মাঠ থেকে সরে যায় জল, সাদা মেঘে আকাশটা নির্মল। জেগে ওঠে নতুন নতুন চর, চরের ওপর কাশ থরথর। ঝরে যায় দিন, ঝরে যায় ফুল—কুয়াশা-ধোঁয়ার ভোরে ঝরে যায় বিষণ্ন বকুল।ঢেউ লাগে কাশবনে,ঢেউ লাগে মনে-মনে। ঢেউ লাগে জোসনায়, শিশির মাড়িয়ে কে তবে যায়!
কেউ যায়, কেউ আসে। এটাই তো নিয়ম। এটাই তো খেলা। ভারী ভারী মেঘ কখন যে লঘু হয়ে যায়! মৌসুমীর ছোঁয়ায় কত-না তার ছোটাছুটি। এই ছোটাছুটি বাদ দিয়ে সে আজ কত-না অলস! মহুরী বাজে না আর তার ঘর্ষণে ঘর্ষণে। নিরুদ্দেশ যাত্রা থেমে গেছে যেন। নেই আর বর্ষার ঘন-ঘোর অন্ধকার। তার বদলে আলো-ছায়ার লুকোচুরি। মেঘের ছায়ায় রোদের মায়ায় চোখ চলে যায় দূর অজানায়। কত দূরে থাকো তুমি মেঘ! কোথায় যাও অমন করে! মামার বাড়ি? না-কি পাঠশালায়। যেখানেই যাও ফিরে ফিরে এসো। আমিও যাচ্ছি পাঠশালায় পাঠে, আবার দেখা হবে কাশফুলের মাঠে!
পাঠশালা তো বকুল ফুল, তার গন্ধ ভরা আকুল আহ্বানে, আমি যে পারি না যেতে অন্য কোনো খানে। আর ওই যে দেখো শিউলি ঝরে অগোচরে। আমিই যে তার অতিথি, যাচ্ছি তাই তার দুয়ারে। দুয়ার মাখা দুর্বা ঘাসে, শিশির মেখে রোদ যে হাসে। রোদের হাসি হয় না বাসি, ঝিলিক ওঠে নথে, কিশোরী যায় আলতো পায়, রবীন্দ্রনাথের সাথে: ‘শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি/ ছড়িয়ে গেল ছাপিয়ে মোহন অঙ্গুলি।’
এই আলোয় কি আর ঘরে থাকা যায়! না-কি যাওয়া যায় পাঠশালায়! পাঠশালাও তো ঘর। পায়ে শিশির মাখলে যে সবকিছু হয়ে যায় পর! শুধু ডাকে নদীতে জেগে ওঠা নতুন চর:
এই শরৎ আলোর কমল-বনে
বাহির হয়ে বিহার করে যে ছিল মোর মনে মনে
(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
এই তো সময়। ভেতরে যে থাকে তাকে বের করে আনে শরতের আলো। যেন কোনো কথা নেই আর। কোনা ইশারাও নেই। শুধু হাত বাড়ানো আলতো করে। তারও নেই কোনো দ্বিধা। মনে মনে। যেন এরকমই হওয়ার কথা ছিল। যেন এরকম আহ্বানের জন্যই রচিত হয়েছিল এই শ্বেত শুভ্রতা। তারপর নদীর চরে দুলে দুলে ডাক দেওয়া কাশবনের মাঝে হারিয়ে যাওয়া। শুধু হারিয়েই যাওয়া। আর কিছু নয়।
বন্ধু মেঘকে তো বলাই ছিল যেয়ো নাকো বহুদূরে। আমি আসছি তোমার কাছে। কিন্তু কাশবন পেয়ে যেন পেয়েছি শতাব্দীর ভ্রমণ-পিপাসা। ভুলেছি মেঘকে, কথা দেওয়া বন্ধুকে। কিন্তু সে তো ভোলেনি। খুঁজে খুঁজে স্থির হয়েছে মাথার ওপরে। অভিমানে অভিমানে হয়েছে টইটম্বুর। তারপর অকস্মাৎ উড়াল পানিতে ভিজিয়ে দেওয়া। মাথার ওপরে মেঘের ছায়া, তার পর বৃষ্টির পরশ। দূরে তো ঠিক ঠিক রোদ্দুর! আহা! এ তো আসলেই খেলা!
তাহলে হয়তোবা ফিরব। কিন্তু ফিরব না। কারণ
আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ
আমরা গেঁথেছি শেফালি মালা
নবীন ধানের মঞ্জরি দিয়ে
সাজিয়ে এনেছি ডালা
(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
এই মালাতেই হয়ে যাবে প্রণয়, ডালাতে রচিত হবে ভবিষ্যৎ।
কিন্তু তাতেও যে মিষ্টি একটা কষ্ট লেগে থাকে! শরতের মতো তাকেও পাওয়া না-পাওয়ার মাঝামাঝিতে পার হয়ে যায় জীবন। মালাতে ডালাতে প্রণয়ে সময় পার হয়ে যায়। আলোকে আড়াল করার জন্য মেঘও যেন সরে সরে যায় একটু একটু করে। সরে সরে যায় সূর্যের দিকে। সাদা দুপুরটি এভাবে কখন যে বিকেলের দিকে যাত্রা করে বুঝতে পারি না। হাত ধরাধরি তবুও তো থেমে থাকে না। বিকেলের ছায়ায় তবু চলে আমাদের দৌড়াদৌড়ি। সহসা মনে পড়ে কোথায় গেল মেঘ, আমার বন্ধু মেঘ! কোথায় বিধবা রং ওড়াউড়ি! সূর্যকে আড়াল করতে চলে গেছে সে। তখন পশ্চিমাকাশে ধারণ করেছে বেগুনী রং। ওই রঙ দেখে উড়াল দিয়েছে শঙ্খচিল। আকাশে তার পাখার রঙ হয়ে গেছে সোনালী। তখনই হায় হায় করে ওঠেন জীবনানন্দ।
তখন মন খারাপ করে ফিরে আসতে ইচ্ছে করে। তখন শঙ্খচিলের করুণ পাখার দিকে তাকিয়ে থাকি। এভাবে কখন বিকেলটি যে সন্ধে হয়ে যায় বুঝতে পারি না। তারপর শুরু হয়ে যায় নিশীথিনীর অনুরোধ, তারপর শুরু হয়ে যায় জারুলের রঙিন ছাপ, তারপর শুরু হয় যায় ছাতিম বৃক্ষের চন্দ্র-ছায়া, তারপর শুরু হয়ে যায় শিউলির গন্ধ, তারপর শুরু হয়ে যায় কামিনির আহ্বান। এরই মধ্যে আকাশে গোল চাঁদ! সঙ্গে-সঙ্গেই চারিদিকে দুধভাসা চরাচর। আহা। এত শ্বেত-শুভ্রতা কোথায় লুকিয়ে রাখো তুমি প্রকৃতি! এত শ্বেত-শুভ্রতা যে শুধুই সম্ভাবনাময়।
দুই.
এই শুভ্রতার মাঝে এখানে সেখানে দেখা যায় স্বচ্ছ জল। জলধারা শুকিয়ে শুকিয়ে রচনা করে জল-দাগ। আহা তার মাঝে ধরতে যাওয়া তিলা পুঁটির তেড়সা দৌড়। কিংবা বিলের ভেতরে কাঁদা খুঁচে খুঁচে ধরতে যাওয়া শাপলা ফুল। সাদা শাপলা, রক্ত শাপলা, নীল শাপলা, চাঁদ মালা। পদ্ম ফুলের কথা আর নাই বা বললাম। জলজ পানা মাড়িয়ে মাড়িয়ে এইসব শাপলার কাছে যাওয়া। পানা সরালেই তো কালো কালো কই মাছ। খলবল খলবল করে ছোটাছুটি। আহ কেন এত বিরক্ত!ওপাশে যে মৌনী তাপসের মতো এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে ধ্যানী বক। সাদা সাদা বক, হালকা ধূসর বক। সাদা বকের পাখায় লেগে থাকা রোদ্দুর। আহা রোদ্দুর মাখা বক। খলবল আর ছোটাছুটিতে কী আর করা। মৌনী তাপস তার ধ্যান ভেঙে দিলেন উড়াল। নির্লিপ্ত, উদাসীন, নির্বিকার। এদিকে পানকৌড়ীর নেই কোনো বিকার। ভেসে ভেসে ডুব দেওয়া। জলের সঙ্গে জলকেলি। মাথার দুলুনি, চঞ্চলতা। রাঙা হালতিরও তো দেখি নেই কোনো বিকার। হেঁটে চলছে সতর্ক হয়ে ছানাপোনা নিয়ে। চলছে তাদের জীবন-শিক্ষা, টিকে থাকার কৌশল কিংবা যুদ্ধবিদ্যা। মাঝে মাঝে শোনা যায় ডাহুকের ডাক। চোখ ফেরানো দায় হয়ে যায় যখন দেখা যায় বালিহাঁসের ঝাঁক। এর ভেতরেই খুঁজি কোড়াকে। কোথায় গেল কোড়া। কিংবা জল মোরগ? কিংবা ‘তুই কেন এত সুন্দর হইলি রে’ গেয়ে গেয়ে পার করা আ-কৈশরের মুনিয়া! কোথায় মুনিয়া? কত ধরনের মুনিয়া! তিলা মুনিয়া, সাদা মুনিয়া, কালোমাথা মুনিয়া। চোখ খুঁজে ফেরে জলপিপি, জল য়ূর।
কত কী যে হারিয়ে গেল, কত কী যে হারিয়ে গেছে, কত কী যে হারিয়ে যাচ্ছে। আরও কত কী যে হারিয়ে যাবে! এসবের মাঝে সন্ধ্যে বেলা জোসনা উঠুক আর না উঠুক ঠিক ঠিকই গন্ধ বিলাবে ছাতিম ফুল। গন্ধে গন্ধে করবে মাতোয়ারা। আবার বের করে আনবে ঘর থেকে। তখন আবার যেতে ইচ্ছে করবে ওই ব্যাপ্ত চরাচরে। তখন আবার যেতে ইচ্ছে করবে বিলের কাছে। তখন আবার যেতে ইচ্ছে করবে কাশের কাছে। তখন আবার যেতে ইচ্ছে করবে মেঘের কাছে। কিন্তু না, চাঁদ ডাকছে এখন। চাঁদের কাছে যেতে যেতে দেখা যায় বিলের ওপর পড়ে যাওয়া আলোর ঝিকিমিকি। কী আশ্চর্য দিনের বেলা দেখা সাদামাটা হোগলাবনকে এখন কেমন রহস্যময় লাগছে!
কেন এত রহস্য রহস্য লাগে! ছলনা? না না । তা হতেই পারে না। এ যে ঝরা ফুল কুড়াবার দিন! না না। এ যে সাদার দখলে চলে যাওয়া আমাদের পুরো পৃথিবী! না না। এ যে ডালা সাজিয়ে আনার দিন। না না। এ যে কাশবনে ঢেউ লাগানোর দিন। না না। এ যে প্রবল জোসনায় চোখে ঘোর লাগা রজনী। না না। এ যে শির শির হিমেল স্পর্শের দিন। না না । এ যে শরৎ নামের হরিৎ মেয়ের রানি হয়ে ওঠার দিন।