বাংলায় বর্ষা আসে চিরায়ত সৌন্দর্য নিয়ে । হিসেবের খাতায় বর্ষা দু’মাস হলেও এর ব্যাপ্তি প্রায় চার মাস। বর্ষা এলে নদী-নালা, খাল-বিল জলে টইটুম্বুর হয়ে যায়। মরা নদীতে জোয়ার আসে। বিলের জলে দেখা যায় শাপলার হাসি। নৌকায় চড়ে খাল-বিল পেরিয়ে বহুদূর চলে যাওয়া যায়। ঢেউয়ের তালে তালে ছলাৎ ছলাৎ শব্দে নেচে ওঠে মন। কখনো হঠাৎ আকাশ জুড়ে মেঘের ঘনঘটা। আকাশ ছাপিয়ে বৃষ্টির ধারা নেমে আসে। বৃষ্টির জলে অবগাহনে মনে অফুরান আনন্দের শিহরণ জেগে ওঠে। ঘরের টিনের চালে বৃষ্টির রিমঝিম ছন্দ শুনতে পাওয়া যায়। জানালা খুলে বিছানায় শুয়ে বৃষ্টির শীতল পরশ অনুভব করা যায়। বর্ষার জলে কাগজের নৌকা ভাসিয়ে উল্লাসে মেতে ওঠে শিশুরা। অলস দুপুরে কৃষাণের কণ্ঠের মধুর সুর এক অলৌকিক আবেশ সৃষ্টি করে। কুশিকাটায় মা-চাচির হাতের নিপুণ নকশা, পাটের আঁশ দিয়ে সিকা বানানো এবং নকশিকাঁথা সেলাই করা দেখে দেখে সময় কখন যে চলে যায় বোঝাই যায় না।
ঋতুবৈচিত্র্যের মাঝে বর্ষাকে আলাদা বৈশিষ্ট্যে চিহ্নিত করা যায়। যুগে যুগে কবিরা বর্ষাকে প্রেম-বিরহ ও সৃজনক্রিয়ার ঋতু হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। একথা সত্য, বর্ষা এলে স্বভাবতই মানুষের মনে বিরহ দানা বাঁধতে থাকে। প্রিয়তমার অনুপস্থিতি প্রেমিককে আবেগাপ্লুত করে তোলে। প্রিয়জনের শূন্যতাকে বর্ষা আরো দ্বিগুণ করে তোলে। আর তাইতো বর্ষা কাল আলাদা এক উপাখ্যানের জন্ম দিয়েছে।বর্ষা নিয়ে এ যাবৎকালে কম সাহিত্য রচিত হয়নি। সাহিত্যের সবগুলো শাখার মধ্যে কবিতায় বর্ষার অনুষঙ্গ এসেছে অসংখ্যবার। কোনো কোনো কবির হাতে রচিত হয়েছে পূর্ণাঙ্গ এক কাব্য, যার আদ্যোপান্ত বর্ষায় সিক্ত।
বর্ষাকে নিয়ে লেখা হয়েছে অনেক প্রেম ও বিরহের কবিতা। আর এসব কারণেই বর্ষাকে বিরহের কাল বলা হয়ে থাকে। প্রেমিকের জীবনে বর্ষা আসে বিরহ নিয়ে। কী জল কী বর্ষা; বাদলের ধারায় বেদনার্ত হয়ে ওঠে মন। ঝরে বেদনাশ্রু। প্রিয় কিছু হারানোর বেদনা বর্ষা এলেই খুব বেশি মনে পড়ে। অথই জলের মধ্যে হাবুডুবু খায় প্রেমিকপ্রবর। তাকে যেন বানের জলের মতো ভাসিয়ে নেয় অজানা গন্তব্যে। তাই তো কবির কাছে বর্ষা মানে ক্ষণে ক্ষণে বিরহের গান। বলা নেই-কওয়া নেই অমনি শুরু হয়ে গেল অশ্রুবর্ষণ। কখনো কখনো মনে হয় চোখভরা অভিমান নিয়ে ধেয়ে আসা কিশোরীর পায়ের নূপুরের রিনিঝিনি আওয়াজ।
বর্ষা হাসাতে পারে, কাঁদাতে পারে। বর্ষা ভাবায়, বর্ষা ভালোবাসায়। বর্ষা মানেই গর্জে ওঠা নদী। দু’কূল ছাপিয়ে তলিয়ে দেয়া গ্রামের পর গ্রাম। সুখ-দুঃখে একাকার হয়ে ভেসে বেড়ানো পালতোলা নৌকা। বিরহী সুর জেগে ওঠা মাঝির ভাটিয়ালি গান। কলা গাছের ভেলায় ভেসে যাওয়া ক্ষুদ্র জীবন। ব্যাঙের একটানা ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ ডাকে দূর থেকে ভেসে আসা রাগ-রাগিণী। পানকৌড়ির ডুবসাঁতারের খেলার মতো প্রিয়তমার লুকোচুরি।
বর্ষা নিয়ে মহাকবি কালিদাস রচনা করেছেন বিখ্যাত মহাকাব্য ‘মেঘদূত’। মেঘকে সেখানে যক্ষের বন্ধু বলা হয়েছে। যক্ষ তার প্রিয়ার কাছে মেঘকে দূত করে খবর পাঠাতেন। কী করে একখণ্ড মেঘ কবির কল্পনায় হয়ে উঠছে বিরহীর বার্তাবাহক প্রাণবন্ত-জীবন্ত দূত! কল্পনায় মেঘখণ্ডকে ইন্দ্রিয়ানুভব প্রদান করে মেঘের স্তুতি করে যক্ষ বলছে, ‘ওগো মেঘ, আমি জানি তুমি পুষ্কর এবং আবর্তক মেঘের বংশে জন্মগ্রহণ করেছ, তুমি ইন্দ্রের প্রধান সহচর, তুমি তোমার ইচ্ছানুযায়ী রূপগ্রহণ করতে পারো! অদৃষ্টবশে আমার প্রিয়া আজ দূরবর্তী, তাই তোমার কাছে আমি প্রার্থী হয়ে এসেছি; গুণবান ব্যক্তির কাছে প্রার্থনা যদি ব্যর্থ হয় তবে তাও ভালো, অধম ব্যক্তির কাছে প্রার্থনা সফল হলেও তা বরণীয় হতে পারে না।’কর্তব্যে অবহেলার দায়ে একবছরের জন্য নির্বাসিত যক্ষ মেঘকে অনুরোধ করেছে তার প্রিয়ার কাছে খবরটুকু পৌঁছে দিতে। মেঘদূতের ৪২ নম্বর শ্লোকে বলা হয়েছে-
ত্বন্নিষ্যন্দোচ্ছ্বসিতবসুধাগন্ধসংপর্করম্যঃ
স্রোতোরন্ধ্রধ্বনিতসুভগং দন্তিভিঃ পীযমানঃ
নীচৈর্বাস্যত্যুপজিগমিষোর্দেবপূর্বং গিরিং তে
শীতো বাযুঃ পরিণমযিতা কাননোদুম্বরাণাম্
যার ভাবার্থ হচ্ছে-
তোমার প্রথম বর্ষণে ভেজা মাটির সুবাস পেয়ে
নিদাঘের জ্বালা জুড়াতে আসিবে শীতল পবন ধেয়ে,
ছোঁয়া লেগে তার পরিণত হবে কাননে উদুম্বর,
সজল বাতাস টানিবে সরবে গজেরা শুণ্ডধর!
দেবগিরিগামী তোমারে ব্যজন করিবেহে সমীরণে,
নিঃশেষ কোরো ভান্ডার সেথা অবিরত বরিষণে।
মেঘদূত ছাড়াও বৈষ্ণব পদাবলীতেও বিরহের সঙ্গে বর্ষার একটি নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করেছেন পদকর্তারা। পদাবলী সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ মহাজন বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস আর বিহারীলালের কবিতায় বর্ষা এসেছে একাধিকবার। তাদের বিরহের কবিতায় ও গানে বর্ষা ও বিরহ একাকার হয়ে গেছে। যা নতুনরূপ নিয়েছে মধ্যযুগের বাংলা কবিতা ও গানে। ওই সময়ে বর্ষাই যেন প্রিয়জনের আরাধনার উৎকৃষ্ট সময়। ভাবনার নিরবচ্ছিন্ন উপলক্ষ হয়ে উঠেছিল।
মধ্যযুগে চণ্ডীদাসের কোনো কোনো কবিতায় বর্ষা এসেছে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের ইন্ধন হিসেবে। মধ্যযুগের কবিরা বর্ষাকে অভিসার ও বিরহ পর্বে ‘প্রেমের আগুনে ঘিয়ের ছিটা’ হিসেবে কল্পনা করেছেন। একই ধারায় চণ্ডীদাস তাঁর প্রেম-বিরহ-কাতরতার কথা প্রকাশ করেন তাঁর কবিতায়। কবি বলেছেন-
এ ঘোর রজনী মেঘের ঘটা
কেমনে আইল বাটে
আঙ্গিনার মাঝে বধূয়া ভিজিছে
দেখিয়া পরাণ ফাটে।
আঙিনায় বর্ষাসিক্ত রমণী দেখে কবিমনে প্রেমাবেগ জাগ্রত হয়েছে। রমণীর ভেজা শরীরের স্পর্শ পেতে উতলা হয়ে উঠেছে মন। তবে ছুঁতে না পারার আকাঙ্ক্ষায় প্রাণ যেন ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে।
এদিকে বিদ্যাপতির কবিতায়ও বর্ষার বিরহ কাতরতা কোনো অংশে কম নয়। তিনি বলেছেন-
এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর
এ ভরা ভাদর মাহ বাদর
শূন্য মন্দির মোর।
কবিদের সব বিরহ যেন এখানেই এসে সিক্ত হয়ে ওঠে। বর্ষায় মাঠ-ঘাট ভিজে একাকার। মানুষগুলো অনিচ্ছাকৃত বন্দিদশা বরণ করে। শূন্যতা দানা বেঁধে ওঠে বুকের ভেতর। বর্ষার এ আলস্যে প্রিয়তমার সান্নিধ্যই তার পরম আরাধ্য।
বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যে কৃষ্ণের জন্য রাধার বিরহের যন্ত্রণা বেড়ে যায় এই বর্ষা এলেই। কৃষ্ণের বিরহে ব্যাকুল হয়ে প্রেমিকা রাধা তার সহযোগী বড়াইকে বলেছে-
আষাঢ় শ্রাবণ মাসে মেঘ
বরিষে যেহ্ন
ঝর এ নয়নের পানী।
আল বড়ায়ি
সঙপুটে প্রণাম করি দুইলো সখিজনে
কেহো নান্দ কাহবনঞিকে আনী।
এমনও দেখা গেছে, বর্ষায় অভিসারে যাওয়ার পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে রাধা নিজের ঘরের মধ্যে পানি ছিটিয়ে কর্দমাক্ত করে কাঁটা পুতে রেখে রাতের অন্ধকারে তার ওপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে প্রিয় কৃষ্ণের সান্নিধ্য লাভের সাধনা করতেন। যেন বর্ষায় প্রিয় কৃষ্ণের অভিসারে যেতে পথের কাঁটা তার বাঁধা হয়ে না দাঁড়ায়। পিচ্ছিল পথ যেন অনায়াসেই হেঁটে যেতে পারে।
মধ্যযুগের আরেক কবিপ্রতিভা কবিকঙ্কন উপাধিখ্যাত মুকুন্দরাম চক্রবর্তী ‘কালকেতু উপাখ্যানে’কালকেতুর স্ত্রী ফুল্লরার বারমাসের দুঃখ বর্ণনা করতে গিয়ে বর্ষাকাল সম্পর্কে বলেছেন-
আষাঢ়ে পুরিল মহী নবমেঘে জল।
বড় বড় গৃহস্থের টুটয়ে সম্বর॥
মাংসের পসরা লয়্যা বুলি ঘরে ঘরে।
কিছু খুদকুঁড়া মিলে উদর না পুড়ে॥
শ্রাবণে বরিষে মেঘ দিবস রজনী।
সিতাসিত দুই পক্ষ একই না জানি॥
আচ্ছাদন নাহি অঙ্গে পড়ে মাংস-জল।
কত মাছি খায় অঙ্গে করমের ফল॥
ভাগ্য মনে গুণি ভাগ্য মনে গুণি।
কত শত খায় জোঁক নাহি খায় ফণী॥
কালকেতু উপাখ্যানে বর্ষা এসেছে উপার্জনের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে। স্বভাবতই গ্রামাঞ্চলে বর্ষা এলে কাজ-কর্ম কমে যায়। চারিদিকে অথৈ পানি থাকায় উপার্জনের তেমন কোনো পথ থাকে না। ফলে গ্রামের পুরুষেরা অলস সময় কাটায়। নারীরা ঘরের মধ্যে বসে টুকটাক হস্তশিল্পের কাজ করে। তাদের জন্য বরং বছরের অন্যান্য মাসে উপার্জিত শস্যই তখন তাদের ক্ষুধা নিবারণে সহায়ক হয়ে ওঠে।
মধ্যযুগের কাব্যে বর্ষার ব্যাপক উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়- একথা অনস্বীকার্য। তবে মধ্যযুগের ধর্মাশ্রিত কাব্যচর্চার পরে আধুনিক যুগে এসে কবিদের কবিতায় মানবতার সুরের সঙ্গে-সঙ্গে তাল মেলাতে বর্ষার প্রসঙ্গও এসেছে সমানতালে। আধুনিক যুগের অন্যতম কবি মাইকেল মধুসুদন দত্ত তাঁর ‘বর্ষাকাল’ কবিতায় বর্ষার রূপকল্প বর্ণনা করেছেন-
গভীর গর্জন করে সদা জলধর
উথলিল নদ-নদী ধরনীর উপর
রমনী রমন লয়ে
সুখে কেলি করে
দানবাদি দেব যক্ষ সুখিত অন্দরে।
মেঘের গর্জনে নদ-নদী উথাল-পাথাল হয়ে ওঠে। সাথে সাথে বর্ষার মিষ্টি মধুর আবহাওয়া বা হালকা শীতল পরিবেশ নর-নারীর মনে কাম বাসনা জাগ্রত করতে সহায়ক হিসেবে আবির্ভূত হয়। কর্মহীন অলস সময় তখন তারা মেতে ওঠে জৈবিক চাহিদা নিবৃত্তের উৎসবে। মেঘের গর্জনের সাথে সাথে নারী বক্ষে উন্মাতাল ঢেউ ওঠে। যা আছড়ে পড়ে পুরুষের সুবিশাল বক্ষে।
বাংলা সাহিত্যের শক্তিমান মহাপরুষ বিশ্বকবি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কবিতায় বর্ষাকে উপস্থাপন করেছেন বিভিন্ন আঙ্গিকে। তাঁর হাত ধরেই কবিতার মাধ্যমে বর্ষা যেন পূর্ণতা পেয়েছে। তাঁর কবিতায় বর্ষার বিচিত্র রূপ প্রকাশ পায় বর্ষাবন্দনা রূপে। রবীন্দ্রনাথের গানের কথা বাদ দিলেও বহু জনপ্রিয় কবিতার মধ্যে আমরা বর্ষার অনুষঙ্গ খুঁজে পাই। তাঁর ‘আষাঢ়’, সোনার তরী’, ‘বাঁশি’সহ বহু কবিতায় বর্ষা এসেছে বিভিন্ন আঙ্গিকে।
‘আষাঢ়’ কবিতায় তিনি মানুষকে ঘরের বাইরে যেতে নিষেধ করেছেন। তবে আষাঢ় মাসের একটি নিটল বর্ণনা তার কবিতার দৃশ্যপটে ভেসে উঠেছে। আউশের খেত, কালিমাখা মেঘ, ধেনু ও ধবলীর বর্ণনায় সত্যিই গ্রামবাংলার অপরূপ দৃশ্য প্রস্ফুটিত হয়েছে। যা পাঠকমনে চিরজাগরুক হয়ে থাকবে।
‘সোনার তরী’ কবিতার দৃশ্যকল্প এ রকম—আকাশে মেঘ গর্জন করছে। চারিদিকে বরষার পানি থৈথৈ করছে। সঙ্গে খরস্রোত বয়ে চলছে। জমির ধান কেটে একটি ছোট খেতে কৃষক একা বসে আছেন, পার হওয়ার কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না। ধান কাটতে কাটতে নদীর জল বেড়ে গেছে। খেতের চারিদিকে নদীর বাঁকা জল খেলা করছে।
‘বাঁশি’ কবিতায় দেখা যায়, বর্ষা এলেই ট্রামের খরচা বাড়ে। ছাতার অবস্থা জরিমানা দেয়া মাইনের মতো- বহু ছিদ্র তার। চারিদিকে ময়লা-আবর্জনা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে। তখন গলিটাকে ঘোর মিছে অন্ধকার মাতালের প্রলাপের মতো মনে হয়।
এছাড়া কবিগুরুর অন্যতম ছড়া কবিতা ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর’ আমাদের দুরন্ত শৈশবকে হাতছানী দিয়ে ডাকে। তারও অনেক পরে বর্ষার স্মৃতিতাড়িত হয়ে কবিই আবার বলেছেন-
কবে বৃষ্টি পড়েছিল, বান এলো যে কোথা
শিব ঠাকুরের বিয়ে হলো কবেকার সে কথা।
সে দিনও কি এমনিতরো মেঘের ঘনঘটা
থেকে থেকে বাজ বিজুলি দিছিল কি হানা।
গ্রামীণ জনপদ ছেড়ে যারা নাগরিক কোলাহলে মত্ত হয়ে ওঠে, তাদের জন্য বর্ষা তখন স্মৃতিই হয়ে ওঠে। এমনও হয় যে, নাগরিক জীবনে বহুদিন হলো বৃষ্টিতে ভেজা হয় না। কিংবা কংক্রিটের দেয়ালের মাঝে বসে উপলব্ধিই হয় না যে, বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। কখনো কখনো অতীতের স্মৃতিগুলো নাড়া দিয়ে কেবল স্মরণ করিয়ে দেয় প্রিয় বর্ষাকে।
কবিগুরু তাঁর ‘বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর’ ছড়ায় যা বলেছেন; শিশুপাঠ্য হলেও তা কমবেশি আমাদের সবারই মনে থাকার কথা-
মনে পড়ে সুয়োরানী দুয়োরানীর কথা,
মনে পড়ে অভিমানী কঙ্কাবতীর ব্যথা।
মনে পড়ে ঘরের কোণে মিটিমিটি আলো,
চারিদিকের দেয়ালজুড়ে ছায়া কালো কালো।
বাইরে কেবল জলের শব্দ ঝু-প ঝু-প ঝুপ-
দস্যি ছেলে গল্প শোনে, একেবারে চুপ।
তারি সঙ্গে মনে পড়ে মেঘলা দিনের গান-
বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর, নদেয় এল বান॥
কবির মতোই আজো বৃষ্টি এলে নিজের অজান্তেই মুখ ফুটে বেরিয়ে আসে ‘বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর’। তবে দাদা-দাদির কোলে বসে গল্প শোনা হয় না। নদীর ভরা জল হয়তো চোখে পড়ে না। ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টেই কেবল দেখি- আজ আষাঢ়ের প্রথম দিন।
কবিগুরুর পরেই বর্ষাবন্দনার জন্য বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে স্মরণ করা যায়। তাঁর কবিতায়ও বর্ষা ধরা দিয়েছে বিভিন্ন প্রতিকী ব্যঞ্জনায়। বর্ষার মেঘ তাঁর বিরহ-বেদনাকে আরও বেশি উসকে দিয়েছে। কবির ‘বাদল-দিনে’ কবিতায় বলা হয়েছে-
ব্যাকুল বন-রাজি শ্বসিছে ক্ষণে ক্ষণে,
সজনি! মন আজি গুমরে মনে মনে।
বিদরে হিয়া মম
বিদেশে প্রিয়তম।
এ জনু পাখি সম
বরিষা-জর-জর॥
যার প্রিয়জন দূরে, বর্ষা তাকে আরো বেশি পীড়া দেয়। একাকীত্ব অনুভূত হয় মনের মাঝে। ব্যাকুল মন কেবলি প্রিয়জনের স্পর্শ কামনা করে।
কিংবা ‘বাদল-রাতে পাখি’ কবিতায় নজরুল বলছেন-
বাদল-রাতের পাখি।
কবে পোহায়েছে বাদলের রাতি, তবে কেন থাকি
কাঁদিছ আজিও ‘বউ কথা কও’ শেফালি বনে একা,
শাওনে যাহারে পেলে না, তা’রে কি ভাদরে পাইবে দেখা?
তুমি কাঁদিয়াছ ‘বউ কথা কও’ সে-কাঁদনে তব সাথে
ভাঙিয়া পড়েছে আকাশের মেঘ গহীন শাওন-রাতে।
তিনি তাঁর কবিতার মাধ্যমে বাদল রাতের পাখিকে বন্ধু ভেবে বিরহের সঙ্গে নিজের বিরহ একাকার করতে চেয়েছেন। তিনি বর্ষাকে ভেবেছেন তাঁর দুঃখ-যাতনার সাথী। সে কারণেই ‘বর্ষাবিদায়’ কবিতায় তাঁর যত আকুতি-
যেথা যাও তব মুখর পায়ের বরষা নূপুর খুলি
চলিতে চলিতে চমকে ওঠনা কবরী ওঠে না দুলি
যেথা রবে তুমি ধেয়ানমগ্ন তাপসিদী অচপল
তোমায় আশায় কাঁদিবে ধরায়, তেমনি ফটিক জল।
রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ ‘শ্রাবণরাত’ কবিতায় বলেছেন-
শ্রাবণের গভীর অন্ধকার রাতে
ধীরে ধীরে ঘুম ভেঙে যায়
কোথায় দূর বঙ্গোপসাগরের শব্দ শুনে?
বর্ষণ অনেকক্ষণ হয়ে থেমে গেছে;
যতদূর চোখ যায় কালো আকাশ
মাটির শেষ তরঙ্গকে কোলে ক’রে চুপ করে রয়েছে যেন;
নিস্তব্ধ হয়ে দূর উপসাগরের ধ্বনি শুনছে।
মনে হয়
কারা যেন বড়ো বড়ো কপাট খুলছে,
বন্ধ ক’রে ফেলেছে আবার;
কোন্ দূর- নীরব- আকাশরেখার সীমানায়।
শ্রাবণের গভীর রাতে কবির ঘুম ভেঙে যায়। সাগরের গর্জন শুনতে পান তিনি। বৃষ্টি থেমে গেলেও নিস্তব্ধ হয়ে উপসাগরের ধ্বনি শুনতে পান। মনে হয় কারা যেন বড় বড় কপাট খুলছে, আবার বন্ধ করছে। শ্রাবণরাতের এমন দৃশ্যকল্পই কবির চোখের ঘুম কেড়ে নেয়।
‘পল্লী-বর্ষা’ কবিতায় পল্লীকবি জসীমউদদীন বলেছেন-
আজিকার রোদ ঘুমায়ে পড়িয়া ঘোলাট-মেঘের আড়ে,
কেয়া-বন-পথে স্বপন বুনিছে ছল ছল জল-ধারে।
কাহার ঝিয়ারী কদম্ব-শাখে নিঝ্ঝুম নিরালায়,
ছোট ছোট রেণু খুলিয়া দেখিছে অস্ফুট কলিকায়!
বাদলের জলে নাহিয়া সে-মেয়ে হেসে কুটি কুটি হয়,
সে-হাসি তাহার অধর নিঙাড়ি লুটাইছে বনময়।
…
হিজলের বন ফুলের আখরে লিখিয়া রঙিন চিঠি,
নিরালা বাদলে ভাসায়ে দিয়েছে না জানি সে কোন্ দিঠি।
…
গাঁয়ের চাষীরা মিলিয়াছে আসি মোড়লের দলিজায়,-
গল্পের গানে কি জাগাইতে চাহে আজিকার দিনটায়!
…
কেউবা রঙিন কাঁথায় মেলিয়া বুকের স্বপনখানি,
তারে ভাষা দেয় দীঘল সুতার মায়াবী নক্সা টানি।
…
আজিকে বাহিরে শুধু ক্রন্দন ছল ছল জলধারে,
বেণুবনে বায়ু নাড়ে এলোকেশ, মন যেন চায় কারে।
পল্লীকবির কবিতায় স্বভাবতই গ্রামীণ দৃশ্যপট ভেসে ওঠে। বর্ষার প্রিয় অনুষঙ্গ কদম ফুল ধরা দেয় কবিতায়। এমনকি বর্ষা এলেই হিজল ফুলের মালা গেথে সময় কাটায় বালিকারা। গ্রামের কৃষকরা মোড়লের বৈঠকখানায় গল্প-গানে মাতিয়ে তোলে। গাঁয়ের বধূরা অন্দরে বসে রঙিন কাঁথা সেলাই করেন। নকশার ভেতরে যেন তার মনের অব্যক্ত কথাগুলোই ফুটে ওঠে।
কবি আহসান হাবীব বৃষ্টিকে ঘিরে আমাদের দারিদ্র্য, হতাশা আর স্বপ্নকে বুনেছেন নিজস্ব স্বপ্নময়তাকে অবলম্বন করে। তিনি যেন প্রবল কোনো ঘোরের মধ্যে থেকে পার করছেন অপেক্ষার নিরন্তর প্রহর। তাঁর ‘রেনকোট’ কবিতায় লিখেছেন-
পঁচিশটি বর্ষা ত পেরিয়ে এলাম
দেখে এলাম
কত অন্ধকার অরণ্যশীর্ষ
কালো মেঘের অন্ধকারে ছাওয়া,
দেখলাম
কত ঝরঝর বর্ষা
আর কত নিঃসঙ্গ জানালার
ইতিহাস পড়লাম
আমার নির্বিকার জানালায়।
…
তবু বর্ষার দিনগুলি
একটি অপেক্ষা রেখে গেছে
জীবনের থমকে যাওয়া পদক্ষেপের প্রান্তে!
কতবার
জীবনের কত বর্ষায়
এক একদিন।
বর্ষণক্লান্ত বাইরের পানে তাকিয়ে
হঠাৎ এ কথা মনে হয়েছে:
একটা রেনকোট যদি থাকতো আমার!
কবি একটা রেনকোটের অভাব অনুভব করেছেন। পঁচিশ বছর কেটে গেছে বর্ষা দেখতে দেখতে, তবু আজো একটা রেনকোট তার হয়নি। জানালায় নির্বিকার বসে বসে নিঃসঙ্গতাকে পুষেছেন। নিঃসঙ্গ জানালার ইতিহাস পড়েছেন।
কবি আবুল হোসেন ‘বর্ষার দিনে’ কবিতায় লিখেছেন-
সমস্ত দিন শুয়ে শুয়ে বৃষ্টির শব্দ শুনি,
মৌলালীর মোড়ে কারখানার টিনের ছাদে
নরম পীচের ওপরে শান বাঁধানো হাঁটা পথে
অবিশ্রাম ঝনঝন্ ধ্বনি ওঠে,
য়্যুক্যালিপ্টাস পাইন জড়ানো পাহাড়ী আবাসে
ঝর্ণার দূরাগত ঝঙ্কারের মতো আসে
ঝিরঝিরে জলের একটানা বাজনার সুর,
যেন কোন্ দূর আকাশ বাতাস আজ
গান হয়ে গলে যায় মাটিতে অরণ্যে ঘাসে।
আর তারই এক কণা আমার এ কামরায়
সূরার কুয়াশা ছড়ায় মনের অসীম শূন্যে,
স্নান সারে স্নায়ুতে স্নায়ুতে
শুকনো প্রাণের পাতা।
কবি সারাদিন শুয়ে শুয়ে বিৃষ্টির শব্দ শোনেন। এটা কবির কথা হলেও আমাদের সবার জন্য প্রযোজ্য। ঝিরিঝিরি জলের বাজনার সুর শুনতে পাওয়া যায়। তিনি তার স্মৃতিকোটর থেকে বর্ষার যাবতীয় স্মৃতি তুলে এনেছেন পাঠকের সম্মুখে। কবির দেখা মৌলালীর মোড়ে কারখানার টিনের ছাদে নরম পীচের ওপরে শান বাঁধানো হাঁটা পথে ঝনঝন্ শব্দ শোনা যায়। তিনি ঝর্ণার ঝংকারের সঙ্গেও তুলনা করেছেন বৃষ্টির শব্দকে।
গ্রামবাংলায় বর্ষার অপরূপ দৃশ্য চোখে পড়ে। মনে প্রেম জাগ্রত হয়। আমার পূর্ববাংলা কবিতায় সৈয়দ আলী আহসান বাংলাকে সিক্ত নীলাম্বরী পড়া রমণীর সঙ্গে তুলনা করেছেন। চণ্ডীদাসের কাব্যের প্রেমিকা রাধা আর বর্তমান কবির প্রেমিকা ঘুরেফিরে যেন একই রূপে আবির্ভূত হন। সবার বিরহ যেন বর্ষাকে ঘিরেই। আঙিনায় দাঁড়ানো ভেজা নারীর অঙ্গ দেখলে সব পুরুষের অন্তরেই প্রেম জাগ্রত হয়। এটাই চিরন্তণ সত্য।
কবি শামসুর রাহমানের বৃষ্টি বন্দনায় ‘অনাবৃষ্টি’ কবিতায় লিখেছেন-
টেবিলে রয়েছি ঝুঁকে, আমিও চাষীর মতো বড়
ব্যঘ্র হয়ে চেয়ে আছি খাতার পাতায়,
যদি জড়ো হয় মেঘ, যদি ঝরে ফুল বৃষ্টি
অলস পেন্সিল হাতে বকমার্কা। পাতা জুড়ে আকাশের নীল।
কবি শামসুর রহমান মূলত বৃষ্টির জন্য অপেক্ষায় থেকেছেন।তাই তার কবিতার নাম অনাবৃষ্টি। বাস্তবিক বৃষ্টি না হলেও এ কবির কল্পনার পুষ্পবৃষ্টি। হয়তো এসেছে, হয়তোবা আসেনি।
শহীদ কাদরী তাঁর ‘বৃষ্টি, বৃষ্টি: উত্তরাধিকার’ কবিতায় বলেছেন-
এইক্ষণে আঁধার শহরে প্রভু, বর্ষায়, বিদ্যুতে
নগ্নপায়ে ছেঁড়া পাৎলুনে একাকী
হাওয়ায় পালের মতো শার্টের ভেতরে
ঝকঝকে, সদ্য, নতুন নৌকোর মতো, একমাত্র আমি,
আমার নিঃসঙ্গে তথা বিপর্যস্ত রক্তেমাংসে
নূহের উদ্তাম রাগী গরগরে লাল আত্মা জ্বলে
কিন্তু সাড়া নেই জনপ্রাণীর অথচ
জলোচ্ছ্বাসে নিঃশ্বাসের স্বর, বাতাসে চিৎকার
কোন আগ্রহে সম্পন্ন হয়ে, কোন শহরের দিকে
জলের আহ্লাদে আমি একা ভেসে যাবো?
এখানে কবি জলোচ্ছ্বাসে নিঃশ্বাসের স্বর শুনতে পেয়েছেন, বাতাসে শুনছেন চিৎকার। তিনি চেয়েছেন জলের আহ্লাদে একাই ভেসে যেতে।কবি বর্ষায় নগ্নপায়ে একাকী হেঁটেছেন, যেখানে কোনো জনপ্রাণির সাড়া নেই।
সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের ভাষায়-
মেঘ থেকে বৃষ্টির দু’ফোঁটা! উড়ে গেলে তুমি!
কোথাও কি খাদ্য চোখে পড়েছে হঠাৎ? বৃষ্টির বিশুদ্ধ জল
তবে পড়ে আজও পৃথিবীতে?- আমিও তো উড়ে যেতে চাই
বৃষ্টিজলে মানুষের যাপিত সংসারে।
সৈয়দ হক বৃষ্টিজলে মানুষের যাপিত সংসারে উড়ে যেতে চেয়েছেন। বৃষ্টির জলকে কবি বিশুদ্ধ বলে আখ্যা দিয়েছেন।
কবি আল মাহমুদ বর্ষা-বিবরণে হাজির করেছেন মানুষ-সভ্যতা আর সমাজগতির ধারাপাত। তিনি ‘আষাঢ়ের রাতে’ কবিতায় লিখছেন-
কেন যে আবিল গন্ধে ভরে ওঠে আমার নিঃশ্বাস।
এই রাত, এই হাওয়া, নীলিমার নক্ষত্রনিচয় আর
আত্মীয় চাঁদের পিঠ, সবি যেন আচ্ছন্ন ধোঁয়ায়,
যেন সবি প্রায়ান্ধ চোখের কাছে অস্পষ্ট সুদূর।
শুধু দিগন্তবিস্তৃত বৃষ্টি ঝরে যায়, শেওলাপিছল
আমাদের গরীয়ান গ্রহটির গায়।
যেন শত শতাব্দীরও আগে
মৃত এক অতিকায় কাছিমের খোলের ওপরে বসবাস
করছে মানুষ আর
পৃথিবী উঠেছে পচে, চতুর্দিকে তার
গলিত পুঁজের উৎস খুলে গিয়ে উপচে পড়ে মাংসভুক কীট।
কবির দৃষ্টিতে শুধু দিগন্তবিস্তৃত বৃষ্টি ঝরে যায়। পিচ্ছিল পৃথিবী অতিকায় কচ্ছপের খোলের ওপর স্থাপিত। পৃথিবী পচে উঠেছে ক্রমশ। আষাঢ়ের রাতে এযেন কবির বিদ্রূপ আর আক্ষেপ। বৃষ্টি যেন পৃথিবীকে শুচি-শুভ্র করে দেয়। কবি হয়তো মনে মনে এমনটাই কামনা করেছেন।
কবি আসাদ চৌধুরী ‘প্রথম কবি তুমি প্রথম বিদ্রোহী’ কবিতায় লিখেছেন নিজের কথা-
টেবিলে মোমবাতি কোমল কাঁপা আলো
বাহিরে বৃষ্টির সুরেলা রিমঝিম-
স্মৃতির জানালায় তোমার মৃদু টোকা।
রূপার সংসারে অতিথি সজ্জন
শিল্পী কতজন হিসেব রাখিনি তো!
স্মরণে ওস্তাদ- গানের মমতাজ
দারুণ উচ্ছ্বাস, সামনে চা’র কাপ
প্রধান অতিথি তো আপনি, বলবেন-
কিন্তু তার আগে এ ঘোর বরষায়
সমানে বলছেন নিজের সব কথা।
…
প্রথম কবি তুমি, প্রথম বিদ্রোহী
এমন দুর্দিনে তাই তো মনে পড়ে
তোমার হাসি মুখ, তোমার বরাভয়
ভীরুতা চারদিক, তুমিও নেই পাশে।
বলতে গেলে কবিদের কল্পনা জুড়ে কেবল বৃষ্টির আনাগোনা। স্মৃতির জানালায় বৃষ্টির টোকা। গানের আসর বসে, গরম চায়ে ঠোঁট লাগিয়ে খোঁজে উত্তাপ। বৃষ্টির ক্ষণে তোমাকে প্রথম কবি এবং বিদ্রোহী মনে হয়।
কবি মুহাম্মদ নূরুল হুদা তাঁর ‘বৃষ্টি পড়ে’ কবিতায় বৃষ্টিকে নানা আঙ্গিকে প্রকাশ করেছেন-
বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি পড়ে
মনে মনে বৃষ্টি পড়ে
বৃষ্টি পড়ে বৃষ্টি পড়ে
বনে বনে বৃষ্টি পড়ে
মনের ঘরে চরের বনে
নিখিল নিঝুম গাও গেরামে
বৃষ্টি পড়ে বৃষ্টি পড়ে
বৃষ্টি পড়ে বৃষ্টি পড়ে।
নিতান্তই একটি বৃষ্টির ছড়া। শিশু-কিশোরদের ভালো লাগার মতো কথা। তবু এর ভেতরে গভীর একটি উপলব্ধি আছে। মনে মনে, বনে বনে- সর্বত্রই বৃষ্টি পড়ে।
কবি হাসান হাফিজ তাঁর ‘বর্ষাভেজা পদাবলীতে’ বর্ষাকে আনন্দ-বেদনা উভয় রূপেই কল্পনা করেছেন। শ্রাবণে কেবল বিরহকেই কবি প্রাধান্য দেননি। তিনি শ্রাবণের মাঝে অগ্রাহায়ণকেও উপলব্ধি করেছেন। আর সেই তাপেই শুদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। কবির ভাষায়-
শ্রাবণে বিরহ শুধু নয়, আগুনও রয়েছে
সেই তাপে শুদ্ধ হবে অসবর্ণ মিল পিপাসা।
এতো কেবল কয়েকটি বাংলা কবিতায় বর্ষার উপস্থিতির কথা। আরো কতশত কবিতা যে দৃষ্টিগোচর হয়নি, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। কবিতার কথা বাদ দিলেও সাহিত্যের অন্যান্য শাখা- উপন্যাস, গল্প, নাটকেও বর্ষা এসেছে বিভিন্ন উপলক্ষে। শিল্প-সংস্কৃতির শক্তিশালী মাধ্যম চলচ্চিত্রের প্রায় সব নির্মাণেই বর্ষাকে পাই নানাবিধ কৌশলে। বেলাশেষে কেবল এটুকুই বলতে পারি, আসলে বর্ষা নিয়ে যত কথাই বলি- সেতো শেষ হওয়ার নয়।
একেকজনের দৃষ্টিতে বর্ষা একেক রকম। কখনো কোমল, কখনো বিদ্রোহী, কখনো কাম-বাসনার আকড়, কখনো আনন্দদায়িনী। আর তাইতো পৃথিবীতে বর্ষা আসবে। আমাদের ভিজিয়ে দিয়ে চলে যাবে। রেখে যাবে নানা অনুভূতি। সেই অনুভূতিকে উপজীব্য করেই কবিরা লিখবেন। পাঠক ছুঁয়ে দেখবেন কবিদের ভাবনা। কবিদের সঙ্গে-সঙ্গে পাঠকরাও বর্ষাসিক্ত হবেন। আবেগের বশবর্তী হয়ে প্রিয়ার বন্দনা করবেন। হয়তো খুঁজে পাবেন সামান্য প্রশান্তি। পাবেন কিছু প্রশ্রয়ও। বর্ষার ধারায় শুদ্ধ হবে মানবমন। পৃথিবী যতদিন থাকবে, কবিতা ততদিন থাকবে। কবিতা যতদিন থাকবে, কবিতায় বর্ষার উপস্থিতি ততদিন থাকবে। কবিতায় খুঁজে পাব দেশ, কবিতায় খুঁজে পাব মানুষ, কবিতায় খুঁজে পাব প্রিয় ঋতু।