‘তিনি কবিতায় ছন্দকে বিধৃত করেছেন ধ্বনিসৌষ্ঠবে, বাক্যকে গ্রথিত করেছেন শব্দবন্ধে। তাঁর ভাষা ধীরোদাত্ত, নির্মাণ স্থাপত্যিক। তাঁর কবিতা মহাকাব্যের লক্ষণমণ্ডিত।’ ফারুক সিদ্দিকী জীবিত থাকা অবস্থায় তাঁর কবিতা সম্পর্কে এ রকম মন্তব্য করেছিলেন তার বন্ধু কবি সাযযাদ কাদির।
ফারুক সিদ্দিকীর একমাত্র কাব্যগ্রন্থ ‘স্বরচিহ্নে ফুলের শব’ প্রকাশিত হয় ১৯৭২ সালে। তারপর আর কোনো কবিতার বই প্রকাশিত হয়নি। ফারুক সিদ্দিকী’র একমাত্র কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে তার কবিতার কঠোর সমালোচনা শুরু হয়। বিশেষ করে দুর্ভেধ্যতার অভিযোগ ওঠে। কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী কঠিন ভাষায় আক্রমণও করে বসেন। ফারুক সিদ্দিকীও পাল্টা আক্রমণ করে তার জবাব দেন। ২০০৩ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর একমাত্র প্রবন্ধগ্রন্থ ‘তামসিক নিসর্গে ঈশ্বরনামা ও অন্যান্য’। অর্থাৎ সবমিলিয়ে তার প্রকাশিত গ্রন্থ মাত্র দুটি।
ফারুক সিদ্দিকীর পুরো নাম আহমেদ ফারুক সিদ্দিকী, ডাক নাম শাজাহান। বাড়িতে তিনি শাজাহান নামেই পরিচিত। ব্যক্তি জীবনে কবি ফারুক সিদ্দিকী ব্যাংকে অফিসার পদে কর্মরত ছিলেন। ২৩ এপ্রিল ২০১৬ ফারুক সিদ্দিকী’র দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। প্রায় এক বছরেরও অধিক সময় রোগে ভোগার পর গত বছর এই দিনে রাত আটটায় বগুড়ায় সূত্রাপুরস্থ তাঁর নিজবাসভবনে ইন্তেকাল করেন। তাঁর জন্ম ১৯৪১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর। তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের প্রবীণতম লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদকের বিদায় ঘটে। ফারুক সিদ্দিকী একাধারে কবি, অনুবাদক, প্রবন্ধকার এবং লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক ছিলেন। ষাট দশকের কবিদের মধ্যে বগুড়ায় ফারুক সিদ্দিকীই ছিলেন বয়সে সবার বড়।
‘তিরিশ-উত্তর হয়ে ওঠার জন্য একটা বড় ভাঙচুর প্রয়োজন-এমন বুঝেছিলেন ষাটের তরুণরা। এ জন্যেই ওই সময়ের নানা সাহিত্যপত্রে দেখা গেছে ভাব, ভাষা নির্মাণে অ-তিরিশ প্রবণতা, প্রয়াস ও পরীক্ষা নিরীক্ষা। এমন এক অবস্থা যখন ঢাকায়, তখন সবাইকে চমকে দিয়ে বগুড়া থেকে আত্মপ্রকাশ করে ‘বিপ্রতীক’ (কবি সাযযাদ কাদির)। ফারুক সিদ্দিকী সম্পাদিত লিটল ম্যাগাজিন ‘বিপ্রতীক’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালে। এ পর্যন্ত প্রকাশিত সংখ্যা সম্ভবত ৩৫ টি। আমৃত্যু তিনি ‘বিপ্রতীক’ সম্পাদনা করেছেন। অসুস্থতার কারণে শেষের দিকে তিনি আর পত্রিকাটি সম্পাদনা করতে পারেননি। বিশাল দেহের অধিকারী রাশগম্ভীর ফারুক সিদ্দিকী চলাফেরা যতদিন করতে পেরেছেন, ততদিন সাহিত্যে সচল ছিলেন। বগুড়ার ষাট দশকের যে কয়জন কবি জীবিত আছেন, তাদের মধ্যে কবি ফারুক সিদ্দিকী সব সময় আলাদা। কবিতায়, সম্পাদনায়, চলাফেরায়, তরুণদের সঙ্গে আড্ডায় ছিলেন সবসময় মুখর। সিনিয়রদের মধ্যে ফারুক সিদ্দিকীর সঙ্গে তরুণরা নিবিড়ভাবে মিশতে পারতো। ফারুক সিদ্দিকী’র সঙ্গে খারাপ সম্পর্ক ছিল, এমন লেখক বগুড়ায় কেউ নেই। ফারুক সিদ্দিকীর বাসা অর্থাৎ তাঁর মাটির ঘরে সাহিত্য আড্ডা, বগুড়ার সাহিত্য আড্ডায় বড় একটি স্থান দখল করে আছে। তিনি সাহিত্য ও লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের জন্য পেয়েছেন বগুড়া লেখক চক্র স্বীকৃতি পুরস্কার, কবি মনোজ দাশগুপ্ত সম্মাননা, বগুড়া জেলা প্রশাসন কর্তৃক পদক, কণ্ঠসাধন আবৃত্তি সংসদ কর্তৃক সম্মাননা, কবি আন্ওয়ার আহমদ স্মৃতি পদক, মতিয়ার রহমান পিলু স্মৃতিপদক, প্রথম জাতীয় লিটল ম্যাগাজিন মেলা সম্মাননা ও সম্মিলিত লিটলম্যাগ প্রয়াস-২০০৯, নাট্যকর্মী স্বপন পদক প্রভৃতি। ইসলাম রফিক সম্পাদিত লিটলম্যাগাজিন ‘দোআঁশ’-এর একটি সংখ্যা তাঁকে উৎসর্গ করা হয় ২০০৬ সালে। ‘সেই সময়কাল থেকে আজপর্যন্তও কবি ফারুক সিদ্দিকী প্রাণে কম্পনে, শিল্পের সংরাগে, অনুভূতির নিস্বনে, প্রকাশ করে চলেছে লিটলম্যাগ বিপ্রতীক। কলাকৈবল্যবাদের এই নিঃসঙ্গ স্রষ্টাকে, এই কৃতি শেরপাকে জানাই আনন্দ ও সপ্রশংস অভিনন্দন।’ (কবি বজলুল করিম বাহার)। কবি বজলুল করিম বাহারের দৃষ্টিতে ‘বিপ্রতীক মূলত আত্মপ্রকাশ করে আধুনিক সৃজনশীল কবিতার মুখপত্ররূপে। সেসময়ে নতুন কবি ও লেখকদের আড্ডা ও পৃষ্টপোষকতার অভাব ঘুচিয়েছিল ‘বিপ্রতীক’।’
বগুড়া লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনে অন্যতম আধুনিক পুরোধা ফারুক সিদ্দিকী বাংলাসাহিত্যে, লিটল ম্যাগাজিনে কিংবা আমাদের হৃদয়ের মণিকোঠায় বেঁচে থাকবেন অনেকদিন। তাঁর কবিতা পাঠে শেষ করছি-
‘পৃথিবীর কুটিল বিধিবিধানের খিলান ধরে নিতুই বন্ধু ডাকে
আমাকে তিমিরচূড়ায়,-‘ফারুক দেখ, এই তোর
সত্তার নাচের মাতা মুদ্রা’।
মন্তব্য