‘আলো-আঁধারির মধ্যখানে’ কবিতাটি ২০০০ সালের দিকে লেখা। তখন মৌলভীবাজারে ছিলাম। যে বাড়িতে থাকতাম, সেটি ছিল ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশে। মহাসড়কের পশ্চিম পাশে নিচু জমিতে বর্ষায় জমতো থৈ থৈ জল। দেখতে বিশাল হাওরের মতো লাগতো। পূর্ব পাশটাজুড়ে ছিল জনবসতি। প্রায়ই আমি রাস্তার পশ্চিমপাশে বসে থাকতাম। বিশেষ করে, বিকেল বেলাটা ছিল খুবই উপভোগ্য। সূর্যাস্ত, পাখিদের ঘরে ফেরা, ফড়িংয়ের ওড়াউড়ি, পানিতে ঢেউয়ের উল্লাস—সব আয়োজনই ছিল সেখানে। সেইসঙ্গে অনিশ্চিত জীবন, ব্যর্থ প্রেম যোগ করেছিল নতুন মাত্রা। কবিতাটিতে এসবের চিত্র আছে।
পুলিৎজার পুরস্কারজয়ী আলোকচিত্র ‘নাপাম গার্ল’ অবলম্বনে ‘নাপাম গার্ল’ কবিতাটি লেখা। ১৯৭২ সালের ৮ জুন ভিয়েতনামের ট্যাং ব্যাং শহরে নাপাম বোমা হামলার পর আট-দশ বছরের একদল শিশু আতঙ্কে পালায়। এ দৃশ্যটি ক্যামেরায় ধারণ করেন এপির আলোকচিত্রী নিক উট। এটি এখনো ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রতীক হয়ে আছে। এটি ২০১৭ সালে প্রকাশিত ‘আর কতো, হে গিরিগিটি’ কবিতাগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত।
২০১৩ সালে দৈনিক মানবকণ্ঠে কর্মরত অবস্থায় একটি সংবাদ দেখতে পাই যে, একজন মা অভাবে পড়ে অর্থের বিনিময়ে নিজের সন্তান বিক্রি করে দিয়েছেন। সংবাদটি আমাকে এতোটাই প্রভাবিত করে যে, বেশ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসেছিলাম। এরপর অফিসে বসেই লিখি ‘যে মা তার সন্তান বিক্রি করে এসেছেন’ কবিতাটি। সরাসরি কম্পিউটারে কম্পোজ করে লেখা এটি। লেখা শেষ হতেই কালি ও কলমের আবুল হাসনাত ভাইয়ের ইমেইলে পাঠিয়ে দেই। কিছুদিন পর কবিতাটি প্রকাশিত হয়। কবিতাটি ২০১৪ সালে প্রকাশিত ‘ওয়ানওয়ে রোড’ কবিতাগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
আলো-আঁধারির মধ্যখানে
সামনে দেখছি সুবিশাল জলা-মাঠ
পেছনে রয়েছে কোলাহল যন্ত্রণা
সামনে দেখছি ফড়িংয়ের আছে হাট
পেছনে কেবল কালো গোখরার ফণা।
সামনে শুনছি কুলুর কুলুর ঢেউ
অথচ পেছনে হতাশা জড়ানো গান
নীরবে একাকী, আগে পিছে নাই কেউ
পেছনে শহর বড় বেশি নিষ্প্রাণ।
সামনে বাতাস সাইরে সাইরে বয়
বিশাল ডানার চিল উড়ে যায় দূরে
পেছনে কেবল পাড় ভাঙে, হয় ক্ষয়
সামনে শালিক ডেকে ওঠে মধু-সুরে।
সামনে শাপলা ঢেউয়ে দুল্যমান
পেছনে টায়ার পোড়ানো গন্ধ আছে
সামনে পাচ্ছি ভেজা বাতাসের ঘ্রাণ
পিছ ছেড়ে আজ আমি সামনের কাছে।
সামনে আকাশ মেঘের পাহাড় আর
পেছনে রয়েছে অশেষ অন্ধকার।
নাপাম গার্ল
পেছনে বোমায় বিধ্বস্ত জনপদে আগুন জ্বলছে—
ধোঁয়ার কু-লী চারপাশে, আর পিচ-রাস্তা ধরে
বস্ত্রহীন শিশুরা পালিয়ে যায় নগ্ন পায়ে
. অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে—
তাদের কান্নার ঠিক পেছনেই
সামরিক বাহিনীর বন্দুকের নল
সামনে কোথাও নেই সহায়ের হাত, সান্ত্বনার বুক
হে যুদ্ধ—আকাশ ছেড়ে নেমে আসা আগুনের গোলা
ট্যাংক-কামান, বলো—এরা এখন কোথায় যাবে
. কার কাছে যাবে
এদের ঘর পুড়ে গেছে, খেলার মাঠের ঘাস মরে
হয়ে গেছে ফ্যাকাশে, বিবর্ণ—এরা এখন কোথায় যাবে?
হে ধ্বংস, বলো—সব কিছু হারিয়ে এখন
. এরা কেন নিখিলের যাত্রী?
যে মা তার সন্তান বিক্রি করে এসেছেন
যে মা তার কোলের শিশুটিকে অর্থের বিনিময়ে এইমাত্র
বিক্রি করে এসেছেন, তার জন্য আমার চোখে কোনো জল নেই
আমার শোক হতভাগা সেই শিশুটির জন্য, কারণ সে তার মাকে
ভালোবাসতে চাইবে—মধ্যরাতে কেঁপে, কেঁদে উঠলে সে চাইবে
মা তাকে জড়িয়ে ধরুক বুকে, সে ‘মা’ বলে ডাকতে চাইবে কাউকে
উন্মাদ অশ্বদের পিঠে চড়েছি আমি বহুকাল, এখন গোপন এক আস্তাবলে
তাদের রেখে দিব্যি হেঁটে যাচ্ছি দিগ্বিদিক—অথচ যোদ্ধা অশ্বের পাল মধ্যরাতে বেরিয়ে
পড়ে—খরস্রোতা নদীর যে তীর ভেঙে পড়ে
রাতের আঁধারে, তার খোঁজ কে রাখে—আমি জেনেছি, ক্ষুধাকে খোদা মানতে জেনেছে
মানুষ, তবুও অনেক প্রশ্নের জবাব আজো
অজানা রয়ে গেছে আমার
এইমাত্র নিজের সন্তান বিক্রি করে আসা হে মা, আমাকে আপনি
নিরপেক্ষ না-ই বলুন, স্বার্থপর বলুন, আমি আপনাকে বলছি, আপনি ক্ষুধা মেটাতে
বুক থেকে সরিয়ে দিয়েছেন উদরের ধন—কখনো কি ভেবেছেন,
আপনার সন্তানটি সারাজীবন মায়ের স্নেহের জন্য ক্ষুধার্ত থেকে যাবে?
তার মনের সেই অসীম ক্ষুধা কে মেটাবে?