বর্তমান সময়ে একটা বই হলে কী, আর প্রকাশ না হলেইবা কী! বাস্তবতার সঙ্গে কিঞ্চিত রসিকতা মিশিয়ে বলা যায়, এখন বই প্রকাশিত হলে লেখক নিজে প্রথম কিছুদিন (হানিমুন পিরিয়ডের মতো) আনন্দিত থাকেন; বই প্রকাশিত না হলে লেখকের বন্ধু ও নিকটজনরা নির্ভার থাকতে পারেন! অবশ্য সব ক্ষেত্রে এমন চিত্র ধর্তব্যে নেওয়া যাবে না। তবে এটাও কিন্তু বিপ্রতীপ বাস্তবতা। যে ঘনিষ্ঠজনরা মুখের কথায় লেখককে গাছে চড়িয়ে দেন, সেই তারাই আবার পেছনে গিয়ে বই প্রকাশ নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করতে ভোলেন না। প্রথম বই প্রকাশের পর একজন স্বপ্নবাজ লেখক বুঝে যান, আদতে সমাজে তার কদর কতটুকু; কী তার লেখার মূল্য! বিগত কয়েক বছরে বই প্রকাশ নিয়ে আমি নিকটজনদের সঙ্গে ‘নিষ্ঠুর’ একটা ঠাট্টায় মেতেছি। খুব নিষ্ঠুরভাবেই বলেছি, যত গুরুত্বপূর্ণ টেক্সটই হোক, একটা বই প্রকাশিত হলে যতটা ভালো, না হলেও তার চেয়ে ঢের বেশি ভালো! গাছ কাটা হবে বলে এমন সতর্কবাণী দিচ্ছি না, অত কাঠখোট্টা প্রকৃতিপ্রেমিক এখনো হয়ে উঠতে পারিনি। বই প্রকাশ না হলে লেখক বেঁচে যান অনেক অপ্রয়োজনীয় হুজ্জত থেকে।
বই প্রকাশের সংখ্যার দিক দিয়ে কবিতা বরাবরই এগিয়ে। অথচ কবিতার বই সেই অর্থে বিক্রিও হয় না। আধুনিক কবিদের নিয়ে প্রকাশ্যে কিংবা আড়ালে-আবডালে হাসাহাসিও হয় অনেক। কবি শব্দটিকে গালি কিংবা তাচ্ছিল্যভরে ব্যবহার করেন এমন মানুষের সংখ্যা চারপাশে কম নয়। কবিতা যদি অনিরাময় একটি অসুখ হয়, বই প্রকাশের বাসনাকেও বোধকরি এর বাইরে রাখার সুযোগ নেই। শুধু পত্রপত্রিকায় নিজের মতো লিখে গেলে, বই প্রকাশ না করলে কী ক্ষতি হয় একজন লেখকের! বই না থাকলে তিনি কি অলেখক হিসেবে বিবেচিত হবেন?
আদতে বইয়ের সঙ্গে লেখক হয়ে ওঠার একটা ব্যাপার থাকেই। বিভিন্ন জায়গায় বিচ্ছিন্নভাবে লিখে একজনের পক্ষে লেখক হয়ে ওঠা কঠিন। পাঠকেরও এত দায় পড়েনি, খুঁজে-বেছে লেখককে যথাস্থানে বসিয়ে দেবে। বইয়ের ভেতরেই থাকে লেখকের রকমারি ভাবনার নির্যাস। ভাবনা-ক্ষমতার নিদর্শন। লেখকের রুচি, উপলব্ধি, বোধ এসব শনাক্ত করতে বইয়ের বিকল্প হয় না। সব লেখা লেখকের প্রিয়ও নয়। শেষপর্যন্ত মান বিচারে সেরা লেখাটিই সংকলনের স্থান পায়। প্রয়োজন বোধে প্রকাশিত লেখাগুলো লেখক আবার লেখেন, পুনর্লিখন করেন বা আমূল বদলে দেন।
প্রথম প্রকাশিত বই কোনটি, এমন প্রশ্ন কেউ আমাকে করলে বিব্রত বোধ করার জন্য যথেষ্ট। ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছিল দুটি বই। যেখানে একটিও হওয়ার কথা নয়, সেখানে দুটি! তালগোল পাকানোর মতো অবস্থা। প্রথম বইয়ের সঙ্গে মিশে থাকে লেখকের হাসি-কান্নার রকমারি গল্প। অমোচনীয় ইতিহাসও বটে। পাঠকের দরবারে লেখকের স্থানও অনেকাংশে নির্ধারণ হয়ে যায় বই প্রকাশের মাধ্যমে। ২০১৩ সালের অমর একুশে বইমেলায় একত্রে প্রকাশিত দুটি বই হয়েছিল। গল্পগ্রন্থ : প্রতিদিন একটি খুন, রম্যগল্পগ্রন্থ : সবার উপরে ছাগল সত্য। দুটি বই-ই আমাকে বিস্তর আনন্দ-বেদনায় ভাসিয়েছে, ডুবিয়েছে। চুবিয়েছেও! তবে আনন্দ একসময় ফিকে হয়ে এলেও বেদনা রেখে গেছে গভীর ক্ষত। সেই ক্ষতে এখনো, অমাবস্যা রাতে ব্যথা জানান দেওয়ার মতো অবস্থা হয়! ২০১৩ সালে বইমেলার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হলো। তাতে পুড়েছে সম্ভবত ২৩টি স্টল।
আমার দুটি বইয়ের প্রকাশনীই ভুঁইফোড়। প্রকাশক দুজনের একজনেরও বইমেলায় নিজস্ব স্টল নেই। ‘প্রতিদিন একটি খুন’ গল্পগ্রন্থের পরিবেশক ছিল গদ্যপদ্য। ২২ ফেব্রুয়ারি বই স্টলে ওঠে, ওই রাতেই অগ্নিকাণ্ডে স্টলে থাকা সব বই পুড়ে যায়। বইটি ছিল পাঁচ ফর্মার। ফর্মা মেলানোর জন্য গল্পের নতুন অধ্যায় (পরিচ্ছদ) পৃষ্ঠা থেকে শুরু করা হয়েছে। অথচ চাইলে বাড়িয়ে ছয় ফর্মা কিংবা কমিয়ে সাড়ে চার ফর্মায়ও আনা যেতো। আকার ছোট রাখার জন্য কিছু গল্প বাদ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ফর্মা মেলানোর জন্য এমন কিম্ভুত মেকআপ দেওয়া ছিল অপ্রত্যাশিত। বইয়ের পাতায় ঢেউ খেলানো। পুরোনো স্যাঁতস্যাঁতে কাগজে ছাপলে এমন হয়। অনেক সময় প্রেসের গাফিলতির কারণেও হয়তো এমনটি ঘটতে পারে। কম্পিউটারের ভার্সনজনিত সমস্যার কারণে ণ্ড (ণ+ড) ভেঙে ওই জায়গাটা স্পেস সৃষ্টি হয়েছে। অথচ আমি দেখতে না চাইলেও প্রকাশক ট্রেসিংয়ের প্রিন্ট দেখিয়েছিলেন। ফন্ট ভাঙার বিষয়টি তাকে জানালে বললেন, ‘এটা ঠিক করবো। রাতে আমিও শুরু থেকে শেষপর্যন্ত চেক দেবো। দেখবো অন্য কোনো সমস্যা আছে কি না।’ পরে সেসব আর ঠিক হয়নি। হয়তো আমাকে খুশি করার জন্যই এসব বলেছিলেন। চেক করার বিষয়টিও নিছক কথার কথা!
পরের বইটির অবস্থাও সুখকর ছিল না। ‘সবার উপরে ছাগল সত্য’ রম্যগল্পের বই। বিভিন্ন ফান ম্যাগাজিনসহ নানা জায়গায় প্রকাশিত লেখার সংকলন। প্রকাশককে প্রস্তুত করে দিয়েছিলাম চার ফর্মার বই। প্রকাশিত হওয়ার পরে দেখা গেলো সেটা তিন ফর্মা! আমাকে না জানিয়েই পৃষ্ঠাসংখ্যা কমানো হয়েছে। অথচ ‘পুস্তিকা’ প্রকাশের পক্ষপাতী ছিলাম না, এখনো নই। পরে জানা গেলো, আসল রহস্য। বাংলা একাডেমিতে স্টলের আবেদন করার শর্ত হিসেবে চলতি বছরে প্রকাশিত বই নির্দিষ্ট সংখ্যক বই থাকতে হয়। স্টল পাওয়ার চালাকিতে প্রকাশক আমাকে বলির পাঁঠা বানিয়েছেন। এমন আরও অনেককে। যেনতেনভাবে ‘বই’য়ের সংখ্যা বাড়ানোই ছিল লক্ষ্য। সেখানেও বড় কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু ইনারে পর্যাপ্ত পৃষ্ঠা না রাখা, এক ফর্মা কমিয়ে ফেলা এসব ভালো লাগেনি। অন্তত জানাতে তো পারতেন! শেষপর্যন্ত প্রকাশকের ভাগ্যে শিকা ছেঁড়েনি; মেলেনি স্টল। বইটি বিক্রি হয়েছে লিটলম্যাগ চত্বরের বয়রাতলায়। ৪৮ পৃষ্ঠার ফিনফিনে বইটির দাম রাখা হয়েছে ১২০ টাকা। ২০১৩ সালের বাজারমূল্য বিবেচনায় দামটা অস্বাভাবিক। ‘ন্যায্য মূল্য’ হতে পারতো ৬০ থেকে ৭০ টাকা। বন্ধুবর মাইনুল এইচ সিরাজী, শিরীন সুলতানা সম্পা জানালেন উচ্চমূল্যে বই ক্রয়ের কথা। প্রকাশককে দামের বিষয়ে জানালে তিনি বললেন, বেশি লিখলেও কমিশন বেশি দিচ্ছি। ৫০ পার্সেন্ট ছাড় দিয়ে দাম ৬০ টাকা। অথচ চেনা-জানা কেউই ৯০ টাকার কমে কেনার সুযোগ পাননি! একটি বই থেকেও নেই, অন্যটির গলাকাটা মূল্য! পুড়ে যাওয়া স্টল পুনরায় নির্মাণ করা যায়নি। সুতরাং বইটি কেঁদেছে অচেনা কোনো গুদামে, সিগারেটের বাক্সে বন্দি হয়ে।
‘সবার উপরে ছাগল সত্য’ রম্যগল্পগ্রন্থটির প্রচ্ছদ করেছিল প্রথম আলোর ফান ম্যাগাজিন আলপিন’র সেই দুর্ভাগা কার্টুনিস্ট আরিফুর রহমান। ততদিনে সে স্থায়ী হয়েছে নরওয়ে’তে। সেখান থেকে ইমেইলে প্রচ্ছদ পাঠিয়েছিল। প্রতিদিন একটি খুন গল্পগ্রন্থের প্রচ্ছদ করেছিলেন পীযুষ দস্তিদার। তাকে সৌজন্য কপি দিতে গেলে বললেন, ‘বইটির কিছু রিভিউ করাও। প্রচার-প্রচারণাও জরুরি।’
উত্তর দিলাম, ‘আমার বইয়ের রিভিউ ছাপবে কে?’
পীযুষদা শীর্ষস্থানীয় একটি দৈনিকের কথা উল্লেখ করে বললেন, ‘সাহিত্য সম্পাদক আমার ঘনিষ্ঠ। তুমি ইমেইলে আমার কথা লিখবে।’
নাদিম মজিদকে বলার পর তিনি ছোট্ট একটি আলোচনা লিখে দিলেন। সাময়িকীতে পাঠালাম। ছাপাও হলো কয়েক মাস পরে। ছাপানোর খবরটা পীযুষদাকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করলাম। কল করে তাকে জানাতেই বললেন, ‘আমি জানি বিষয়টা। ও (সাহিত্য সম্পাদক) কল করে আমার কাছ থেকে সত্যতা নিশ্চিত হয়েছে।’
তব্দা মেরে গেলাম সাহিত্য সম্পাদকের ‘অনুসন্ধান’ দেখে। কম-বেশি দুইশ শব্দের ক্ষীণকায় লেখাটি তিনি ‘বিশ্বাস’ কিংবা ‘নিজ দায়িত্বে’ ছাপতে পারলেন না! সম্পাদক-চরিত্রের ওই অবিশ্বাসের ক্ষত এখনো আমাকে বিপর্যস্ত করে। বইটির দ্বিতীয় রিভিউ ছাপা হয় সেবা প্রকাশনীর সহযোগী প্রকাশনা রহস্যপত্রিকায়। এরপরও বেশ কিছু আলোচনা লিখেছেন কেউ কেউ। বইটি উৎসর্গ করেছি জনপ্রিয় লেখক সুমন্ত আসলামকে। ‘সবার উপরে ছাগল সত্য’ উৎসর্গ করা হয়েছে আমার ভাগ্নে-ভাগ্নি, ভাতিজা ও ভাতিজিদের। মোট ১০৪ জনের ডাকনাম ছাপা হয়েছিল। প্রকাশক কিংবা মেকআপম্যানের উটকো মাতব্বরিতে উৎসর্গপত্রের নান্দনিকতা রক্ষিত হয়নি। এতজনকে উৎসর্গ করার পেছনে একটি গল্প ছিল। বড় খালাম্মা মারা গেছেন। তাঁকে শেষ দেখা দেখতে গিয়েছি মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে। সেখানেই অনেকের সঙ্গে দেখা। এরা আমারই নিকটাত্মীয় অথচ জীবনে কারও সঙ্গে দেখাই হয়নি! এক খালাতো বোনের ছেলে আবার একটি ব্যাংকের ম্যানেজার। দেখা হলো তার সঙ্গেও। ভাবনাটা তখন মাথায় এলো। অপরিচয়ের গণ্ডি পেরোতে সিদ্ধান্ত নিলাম এদেরই উৎসর্গ করব রম্যগল্পগ্রন্থটি। এক দঙ্গল দামালকে বই উৎসর্গ করার ফল খুব একটা সুখকর ছিল না। কেউ কেউ গালমন্দও করেছে এমন ‘উদ্ভট’ উৎসর্গে। একদিন লিটলম্যাগ চত্বরে বসেছিলাম। নিঝুম বিকেল। এসময় এলো এক প্রেমিক জুটি। মেয়েটি হাতে তুলে নিলো বইটি। উৎসর্গপত্রে নামের বহর দেখে বয়ফ্রেন্ডকে বললো, ‘ও (লেখক) ইচ্ছা করলে আমার নামটাও রাখতে পারতো!’
তরুণটি বোধহয় শনাক্ত করতে পেরেছে আমাকে। তাই প্রেমিকাকে ঝাড়ি দিয়ে সামনে হাঁটা ধরলো! দুই বছর পর বইটি অন্য প্রকাশনী থেকে বেরিয়েছিল। মুদ্রণ শেষের পথে। আগামীতে হয়তো নতুন সংস্করণ আসবে। অন্যদিকে ‘প্রতিদিন একটি খুন’ গল্পগ্রন্থের তিনটি সংস্করণ বেরিয়েছে এপর্যন্ত। বইটি প্রকাশিত হওয়ার পরই আবিষ্কার করলাম কিছু লিখতে পারিনি। পাপমোচন করতে দ্বিতীয় সংস্করণে উদ্যোগী হলাম। তাতেও তৃপ্ত হতে পারিনি বলে তৃতীয় সংস্করণে হাত দিতে হলো। প্রতিটি সংস্করণেই ভিন্ন প্রকাশক; প্রয়োজনীয় সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত করেছি নতুন নতুন গল্পও। ছোটগল্পগ্রন্থের ফ্ল্যাপ লিখে দিয়েছিলেন এমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান; রম্যগল্পগ্রন্থের ফ্ল্যাপ উন্মাদ সম্পাদক আহসান হাবীব।
দুটি বই-ই পর্যায়ক্রমে জাতীয় গণগ্রন্থাগার ও জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র বাৎসরিক বই ক্রয় প্রকল্পে নিয়েছিল। অবাক কাণ্ড, ‘প্রতিদিন একটি খুন’ বইয়ের দুই কপি পৌঁছেছিল যুক্তরাষ্ট্রের লাইব্রেরি অব কংগ্রেসে। ওখান থেকে কিভাবে অর্ডার এলো বুঝিনি, এখনো জানি না। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান প্রকৃতি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী লেখক সৈকত হাবিব প্রথম দিকে কাছের মানুষদের মজা করে বলতেন, ‘এই সেই লেখক, যার বই লাইব্রেরি অব কংগ্রেস কেনে!’
প্রকাশকের কাছে ফিরি আবার। দুটি বইয়ের প্রকাশকই আমার স্বল্প পরিচিত। অচেনা গন্ধ থাকতেই তারা প্রস্তাব দিয়েছিলেন বই করবেন। ‘প্রতিদিন একটি খুন’ বইয়ের প্রকাশক জেলা শহর থেকে ঢাকায় এসে থিতু হওয়ার চেষ্টা করছেন তখন। এক বন্ধু পরিচয় করিয়ে দিলেন তার সঙ্গে। এর কিছুদিন পরই তিনি বললেন, ‘আমি তরুণদের প্রাধান্য দিই। আপনার বই করতে চাই।’
নিকট অতীতে প্রকাশকদের দেওয়া অপমানের গ্লানি ভুলে আনন্দিত হলাম। পাণ্ডুলিপি হস্তান্তর করা হলো। এরপর যথারীতি ফেব্রুয়ারির ১ তারিখ থেকে বইমেলা শুরু হয়। ১, ২, ৩ করে ১০ তারিখ যায়, ১৫ তারিখ যায় বই আর আসে না! যেহেতু লেনদেন নেই জোর গলায় কিছু বলতেও পারি না। ১৭ তারিখে প্রকাশক কল দিলেন। কিছু টাকা ধার চান তিনি। বেশ বড় অঙ্কের টাকা। তখন একটি মাসিক ম্যাগাজিনে কাজ করি। বেতন পাই ১০ হাজার টাকা। উদ্বৃত্ত টাকা তাই থাকার কথাও নয়। আমি যতই পারব না বলি, প্রকাশক আবার কল করেন। করতেই থাকেন। নানা সমস্যা দেখান। একপর্যায়ে বুঝে যাই, বইকে হাতিয়ার করে টাকা ধার চাইছেন জোরালোভাবে! ত্যক্তবিরক্ত হয়ে ফেব্রুয়ারি মাসের বেতনের পুরো ১০ হাজার টাকা তুলে দিই তার হাতে। যদিও জানতাম না, কপর্দকশূন্য অবস্থায় এই নিষ্ঠুর ঢাকা শহরে কতদিন চলতে পারব। বস্তুত, টাকা পাওয়ার পরপরই শুরু হলো বই প্রকাশের তোড়জোড়। বই তো বের হলো, পুড়েও গেল; এদিকে ধার দেওয়া টাকা তো আর ফেরত পাই না। দুই মাস নীরব অপেক্ষার পর বুঝে যাই, ‘ধারের’ টাকা আর ফেরত পাওয়া যাবে না। পর্যায়ক্রমে বই কিনে কিনেই সমুদয় টাকা পরিশোধ হয়।
‘সবার উপরে ছাগল সত্য’ বইটি স্টল পাওয়ার জন্য ‘সংখ্যা’ হিসেবে কাজ করেছে, আগেই বলেছি। ওই সময় ফকিরাপুলে ঘনঘন যেতে হতো আমাকে। প্রকাশক কাজ করাতেন দুই জায়গায়। আরামবাগে গ্রাফিক্সের কাজ, ফকিরাপুলে কম্পোজের। গ্রাফিক্সের কাজ বলতে ইন্টারনেট থেকে ছবি নামিয়ে প্রচ্ছদ বানানো পরবর্তী আউটপুট নেওয়া। ফকিরাপুলের গরম পানির গলি পেরিয়ে সুশীতল একটি জায়গায় কম্পিউটারের দোকানে কম্পোজ ও প্রুফের কাজ সারতেন প্রকাশক। সেই দোকানের কম্পোজিটর একজন মহিলা। একদিন প্রকাশক জানালেন, লেখকদের পাণ্ডুলিপি কম্পোজ করতে করতে ভদ্রমহিলা নিজেও লেখক হয়ে গেছেন! লিখে ফেলেছেন একটি উপন্যাস ‘বেদনার বৃত্তে’। তাকে বললাম, ‘আপনার বই আমি কিনব।’
নবীন লেখক মৃদু হাসলেন খুশিতে। পরে বোধহয় সেই বই আর বের হয়নি। প্রকাশকেরও মোহভঙ্গ হওয়ায় ধীরে ধীরে সরে এলেন প্রকাশনা থেকে। পরের বছরের বইমেলায় তার টিকিটিও দেখিনি। এই প্রকাশকের সঙ্গে পরিচয় একটি দুর্ঘটনার মাধ্যমে। লিটলম্যাগ চত্বরে স্টলের আবেদন করেও পাইনি সেবার। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ড. সরকার আমিন বললেন, ‘আপনি উন্মুক্ত স্টলে বসুন। আমারও তো স্টল নেই। আপনার পাশে আমি বসব মঙ্গলসন্ধ্যা নিয়ে।’ মঙ্গলসন্ধ্যা লিটলম্যাগ নিয়ে সরকার আমিন বসেননি। আমার স্টলে অবসর সময়ে বসতেন তরুণ কবি ফরিদ উদ্দিন মোহাম্মদ। অফিসে কাজ থাকায় প্রতিদিন বইমেলায় যেতে পারি না। একদিন রাতে ফরিদ কল করে জানালেন, স্টলে উটকো আরেকজন লোক জুটেছে। তিনি দাবি করছেন, সরকার আমিন তাকে বসতে বলেছেন। পরদিন গিয়ে দেখি, আমার আগেই জবরদখলকারী হাজির! আমার নিজের লিটলম্যাগ, বইও সাজিয়ে দিয়েছেন নিজ হাতে। তার আছে বোর্ড বাইন্ডিং করা কবিতাবিষয়ক লিটল ম্যাগাজিন আর কিছু কবিতার বই। কাঁচা কবিতা ও আনাড়ি কাজ দেখে কেন যেন বাধা দিলাম না। ঘনিষ্ঠতা হয়ে গেল ধীরে ধীরে। জানলাম, তিনি ছোটখাটো একজন শিল্প উদ্যোক্তা। শুধু কবিতাকে ভালোবেসে দিনের পর দিন ব্যবসা থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছেন। এমন মানুষের প্রতি সহানুভূতি জাগাই স্বাভাবিক।
প্রেমের মায়ায় কিংবা প্রতারণার জালে পড়ে চিরচেনা ঘর ছাড়ে অসংখ্য কিশোরী-তরুণী। শেষমেশ এদের কম অংশই সুখী হয়, বেশির ভাগই কুলটা গালি পায়। অনেকেই ঘর হারায়, বর হারায়। যখন বাস্তবতা উপলব্ধি করে, ফেরার পথ থাকে না। লেখালেখিও অনেকটা এমন। নইলে আমার কী দরকার ছিল চট্টগ্রামের সুনিশ্চিত জীবন ছেড়ে ঢাকায় কষ্টকর অধ্যায় বেছে নেওয়ার! লেখক হতে কেন ঢাকাতেই থাকতে হবে? এটাও একধরনের মোহ, অন্ধ অনুরাগ। কাঁচা বয়সের প্রেমের মতো বাঁধনহারা আবেগ। তবে আমার বই করার স্বপ্ন জেগেছিল কিশোরবেলায়, চট্টগ্রামে। প্রথমে বইয়ের কথা উচ্চারণ করেছিলেন আমার স্কুলশিক্ষক ইউসুফ স্যার। তিনি কীভাবে যেন আমার লেখালেখির বিষয়টা জেনেছিলেন। একদিন ডেকে পাঠালেন। তখন সাপ্তাহিক চলতিপত্রে ‘গর্দভ কথন’ নামে নিয়মিত রম্য কলাম লিখি। স্যার একদিন আমার উপস্থিতিতে অন্য শিক্ষকদের কলামটা পড়ে শোনালেন। শেষমেশ এও বললেন, ‘শফিক তো এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক!’
আমার অপরিণত আবেগ ছিল সত্য, তাই বলে স্যারের অলীক উপাধিতে খুশি হওয়ার মতো অবস্থা ছিল না।
কিছুদিন পরে স্যারের কাছে আবার গেলে বললেন, ‘তোমার একটি বই প্রকাশ করতে কত টাকা লাগবে?’
আন্দাজে ঢিল ছোড়ার মতো করে বলে ফেললাম, ‘এই হাজার দশেক!’
স্যার বললেন, ‘ঠিক আছে। প্রস্তুতি নাও। প্রয়োজনে আজাদীর প্রদীপকে এখানে ডাকিয়ে এনে ছবি আঁকিয়ে নেব।’
চট্টগ্রামের স্থানীয় দৈনিক আজাদীর ফিচার পাতাগুলোর অলংকরণ করতেন প্রদীপ সাহা। এখনো করেন হয়তো। তিনি কেন আমার মতো আনাড়ি একজনের জন্য কাজ করবেন; তাও নিজ বলয়ের বাইরে এসে! অনুভূতি স্পষ্ট না হলেও এটুকু বুঝেছিলাম, এভাবে হয় না। শিল্পীরা এত সহজ ও সস্তা নন। একসময় ঝিমিয়ে পড়ল আবেগ। ইউসুফ স্যারের সঙ্গে যোগাযোগ কমে গেল। ঢাকায় চলে আসি ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে। তারপর তো স্থায়ী দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। এরপর দেখা বা কথা হয়নি একবারও।
বেদনা তো আনন্দেরই সহোদর! প্রকাশকদের উপরেও এখন আর কোনো খেদ বা ক্ষোভ নেই। যেভাবেই হোক, তারা বই প্রকাশ করেছিলেন বলেই তো পায়ের নিচে মাটি পেয়েছি। বুঝতে শিখেছি, ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে আছি, যেতে হবে কত দূরে; কোন পথে!
তিক্ত অভিজ্ঞতায় ফিরি আবার। ‘সবার উপরে ছাগল সত্য’র পরবর্তী (দ্বিতীয়) সংস্করণের প্রচ্ছদ করেছেন শাহানারা নার্গিস শিখা। রামপুরায় তার বাসার কাছে গিয়ে সিডিতে প্রচ্ছদ এনেছি। খামে ভরে দিয়ে এসেছি সম্মানী। পেমেন্ট দেওয়ার মাস খানেক পর শিখা জানালেন, একটি নোট জাল! প্রকাশকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তাকে পৌঁছে দিয়েছিলাম। বড় নোট বলতে সেদিন ছিল প্রকাশকের টাকা, আর কবি কুতুব হিলালী দিয়েছিলেন পাঁচ শত টাকার একটি নোট। প্রুফের বকেয়া বিল। দুজনের যেকোনো একজনের কাছ থেকেই এসেছে নোটটা। তাই সরাসরি কাউকে ‘অভিযুক্ত’ করতে পারলাম না। এদিকে জাল টাকার বিষয়ে শিখা ফেসবুকে পোস্ট দিলেন। লেখক-প্রকাশককে ঘায়েল করার এমন বড় সুযোগ পেয়ে হামলে পড়লেন অনেক ফেসবুকবাসী। যদিও এর আগে আমি কল করে শিখাকে বলেছিলাম, আরেকটা ‘আসল নোট’ পৌঁছে দেব তাকে। তিনি জানালেন, লাগবে না। এখানে আমার কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিল না। সেই তিনি যে পরে এমন রসাল স্ট্যাটাস দেবেন বুঝতে পারিনি। যেহেতু তোপের মুখে নিজের ‘আসামি পরিচয়’ প্রকাশ করার সুযোগ ছিল না, সব মন্তব্য-হুল হজম করলাম নীরবে।
‘প্রতিদিন একটি খুন’ গল্পগ্রন্থের দ্বিতীয় ও তৃতীয় সংস্করণের প্রচ্ছদ শিল্পী ছিলেন ধ্রুব এষ ও রাজিব রায়। এখানে অন্তত জাল নোটের (!) লেনদেন ছিল না। বইটি প্রকাশ করার শুরুর নেপথ্যের দৌড়-ঝাঁপের শুরুর গল্প বলি এবার।
ঢাকায় আসার অল্প দিনের মধ্যেই পরিচয় হয়েছিল জাগৃতি প্রকাশনীর ফয়সল আরেফীন দীপনের সঙ্গে। একদিন পাণ্ডুলিপি নিয়ে গেলাম। তিনি বললেন, ‘এবার তো সময় শেষ। আগামী বছর দিয়েন।’ আমার সরল হিসাব বলল, দেরি কোথায় হলো, বইমেলার তো আর পাঁচ মাস বাকি! পরের বছরে আগেভাগেই কয়েকদিন তার অফিসে গেলাম। পেলাম না। শেষমেশ কল করলাম। বললাম, ‘আমার পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত। কখন আসব?’
দীপন ভাই নয়-ছয় করলেন। শেষ কথা হচ্ছে; ‘তরুণদের পেছনে ইনভেস্ট করা এখন আমাদের জন্য কঠিন।’
মনটা ভেঙে গেল কাচভাঙার মতো। গুনে গুনে প্রায় এক বছর অপেক্ষা করলাম তার পরামর্শ অনুযায়ী; অন্য কোনো প্রকাশনীতে চেষ্টাও করিনি আর এখন কিনা উল্টো কথা বলছেন! দীপন ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন কার্টুনিস্ট রম্যকার ও উন্মাদ পত্রিকার সম্পাদক আহসান হাবীব।
বাধা পেয়ে গেলাম শীর্ষস্থানীয় একটি প্রকাশনীতে। প্রকাশক বই করবেন, কথা ফাইনাল। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় ধরা পড়ল তার দ্বিমুখী নীতি ও টলমল মনোভাব! প্রকাশ করার কথা ছিল, করলেন না। বললেন, পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আপনার বইটি প্রকাশ করব। নইলে তো মন খারাপ করবেন! বৈশাখেও হলো না। এরপর তিনি যোগাযোগই বন্ধ করে দিলেন। ইমেইল বা এসএমএস করলে রিপ্লাই দেন না। অফিসে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকি। তিনি ‘ধরা’ দেন না। বছর দুয়েক পর একদিন কল করলেন গল্পকার পিন্টু রহমান। বই প্রকাশ পায়নি শুনে বললেন, ‘আমি তো ভাইয়ের কাছে পাণ্ডুলিপি নিয়ে গিয়েছিলাম। তিনি বললেন, এই বছর শুধু একটা গল্পের বই করব। সেটা শফিক হাসানের।’
তবুও কেন, কোন অপরাধে বইটি প্রকাশ হলো না, জানি না। প্রথম থেকেই শপথ করেছি, টাকা দিয়ে বই করব না। সেই শপথ রক্ষা করতেই একের পর এক প্রকাশকের পেছনে দৌড়ে চলেছি। এরপর গেলাম আড়িয়াল প্রকাশনীতে। শামীম ওয়াহিদ গায়ক ফেরদৌস ওয়াহিদের বড় ভাই। পেশায় তিনি বৈমানিক। কানাডা প্রবাসী। দেশে থিতু হওয়ার চেষ্টা করছেন। সম্পাদনা শুরু করেছেন দ্বিমাসিক সাহিত্যপত্রিকা ‘ফেরারি’। পত্রিকার পাশাপাশি প্রকাশনাও দাঁড় করাচ্ছেন। তার বইয়ের বাজার রয়েছে কানাডায়ও। একদিন কথায় কথায় বললেন, বই সেখানেই বেশি বিক্রি হয়।
গল্পকার নূর কামরুন নাহার তখন ফেরারিতে লিখতেন, কাজও করতেন। তাকে পাণ্ডুলিপির কথা বলায় বললেন, ‘শামীম ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে পারো। আড়িয়াল নতুনদের বইও করে।’ আড়িয়াল থেকে প্রকাশিত হয়েছিল নুরুল করিম নাসিমের ‘প্রিয় গল্প’, নূর কামরুন নাহারের ‘গুচ্ছগল্প’, সোহেল হাসান গালিবের কাব্যগ্রন্থসহ ‘রক্ত মেমোরেন্ডাম’সহ কয়েকজনের বই। বইমেলায় তাদের নিজস্ব স্টল ছিল না, বই রাখা হতো প্রবাসী লেখকদের জন্য বরাদ্দকৃত পৃথক স্টলে।
তদ্দিনে আমি শামীম ভাইয়ের ‘ফেরারি’তে লিখে প্রায় পুরো টিমের সঙ্গে পরিচিত হয়ে গেছি। শিল্পী ও অনুবাদক মার্জিতা প্রিমার সঙ্গে পরিচয় সেখানেই। নতুন করে আবিষ্কার করলাম বন্ধুতুল্য অগ্রজ আমির খসরু সেলিমের ছোট বোন নুসরাত জাহান চামেলীকে। চামেলী ওই প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। লন্ডনপ্রবাসী কবি শামীম আজাদের জন্মদিন পালন হলো একদিন। সেখানেও দেখলাম, চেনাজানা অনেককে। নানা আয়োজনে শামীম ভাইয়ের অফিসে যেতাম। গল্পকার মনি হায়দার, লেখক-গবেষক সরকার আব্দুল মান্নান প্রমুখ ছিলেন এসব আয়োজনের সঙ্গী। লন্ডনপ্রবাসী সাহিত্যিক শামীম আজাদের জন্মদিন উপলক্ষে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন শামীম ভাই। তার ডাকে সেখানে গিয়ে প্রথমবারের মতো সরাসরি পরিচিত হই ফেরদৌস নাহার, নজরুল কবীর, মসিহউদ্দিন শাকের, মিলটন রহমান, সাহানা খানম শিমু, ঋভু অনিকেত প্রমুখের সঙ্গে।
পরে একদিন স্পাইরাল বাইন্ডিং করা পাণ্ডুলিপি পৌঁছে দিলাম শামীম ভাইয়ের হাতে। তিনি পড়ে মতামত জানাবেন বললেন। প্রত্যাশিত সাড়া না পেয়ে কয়েক মাস পরে সরাসরিই গেলাম। ধানমন্ডিতে, তার কার্যালয়ে। পাণ্ডুলিপিটা খুঁজে বের করে সামনে রাখলেন তিনি। বললেন, ‘আপনি হুমায়ূন আহমেদ নন, আবার ইমদাদুল হক মিলনও নন; তবে আপনার সম্ভাবনা আছে।’
হায়, এ কেমন তুলনা! কীসের মধ্যে কী? কোথায় আগরতলা আর কোথায় চৌকির তলা!
কথাবার্তার একপর্যায়ে শামীম ভাই বললেন, ‘একটু উঠে দাঁড়ান তো!’
ভড়কে গেলাম এমন কথায়। আমার পরনে ছিল ক্যাজুয়াল প্যান্টের সঙ্গে স্ট্রাইপ নকশার ঘি রঙা শার্ট। শামীম ভাই তা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বললেন, ‘এসবে হবে না। লেখকসুলভ ভেক ধরতে হবে। পাজামা-পাঞ্জাবির সঙ্গে থাকে হবে শৈল্পিক শান্তিনিকেতনি ব্যাগ।’
‘এসব পাব কোথায়!’
‘কিনতে পাওয়া যায়! আমি শুনেছি, আপনি অনেক জায়গায় আমাদের কথা বলেন। সেই হিসেবে আপনি আমাদের নিজেদের লোক। সময়টা হচ্ছে এমন— আপনি আমাদের পিঠ চুলকাবেন, আমরা আপনার। চাইলেও এই চুলকা-চুলকির সংস্কৃতির বাইরে কেউই থাকতে পারব না।’
আমাকে লেখকসুলভ পোশাক পরার সুযোগ দিলেন না তিনি। বইও প্রকাশ হলো না। তদ্দিনে তিনি সব গুটিয়ে কানাডায় প্রবাসী হয়েছেন আবার। শামীম ভাই প্রকাশনাটা চালিয়ে গেলে আগে-পরে হয়তো আমার বই প্রকাশ পেতো।
আমরা যারা একসময় ফান ম্যাগাজিনে লেখালেখির মকশো করতাম তাদের কারও কারও বই প্রকাশে সাহায্য করেছেন সুমন্ত আসলাম। মুখ ফুটে কখনো তাকে নিজের বই প্রকাশ করে দেওয়ার কথা বলিনি। কথা প্রসঙ্গে একদিন সুমন্তদা বললেন, ‘আপনি রহস্যপত্রিকায় নিয়মিত গল্প লেখেন। এদিকে আমি পড়তে থাকব। যে গল্পটা ভালো হবে, আপনাকে বলব, এটাকে উপন্যাস বানান। তারপর বই হবে।’ রহস্যপত্রিকা কেন, কোনো পত্রিকাতেই নিয়মিত গল্প লেখা আমার জন্য সহজ ছিল না। এখনো নেই। তাই এমন আহ্বানে সাড়া দিতে পারিনি। এটাও জানি, তিনি কারও কারও বই প্রকাশ করে দিতে পেরেছেন বটে আবার কথা দিয়েও বই প্রকাশ করে দিতেন পারেননি, এমন লেখকও রয়েছেন। সবার বই প্রকাশ হয়নি শেষপর্যন্ত। একদিন কথায় কথায় সুমন্তদা বললেন, ‘একটা বই প্রকাশ করতে ১৫/১৬ হাজার টাকা খরচ হয়। আমার কথায় প্রকাশকরা কারও কারও বই ছাপেও। তবে তারা আবার এই টাকা রয়্যালটি থেকে কেটে রাখে।’
কিভাবে! কৌশলে? জানি না।
একবার বড় একজন কবির সুপারিশ নিয়ে মাঝারি মানের একটি প্রকাশনীতে গিয়েছিলেন কবি ও ঔপন্যাসিক জাহীদ ইকবাল। প্রকাশক বলেছিলেন, ‘উনার কথায় বই প্রকাশ করে আমার লাভ কী?’
কথা সত্য। লাভই যদি না থাকে বড় ও ক্ষমতাধর কবির সুপারিশ প্রকাশক রাখবেন কেন। এমন আরও কিছু তদবিরের সাক্ষী আমি। কবি-অভিনেতা রিফাত চৌধুরীর বই প্রকাশ করে দিতে চেয়েছিলেন শিল্পী ধ্রুব এষ। শেষমেশ হয়তো পারেননি। মেকআপ করে, ট্রেসিং দিয়েছিলেন রিফাত ভাই। প্রকাশকের জায়গায় লিখেছিলেন ধ্রুব প্রকাশনী! পরে ধ্রুব এষ আজিজ সুপার মার্কেটে এলে বলেছিলেন, ‘আপনি করে দেবেন তো, তাই আপনার নাম বসিয়েছি। মূল প্রকাশনী এটা বাদ দিয়ে নিজেদের লোগো বসাতে পারবে!’
বন্ধুবর রুবেল কান্তি নাথের বইও করে দিতে চেয়েছিলেন ধ্রুবদা। শেষমেশ অনেক কিছুই হয় না। তাই বলে সদিচ্ছা ও সহানুভূতি মূল্যহীন হয়ে যায় না। বই প্রকাশ করার জন্য নাকি উৎসর্গপত্রও কেনাবেচা চলে। উৎসর্গের বিনিময়ে বই প্রকাশের খরচ বহন করেন কোনো সুনাম-লিপ্সু! এভাবে বই করার পরামর্শ দিয়েছিলেন একজন। সবিনয়ে ফিরিয়ে দিয়েছি। উৎসর্গ হচ্ছে একজন লেখকের জন্য সবচেয়ে মর্যাদার জায়গা। যাকে তাকে বই উৎসর্গ করা যায় না। সেটা একেবারেই অনুচিত। লেখকসত্তারও অপমান।
‘সবার উপরে ছাগল সত্য’ বইয়ের নাম ও উৎসর্গপত্রে একটু ছেলেমি করেছিলাম বটে, পরে শুধরেও নিয়েছি। দ্বিতীয় সংস্করণে উৎসর্গের মানুষ পাল্টেছি! বইয়ের নাম যেহেতু পাল্টানোর সুযোগ নেই, এই নামের জন্য সারা জীবন গালি পেতেই থাকব। এই নামের জন্য বইমেলায় যুগপৎ অভিনন্দন-প্রশংসা ও নিন্দা পেয়েছি। অনেকেই অনেক কথা বলেছেন। কেউ দিয়েছেন গালি, কেউ ভালোবাসা। যেমন বুয়েটের অধ্যাপক ও লেখক ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী আমার কথা কোথাও উচ্চারিত হলে বলেন, ‘ও, ছাগল…!’
আমার সাবেক একজন বস (তৎকালীন কর্মস্থলের) প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ১০০ কপি কিনে নেবেন। তার অপ্রত্যাশিত প্রতিশ্রুতিতে খুশি হয়েছিলাম মনে মনে। হাসি ফুটবে প্রকাশকের মুখে। শেষপর্যন্ত বই ১০০ কপি বই কেনেননি। তবে ২/১ কপি করে কিনে কিনে উপহার দিয়েছিলেন বিভিন্নজনকে। তখন রসিয়ে রসিয়ে বর্ণনা করতেন নাম-মাহাত্ম্য! মজা করে আমাকে ছাগল হাসান বলেও ডাকতেন।
কথায় কথা বাড়ে। রাত বাড়ে। দিন বাড়ে। শব্দ বাড়ে। কথা ফুরায় না। প্রথম বই কোনটি, কোনটি বলব প্রথম এ বিষয়ে বরাবরই দোটানায় ভুগি। তাই প্রথম বই খুঁজতে যাই না। দুটিকেই প্রথম বই হিসেবে বিবেচনা করি। প্রথম দুই বইয়ে প্রচুর ভুলভাল ছিল সত্য, তবে সেটা আমার জন্য একধরনের শিক্ষা। বেদনা তো আনন্দেরই সহোদর! প্রকাশকদের উপরেও এখন আর কোনো খেদ বা ক্ষোভ নেই। যেভাবেই হোক, তারা বই প্রকাশ করেছিলেন বলেই তো পায়ের নিচে মাটি পেয়েছি। বুঝতে শিখেছি, ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে আছি, যেতে হবে কত দূরে; কোন পথে!
এবার বরং বই প্রকাশ পরবর্তী কিছু অভিজ্ঞতার কথা বলি।
পাঠক ও সম্পাদক মহোদয় চাইলে এ লেখা নতুন আঙ্গিকে আরও এক কিস্তি লেখা যাবে। মজুদ আছে পর্যাপ্ত রসদ!
নানা অর্থেই লেখক যত ছোট হোন, তার দুর্ভোগগুলো তত বড় হয়। প্রথম বই বেরোনোর পর সাবেক এক সহকর্মী কল দিয়ে জানাল তাকে যেন দুই কপি বই পাঠাই। টাকা বিকাশ করে দেবে। দুই সপ্তাহ পর কল করে সে জানাল, বই পায়নি। যেই না আমি প্যান্টের পকেট থেকে সুন্দরবন কুরিয়ারের রিসিটে থাকা সিরিয়াল নম্বর বলতে শুরু করলাম তড়িঘড়ি করে সে বলে উঠল, টাকা এই নম্বরে পাঠালে হবে?
আমি হতভম্ব। বলছে বই পায়নি, এখন আবার টাকা পাঠানোর কথা বলছে! তবে এটুকু বুঝলাম, সে মিথ্যা বলেছিল। তারপর সেই টাকা আর আসেনি। সে নিজেও চলে গেছে বিদেশে!
অনুপ্রাণন প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে গল্পগ্রন্থ প্রতিদিন একটি খুন, তৃতীয় সংস্করণ। এক বন্ধু বলল, বই পাঠাতে। কুরিয়ার করলাম। তারপর সে কল করে জানাল, টাকা বিকাশ করেছে। আসলে করেনি, ফাঁকা আওয়াজ। এদিকে ব্যালেন্স যোগ হয়নি, মেসেজও আসেনি। বাধ্য হয়েই আমি বললাম, ধন্যবাদ!
আমার প্রথম দুই প্রকাশকই যেহেতু নতুন তাদের কোনো বিক্রয়কেন্দ্র বা শোরুম নেই। এসব অপূর্বতার মধ্যে রকমারি ডট কমের ওয়েবসাইটে অন্তর্ভুক্ত করলাম বই দুটি। কাজটা সারতে হয়েছে রকমারির প্রধান কার্যালয় আরামবাগে গিয়ে। যোগাযোগের ঠিকানার জায়গাটা আমার ফোন নম্বর দিয়ে এসেছি। অর্ডার এলে আমিই পৌঁছে দেব আরামবাগে। তারপর অর্ডার এল শুধু একটি। দিনাজপুরের কবি ও শিক্ষক রবিউল ইসলাম দুই কপি বই-ই নিলেন। এদিকে আমার পরিচিত অনেক শুভানুধ্যায়ী জানালেন বই কেনার খবর! উন্নত মানের বই বলে প্রশংসায়ও ভাসালেন কেউ কেউ। বই যদি আমার হাত দিয়ে না যায়, তারা কীভাবে পাবেন! কেউই তো জানে না, আমিই যে বইয়ের একমাত্র জোগানদার। এ সুযোগে চিনে ফেললাম কতিপয় শুভাকাক্সক্ষীী ও বন্ধুর চেহারা। কেন এমন মিথ্যাচার করতে হলো! আমি তো কারও কাছে যাইনি, জোরাজুরিও করিনি! তাহলে কেন মিথ্যাচার করতে হবে। সেই গভীর ক্ষত এখনো বয়ে বেড়াচ্ছি।
কেন জানাচ্ছি ঘরের খবর? তরুণ লেখকদের সতর্ক করার জন্য। বইয়ের ক্ষেত্রে কম মানুষই আপন পাবেন। প্রকাশককে বিপদে ফেলবেন না, নিজেকেও ঝামেলায় জড়াবেন না। বই প্রকাশ না করলে বড় কোনো ক্ষতি নেই। কিন্তু চারপাশের মানুষের প্রতি আপনার অবিশ্বাস সৃষ্টি হলে টিকে থাকাটাই কষ্টকর হয়ে উঠবে। বলছি না যে, সবার অভিজ্ঞতাই নেতিবাচক হবে। তবে সন্দেহ নেই, এ পথ বড় বন্ধুর। প্রতিনিয়ত নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে যেতে হয়। চিনে নিতে হয় ছদ্মবেশী বন্ধু ও কাছের মানুষদের পিঠ-দেখানো আচরণ!
নিজের আরও যৎকিি ত অভিজ্ঞতা বয়ান করে বিদায় নেব। চাকরি ছাড়ার মতো বীরত্বপূর্ণ কাজ আর কী আছে! তো চাকরি ছেড়ে ঝাড়া হাত-পা তখন। নিজেই ওইবার সম্পাদিত লিটল ম্যাগাজিন ‘প্রকাশ’-এর স্টলে বসেছি। বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউজের পেছনে, কাঁঠালতলায়। আমার তৃতীয় (রম্য)বই ‘নোমান মামার সমাজসেবা’ প্রকাশিত হওয়ার কথা। আসি আসি করেও আসছে না। এদিকে এক সাংবাদিক সুহৃদ ঘনঘন তাগাদা দেন। কবে আসবে বই, বই স্টলে উঠলেই কেবল তিনি মেলায় আসবেন। অটোগ্রাফসহ বই সংগ্রহ করবেন! বইমেলার বয়স অর্ধেকেরও বেশি পেরোলে বই এল। নিজ স্টলে বিক্রির জন্য কিছু কপি কিনে আনলাম। এরপর সেই সুহৃদকে ফোনকল করে জানালাম খবরটি। তিনি এলেন, অটোগ্রাফসমেত বইও সংগ্রহ করলেন। লিটলম্যাগ স্টলে বসেই টানা দুই ঘণ্টা নানা বিষয়ে গল্পগুজবও চলল। শেষপর্যন্ত তিনি বিদায় নিলেন, টাকা না দিয়েই! আমিও কিছু বললাম না, এত ঘনিষ্ঠ মানুষের কাছে মুখ ফুটে ছোটলোকের মতো টাকা চাওয়া যায় নাকি! না বলার আরেকটি কারণও ছিল অবশ্য : ‘আমার বলার কিছু ছিল না/ চেয়ে চেয়ে দেখলাম তুমি চলে গেলে/ তুমি চলে গেলে…’।
অনুপ্রাণন প্রকাশন থেকে বেরিয়েছে সাক্ষাৎকারের বই ‘গল্প-কথায় ৩৫ গল্পকার’। এই বই নিয়ে জমা হয়েছে সবচেয়ে বেশি গল্প। তো একজন অধ্যাপক গল্পকার বললেন, ‘আমি তো ওদিকে (প্রকাশনীর শোরুম) যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছি না। কাইন্ডলি তুমি আমাকে একটা বই দিয়ে যেয়ো। টাকা পরিশোধ করে দেব।’ এক সন্ধ্যায় কল করে জানলাম তিনি ইস্টার্ন মল্লিকার আগে স্টার কাবাবে আছেন। স্টার কাবারের সামনে যেতে যেতে পথে দেখা হয়ে গেল কবি ও প্রাবন্ধিক সৈয়দ শিশিরের সঙ্গে। তাকেও সঙ্গে নিয়ে চললাম। হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে কল করলে অধ্যাপক গল্পকার বেরিয়ে এলেন। বইটি হাতে তুলে দিলে বললেন, ‘এটার দাম তোমাকে নিতেই হবে!’
এমন কথায় আমার বিস্মিত হওয়ার পালা। প্রকাশনী থেকে বই কিনে তার সুবিধার জন্য পৌঁছে দিয়েছি, সেখানে এমন সৌজন্যমূলক (!) কথা কেন আসবে। আমার নিতে আপত্তি নেই দেখে তিনি পকেট থেকে বের করলেন ৫০০ টাকার একটা নোট। বইয়ের দাম ৩৩০ টাকা, এদিকে আমার কাছে ভাংতি নেই। ভাংতি করানোর জন্য অধ্যাপক গল্পকার ডানে-বামে কয়েক জায়গায় ঢুঁ মারলেন। এত বিতিকিচ্ছিরি পরিস্থিতি দেখে সৈয়দ শিশির বললেন, ‘আমাকে কোথায় নিয়ে এলেন, ভাই?’
বললাম, ‘নতুন শাখা হয়েছে। অভিজাত হোটেল। দেখে যান!’
ভাংতি পাওয়ার পর আমরা হাঁটা দিলাম কাঁটাবনের দিকে। তারও আগে বইমেলা চলাকালীন হাঁটতে হাঁটতে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন আরেকজন গল্পকার। তাকে বললাম, ‘আপা, সাক্ষাৎকারের বইটা বেরিয়েছে। এই স্টলে আছে।’ মূল বইমেলার পাশাপাশি লিটল ম্যাগাজিন চত্বরেও থাকে অনুপ্রাণন ম্যাগাজিনের স্টল। সেখানেও কিছু বই থাকে। তো আমার কথা শুনে আপা গল্পকার বইটি নেড়েচেড়ে দেখারও প্রয়োজন বোধ করলেন না। প্রচ্ছদে তার স্কেচটা কেমন ছাপা হয়েছে, ভেতরে সাক্ষাৎকারের শিরোনামটাইবা কেমন, কোনো কিছুতেই ভ্রূক্ষেপ নেই। কবি চৈতী আহমেদ তখন কাজ করতেন অনুপ্রাণনে। তিনি আপা গল্পকারকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘অ্যাই, তুমি এবার আমাদের স্টল থেকে একটা বইও কেনোনি!’
এমন অপ্রত্যাশিত কথা শুনে তিনি আর দাঁড়ালেন না। বিপরীত দিকে মুখ করে হাঁটা শুরু করলেন। তার মনোস্তত্ত্ব আমি বুঝেছি আরেকজন কবি কাম গল্পকারের আচরণে। তিনি পরিচিতদের মধ্যে (অপরিচিতদের ভাষ্য যেহেতু আমার জানার সুযোগ নেই) অভিযোগ জানানো শুরু করলেন, শফিক হাসান তো বই প্রকাশ করেছে, কিন্তু আমার কপিটা এখনো পৌঁছে দেয়নি! তাকে কিছুতেই অনুধাবন করানো যায়নি, বই প্রকাশক বের করেন আর সেটা কিনে নিতে হয়। বই আর লিটল ম্যাগাজিন আলাদা বিষয়। ৩৫ জন গল্পকারকে সৌজন্য বই দেওয়া প্রকাশক বা সাক্ষাৎকারগ্রহীতা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। কিন্তু অভিযোগ ও বদনাম আরও বহু দূরে বিস্তৃত হওয়ার পর একদিন তাকে এক কপি বই কিনে দিয়ে এলাম, নিষ্কৃতি পেতে!
এসব হচ্ছে বইয়ের অতীতচারী গল্প। বর্তমান গল্পের সঙ্গে ও এখনকার বইয়ের বাজারের ভেদাভেদ কম নয়। চাইলে ধৈর্যচ্যুতি ঘটাতে এসব নিয়েও নতুন রচনা ফাঁদা যায়। পাঠক ও সম্পাদক মহোদয় চাইলে এ লেখা নতুন আঙ্গিকে আরও এক কিস্তি লেখা যাবে। মজুদ আছে পর্যাপ্ত রসদ!