রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ও দার্শনিক প্রফেসর আবু সয়ীদ আইয়ুবের (১৯০৬- ১৯৮২) নিজের কথা দিয়েই এ লেখার সূচনা করতে চাই। তিনি বলেছেন—’মানুষের জীবন যদি অভিশপ্ত হয়ে থাকে, তবে অভিশাপ মোচনের দায়িত্বও মানুষের ওপরই বর্তায়, সত্য বা মিথ্যা দেবতার ওপর নয়।’ তাঁর এ কথায় বিশেষভাবে লক্ষণীয় তাঁর সদর্থক আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ। ১৯০৬ সালের ৫ এপ্রিল দ্বারবাঙ্গার এক রক্ষণশীল ঊর্দুভাষী মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। নিজের আগ্রহ ও অধ্যবসায়ের জোরে বাংলাভাষা শিখে বাংলাভাষায় অসাধারণ গ্রন্থ রচনা করে তিনি তাঁর প্রজ্ঞার যে নজির রেখে গেছেন, তার তুলনা মেলা ভার। তাঁর চিন্তার অভিনবত্ব প্রকাশ পেয়েছে ‘আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ’ (প্রথম প্রকাশ এপ্রিল ১৯৬৮), ‘পান্থজনের সখা ‘ (প্রথম প্রকাশ: অক্টোবর ১৯৭৩), ‘পথের শেষ কোথায়’ (প্রথম প্রকাশ মে ১৯৭৭ ), ‘ব্যক্তিগত ও নৈর্ব্যক্তিক’ ( প্রথম প্রকাশ ১৯৯১) প্রভৃতি গ্রন্থে।
পারিবারিক ও মাতৃভাষা উর্দু হলেও আইয়ুব কৈশোরে মিশনারি স্কুলে শেখেন ফার্সি। ফার্সি কবিতা পাঠ করে তিনি মুগ্ধ হন। এমন একটা সময় এলো তাঁর জীবনে, যে সময় তিনি বাংলাভাষা শিখতে আগ্রহী হয়ে উঠলেন। বাংলাভাষা শেখার অনুপ্রেরণা রবীন্দ্রনাথের লেখা পড়ে পেলেন তারই আভাস লুকিয়ে আছে তাঁর নিজের এই উক্তির মাঝে— ‘আমি রবীন্দ্রপ্রেমিক তের বছর বয়স থেকে, উর্দু অনুবাদে রবীন্দ্রনাথ পড়ে। এ প্রেম আরও অনেক গভীর হলো।’ বাংলাভাষার লেখা রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলী পড়ার আগ্রহে তিনি বাংলাভাষা শিখলেন কলকাতার পাঠ্যজীবন বাংলাভাষা শেখার পথ সুগম করে দিয়েছিল, সে প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে কলকাতার পাঠ্যজীবন সম্পর্কে আলোচনা করতে হয়। কলকাতার প্রসিডেন্সি কলেজ থেকে বিএসসি অনার্স পাস করার পর তিনি এমএসসি পড়েছিলেন পদার্থ বিজ্ঞানে। কিন্তু এক পর্যায়ে এক বছর ড্রপ দিয়ে দর্শনে এমএ পাস করলেন। তাঁর লেখালেখির ইচ্ছে ছিল দর্শনশাস্ত্রে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দর্শনশাস্ত্রে লেখালেখি তেমনটা করা হলো না। ঘুরেফিরে তিনি এলেন সাহিত্য জগতে। তাঁর নিজের কথায়—’ঘুরে-ফিরে আসতে হলো সাহিত্যেই, স্থির করলাম,—সাহিত্যই হবে আমার প্রধান কর্মক্ষেত্র, অর্থাৎ লেখার এই সিদ্ধান্ত আমার জীবনের মোড় ফিরিয়ে দিল।’ সাহিত্য জগতে প্রবেশ প্রসঙ্গে তিনি যা বলেছেন তার মধ্যেই তাঁর মনের অভিব্যক্তি ধরা পড়েছে। তিনি আরও বলেছেন—’আমার মনে প্রশ্ন উঠল কোন সাহিত্যিককে অবলম্বন করে লিখব এবং কোন ভাষায় লিখব। ইংরেজি সাহিত্যকে অবলম্বন করে ইংরেজি ভাষায় লিখে আন্তর্জাতিক মহলে খুব একটা সাড়া জাগাতে পারব, সে আশা আমি ত্যাগ করলাম। যদি উর্দুভাষার কেন্দ্রস্থল এলাহাবাদ,লক্ষ্মৌ, দিল্লি বা আলিগড়ে জন্মাতাম, অন্তত বড় হয়ে সেইকালে শিক্ষালাভ করতাম তাহলে উর্দুভাষায় উর্দু সাহিত্যকে অবলম্বন করে লিখবার কথা আমাকে ভাবতে হতো। কিন্তু কলকাতার উর্দুভাষার প্রান্তীয় নগরে আজন্ম বসবাস করে সে ভাবনা একেবারেই অবান্তর।’
এক পর্যায়ে আবু সয়ীদ আইয়ূব ইংরেজি ভাষায় লিখলেন varieties of Experience, Truth and Poetry and poetry I Tagore Quest। উর্দু ও ইংরেজি ভাষায় পরদর্শী হওয়া সত্ত্বেও তিনি বেশি বয়সে বাংলাভাষা শিখে বাংলাভাষায় অসাধারণ গ্রন্থ রচনায় ঋদ্ধতার উজ্জ্বল স্বাক্ষর রাখলেন। নতুন করে বাংলাভাষা শিখে এই ভাষায় গ্রন্থ রচনা করে নন্দিত হওয়াটা চারটিখানা কথা নয়। বাংলা শেখার তিনপর্বের কথা তিনি উল্লেখ করতে ভোলেননি—’এই দেশে, অন্ততপক্ষে বাংলাভাষার দেশে, সংস্কৃতি-উদ্যানের সবচেয়ে জীবন্ত-ফলন্ত বৃক্ষ হচ্ছে সাহিত্য এবং সংশ্লিষ্ট চিন্তা-ভাবনা। তার সঙ্গে যুক্ত হবার উচ্চাভিলাষ জাগলো আমার মনে।’
এখানে বলে রাখা ভালো—আইয়ুবের কলকাতা জীবনে গানবাজনা, চিত্রকলা, সিনেমা কিংবা থিয়েটার তাকে টানতে পারেনি, যেম টেনেছিল সাহিত্য। বাংলা সাহিত্য জগতে বাংলাভাষায় অমূল্য গ্রন্থ রচনার শুরুতে আইয়ুব ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত রকফেলার স্কলার হিসেবে কাজ করেন লেকটিক্যাল মেটেরিয়ালিজম,মার্কসিস্ট থিওরি অব ভ্যাল্প বিষয়ে। ১৯৬১ সালে তিনি মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারতচর্চা বিভাগে অধ্যাপনা করেন।
বাংলাভাষায় লেখা আবু সয়ীদ আইয়ুবের গ্রন্তগুলোর মধ্যে প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় ১৯৬৮ সালের এপ্রিলে প্রকাশিত ‘আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ’-এর কথা। তিনি গ্রন্থটি উৎসর্গ করেন কবি বুদ্ধদেব বসুকে। ‘আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ’ গবেষণা গ্রন্থটিতে তিনি রবীন্দ্রনাথকে নতুন মাত্রায় আবিষ্কার করতে সচেষ্ট হন। এ গ্রন্থের জন্য তিনি রবীন্দ্র পুরস্কার ও সাহিত্য একাডেমি পুরস্কারও লাভ করেন।
‘আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থের পূর্বাভাষে অংশে আবু সয়ীদ আইয়ুব যা বলেছেন তা পাঠ করলে রবীন্দ্র গবেষক ও বোদ্ধা পাঠক বুঝতে পারবেন, রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তাঁর নতুন চিন্তা-চেতনা। তিনি এ গ্রন্থের পূর্বাভাষে প্রথমে লিখেছেন—’বইখানা পড়ে বিশুদ্ধ সাহিত্য রসিক হয়তো ভাববেন, এত তত্ত্বকথা কেন?’ আইয়ুব বাংলা সাহিত্যের ওপর গবেষণা করতে গিয়ে দর্শনের চিন্তা মাথা থেকে বিদায় করে দেননি। তাঁর অধীত দর্শনের শাস্ত্রের আলোকে রবীন্দ্রনাথের কাব্যে দার্শিনিক তত্ত্বকে খুঁজে পেতে সচেষ্ট হয়েছেন। তিনি আধুনিক সাহিত্যের কিংবা সমগ্র রবীন্দ্র প্রতিভার দিকদর্শন খুঁজতে প্রয়াসী হয়েছেন আপন চিন্তা-চেতনায়। তিনি ‘আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থে আধুনিক সাহিত্যের বহু বৈশিষ্ট্যের মধ্যে কেবল দুটো বৈশিষ্ট্যের কথা তুলে ধরেছেন ভূমিকায়। তিনি বলেছেন—’এক, কাব্যদেহের প্রতি একাগ্র মনোনিবেশ, যার পরিণাম কাব্যরচনায় ও সমালোচনায় দেহাত্মবাদ, ভাষাকে আধার বা প্রতীক জ্ঞান না করে আপনারই দুর্ভেদ্য মহিমায় সুপ্রতিষ্ঠিত স্বয়ংসম্পূর্ণ সত্তা জ্ঞান করা। সার্ত্র-এর উক্তি হয়তো অতিরঞ্জিত, তবুও আধুনিক কাব্য প্রবণতার পরিচয় পাওয়া যায় তাতে; কবিতার ভাষা স্বচ্ছ কাচের মতো মোটেই নয়, নিজেরই অনবদ্য ধ্বনিরূপে ফুটিয়ে তোলা তার কাজ। দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য—জাগতিক অমঙ্গল বিষয়ে চেতনার অত্যাধিক্য—আমাকে অধিকতর পীড়িত করে।—তাহলেও আধুনিককালে সাচ্চা সাহিত্য রচিত হয়েছে, মহৎ সাহিত্যের ও একান্ত অভাব ঘটেনি।’
আইযুব ‘আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থে রবীন্দ্রসাহিত্য আলোচনা করতে গিয়ে অন্য ভাষার লেখকদের প্রসঙ্গ টেনেছেন, তুলে এনেছেন রবীন্দ্রোত্তর বাংলা সাহিত্যের কবিদের প্রসঙ্গও। আইয়ুব বলেছেন—’বাংলাসাহিত্যে অনেকেই প্রতিভার উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখে গেছেন তাঁদের সাহিত্যসৃষ্টিতে। রিল্কের ডুইনো এলিজিস, এলিয়টের ফোর কোয়াটেট্স, মান্-এর ম্যাজিক মাউন্টে, কামুর আউট সাইডার, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মানদীর মাঝে, বিভূতিভূষণ বন্দ্রোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালি, বুদ্ধদেব বসুর তপস্বী ও তরঙ্গিনী সর্বদেশকালের সৎ সাহিত্যের স্থান পাওয়ার যোগ্য।’ গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি দেশি-বিদেশি সাহিত্যের প্রতিভাবানদের প্রসঙ্গে খোলামেলা কথা বলতে দ্বিধা করেননি। আধুনিক কালের কবি সাহিত্যিকদের সাহিত্যকর্মের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্মের তুলনামূলক আলোচনা প্রসঙ্গে আইয়ুব বলেছেন—’লের বাঙালী কবিদের মধ্যে অমিয় চক্রবর্তী যদিও আমার প্রিয়তম কবি তবুও বিষ্ণু দে এবং সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে রাজনৈতিক মতবিরোধ আমাকে বাধা দেয়নি। তাঁদের কবিতার গুণমুগ্ধ পাঠক হতে; তেমনি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত এবং সাম্প্রতিককালের বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে সাহিত্যেক মতভেদ সত্ত্বেও আমি মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করি, তাঁদের সৃজনশীলতা সাহিত্যকর্মে স্থায়ী ঐতিহাসিক মূল্য; যেমন স্বীকার করি আরও একটু স্তরে বোদলেয়র, ভেলেরি, ফকনার এবং কাফ্ফার সৃষ্টি প্রতিভা। এরা সবাই আধুনিক।’
__________________________________________________________________________________
আইয়ুব ‘আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থের প্রথম সংস্করণে আধুনিকতার সংজ্ঞা দেননি। কিন্তু দ্বিতীয় সংস্করণের আধুনিক সংজ্ঞা দিয়েছেন। দ্বিতীয় সংস্করণে আধুনিকতার প্রসঙ্গে তিনি যা বলেছেন, তাতে তার মধ্যে তাঁর চিন্তা চেতনার বহিঃপ্রকাশ বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়। আইয়ুবের এই লেখা পড়লে পাঠক সহজেই উপলব্ধি করবেন তিনি কাব্য ভাবনায় ভাববাদী, দেহবাদী নয়।
__________________________________________________________________________________
আইয়ুব ‘আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থের ভূমিকায় আধুনিক সাহিত্যের পূর্বোল্লিখিত দুই ধারার বিরুদ্ধেই বলেছেন। তিনি আধুনিক সাহিত্যের বিরুদ্ধবাদী নন, আধুনিক সাহিত্যের বিভক্ত ধারার বিরুদ্ধে মাত্র। তিনি এই গ্রন্থে সমগ্র রবীন্দ্র সাহিত্যকে আলোচনা করেননি। তাঁর আলোচনায় এসেছে কয়েকটি রবীন্দ্রকাব্য। এ প্রসঙ্গে তাঁর আলোচিত রবীন্দ্রকাব্যগুলোর নাম করা যেতে পারে। এগুলো হলো—মানসী ও সোনারতরী, চিত্র ও কল্পনা, ক্ষণিকা ও নৈবেদ্য, বলাকা এবং গীতাঞ্জলি। এছাড়া, অমঙ্গলবোধ ও আধুনিক কবিতা, অমঙ্গলবোধ ও রবীন্দ্রনাথসহ আরও কয়েকটি প্রবন্ধ সন্নিবেশিত হয়েছে। আর এ গ্রন্থের পরিশিষ্টে অরুণ সরকারের সমালোচনায় লেখকের উত্তর।
আইয়ুব ‘আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থের প্রথম সংস্করণে আধুনিকতার সংজ্ঞা দেননি। কিন্তু দ্বিতীয় সংস্করণের আধুনিক সংজ্ঞা দিয়েছেন। দ্বিতীয় সংস্করণে আধুনিকতার প্রসঙ্গে তিনি যা বলেছেন, তাতে তার মধ্যে তাঁর চিন্তা চেতনার বহিঃপ্রকাশ বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়। আইয়ুবের এই লেখা পড়লে পাঠক সহজেই উপলব্ধি করবেন তিনি কাব্য ভাবনায় ভাববাদী, দেহবাদী নয়।
আধুনিকতা প্রসঙ্গে আইয়ুবের বক্তব্যকে এখানে উপস্থাপন করা যেতে পারে। ‘আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণে তিনি এ প্রসঙ্গে যা বলেছেন, তা হলো—’প্রথমত, আধুনিকতার ধারণা স্বভাবতই গতিশীল, ধাবমান। সেকালের যৌবনমদমত্ত আধুনিকতা একালে লোলচর্ম, পলিতকেশ; আবার একালের ঝকমকে আধুনিকতা পঁচিশ, পঞ্চাশ কি একশ বছর পরে বেজায় সেকেলে হয়ে যাবে। কালেরযাত্রার ওই ধুলো-ওড়ানো পথে কদাচিৎ এমন কবির আবির্ভাব ঘটে, যিনি সত্যই কালজয়ী; স্বকালে তিনি আধুনিক বলে মন্য হয়ে থাকতে পারে, নাও পারেন, হয়তো বা পরবর্তীকালের বার্তা মর্মে নিয়ে আগাম জন্মে ছিলেন বলে নিজ দেশকালে পরবাসী হয়েই কাটালেন, কিন্তু দীর্ঘকালের সাহিত্যাকাশে এঁদের পদধ্বনি শোনা যায়।’
আইয়ুব কাব্যের আধুনিকতা প্রসঙ্গে যে প্রশ্ন করেছেন, তা বিশেষ অর্থবহ। তিনি যা বলে প্রশ্ন করেছেন, তা হচ্ছে এমন—পাশ্চাত্যে তিরিশের দশকে প্রগতি-সাহিত্যের আওয়াজ বলিষ্ঠ হয়ে উঠল, কিন্তু তখন এলিয়টের ধর্মবিশ্বাসী, অন্তত ধর্ম সন্ধানী কণ্ঠ মোটেই ক্ষীণ নয়, বোদলেয়রীয় সর্বেব জীবন বিতৃষ্ণাও স্তিমিত হয়নি। বাংলায় ওই সময়ে এবং অব্যবহিত পরে রবীন্দ্রনাথ, সুধীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, বিষ্ণু দে প্রভাবশালী কবি, আরও একটু পরে প্রভাব বিস্তার করলেন অমিয় চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু, সুভাষ মুখোপাধ্যায়। এঁরা কি সবাই একই প্রকার মন মেজাজ বেদনা ও উদ্দীপনা ব্যক্ত করেছেন তাঁদের কাব্যে? তবু কি এঁরা সবাই আধুনিক নন এবং আধুনিকতার পথিকৃৎ?
কল্লোলগোষ্ঠীর লেখকবৃন্দ আধুনিকতার প্রবক্তা হিসেবে বাংলা সাহিত্যজগতে আবির্ভূত হয়ে রবীন্দ্র ভাবধারা থেকে বের হয়ে নতুনধারার লেখা লিখতে থাকেন। কল্লোলগোষ্ঠীর আধুনিকতাবাদী সাহিত্য আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন বুদ্ধদেব বসু। প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, অন্নদাশংকর রায়, জীবনানন্দ দাশ, নজরুল ইসলাম সাহিত্য পত্রিকাকে ঘিরে, কল্লোলকে ঘিরে, কল্লোল গোষ্ঠীর আত্মপ্রকাশ বাংলা সাহিত্যজগতে আলোড়ন সৃষ্টি করে। পরবর্তীকালে কল্লোল সাহিত্য গোষ্ঠী থেকে বের হয়ে একদল লেখক কালিকলম সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশে আত্মনিয়োগ করেন। তারপর সুধীন্দ্রনাথ দত্তের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় পরিচয়। এই যুগের প্রতিবাদী লেখকরা প্রশ্ন তোলেন, রবীন্দ্রনাথ কতটা আধুনিক? আইয়ুব আধুনিকতার সংজ্ঞা দেওয়ার চেষ্টায় রবীন্দ্রনাথকে মূল্যায়নে নিবেদিত হয়েছেন। আধুনিকতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন—’আধুনিকতা কারো কাছে প্রশংসক শব্দ, কারো কাছে নিন্দুক। প্রথম শ্রেণীর সমালোচকেরা যুগের মনমেজাজের মধ্যে যেটিকে বা যে গুলিকে পছন্দ করেন তাকেই আধুনিকতার সংজ্ঞাযুক্ত করেন, দ্বিতীয় শ্রেণীর সমালোচকরা যুগের খারাপ ( তাদের চোখে খারাপ) রক্ষণগুলিকেই আধুনিক বলেন..। আমার অভিধানে আধুনিকতা বহুবিচিত্র, অর্থবাহী, শুধুমাত্র প্রশংসা বা নিন্দাসূচক শব্দ নয়।’
আইয়ুবের দৃষ্টিতে আধুনিতার অর্থ বহুবিচিত্র অর্থবহ, আর সে কথা বোঝাতে গিয়ে তিনি ওয়ার্ডসওয়ার্থ, বোদলেয়ার, মালার্ম প্রমুখের প্রসঙ্গ উপস্থাপনে ব্রতী হয়েছেন। তিনি বলেন, Lyrical Ballads Ges †ev`‡jq‡ii Les Fleurs du ma ও Lyrical Ballads পাশ্চাত্য কাব্যধারা দুটো বড় আকারের বাঁক নিয়েছিল। মালর্মের কবিতা ও প্রগতি- কাব্যকে তৃতীয় ও চতুর্থ্ বাঁক বলা যেতে পারে, কিন্তু শেষের দুটির বাঁক সাহিত্যের বিচারে ছোট আকারের।
আইয়ুব কবিতা ও কাব্যে তীব্র অমঙ্গলবোধ এবং কবিতার ভাষার প্রতি নিবিড় মনোনিবেশ ইঙ্গিত করে রবীন্দ্রকাব্যের মূল্যায়ন করতে সচেষ্ট হন। এ দুটো বিষয়ের আলোকে রবীন্দ্রকাব্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন,—’এ দুটি বিষয় আমার মতে দোষ নয়, গুণই। দোষ হয়ে ওঠে যখন অমঙ্গলবোধ এতটা আধিপত্য বিস্তার করে যে মঙ্গলবোধকে মিথ্যা বা মেকি বলে পাশে সরিযে রাখে; যখন ভাষা এবং সাধারণভাবে আঙ্গিকের একান্ত সাধনা এতদূর পর্যন্ত পৌঁছয় যে, ওই কারুকার্য খচিত কাচটি আর স্বচ্ছ তাকে না।, অস্বচ্ছও থাকে না, প্রায় অস্বচ্ছ হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রকাব্যে আমি অমঙ্গলবোধের ক্রমবিকাশ দেখবার চেষ্টা করেছি তাঁকে আধুনিক সাব্যস্ত করবার জন্য নয়; কবিরূপে তিনি কেমন করে আমার চোখে মহৎ থেকে মহত্তর হয়ে উঠেছেন সেই কথাটা, সেই আনন্দটা পাঠকের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার জন্য।’
আইয়ুব পদার্থ বিজ্ঞান পড়া ছেড়ে দর্শনে এমএপাস করে দার্শনিক জ্ঞানের অধিকারী হন। আইয়ুব এই চিন্তাচেতনার আলোকে রবীন্দ্রকাব্যের অর্ন্তনিহিত ভাবকে অনুধাবন করে তা উপস্থাপনে ব্রতী হয়েছেন। তিনি দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে রবীন্দ্রনাথের লেখায় দার্শনিকতা অন্বেষণ করতে সচেষ্ট হয়েছেন। দার্শনিক শুধু বুদ্ধি নয়, বোধকে অবলম্বন করে দার্শনিক তত্ত্বকে দাঁড় করান। প্রাজ্ঞ আইয়ুব শুধু সাদামাটা লেখক নন, তিনি দার্শনিক তত্ত্ববোধে অভিসিক্ত একজন লেখক। তাই তিনি রবীন্দ্রনাথের কাব্য দর্শন তত্ত্বকে আবিষ্কার করেছেন তাঁর লেখায়। তিনি বলেছেন, ‘কাব্য রচনা নিছক শব্দে আলিঙ্গন নয়।’
কবি একজন সত্যদ্রষ্টা হিসাবে তাঁর বোধকে দার্শনিক দৃষ্টি ভঙ্গিতে রচনা করেন তাঁর কাব্যসমূহ। রবীন্দ্রকাব্যেও ব্যত্যয় ঘটেনি এই দৃষ্টিভঙ্গির। আইয়ুব নন্দনতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে তাঁর চিন্তা চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন তাঁর লেখায়। তাঁর নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমেই আবিষ্কার করতে সচেষ্ট হয়েছেন রবীন্দ্রনাথকে। এমনকি তাঁর ঈশ্বর বোধের সৃষ্টি হয়েছে তাঁর নান্দনিক বোধ থেকে।
‘পান্থজনের সখা’র লেখক আবু সয়ীদ আইয়ুব সম্বন্ধে আর এক প্রাজ্ঞ চিন্তাবিদ ও গবেষক শিবনারায়ণ রায়ের লেখা থেকে তুলে ধরা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। শিবনারায়ণ আইয়ুব ও তাঁর বিদুষী সহধমির্ণী গৌরী আইয়ুবের সখ্য ছিল। তিনি অন্তরঙ্গ আলোকে আইয়বুকে আবিষ্কার করেছেন। তাঁর সম্বন্ধে শিবনারায়ণের ভাষ্য কেমন ছিল, তা প্রথমে দেখা যেতে পারে। তিনি বলেন—’রবীন্দ্রনাথ বিগত হবার পরেও যে অল্প কয়েকজন মনীষীর সান্নিধ্য বাংলার রেনাসাঁসকে আমার চেতনায় প্রত্যক্ষ করে তুলেছিল, আবু সয়ীদ আইয়ুব তাঁদের একজন।’
আবু সয়ীদ আইয়ুব মধ্য জীবনে দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হলেও তাঁর সাহিত্য সাধনা , পঠন-পাঠন আর সাহিত্য আর সাহিত্যালোচনায় ছেদ পড়েনি। আইয়ুবের মাতৃভাষা বাংলা না হওয়া সত্ত্বেও তিনি বাংলাভোষায় সৃজনশীল সাহিত্যকর্মে একনিষ্ঠ সাধক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন আপন চিন্তাচেতনায়। শিবনারায়ণ রায় আবু সয়ীদ আইয়ুবকে সৌম্য প্রমিথিউস আখ্যায় আখ্যায়িত করেছেন।
ভারতীয় কম্যুনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা ও পরবর্তীকালে মৌল মানবতন্ত্রী দর্শনের মূল প্রবক্তা মানবেন্দ্রনাথ রায়ের সঙ্গে আইযুবের সখ্য ছিল। চল্লিশ দশকের শেষার্ধে মানবেন্দ্রনাথ রায় ও তাঁর স্ত্রী এলেন গিটশাখকে নিয়ে শীতকালে কলকাতায় আসতেন। শীতকালের সন্ধ্যায় নিয়মিত সুশীলকুমারের থিয়েটার রোডের ফ্লাটে আড্ডা বসত। সেই আড্ডায় আসতেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ও তার স্ত্রী রাজেশ্বরী, আইয়ুব, শিবনারায়ণ এবং মানবেন্দ্র রায়। সেই আড্ডায় সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস, বিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব, রাজনীতি, ধনবিদ্যাসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হতো। সেখানে আইয়ুব ছিলেন সুরায় বীতরাগ, খাদ্যে নিস্পৃহ, কিন্তু আলোচনায় প্রাণবন্ত।
আইয়ুবের প্রথম প্রবন্ধ ‘বুদ্ধি বিভ্রাট ও অপরোক্ষানুভূতি’ প্রকাশিত হয় সুধীন্দ্রনাথ দত্তের পরিচয় ত্রৈমাসিক পত্রিকায়। তাঁর প্রথম প্রবন্ধ সম্বন্ধে তিনি ভারত বিচিত্রা পত্রিকায় (১৯৭৭) যা বলেছিলেন, তা এখানে তুলে ধরা যেতে পারে। তিনি বলেন—’খুব খেটে বাংলায় প্রথম প্রবন্ধ লিখলাম ‘বুদ্ধি বিভ্রাট ও অপরোক্ষানুভূতি’। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের মুখে প্রবন্ধটি শুনে রবীন্দ্রনাথ খুব প্রশংসা করেছিলেন। তারপর পরিচয়, কবিতা, চতুরঙ্গ ও অন্যান্য পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখতে শুরু করলাম।
প্রসঙ্গত বলা যায়, আবু সয়ীদ আইয়ুবের লেখা ‘কাব্যের বিপ্লব ও বিপ্লবের কাব্য’ পড়ে প্রমথ চৌধুরী উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। আইয়ুবের সম্পাদনায় ১৯৫৩ সালে ‘পঁচিশ বছরের প্রেমের কবিতা’ প্রকাশিত হয়। আইয়ুব তার আগেই বাংলা সাহিত্য জগতের সাথে ভালোভাবেই সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে বলতে হয় আইয়ুব ১৯৪০ সালে হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধায়ের সঙ্গে ‘আধুনিক বাংলা কাব্য’ প্রথম সংকলন করেন। এই সংকলন সম্বন্ধে আইয়ুব এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ বইটির ভূমিকা পড়ে খুব খুশি হয়ে আমাকে ডাকেন এবং বলেন, ‘মনে হয় তুমি আধুনিক কবিদের মনের কথাটি ধরতে পেরেছ, আমাকে বুঝিয়ে বলো দেখি কথাটি কী? আমার সব কথা চুপ করে শোনেন। ’ মনে হয় রবীন্দ্রনাথের এই অনুপ্রেরণাই পরবর্তীকালে আবু সয়ীদ ‘আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ’ নামের মূল্যবান গবেষণা গ্রন্থ লিখতে আগ্রহী হন|