কবি ফরিদ কবির সেই নিরীক্ষাপ্রবণ কবি, যিনি প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘হৃদপিণ্ডে রক্তপাত’ প্রকাশের পরপরই পাল্টে ফেলেন নিজেকে। ফলে তার কবিতা প্রথমেই ছিটকে পড়ে বাংলা কবিতার প্রচল ধারা থেকে। এরপর তিনি নিমগ্ন থাকেন নিরন্তর নিরীক্ষায়। এতে তার কবিতা পায় নতুন গন্তব্যের দিশা। তিনি এভাবেই প্রভাবিত করেন তার সময়কে। গত বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে তার শ্রেষ্ঠ কবিতা।
তার সময়ের কবিতা, তার হাতেই পেয়েছে নতুন ডিকশন। এ ডিকশন পরবর্তী সময়ে প্রভাববিস্তারী হয়ে উঠেছে। তার কবিতার ভেতরেই দেখা যায়, রচিত হয়ে গেছে যোজন ব্যবধান। কিন্তু অন্তর্গত সুরে ঠিক ঠিক কথা বলে যায় যেন তার কবিতাগুলো।
কী সেই অন্তর্গত সুর? ঠিক ঠিক চাক্ষুষ করে তো উপস্থাপনীয় নয় এইসব প্রয়াস। কবিতায় তিনি তুলে ধরেন নতুন চিন্তার সূত্র। তুলে ধরেন নতুনতর রহস্যময়তার অপার দিগন্ত। কবিতায় তিনি তুলে আনেন আপাত বিসদৃশ দুটি সত্তার ভেতরে আন্তঃসম্পর্কের সেতু। ফলে তার কবিতা আমাদের ভাবায়। তার কবিতা আমাদের নতুনতর চিন্তার উস্কানি দেয়। তার কবিতা আমাদের নিয়ে যায় অন্যরকম দৃশ্যকল্প-ভাষায়। তার কবিতা আমাদের মুখোমুখি করে মনস্তাত্ত্বিক জটিলতার অনুচ্চারিত অন্দরমহলে,
গণিত বড়ই রহস্যময়
শেখায় দুয়ে দুয়ে চার
কিন্তু বাস্তবে এ হিসাব কখনো মেলে না
দুয়ে দুয়ে দুই, তিন, এমনকি
পাঁচ কিংবা সাত হয়
চার কিছুতেই নয়কী কী বর্ণ যোগ অথবা বিয়োগ করলে
অঙ্কটা মিলবে, জানি নাআমি দুয়ের সঙ্গে দুই যোগ করি, তিন যোগ করি,
লাল এমনকি নীল যোগ করিতুমি দুই থেকে দুঃখ বিয়োগ করেও পাও ৫ অথবা ৭
আমি দুয়ের সঙ্গে তোমাকে যোগ করেও দুই অথবা তিনবিয়োগ করলেও তোমার যোগফল মেলে
আমি যোগ করলেও বিয়োগফলআমি দুয়ে দুয়ে পাই দুই অথবা তিন
তুমি পাঁচ, সাত কিংবা নয়এ কথা আজ বলতেই পারো—
দুয়ে দুয়ে তুমিও চারই চেয়েছিলে,
পাঁচ, সাত, নয়—কিছুতেই নয়…
(গণিত)
কবিতায় নানা ধরনের নিরীক্ষার প্রচলন যখন আমাদের ভূ-খণ্ডে এসে রীতিমতো ক্রেজ শুরু করেছিল, ঠিক সে-সময়ের কুশীলব তিনি। তিনিও সে স্রোতে প্রথমে নিজেকে জড়িয়েছেন। তারপর ঠিক ঠিক নিজেকে স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করেছেন অন্যদের থেকে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, কোন ভঙ্গি বা উপাদানের জন্য তিনি অনন্য হলেন? তিনি অনন্য হলেন, কবিতার ভাব-কেন্দ্র থেকে এর প্রাণভোমরাকে বিতাড়িত না-করার মাধ্যমে। আমরা দেখেছি, কবিতাকে মাল্টিডাইমেনশনাল করতে গিয়ে অনেকেই কবিতার ভাব-কেন্দ্রকে বিচ্ছুরণে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। তাতে বিচ্যুত হতে হতে একসময় দেখা গেছে কেন্দ্র থেকেই উড়ে চলে গেছে এর প্রাণ ভোমরা। শুধু কবিতার অবয়ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কতিপয় শব্দ। এ ধরনের নিরীক্ষার প্রধান ঝুঁকি হলো কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া। ফরিদ কবির তার কবিতার ভাবকে বিচ্ছুরণে ছড়িয়ে দিয়েছেন ঠিকই কিন্তু রচনা করে দিয়েছেন এমন এক সূক্ষ্ণ সেতু, যে-সেতু এর ভাবকেন্দ্রের সঙ্গে নিয়ত যোগাযোগ রেখে চলে। ফলে পাঠক ছিটকে পড়ে না কবিতার অন্তঃস্ত রূপ থেকে। সময়ের সূক্ষ্ণ প্রবাহের ভেতরে তিনি এভাবে অনন্য হয়ে ওঠেন।
প্রাণ জগতের আন্তঃসম্পর্ক যেখানে অধিকাংশ কবির কবিতার বিষয়, সেখানে ফরিদ কবির অনুসন্ধানে রত থাকেন বস্তু জগতের সম্পর্কের সূত্র আবিষ্কারে। নানাবিধ সম্পর্কের অনন্ত রহস্যময়তা হয়ে ওঠে তার কবিতার বিষয়,
একটি বাড়ির দিকে উঁকি দিলো আরেকটি বাড়ি
ভেতরে মানুষ নেই, সিগারেট ঠোঁটে
বসে আছে জানালার কাঁচ
বুক-শেলফ হেঁটে গেলো পয়মন্ত চেয়ারের দিকে
দুলছে চেয়ারবিছানায় শুয়ে আছে বালিশের প্রেত
জানালায় পাট চোখ তুলে
দেখে নিলো চন্দ্রের আলোকে
মৌমাছির মতো টেবিলের ওপর উড়ছে ঘুম
ডায়েরির পাতাকার্নিশে কার্নিশ ছুঁয়ে শাদা বাড়িটিকে
চুমু খেলো দোতলা বাড়িটা।বাড়িতে কেউ কি আছে? সারারাত জেগে
খুব ভোরো ঘুমিয়ে পড়লো আলনায় ঝুলে থাকা
মুণ্ডুহীন শার্ট
পা কোথায়? হাতের আঙুল?
বাতাসে ডানার গন্ধ, আর
বাড়ির ভেতরে ফিসফিস
হাত পা আঙুল খুলে আলনায় ঝোলে মুণ্ডুহীন শার্ট
একবার শুধু বুক-শেলফ
হেঁটে গেলো পয়মন্ত চেয়ারের দিকে
দুলছে চেয়ার
মৌমাছির মতো
টেবিলের ওপর উড়ছে ঘুম, ডায়েরির পাতাএকটি বাড়ির দিকে হেঁটে এলো আরেকটি বাড়ি।
(বাড়ি)
এভাবে ফরিদ কবির সংক্রমিত করে চলেন নতুনতর সম্পর্ক নির্ণয়ে। এ সংক্রাম প্রবল আচ্ছন্নতা তৈরি করে। এ আচ্ছন্নতা এত ব্যপকতর যে, পাঠের অনেক পরেও পাঠক থেকে যান কবিতার ঘোরে। এ ঘোর যেন রহস্যময় আলো। আর সে-আলোর ভেতরে হঠাৎ হঠাৎ খেলে যায় কতিপয় নীল মাছ।
আজ এই কবির জন্মদিন। তার জন্য শুভকামনা