বাঙালি জাতির মহত্তম ও গৌরবময় অর্জন স্বাধীনতা। স্বাধীন ভূ-খণ্ড অর্জনের জন্য একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি জাতিকে ৩০ লাখ শহীদের পবিত্র রক্ত বিসর্জন দিতে হয়। দিতে হয় দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমও। অনেক অশ্রু-ত্যাগের বিনিময়ে এই অর্জন একদিকে করুণ, শোকাবহ ও লোমহর্ষক; অন্যদিকে ত্যাগের মহিমায় উজ্জ্বল-বীরত্বপূর্ণ। বাঙালি জাতিকে পাকিস্তানি দুঃশাসনের কবল থেকে মুক্ত করে জাতির ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে উঠলেন একটি অবিস্মরণীয় নাম। বাঙালি থেকে অবিসংবাদিত নেতা হয়ে ওঠা, সাধারণ মানুষ থেকে জাতির পিতা হয়ে ওঠা এবং সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হয়ে ওঠার জন্য যে দূরদর্শিতা, তা শেখ মুজিবুর রহমানের ছিল বলেই তিনি কালাতিক্রম করতে পেরেছেন। যিনি অশৈশব লালন করেছিলেন বাঙালি জাতির জন্য একটি স্বাধীন ভূ-খণ্ড এবং ক্ষুধামুক্ত-অসাম্প্রদায়িক চেতনার ‘সোনার বাংলা’ গড়ার স্বপ্ন।
কৈশোরে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের শিক্ষা পেয়েছিলাম বাবার কাছ থেকে। তখন আশির দশক, সে সময় বঙ্গবন্ধুর নাম প্রকাশ্যে উচ্চারণ করাও কঠিন ব্যাপার ছিল। বাবা বলতেন, আমি যেমন তোমার পিতা, তেমনি বাঙালি জাতির পিতা হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার নেতৃত্বে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাঙালি স্বাধীকার আন্দোলন করেছে, ছিনিয়ে এনেছে লাল-সবুজ পতাকা, গড়েছে স্বাধীন ভূ-খণ্ড। তখন থেকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বুকে লালন করে পথ চলছি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আমি সরাসরি দেখিনি সত্য, কিন্তু তার বিশ্বস্বীকৃত বীরত্বপূর্ণ অবদান জেনেছি নানাভাবে। জেনেছি সোনার বাংলা নিয়ে তার স্বপ্নের কথা।
এবার একটু পেছন ফিরে দেখে আসা যাক। বঙ্গবন্ধুর জীবনী পর্যালোচনায় জানা যায়, ১২ বছরের বেশি সময় কারাগারে কাটানো এই মানুষটি সব সময় নিপীড়িত মানুষের মুক্তি চেয়েছেন। ফলে যারা নির্যাতিত, নিপীড়িত ও মুক্তির মিছিলে অগ্রগামী, তাদের মনে আশার উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা হিসেবে তিনি চিহ্নিত হয়েছেন। তার সাহসী ও প্রতিবাদী স্ফূরণ স্কুলে পড়াকালীন সময়েই প্রকাশিত হয়। মানুষের প্রতি অকৃত্রিম মমত্ববোধ নিয়ে দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে আদর্শের সঙ্গে সমন্বিত করে তিনি ধাপে ধাপে সামনে এগিয়েছেন। সব ধরনের বাধা-প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে ইতিহাসের মহাসড়ক ধরেই তিনি হেঁটেছেন। তৈরি করেছেন নিজস্ব পথ। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা মুসলিম লীগের রাজনীতি দিয়ে শুরু হলেও বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার সমন্বয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারক বাহক। পাকিস্তান সৃষ্টির পর মুসলিম লীগের সামন্ত মানসিকতা ও শ্রেণীচরিত্র প্রত্যক্ষ করে অনেকের মতো তিনিও অনুধাবন করেন যে পাকিস্তান বাঙালি স্বপ্নপূরণে সমর্থ হবে না। তাই কারো প্রলোভন তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু বাঙালির অধিকার, স্বায়ত্তশাসন ও গণতন্ত্রের জন্য যে আন্দোলন করেছিলেন তার একমাত্র লক্ষ্য এদেশের মানুষের কল্যাণ সাধন এবং স্বাধীন ও মুক্তির লক্ষ্যে তাদের চালিত করা।
বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির মনে প্রদীপ্ত শিখা প্রজ্জ্বলিত করেছেন, জাতিকে করেছেন আত্মসচেতন, জাগিয়েছেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের বোধশক্তি দিয়ে, দিয়েছেন স্লোগান। ‘জয় বাংলা’ দিয়েই বাঙালি জাতিকে একসূত্রে গেঁথেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ই বঙ্গবন্ধুর জ্যোতির্ময় বিভা ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো সে সময় বঙ্গবন্ধুর প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। আবার একাত্তরের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে তার ‘তর্জনীর গর্জন’ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ গর্জনের অন্যতম বলেও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। আসলে যেভাবেই বিশ্লেষণ করি না কেন, মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিজয় ছিল অত্যন্ত কঠিন। কিন্তু বাঙালির দৃঢ় মনোবল এবং জাতির জনকের বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কারণেই মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয়কে ত্বরান্বিত করে। যেখানে জড়িত ছিল বাঙালির জাতিসত্তার প্রশ্ন। যা জাগাতে সক্ষম হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।
প্রকৃত প্রস্তাবে, বঙ্গবন্ধু কতো বিশাল, কতো বড়ো কিংবা কতো মহৎ; এককথায় তার উত্তর দেওয়া সত্যি দুরূহ। বঙ্গবন্ধুর বিশালতার পরিমাপ কী দিয়ে হবে? আকাশের সীমানা দিয়ে কিংবা সমুদ্রের দৈর্ঘ্য দিয়ে? এর উত্তর আসলে কারো কাছেই নেই। তবে মহিমার ব্যঞ্জনার কথা যদি বলি, তা হলে তিল তিল বিশ্লেষণ করে বলা যেতেই পারে, বঙ্গবন্ধু সত্যিই আকাশের মতো উদার আর সমুদ্রের মতোই বিশাল তাঁর হৃদয়ের ঔদার্য। ফলে জাতির এই অবিসংবাদিত মহান নেতাকে স্মরণ করা যে কত গৌরবের, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বঙ্গবন্ধুর বিচক্ষণতা সম্পর্কে নতুন একটি তথ্য সম্প্রতি জানা গেছে। একাত্তরে পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত জোসেফ ফারল্যান্ড স্বীকার করেছেন যে, শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন পূর্ববঙ্গের আন্দোলন প্রশ্নে তিনি সঠিক ধারণা করতে ব্যর্থ ছিলেন (কালের কণ্ঠ, ১৩ আগস্ট ২০১৬)। একাত্তরে নিক্সন-কিসিঞ্জারের পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকে পড়ার নীতির অন্যতম এই ফারল্যান্ডের উপলব্ধি থেকেই বঙ্গবন্ধুর বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী প্রজন্মকেও নতুনভাবে উজ্জীবিত করে।
বাঙালির এই বিরল সম্পদ থাকা সত্ত্বেও অত্যন্ত গভীর বেদনা ও লজ্জার কারণ ঘটে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট। দিনটি বাঙালি জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে শোকাবহ ও বেদনার দিন। কতিপয় পথভ্রষ্ট স্বার্থন্বেষীরা স্বাধীন সার্বভৌম ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে। সমকালীন বিশ্ব ইতিহাসে এর চেয়ে নির্মম ট্র্যাজেডি আর নেই। অথচ এই বঙ্গবন্ধুই যৌবনের অধিকাংশ সময় অন্ধ কারাপ্রকোষ্ঠে কাটিয়ে স্বপ্ন দেখেছেন বাঙালির মুক্তির। আবার পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনেক বিতর্ক ও বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে। ইতিহাস থেকে তার নাম মুছে ফেলার কম চেষ্টা ও ষড়যন্ত্র হয়নি। বাস্তবতা হলো মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস থেকে ষড়যন্ত্রকারীরা তার নাম মুছে ফেলতে পারেনি- এখানেই বঙ্গবন্ধুর সফলতা। তাকে যতো মুছে ফেলতে চাওয়া হয়েছে, তিনি ততই বলিষ্ঠ হয়ে পুনরুজ্জীবন লাভ করেছেন। পাশাপাশি ১৫ আগস্টের শোককে শক্তিতে পরিণত করে বার বার জেগে উঠেছে নতুন প্রজন্ম। যে প্রজন্মকে আর বিভ্রান্ত করা যাবে না।
পাশাপাশি নতুন প্রজন্মের এটাও মনে রাখা দরকার, বঙ্গবন্ধুর এই সোনার দেশে মুক্তিযুদ্ধের মৌল চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার রক্ষা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও সাধারণ মানুষের স্বার্থ রক্ষার জন্য সবাইকে এক সঙ্গে কাজ করে যেতে হবে। স্বাধীনতার মূলস্তম্ভ সমুন্নত রাখতে সরকারের হাতকে করতে হবে শক্তিশালী। রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রকারীরা মানুষ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে সমর্থ হলেও মহামানব বঙ্গবন্ধুর যে আদর্শিক দ্যুতি, তা বুকে লালন করে এদেশের কোটি কোটি তরুণ জেগে রয়েছে। বলা যায়, মৃত্যুঞ্জয়ী বঙ্গবন্ধু আরো তেজদীপ্ত হয়ে বাঙালির মানসে হাজির রয়েছেন। বঙ্গবন্ধু আজীবন কোটিপ্রাণ বাঙালি হৃদয়ে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। আমার উপলব্ধি এমন যে, বাঙালি জাতির প্রাণপুরুষ ‘জ্যোতির্ময় বঙ্গবন্ধু’ কোনো কিছুতেই ম্লান হওয়ার নয়। তার বিরল ভূমিকা আমাদের অনিঃশেষ অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে চিরকাল।