এবার বইমেলায় আপনার কোনো বই প্রকাশিত হচ্ছে? প্রকাশক কে? প্রচ্ছদ কে করেছেন? প্রকাশিত বই সম্পর্কে কিছু বলুন।
রীতিমতো প্রথম বই প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। উপন্যাস। ব্যাপারটা আমি ভুলে থাকতে চাইছি। মনে পড়লেই কেমন একটা ভীতি ঘিরে ধরছে। বই প্রকাশ করার দুঃসাহস দেখিয়েছি ঠিকই, কিন্তু ফলটা বহন করতে পারব কি না, জানি না। এখানেই ভয়। বইয়ের প্রকাশনা সংস্থার নাম অনুপ্রাণন। প্রকাশক আবু এম ইউসুফ, আমাদের গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা ইউসুফ ভাই। প্রচ্ছদ করেছেন কাব্য কারিম। কাব্য কারিমের সঙ্গে আমি জুটি বাঁধব হয়তো। ওর শিল্পীসত্তা এবং মানুষসত্তা দুটোই আমাকে মুগ্ধ করেছে। বই সম্পর্কে বলতে গেলে তো গলা আটকে আসছে। ব্যক্তিগত আবেগের জায়গা থেকে লেখা। স্পর্শকাতরতার জায়গা থেকে লেখা। বাস্তবে যা ঘটেছে, তাকে স্রেফ অতিপ্রাকৃতের রঙিন কাগজে মুড়িয়ে দিতে চেয়েছি। লেখার আগে জানতাম না যে, তার কোনো প্রয়োজন ছিল না। কারণ জগতে যা কিছু ঘটে তা প্রাকৃতিক, আর প্রাকৃতিকের জন্ম তো এমনিতেই অতিপ্রাকৃতিকের জঠরে। উপন্যাসের নাম জঠর।
সারাবছর লেখক প্রকাশক বই প্রকাশ না করে এই একুশে বইমেলা এলেই বই প্রকাশের প্রতিযোগিতায় নামেন। মেলাকেন্দ্রিক বই প্রকাশকে আপনি কিভাবে দেখেন?
ফেব্রুয়ারি ছাড়া অন্য মাসগুলোয়ও কিন্তু বই কম প্রকাশিত হয় না। তারপরও প্রশ্ন যখন উঠেছে, তার পেছনে পটও আছে। এই পটটাকে আমি বিশেষ কোনো চোখে দেখি না। দেখতে চাইও না। ব্যাপারটায় এক ধরনের প্রাবৃত্তিক স্বাভাবিকতা আছে। এর পেছনে সঙ্গত ব্যবসায়িক কারণ আছে। একুশে বইমেলা ছাড়া অন্য সময়ে এত বড় ভোক্তাশ্রেণীকে কখনো একসঙ্গে পাওয়া যায় না। হাটে লোক হবে বলেই পসরা বেশি আসবে। পসরা বেশি আসবে বলেই হাটে হরেক লোক ভিড়বে। ব্যাপারটায় একধরনের পারস্পরিকতা আছে। কোনো অস্বাভাবিকতা নেই।
একুশে বইমেলা বাংলাদেশের সাহিত্যে কী ধরনের প্রভাব ফেলছে?
সাহিত্যে কী ধরনের প্রভাব ফেলছে, সরাসরি এমন প্রশ্ন করে ফেলাটা সহজ। এই প্রশ্ন কিন্তু মোটেও অসঙ্গত নয়। যা ভাষ্য, তা হলো, এই সহজ প্রশ্নের উত্তরটা কালবিস্তারি অসংখ্য উপাত্তনির্ভর। হুট করে দেওয়া যায় না। তবু বিবেকের তো একটা প্রজ্ঞাধর্ম আছে। ওই ধর্মের অনুশাসনগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে-টিলিয়ে আমার মনে দোষগুণ মেশানো একটা স্বর্গের ছবিই আসছে। মানে প্রভাবটা ইতিবাচক। এত বইয়ের সন্নিবেশ, লেখকের সন্নিবেশ, এত আলো, এত রং, এত আয়োজন—মনে একটা আবহসংগীত কিন্তু তৈরি করে। এই সংগীতের প্রভাব তো বৃথা যাবে না। অবশ্যই এর ইতিবাচক ঐশ্বরিকতা আছে। তবে, ঈশ্বরের শক্তিকে সমীকৃত করতে মানুষ শয়তানের রূপকল্প নিয়ে এসেছে তো এমনি এমনি নয়। স্বর্গের পাশাপাশি তাই একটা নরকের ছবিও মনে ভাসছে। কিন্তু ওই ছবিটা আমার কাছে গৌণ। মুখ্য হচ্ছে স্বর্গটা। ভালো হচ্ছে জীবাণুনাশকের মতো। ক্ষতিকর জীবাণু বিনাশ করলেও তার ক্ষয়ধর্মী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে। তবে আশার কথা হচ্ছে, ওটা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। প্রতিক্রিয়া না। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার প্রশমন সম্ভব। সেটা অন্য আলোচনা।
একুশে বইমেলা প্রকাশনা শিল্পে তরুণদের প্রাণিত করার ব্যাপারে কী ধরনের ভূমিকা রাখছে বলে আপনি মনে করেন?
আমি এই প্রশ্নেরও প্রতীকী উত্তর দেব। ভূমিকা রাখছে তো বটেই। তবে, ভূমিকার ধরনটা ব্যাখ্যা করার পথ একটু ঘোরালো। ভূমিকা বিষয়টা যে প্রকট, সাদাচোখেই দেখা যায়, তা কিন্তু নয়। বেশিরভাগ সময়ই এটা প্রচ্ছন্ন। তারুণ্যের খুব শক্তিশালী একটা ধর্ম আছে। সেটা হচ্ছে কৌতূহলধর্ম। তারুণ্য কৌতূহল নিবৃত্ত করতে চায়। এই নিবৃত্তিটাই হলো নিম্নবিভবে গমন। এই গমনের যেহেতু শেষ নেই, নিবৃত্তিও তাই হয় না। তবে হওয়ার আভাস দেখায়। এই আভাস থেকেই উৎসাহ আসে। প্রকাশনা যখন শিল্প হয়ে উঠছে, তখন ওই যে আভাসের ফাঁকটুকু, তা পূরণ করতে উৎসাহ প্রাকৃতিকভাবেই আসছে। তা সেই তরুণ বা তরুণীটি লেখক হোক আর পাঠকই হোক। আরও কিছু কথা চলে আসে। দূরের যে ধোঁয়াটে লক্ষ্যটা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, সেখানে আমি যাব। কেন যাব? তার পেছনে থাকে ঝোঁক। ঝোঁক হলো উৎসাহের রসদ। তারুণ্যের স্বভাবগত ঝোঁকগুলো কোথায়? হালকা ভাষায় বলতে, প্রকৃতিগতভাবে তরুণ-তরুণীরা আলোর ঝলকানি, খাবারের ঘ্রাণ, কামের আহ্বান পছন্দ করে। সমাগম, সঙ্গম পছন্দ করে। উৎসব পছন্দ করে। একুশে বইমেলা তো উৎসব। শিল্পের সঙ্গম। তরুণদের উৎসাহিত করার ধরনটা তাই অনেকটাদূরের লক্ষ্যের ডাক শোনানোর মতো। ওই শোনো, অনাগত ভবিষ্যৎ কোথায় তোমাকে ডাকছে। বইমেলা ঝোঁকগুলোর উপাদান জমা রাখে। আর তরুণ তরুণীরা তো উৎসাহ নিতে মুখিয়ে থাকে।
প্রকাশনা উপকরণের সহজলভ্যতার কারণে যে কেউ ইচ্ছা করলেই বই প্রকাশ করতে পারেন। এতে বছর বছর বাড়ছে বইয়ের সংখ্যা। বইয়ের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মান বৃদ্ধি ঘটছে না বলে অনেকেরই অভিযোগ; বিষযটাকে আপনি কী ভাবে দেখেন। বই প্রকাশের ক্ষেত্রে কোন নির্দিষ্ট নীতিমালা প্রয়োজন আছে কি?
বছর বছর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা বাড়ছে, কথা সত্য। আমি বলি, বাড়ুক না! এই বেড়েও যা হচ্ছে সেটাও যথেষ্ট নয়। আরও বই চাই, আরও। বই তো বুদ্ধির ফুল। ছেয়ে যাক। সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে মান বৃদ্ধি ঘটেছে না এই অভিযোগ তো একেবারেই একদিকদর্শী। ‘একদিকদর্শী’ শব্দটা দিয়েই আমি বিষয়টা কিভাবে দেখি, তা বুঝিয়ে দিলাম। নীতিমালা প্রযোজ্য তো বটেই। তবে হাসি আড়াল করে অফ দ্য রেকর্ডেও কিছু বলি। নীতি আপনাতেই অনুসৃত হয়। এটার ভার প্রকৃতি নিয়ে নেয়। নীতি কিন্তু ভালো বা মন্দ কিছু নয়। নীতি নীতিই। নীতিমালা হচ্ছে একটা পরিণতি। এবং যুগভেদে অবশ্যই অনির্দিষ্ট। এটা নির্দিষ্ট নয়। নীতি সুতোর মালা যদি শেকল হয়ে যায়, তবে সে শেকল ছিড়ে ফেলাই নতুন নীতি। সেই নীতির কথা কে বলে দেয়? প্রকৃতি। নীতিমালা শেকল না হয়ে অঙ্গশোভা বাড়ানোর মালা যদি হয়, তো করতালি। সেটাকে তখন অঙ্গে ধারণ করা উচিত। তবে অঙ্গশোভাও সবসময় শোভনীয় নয়। যেমন অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায়। নীতির মালা যদি হয় ঝড়ঝঞ্ঝায় জোটবদ্ধ থাকার রজ্জু, তো বজ্রমুষ্টিতে তা আঁকড়ে ধরা উচিত। নীতি প্রয়োজন কি নিষ্প্রয়োজন, হলে তার ধরন কেমন, আমি এ সব রূপকল্প থেকে বুঝতে চাই।
প্রসঙ্গ এসে যাচ্ছে তাই বলি, আমি এভাবে জল থেকে গা বাঁচিয়ে সাঁতার কাটার মতো করে কথাগুলো বললাম একটাই ভরসায়। ভরসার জায়গাটা হচ্ছে, কথাগুলো আমি চিন্তাসূত্রকে বলেছি। একটা গল্প মনে পড়ে যাচ্ছে। একবার এক মহাকাশচারী মাথায় অস্ত্রোপচার করাতে গেছে নিউরোসার্জনের কাছে। একথা-সেকথায় মহাকাশচারী লোকটা বলল, এতবার আকাশে-মহাকাশে গেছি, একটাবারের জন্য ঈশ্বরকে দেখলাম না। নিউরোসার্জন তখন বলছে, এতবার লোকের মাথা কাটলাম, কখনো চিন্তা দেখলাম না। তো, এই হলো চিন্তা। সর্বসমস্ত বস্তুক্রিয়ার মহাশক্তিমান লব্ধি, কিন্তু সে নিজে অবস্তু, অনুভবের ব্যাপার। আমিও অনুভবগুলোই বললাম, নিরেট বস্তুকথা এড়িয়ে।