কার করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু শেষাবধি সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে এলাম। কারণ, মনের মধ্যে গুনগুন করে ওঠা নজরুলগীতির একটি লাইন। আগে থেকে ভেবে রাখা লেখাটি যখন সত্যিকার অর্থেই কাগজে ফুটিয়ে তোলার ইচ্ছেয় বসেছি, তখন মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে শুরু করলো—‘বাগিচার বুলবুলি তুই, ফুল শাখাতে দিসনে আজি দোল’ গানের কলিগুলো।
কাজী নজরুল ইসলাম সাহিত্যের প্রায় সব শাখাতেই হাত দিয়েছেন। সবখানেই তার ছোঁয়া। তবে তার সেইসব ছুঁয়ে যাওয়া স্পর্শগুলোকে আমরা সযত্নে এড়িয়ে বাঁচিয়ে রেখেছি তাকে কবি পরিচয়ে। অন্যসব পরিচয় প্রায় মুছে গেছে। গানের বুলবুলি হয়ে তিনি যে অসংখ্য গান রচনা করেছেন, সুর দিয়েছেন, নিজে গেয়েছেন—সেই গানগুলো আমাদের আলোচনায় আসে না। শিশুদের জন্য তার রচনার যে সম্ভার ও তার যে বিস্তার, যা শিশুমনের দরজা খুলে দিতে—অপার, অথৈ। তাও তো আমরা সীমাবদ্ধ করে রেখেছি ওই লিচুচোর, খুকু ও কাঠবেড়ালি ছড়ায়। তার গল্প বলতেই চোখের সামনে তুলে ধরা হয়—পদ্মগোখরা আর জীনের বাদশা।
উপন্যাস বললে হাজির করা হয়—মৃত্যুক্ষুধা। তার অনুবাদে ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াৎ-এর স্বাদ অন্য কোথাও পাওয়া যাবে, এমন তুলনা কোন দুর্মখো না দিলেও এর পরিচয় সাহিত্যের কজনের সঙ্গেই বা? আর সাংবাদিক ও সম্পাদক পরিচয় তো ভুলেই গেছি।
চাকরি আর ভর্তির পরীক্ষা উৎরে যেতে ঝিলিমিলি, পুতুলের বিয়ে, ঝিঙে ফুল, অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশি নামগুলো মনে রাখি। জেনে রাখি—লাঙল আর ধূমকেতুর নাম। কিন্তু খোঁজ রাখি না, তার ভেতরের। তালের শক্ত খোলস ছাড়িয়ে ভেতরের যে মিষ্টি শ্বাস, তার খোঁজ পাওয়াও তো আসলে সহজ না। আর যে কবি পরিচয়ে আমরা আটকে রেখেছি কাজী নজরুল ইসলামকে,সেখানেও কিন্তু তার কবিতা বলতেই জানিয়ে দেয়া হয়—সে তো ‘অসংযমের শিল্প’। করি পরিচয়েও ভেদরেখা—তিনি বিদ্রোহী কবি। নজরুল তো প্রেমেরও কবি, মানবতার কবি, জীবনের কবি। বড় কথা—তিনি কোন বৃত্তের মধ্যে আবদ্ধ রাখেননি নিজেকে। এটিই তার বড় পরিচয়।
কাজী নজরুল ইসলামের দুটি জনপ্রিয় ও বহুল পঠিত কবিতা ‘বিদ্রোহী’ ও ‘বিজয়িনী’। দুটি কবিতার দুই রূপ। কবিতা দুটি নিয়ে অসংখ্য আলোচনা হয়েছে। গবেষণা হয়েছে, গবেষণা হচ্ছে। সাহিত্যের শিক্ষার্থীরা কাজী নজরুল ইসলামের লেখার বহুমাত্রিকতা নিয়ে আলোচনা করছেন। শুরুতে নজরুল পাঠ কেন আমাদের জন্য জরুরি বলে যে আলোচনা শুরু করতে চেয়েছিলাম,তার উদাহরণে আমি ‘বিদ্রোহী’ এবং ‘বিজয়িনী’কেই আনতে চেয়েছিলাম—দুটো কবিতাই সহজে হাতের কাছে পাওয়া যায় বলে।
সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে যারা নজরুল চর্চা করেন,তারা এই কবিতাদুটির নানারকম ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের সঙ্গে পরিচিত। কিন্তু আমরা যারা কবিতা নিয়ে নাড়াচাড়া করি, কবিতা লেখার তাগিদ অনুভব করি মনে, তাদের কাছে নজরুল পাঠের আবশ্যকতা তুলে ধরার জন্যও মোক্ষম উদাহরণ এই দুটি কবিতা। একজন কবি তো শব্দের কারিগর।
একটি পরিচিত, সাধারণ আটপৌরে শব্দকেও মুহূর্তেই কবি পাল্টে দিতে পারেন। সাধারণের ব্যবহৃত প্রতিদিনের শব্দ দিয়েই কবি উপমা, উৎপেক্ষা আর বর্ণনায় তৈরি করেন কবিতা। তখন সেই কবিতার প্রতিটি শব্দ হয়ে ওঠে অসাধারণ। প্রতিটি শব্দকে তার ন্যায্যমূল্য মিটিয়েই কবি কবিতাকে সম্পূর্ণতা দেন। শব্দের যে মালা গাঁথেন কবি, সেখানে পাঠকের কাছে একটি শব্দকেও যদি অসামঞ্জস্যপূর্ণ বলে অনুভূত হয়, তাহলে সেই কবিতার স্বাভাবিকতা, যাকে ছন্দ বলছি, তা যেমন ব্যাহত হয়, তেমনিভাবে ভাবের সম্পূর্ণতাও নষ্ট হয়ে যায়। অতিরিক্ত শব্দে ভারী হয়ে কবিতা তার সঠিক পথ হারিয়ে ফেলে।
কাজী নজরুল ইসলামের বহুল পঠিত ও আলোচিত (তাই উদ্ধৃতি ব্যবহার করছি না) বিদ্রোহী কবিতাটি দীর্ঘ, এখানে অসংখ্য শব্দের ব্যবহার হয়েছে। সেইসঙ্গে ধর্মীয় অনুষঙ্গও এসেছে ঘুরেফিরে। কিন্তু কোন শব্দ কি বেশি মনে হয়? শব্দের ভারে কি কবিতা তার সঠিক পথ হারিয়েছে বলে মনে হয়? অথবা কাউকে ছোট করে, কাউকে আক্রমণ করে, কাউকে হেয় করে কি নিজের শ্রেষ্ঠত্বকে তুলে ধরা হয়েছে? তিনি মানুষের জয়গান করেছেন। ‘বিজয়িনী’ কবিতাতেও একইভাবে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য আক্রমণ নয়, বরং নিজেকে সমর্পণ করার মধ্য দিয়েই তিনি কবিতাকে মুক্ত করেছেন।
আমরা শব্দের মালায় গেঁথে কবিতাকে মুক্ত করার এই প্রকাশভঙ্গি থেকেই দেখতে চাই কাজী নজরুল ইসলামের শিল্প ও শিল্পীসত্তা। কোনো বিশেষ অভিধা না, কোনো বিশেষণে বিশেষায়িত করে কাজী নজরুল ইসলামকে বৃত্তাবদ্ধ করে রাখতে চাই না। তিনি আমাদের বাগানের বুলবুলি না,তিনি ও তার সৃষ্টি খোলা আকাশে মুক্ত পাখির উড়ে চলা। আমাদের নজরুল চর্চার জন্য সেই মুক্তাকাশ এখন জরুরি বলেই আমার ধারণা।