বাড়ি থেকে বেরিয়েই ঠাকুরবাড়ি। তার গায়েই একটা কুলগাছ। ডানদিকে কুলগাছ রেখে একটু এগোলেই পুকুরের পাড়ে শিরীষ গাছটা। আমাদের বাড়ির পেছনেই এসব ছিল। বাড়ি ছাড়া কোনোটাই আমাদের নয়। কিন্তু তবু কী অসম্ভব জোর ছিল! আমাদের নয় বলে যে তা আমাদের হতে পারে না, এটা আমার মন সেই ছোটবেলা থেকেই আমাকে শেখায়নি। চোখের সামনে যা দেখেছি, তাকেই বুকে জড়িয়ে ধরতে এতটুকুও কুণ্ঠিত হইনি। তাই তো শিরীষ গাছটা কখন যে আমার আত্মার আত্মীয় হয়ে উঠেছে, তা আমি নিজেও বুঝতে পারিনি।
মন খারাপ হলে, বাড়িতে কেউ বকলে আমি সোজা শিরীষ গাছের নিচে। যেন ও আমার বন্ধু। বাড়ির পেছন দিক বলে এই জায়গাটায় বিশেষ কেউ আসতো না। এটা আমার ক্ষেত্রে ছিল একটা বড় ইতিবাচক দিক। জায়গাটা অদ্ভুত নির্জন ছিল। মাটিতে শিরীষ পাতা বিছানো থাকতো। কত রকমের যে হলুদ রঙ, তা তখন দেখতাম।
গাছে হেলান দিয়ে বসে আছি। ঝরে পড়ছে পাতা। পাতার আকৃতিগুলো এত অসাধারণ যে, গায়ে এসে লাগলে মনে হতো কে যেন সুড়সুড়ি দিচ্ছে। মনের দিক থেকে এক অদ্ভুত আরাম পেতাম। নির্জনতার পরিমণ্ডলে শিরীষ আমাকে নিয়ে গিয়ে যেন কোথায় ফেলতো। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে আমার চারপাশে এক সৌহার্দ্যের বাতাবরণ গড়ে তুলতো। নির্জনতা প্রিয় আমি তাকে প্রাণপণ শক্তিতে জড়িয়ে ধরতাম। ফিরে আসার পর মনে হলো আমি যেন অন্য মানুষ হয়ে গেছি। গা থেকে খসে পড়েছে অভিমানের চাদর। মনে হতো ‘আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ।’
শিরীষ গাছের নির্জনতা ও সৌন্দর্য আমার চোখের সামনে খুলে দিতো পথ। আমার ভালো-মন্দ চাওয়া পাওয়া সবকিছুই যেন পথের এখানে-ওখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকতো। এই পথই তো আমাকে করেছে উদার। কত সব মহার্ঘ্য বস্তু যা আমাকে প্রতিটি মুহূর্তে আন্দোলিত করতো। সেই আন্দোলন আমার মনোজগতে এতটাই রঙ ধরিয়ে দিতো যে, সেই রঙ আমাকে দিতো দিশা। কোনোকিছু না চেয়েও দুহাত ভরে কতকিছু যে পাওয়া যায়, আর সেই পাওয়া আমৃত্যু সঞ্চয় হয়ে থাকতে পারে, তা তো আমি শিখেছি শিরীষের কাছে এসেই।
আমি ভুলেই যেতাম, কী নিয়ে শিরীষের কাছে এসেছি। কোথায় উবে গেছে মনখারাপ। তখন শিরীষ তো আমার সমগ্র সত্তায়। সে তার সমস্ত ডালপালা দিয়ে আমাকে যেন আগলে ধরেছে। আমাকে চাওয়া পাওয়ার নতুন বাণী শেখানোর জন্য যেন সে বদ্ধপরিকর।
নদীও আমাকে কী ভীষণ তৃপ্তি এনে দিতো! বাড়ি থেকে বেশ কিছুটা হেঁটে এসে তবে শশ্মান। আর শশ্মানের গা দিয়েই বয়ে গেছে ঝিমকি নদী। খুবই অল্প জল থাকতো তাতে। স্রোতস্বিনী হলে ঝিমকির কতটা কাছে আমি আসতে পারতাম, সে বিষয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। তাকে তো বলতেই পারতাম না আমার দুঃখ কথা। সে কি আজকের মতো তখন আমার পাশে এসে বসতো? শোনার সময় পেতো আমার রঙহীন কথামালা। তাই সেদিন ঝিমকি তার শরীর মনে আমার খুব প্রিয় হয়ে উঠেছিল।
নদীটির পাশে গিয়ে বসলেই আমি যেন শিখে যেতাম, দুঃখ কোথায়! এগিয়ে চলো! নদী যেন তার সমগ্র সত্তা দিয়ে আমাকে এই শিক্ষা দিতো, সে বলতো, এই দেখো আমি এগিয়ে চলেছি। আগের রাস্তায় কত কতজন আমার শরীরজুড়ে মাখিয়ে দিয়েছে কালো কালো আলকাতরার রঙ। কিন্তু তারা আজ কোথায়! কষ্টকথার সেই ইতিবৃত্ত কখনো শোনেনি কেউ। নদীর সেই পথ ধরে আমিও বয়ে যেতাম। কত কত দেশ সে আমাকে দেখিয়েছে। একটু একটু করে আমার অন্তর্দেশ থেকে মুছে গেছে কষ্টের নীল আভাস।
আমার চোখের রঙ বদলে যায়। বদলে যায় পথ চলা। শিরীষগাছের সৌন্দর্য ও নির্জনতার কাছে আমি যেন আর আমার কথা বলতে পারি না। সেও ঠিক বোঝে না আমার কথা। নদীর কাছেও যেন আমার সব কথা বলা শেষ হয়ে গেছে। আমার চোখ যেন এখন অন্য কিছু খোঁজে। এখন আকাশ আমায় হাতছানি দেয়। তার বিশাল ব্যাপ্তির কাছে আমি এখন আশ্রয় চাই। আমার দৃষ্টি দিগন্ত ছাড়িয়ে গেছে।
নির্জনতা আর সৌন্দর্যের পাঠ শেষে নদীর মুখরতা আমার মনের ক্যানভাসে আর রঙ বোলোয় না। নদীর গতিময়তায় আমি এখন আর তাল মেলাতে পারি না। গন্তব্যের এই পরিবর্তনের ভাষা আকাশের চেনা। সে আমাকে আলো দেয়। তার চিরধ্যানস্থ মূর্তি আমাকে সম্মোহিত করে। আমার যাত্রা এখন প্রান্তরেখার দিকে। কবি সনৎ দে-র দৃষ্টিপথেও খুঁজে পাই সেই প্রান্তরেখার আভাস:
শিরীষগাছের নির্জনতা এবং সৌন্দর্য
অতিক্রম করলাম। নদীর শব্দ অতিক্রম
করলাম। তারপর আকাশ দেখতে দেখতে,
আকাশ দেখতে দেখতে প্রান্তরেখার দিকে
হাঁটা শুরু করলাম।