শিশু-কিশোরদের চলমান আন্দোলন একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এই ইতিহাস পৃথিবীতে বাংলাদেশেই প্রথম। শিশু-কিশোরদের এই আন্দোলনের ফলেই জাতির কাছে উন্মোচিত হয়েছে চরম দোর্দণ্ড প্রতাপের হাজার হাজার প্রাণহরণকারী পরিবহন সেক্টরের অনিয়মের বেসাতি। এই নিয়ম একদিনে সৃষ্টি হয়নি। একক কোনো ব্যক্তি দ্বারাও সৃষ্টি হয়নি। এই অরাজকতা সৃষ্টির পেছনে ফুটপাতের মাস্তান থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের বড় বড় নেতার অনেকেই জড়িত। বলা যায়, তাদের জন্যই এই অরাজকতা সৃষ্টি হয়েছে, যার সংশোধন করা খুব সহজ নয়। স্বল্প সময়ে তো সম্ভব নয়ই। এত বড় একটি অর্থনৈতিক খাতকে অবহেলা করারও কোনো সুযোগ নেই।
নির্বাচনের আগে প্রতিটি সরকারই রেলের উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে। কিন্তু রেলের উন্নয়ন কোনো সরকারই করতে পারছে না, যার পেছনে সড়ক পরিবহন প্রধান বাধা। অবশ্যই সড়ক পরিবহন অবজ্ঞা করারও উপায় নেই দুটি কারণে। একটি নেতাদের আয় কমে যাবে, দ্বিতীয়টি বড় জনসংখ্যা। এই সেক্টরে নিয়োজিত যাদের উপার্জনে, তাদের একটি বড় সংখ্যার জীবনজীবিকা নির্ভর করছে এখানে। ফলে আইন দ্বারা এর সমাধান সম্ভব নয়। জ্বরের চিকিৎসা করলে হবে না, জ্বরের কারণের চিকিৎসা করতে হবে। আইনের পাশাপাশি শক্তিশালী নীতিমালাও থাকা প্রয়োজন, যে নীতিমালার মাধ্যমে পরিবহন সেক্টরের কিছু সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হতে পারে, যদি সরকার সক্রিয় হয়।
এই নীতিমালায় যেসব বিষয় স্থান পেতে পারে তা হলো: ১. পরিবহন শ্রমিকদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ (কমপক্ষে তিন বছর); ২. তাদের বোনাস, গ্রাচুয়িটি, ইনক্রিমেন্ট এবং বাধ্যতামূলক সেভিং স্কিম বা প্রভিডেন্ট ফান্ড নিশ্চিত করা। ৩. সকল প্রকার চাঁদাবাজি বন্ধ করা (যদিও কেয়ামতের আগে সম্ভব না, তবু নীতি হিসেবে থাকতে হবে)। ৪. কর্মঘণ্টা সুনির্দিষ্ট নির্ধারিত থাকা এবং অতিরিক্ত কর্মঘণ্টার জন্য ওভারটাইম দেওয়া। ৫. চিকিৎসা ভাতা দেওয়া। ৬. প্রতি ৬ মাস পরপর রক্ত পরীক্ষা করে মাদকসেবী কি না, তা নিশ্চিত হওয়া। ৭. চাকরি দেওয়ার সময় রক্ত পরীক্ষা করে মাদকসেবী কি না, তা নিশ্চিত হওয়া এবং তদরাকি কমিটিতে জমা দেওয়া। ৮. ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়া। ৯. কারখানা আইনের মতো আইন থাকা এবং সে আইন অনুযায়ী শ্রমিকদের আইনগত ডিসপুট মীমাংসা করা। ১০. কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে দ্রুত ট্রাইব্যুনালে বিচার করা। ১১. কার্ড সিস্টেমে যাত্রীদের পরিশোধ করার ব্যবস্থা করা, যেন চালকদের প্রতি কোনো সন্দেহ না দেখা দেয়। ১২. বাসস্ট্যান্ডগুলো থেকে মাস্তান বিতাড়ন করা। ১৩. পরিবহনের জন্য আলাদা অধিদপ্তর করা। ১৪. গাড়ির পাশাপাশি চালকদের জীবনবীমা বাধ্যতামূলক করা। ১৫. ড্রাইভার ও হেলপারদের চাকরি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মনস্তাত্ত্বিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং বাধ্যতামূলক করা।
সর্বোপরি এর মাধ্যমে দুর্ঘটনার ভয়াবহতা আর করুণ চিত্র বোঝানোসহ কোন কোন অবস্থায় এবং কী কারণে দুর্ঘটনা হতে, পারে তা বুঝতে দেওয়া। তবে বুঝতে হবে, পরিবহন শ্রমিকরা বাইরে কেউ নন। তারাও এদেশের নাগরিক এবং সকল প্রকার নাগরিক সুবিধা পাওয়ার অধিকার রাখেন।