অমর একুশে বইমেলা সন্নিকটে। আর বেশিদিন বাকি নেই। আয়োজক প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রকাশনী, ছাপাখানায় চলছে ব্যস্ততা। ব্যস্ততা কবি-লেখক-সাহিত্যিকের দেহ-মনেও। বসে নেই প্রচ্ছদশিল্পীরাও। যে যার মতো নিজেদের গোছাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। এ যেন এক মহা উৎসবের প্রস্তুতি। উৎসবই তো বলা হয়। বইমেলা বাংলা ভাষাভাষীদের প্রাণের মেলা, প্রাণের উৎসব। বিকেল গড়ালেই কবি-লেখকের আড্ডা, পাঠক-লেখকের ভালোবাসা প্রকাশ—একটা মোহনীয় আমেজ সৃষ্টি করে।
প্রচার-প্রচারণা চলে বছরের শুরু থেকেই। জানুয়ারি এলেই বইয়ের প্রচ্ছদে ছেয়ে যায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। লেখকরা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে প্রচার চালাচ্ছেন নিজের বইয়ের। প্রকাশকরা প্রকাশ করেই হাত গুটিয়ে থাকেন বরাবরই। কেননা সিংহভাগ বইয়ের প্রকাশনার খরচ জোগাতে হয় লেখককে। এটা একটা সাধারণ রীতিতে পরিণত হয়েছে। সর্তসাপেক্ষে বইগুলো প্রকাশ করেন প্রকাশকরা। প্রকাশের পর বিক্রির ভালো-মন্দও জানা হয় না লেখকের। লাভের একাংশও আসে না লেখকের পকেটে। শুধু আত্মতৃপ্তি এই—‘আমার বই এবার বইমেলার…স্টলে পাওয়া যাচ্ছে’।
লেখক স্বত্ত্ব নিয়ে আমাদের দেশের লেখকদের খুব বেশি মাথাব্যথা বা জানাশোনা আছে বলেও মনে হয় না। এক্ষেত্রে একচ্ছত্র আধিপত্য প্রকাশকদের। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবশ্যই ব্যতিক্রম নিয়ম রয়েছে। প্রবীণদের বই প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রকাশকের নমনীয়তা রয়েছে। যত নিয়ম-কানুন কেবল তরুণ বা নবীন লেখকদের ক্ষেত্রে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শুধু টাকার জোরেই বই আসছে মেলায়। পুরো খরচটাই বহন করেন লেখক। অতপর বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন ধরে-ধরে বিক্রি করা হয় সেই বই। কিংবা সৌজন্য সংখ্যা দিতেও সমস্যা নেই। এতে লেখকের প্রচার বাড়ে।
প্রচার সর্বস্ব সাহিত্যকর্মের ফলে সাহিত্যের মান অবশ্যই কমছে—এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। প্রতিবছর যে হারে বই প্রকাশ হয়; সে হারে বিক্রির খবর পাওয়া যায় না। তবু কেউ কেউ স্বঘোষিত ‘বেস্ট সেলার’ তকমা নিয়ে বাসায় ফেরেন। আবার অনেককে দেখা যায় পাণ্ডুলিপি তৈরি থাকা স্বত্ত্বেও ভালো প্রকাশক না পেয়ে বই বের করছেন না। অথবা কোনো প্রকাশক পাণ্ডুলিপি না চাওয়ায় এবছর বই বের হচ্ছে না। অর্থাৎ প্রকৃত লেখকের বই প্রকাশের আগ্রহের চেয়ে বইয়ের বা প্রকাশনীর মান নিয়ে বেশি ভাবতে হয়। তিনি তো আর পাণ্ডুলিপি নিয়ে প্রকাশনীর দ্বারে দ্বারে ঘুরতে পারেন না। বা ঘোরাটা সমীচীন নয়।
গতবছরের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যাবে, ২০১৬ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় নতুন বই এসেছে ৩ হাজার ৪৪৪টি। তার আগে ২০১৫ সালে নতুন বই প্রকাশ হয়েছিল ৩ হাজার ৭০০টি। দু’বছরের হিসেবে নতুন বই প্রকাশের পার্থক্য খুব বেশি নয়। ২০১৫ থেকে ২০১৬ সালে বই প্রকাশের হার কিছুটা কমলেও গত বছর কবিতার বই সংখ্যায় এগিয়ে। ২০১৫ সালে নতুন কবিতার বইয়ের সংখ্যা ছিল ৮৭৭টি। গত বছর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৯৩৯টিতে। অর্থাৎ ২০১৫ সালের চেয়ে ২০১৬ সালে ৬২টি কবিতার বই বেশি প্রকাশ হয়েছে। তবে গত বছর নতুন উপন্যাস প্রকাশের সংখ্যা কমেছে। ২০১৫ সালে যেখানে ৬২৯টি উপন্যাস এসেছিল, গত বছর সেখানে এসেছে ৫২৯টি।
গত বছর মেলার শেষদিন বাংলা একাডেমির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালের বইমেলায় বই এসেছে উপন্যাস ৫২৯টি, প্রবন্ধ ১৯৭টি, কাব্যগ্রন্থ ৯৩৯টি, গবেষণাগ্রন্থ ৪৫টি, ছড়াগ্রন্থ ১১২টি, শিশুতোষগ্রন্থ ১৬২টি, জীবনীগ্রন্থ ৮১টি, রচনাবলি ১২টি, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গ্রন্থ ১০১টি, নাটক ১২টি, বিজ্ঞান বিষয়ক ৫৩টি, ভ্রমণ বিষয়ক ৫৪টি, ইতিহাস বিষয়ক ৪৮টি, রাজনীতি বিষয়ক ১৫টি, স্বাস্থ্য বিষয়ক ২৫টি, কম্পিউটার বিষয়ক ৯টি, রম্যগ্রন্থ ১৮টি, ধর্মীয়গ্রন্থ ৩২টি, অনুবাদ ২৫টি, অভিধান ৬টি, সায়েন্স ফিকশন ৪৫টি এবং অন্যান্য ৪২১টিসহ মোট ৩ হাজার ৪৪৪টি।
শুনে খুশি হবেন যে, গত বছর অমর একুশে গ্রন্থমেলায় মোট ৪২ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে। এতে বিগত বছরের সব রেকর্ড অতিক্রম করেছে। ২০১৫ সালের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ অর্থ আয় করেছেন প্রকাশকরা। ২০১৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি সোমবার বাংলা একাডেমির জনসংযোগ বিভাগ থেকে এমনই তথ্য জানানো হয়েছিল।
এই ৪২ কোটি টাকার মধ্যে বাংলা একাডেমি বিক্রি করেছে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। অন্য সবগুলো প্রকাশনা সংস্থার বিক্রি ৪০ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে দ্বিগুণ বিক্রি হয়েছে যা প্রকাশকদের জন্য অবশ্যই আনন্দের। কেননা ২০১৫ সালের বইমেলায় বিক্রি হয় ২১ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। সেই বছরের তুলনায় গত বছর বেশি বিক্রি হয়েছে ২০ কোটি ৫ লাখ টাকার বই। তারও আগে অর্থাৎ ২০১৪ সালের মেলায় প্রায় ১৬ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছিল।
অতএব এ কথা স্পষ্টভাবে বলা যায়—প্রতিবছরই বই বিক্রির হার বাড়ছে। কিন্তু কথা হচ্ছে—তাতে কারা লাভবান হচ্ছেন? প্রকাশকরা না কি লেখকরা? অবশ্যই প্রকাশকরা। লেখকের মধ্যে লাভের আশা বরাবরই কম থাকে। তারা প্রকাশের আনন্দ নিয়ে মাসজুড়ে দিব্যি বগল বাজিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এমনও অনেক নামকরা প্রকাশনী আছে; যারা বিক্রির শতকরা আট ভাগ লেখককে দিচ্ছেন। আর তাতেই লেখক খুশি। এ যাত্রায় বরাবরই নবীন লেখকরা বঞ্চিত হন। প্রতিষ্ঠিত লেখকরা হয় পাণ্ডুলিপি একেবারে বিক্রি করে দেন; নয়তো চুক্তিনামা করে রয়্যালিটি পেতে থাকেন।
আবার কেউ কেউ নিজে বিনিয়োগের মাধ্যমে বই প্রকাশ করে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকা, টেলিভিশন এবং রেডিওতে বিজ্ঞাপন দিয়ে আলোচনার ঝড় তোলেন। কখনো কখনো প্রসিদ্ধ কবি-লেখকের সাহচর্য লাভ করে তার সন্তুষ্টি (বিভিন্নভাবে) অর্জন করে প্রচারণার ব্যবস্থা করেন। তিনি কোনো আলোচনা বা সেমিনারে শিষ্যের গুণকীর্তণ করে দিলেন। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় মনে হচ্ছে, গত বছর যার ৬টি বই (উপন্যাস, কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ও অন্যান্য) বের হয়েছে; এ বছর তার ১২টি বই আলোর মুখ দেখছে। হচ্ছে বিশাল প্রকাশনা উৎসব। আলোচনা করছেন প্রথম সারির লেখক-কবিরা। অথচ তারা হয়তো ওনার ১২টি বইয়ের একটি বইও পড়ার সুযোগ পাননি। শুধু প্রচ্ছদ উল্টেপাল্টে ‘সাহসী লেখক’ উপাধী দিয়ে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করলেন। সম্মানিত প্রকাশকগণ, এক বছরে ১২টি উপন্যাস লেখার সাহস ক’জনই রাখতে পারে বলুন? শুধু আপনাদের মতো প্রকাশকের কৃপায় এক প্রকাশনী থেকেই ৪টি বই প্রকাশ হচ্ছে। বইয়ের সংখ্যা বাড়ুক আপত্তি নেই; লেখার মান কি বেড়েছে? সে ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেন কি?
আমরা জানি, প্রকাশকের দুশ্চিন্তার কারণ নেই। বেশির ক্ষেত্রেই তো লেখকের টাকায় বগল বাজাচ্ছেন তারা। তাদের কর্তব্য শুধু পেজ সেটআপ, প্রেসে পাঠানো এবং বাঁধাই শেষে বইমেলার স্টলে তুলে দেওয়া। যাবতীয় খরচ তো লেখকই দিচ্ছেন। তাই লেখকদের প্রতি আমার জোরালো দাবি, চুক্তিনামা ছাড়া কোনো বই প্রকাশ করবেন না। নিজেদের অর্থায়নে বই প্রকাশ করবেন না। অপেক্ষা করুন। পত্র-পত্রিকায়, ছোটকাগজে লিখুন; প্রকাশকই আপনার কাছে পাণ্ডুলিপি চাইবে। আর প্রকাশকদের কাছে বিনীত আবেদন, মানবিচার না করে বই প্রকাশ করবেন না। প্রয়োজনে বিজ্ঞ লেখক-কবির সমন্বয়ে বাছাই কমিটি করে পাণ্ডুলিপি নির্বাচন করুন। লেখকদের সম্মানির ব্যবস্থা করুন। তাদের রয়্যালিটি সময়মতো পৌঁছে দিন। কেননা লেখক বেঁচে থাকলে আপনার প্রকাশনী এমনিতেই টিকে থাকবে। নিজেরা লেখক সৃষ্টিতে এগিয়ে আসুন। নবীন লেখকদের মধ্যে খুঁজে নিন আগামীর নক্ষত্র। তাকে তৈরি করুন মানসম্মত উপায়ে। যেহেতু লেখকের কারণেই প্রকাশনী বিখ্যাত হয়।
এও জানি—নবীনদের কাঠখড় পোড়াতে হয়। ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সমুদ্র পাড়ি দিয়েই তাদের এগোতে হয়। তবে প্রকাশকের বঞ্ছনা তো কাম্য নয়। লেখককে বাঁচিয়ে রাখলে প্রকাশনী বাঁচবে। তাই লেখককে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। নবীনদের প্রণোদনা দিতে হবে। সঠিক পরিচর্যায় আগামীতে ভালো একজন লেখকের সৃষ্টি হতে পারে। তা না হলে অকালেই ঝরে যেতে পারে সাহিত্য আকাশের উজ্জ্বল একটি নক্ষত্র। তাই লেখক ও প্রকাশকের মধ্যে ভালো একটি বোঝাপড়া দরকার। হ্যাঁ, ব্যবসা আপনি করবেন। কারণ ব্যবসা করাই আপনার কাজ। তবে লেখককে বঞ্চিত করে কেন ব্যবসা করবেন? এছাড়া যেসব প্রকাশক নিজেও লেখক; তিনিও তো উপলব্ধি করতে পারেন লেখক হওয়ার যাতনা।
এসব কারণের বাইরে আরো অনেক কারণ হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে। তাতে আলোচনা দীর্ঘায়িত হবে। আমার দাবি, টাকার বিনিময়ে যার-তার বই প্রকাশ করে তার নামের আগে লেখক তকমা জুড়ে দেবেন না। তাতে আপনার লাভ হলেও লেখক সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই প্রতিবছর চার হাজার বই নয়; মান বিচার করে এক হাজার বই প্রকাশ করুন। তাতে সাহিত্যচর্চা আরও বেগবান হবে। উটকো লেখকের চাপে মূলধারার লেখকরা কোণঠাসা হবেন না। পাশাপাশি বিজ্ঞ পাঠকও তাতে উপকৃত হবেন। তাদের বইকেনার প্রতি আগ্রহ ফিরে আসবে। নামসর্বস্ব লেখকের বই কিনে প্রতারিত হওয়ার চেয়ে সবাই মানসম্মত বই কিনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলুক।