বিনয়
নবীগঞ্জ এসে বাস থামলো সকাল সাতটায়। বৃষ্টিভেজা বাতাসে চারপাশ ঠাণ্ডা। এমন বাতাস বুক ভরে নেওয়ার পর প্রতিদিন ভোরে ওঠার লোভ হয়। যদিও ওটা সম্ভব নয় আমার পক্ষে। চমৎকার সকাল। কিন্তু তার চমৎকারিত্ব কেমন পর লাগছে। রাস্তাঘাট অপরিচিত ঠেকছে। একটু পরই আর এমন অচেনা থাকবে না। তবে আপন লাগবে কি না, তাও বলতে পারি না। সকাল যখন শুরু হয়ে গেছে, আমি আর মিতালি তার সঙ্গে সুরেলা হবো। দুজনই একই তাড়না অনুভব করছি এ মুহূর্তে। তা হলো, চাই চমৎকার এক কাপ চা।
কাঁধে গামছা ফেলে দশ বারো বছরের একটা ছেলে কাচের কাপ ধুয়ে পরিষ্কার করছে। ছেলেটার ঠোঁটে মৃদু হাসি। ছেলেটার হাসি হাসি মুখ আমার মনে আঁকা হয়ে থাকলো। আমাদের থামতে দেখে ও চোখ তুলে তাকালো। চোখ দুটো বেশ সুন্দর।
-ঢাকা থেকে আসতেছেন?
-বাস দেখে চিনলে?
-না, মানুষ। ঢাকার মানুষ বোঝা যায়। রহমপুর যাবেন?
-তুমি তো খুব বুদ্ধিমান!
দোকানের পেছনটা খোলা। একটা ঝাঁপের নিচে চেয়ার পেতে বসে আছে এলাকার বয়স্ক কিছু মানুষ।
-রহমপুরের কই? খনখনে গলায় বললো একজন।
-জেলেপাড়া।
নানা রকম পোশাক সবার পরনে। একজনের পরনে জোব্বা। লোকটা ঈমাম বা এমন ধরনের কেউ। চোখে সুরমা। চোখাচোখি হতেই ভদ্রলোক ভদ্রতাসূচক হাসলেন।
-যান, দেখে আসেন।
বাতাস আগের চেয়ে শীতল। টিপ টিপ বৃষ্টি কখন থেমে গেছে খেয়াল করিনি। ‘হিন্দু মানুষ’ বিনয় হয়তো আমার উত্তরে আবারও ঠা ঠা করে হেসে বলার অপেক্ষায় আছে, ‘আমি জানতাম আপনি কী বলবেন।’
চায়ে চুমুক দিতে দিতে দোকানের সাজসজ্জা দেখছি, এমন সময় পেছন থেকে কেউ কথা বলে উঠলো।
-জেলেপল্লী গেলে আমার ভ্যানে উঠতে পারেন।
মঞ্চে বিনয়ের আগমন।
রংপুরের আঞ্চলিক টান পুরোপুরি নেই ওর কণ্ঠে। আছে ঢাকার শহুরে একধরনের দৃঢ়তা। লালচে চোখ নিয়ে একটা রিকশাভ্যানের চালকের সিটে বসে আছে। গায়ের রঙ শ্যামল। পরনে সবুজ টি-শার্টটা বেশ পুরনো। রগওঠা শক্ত হাত। হাসার মতো ভঙ্গি করলো। চোখের শান্ত দৃষ্টি একটা সন্ন্যাসের আলো ছড়াচ্ছিল।
-বেশ, আপনার ভ্যানেই উঠবো। আপনিই একমাত্র আমাদের ডাকলেন।
কথাটার প্রয়োজন ছিল না তবু বলে ফেললাম। সত্যি বলতে, একটা ব্যাপারে একটু অবাকই হয়েছি। বাস থেকে নামার প্রায় ছয় সাতজন ভ্যানচালক দেখেছি, আমাদের দেখে নিজেদের ভেতর কথা বলাবলি করছিল। কেমন যেন মনে হচ্ছিল আমরা কোথাও অনধিকার প্রবেশ করেছি।
রাস্তার উল্টোদিকে একটা জাতীয় পার্টির অফিস। দরজা জানালা সব বন্ধ। এত সকালে বন্ধ থাকাই স্বাভাবিক। তবু মনে হলো অনেকদিন এই ঘরটা বুঝি খোলা হয় না।
-চা খাবেন আপনি?
-জি না ভাই।
-খাননা এক কাপ।
চা’টা ভালো ছিল। বোধ হয় পাতা ছাড়া হয়েছে বেশিক্ষণ হয়নি। কাঁচা পাতার একটা সতেজ সৌরভ মনকে কেমন প্রবোধ দিতে চাইলো। ভয় নেই, এগিয়ে যাও।
মিতালি কী ভাবছে?
আশপাশের কারও দিকে ওর চোখ না থাকলেও অনেকগুলো চোখ ওকে দেখছে। ওর পিঠে ক্যামেরার ব্যাগ। কাঁধে ট্রাইপড। হয়ত আমার মতোই খানিকটা বিব্রত। কিন্তু মনের ভাবটা আড়াল করে রাখতে চাইছে।
একটু পেছন ফিরছি।
এ বছর দুর্গা পূজার আগে তেমন কোনো গণ্ডগোল হচ্ছিল না যেমনটা বরাবর হয়। বাংলাদেশে পূজার আগে আগে প্রতিমা ভাঙা তো নিয়মিত। এবার তেমন খবর না পেয়ে ভেবেছিলাম এ বছর বোধয় পূজাটা ভালোয় ভালোয় যাবে।
কী নাইভ আমি!
ঘটনাটা ঘটল সপ্তমীর দিন রাতে। এমন একটা ঘটনা ঘটানোর অপেক্ষায় ছিল অসুরেরা আমি ভাবতেই পারিনি। কুমিল্লার কান্দিরপাড়লগ্ন উপশহর নিশানদীঘা। ওখানে এক পূজামণ্ডপে কারা যেন সিংহাসনে আসীন দুর্গার কোলের ওপর কোরান শরিফ রেখে এলো। আর ছবি তুলে ফেসবুকে ছড়িয়ে দিলো, নিশানদীঘার পূজামণ্ডপে চলছে কোরান অবমাননা।
প্রবাদ আছে, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। তেমন দমকা বাতাসও দরকার হয় না। মৃদু বয়ে গেলেই হলো, কলটা এতই টলায়মান। তাই হলো। গোটা প্লটটা সব দিক থেকে এত কাঁচা, তবু পরিকল্পনা মতো এগোতে অসুরদের কোনো বাধাই পেতে হলো না।
স্তম্ভিত আমাদের সামনে গোটা দেশে নিম্নবর্গীয় হিন্দুপ্রধান গ্রাম আর সমাগমময় মণ্ডপগুলো বিপর্যস্ত হয়ে পড়লো। তথাকথিত মুসলমানদের হামলা কুমিল্লার পর আর্ত করে তুললো সিলেট গাজীপুর, মুন্সীগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, বান্দরবান, কক্সবাজার, বগুড়া, চাঁপাই, রংপুর।
মানুষ মরলো।
লোকালয় পুড়ে গেলো।
বাজার ছাই হলো।
মণ্ডপে মণ্ডপে মুখ থুবড়ে পড়ল দেবী দুর্গার কবন্ধ প্রতিমা।
আনন্দের দিনগুলো চোখের জলে ভিজে গেল। আর রক্তে। বাংলাদেশে এমন নির্যাতনের খবর তো দেশের গণ্ডিতে চাপা থাকলো না। পশ্চিমবাংলায় বাংলাদেশের পতাকা দলিত করা হলো। আর আসামে ত্রিপুরায় তথাকথিত হিন্দুরা চড়াও হলো গরিব মুসলমানদের ওপর।
ভারত বাংলাদেশের শুভবুদ্ধির সমস্ত মানুষ বোঝে ধর্মের মুখোশের আড়ালে এসমস্ত হামলা ঘোর পলিটিকাল। ব্রিটিশ প্রভুর পায়ের তলে এই ম্যালপলিটিক্সের ঘোলাজলে বাংলার গড়মূর্খ মানুষ বহু আগে ডুবে মরেছে। আর সেই থেকে প্রেতলোকে ওদের চালিত করছে মূর্খের গণতন্ত্র। যে তন্ত্রের তন্তুগুলো রাজতন্ত্রের উচ্ছিষ্টে তৈরি।
তবু, যখন বাংলাদেশের মতো একটা দেশের জন্ম হতে পেরেছিল, মানুষ তো আশা দেখেছিল।
টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। চা শেষ। ভ্যানে ওঠার আগে চালককে বললাম, ভাই, আমি হাসান। আপনার নাম?
বিনয়। তারপর মার্জিত চাপা স্বরে বললো, হিন্দু মানুষ।
বিনয় হাসলো। ওর হাসি দেখে কেন মনে হলো ও কাঁদছে?
এই ‘হিন্দু মানুষ’ কথাটা নানান অর্থ নিয়ে আমার সামনে এলো এবং মনটা ব্যথায় কালো হয়ে উঠল। বিনয় কি জেলেপাড়ার মানুষ? ওর বাড়িতে কি হামলা হয়েছে? জেলাপাড়ার ছেলেমেয়েরা সবাই কিন্তু আর পূর্বপুরুষের পেশায় নেই। এই নতুন সময়ে নতুন অর্থনীতি তাদের ধারা বর্জন করে রাধা অর্জন করতে শিখিয়েছে। হতে পারে বিনয় তাদের একজন।
আমি বললাম, বিনয়, আপনার বাড়ি কি জেলেপাড়ায়?
বিনয় নীরব।
-বললেন না?
-কালকে শিরিন ম্যাডাম আসছিলেন, বিনয় বললো। সাথে আরও বড় বড় সব মানুষ। সব ঘুরে ঘুরে দেখলেন।
শিরিন ম্যাডাম, বেশ। নবীগঞ্জ ওনার এলাকা। এ মুহূর্তে তিনি এলে মানুষ ভরসা পাবে সন্দেহ নেই। বিশেষ করে নিম্নবর্গীয় মানুষেরা। যদিও সেই ভরসা নিতান্তই আত্মিক এবং সাময়িক, সময়ে সাময়িকতারও প্রয়োজন আছে। কিন্তু আমাকে তার আগমন প্রভাবিত করতে পারল না। প্রভাবিত করল এই তরুণের শান্ত মুখ, নীরবতা, আর ওর মুখে স্বাচ্ছন্দ্য শিরিন ম্যাডাম ডাক।
ওর আচরণে শুরু থেকেই একটা বেমানান সপ্রতিভ ভাব মানানসই রকম সাবলীল। এর রহস্য কী।
আমার মনে হলো এই তরুণ ঢাকায় ছিল এবং সেখানে একটা ঘটনাবহুল সময় যাপন করে এসেছে। ওর দশ দুনিয়া আর দশ আনন অনেকটাই খোলা।
বললাম, আপনি ঢাকায় ছিলেন বিনয়?
-জি।
-কোথায় ছিলেন?
-ফ্যান্টাসি কিংডমে কাজ করতাম। সিকিউরিটি। বললো বিনয়।
এরপর অনেকটা কথা সে নিজেই বলে গেলো।
-তখনো দিন ভালো ছিল আমাদের। ভালো দিন বলতে, বেতন নিয়ম করে পেতাম, ওখানে ভালো থাকতাম। খারাপ খাই নাই। বাড়িতে মানে এখানেও খারাপ পাঠাই নাই। তারপর করোনায় খারাপ দিন আসলো। মালিকের ব্যবসা পড়ে গেল। আমার চাকরিটাও গেল। এদিকে আমার পড়ল অসুখে। ভাইবোন দায়িত্ব নেওয়ার মতো আর কেউ নাই। মা বললো চলে আয়। যাই হোক একসাথে থাকি, একসাথে বাঁচি। চলে আসলাম। ভাই!
-বলুন বিনয়।
-আমার মনে দুটা প্রশ্ন আছে। মনে হয় আপনাকে করতে পারি।
-নিশ্চয়ই। মারেন গুলি।
বিনয় হাসল, আচ্ছা, দেশ কি স্বাধীন?
ভ্যানটা ভাঙা রাস্তায় ঝাঁকুনি খেল। মিতালির ক্যামেরার ব্যাগ পড়ে যায় যায়। খপ করে ধরে ফেলল। আর আমি ধরলাম মিতালিকে। বিনয়ের পিঠ স্থির। ভ্যানের মটর চলছে। দুপাশে পেরিয়ে যাচ্ছে ধানক্ষেত, পাড়াবন, একটা দুটো বাড়ি।
আমি চমকিত। ঠিক শুনেছি? ঠিকই শুনেছি।
ছেলেটা অন্যরকম। আর আজ বোধয় এই অন্যরকম দিনে বাঁকানো কিছু বাস্তবতার সামনে দাঁড়িয়ে ঘুরেফিরে কিছু অন্যরকম মানুষের সাথেই আমার দেখা হবে।
বিনয় হঠাৎ ভ্যানের গতি কমিয়ে দূরে হাত তুলে বললো, ওইখানে একটা দহ। বিরাট। আপনাদেরকে নিতে পারলে দেখতেন। তার পাড়ে মেলা বসে। আমি দূরে তাকিয়ে কোনো দহের ঝিলিক দেখতে পেলাম না। বরং বন আরও নিবিড় হয়েছে।
-বিনয়, আপনার প্রশ্নের উত্তর আমি জানি। হ্যাঁ, দেশ স্বাধীন।
বিনয় মুখ ঘুরিয়ে হাসলো, আমি জানি আপনি এইটাই বলবেন।
মনে হলো বিনয়ের কাছে নিজেকে তুচ্ছ প্রমাণ করছি আমি। মিতালির দিকে তাকালাম। ওর চোখ হাসছে। বললো, বিনয় আমি আপনার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি। দেশ স্বাধীন। তবে অনেকেই সেটা জানে না।
বিনয় বললো্, আচ্ছা। আপা ভালো বলছেন। অনেকে জানে না, কিন্তু আসলে দেশ স্বাধীন। ওর কণ্ঠ হাসছে।
-হ্যাঁ। মোটের ওপর বলতে গেলে এটাই।
-তাইলে আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন। আমরা হিন্দুরা কি দেশের নাগরিক?
ভ্যানের গতি হঠাৎ বেড়ে গেছে। দুপাশে সাঁ সাঁ করে সরে যাচ্ছে পথের ধারের যত আঁচিল ওঠা কাঁঠাল গাছ আর সারসার আকাশমণি। মাঝে মাঝে একেকটা ভুতুড়ে আমগাছ কোত্থেকে উদয় হচ্ছে কে বলবে। বাতাস আগের চেয়ে শীতল। টিপ টিপ বৃষ্টি কখন থেমে গেছে খেয়াল করিনি। ‘হিন্দু মানুষ’ বিনয় হয়তো আমার উত্তরে আবারও ঠা ঠা করে হেসে বলার অপেক্ষায় আছে, ‘আমি জানতাম আপনি কী বলবেন।’
হঠাৎ দুইজন আমার হাত আর পা ধরে তুলে ফেলল। ছুড়বে এমন সময়ে আমি শুনলাম কে জানি চিৎকার করে উঠল। ‘জানে মারবেন না বড় ভাই, আল্লার দোহাই! জানে মারবেন না!’
মনে হলো বিনয় যখন আশুলিয়ায় ছিল তখন বোধয় ওর জীবনে বাঁক বদল করা কিছু সঙ্গ এসেছে। না কি সব আমার শহুরে মধ্যবিত্তের চিন্তাপথের স্টেরিওটাইপ। গড় মানুষকে আমিও হয়ত স্রেফ দম দেওয়া কথা বলা পুতুলের মতোই মনে করি যেমনটা মনে করে বাংলাদেশের রাজনীতিকেরা।
রংপুর বিপ্লবীদের জায়গা। এখানে তেভাগার দিনের স্মৃতির আগুনে মানুষ এখনো আঁচ পোহায়। আমি হয়তো আমার কোনো বন্ধুকে বিশ্বাসই করাতে পারব না এখানে বিনয় নামে এক দিনমজুর ভ্যানচালক আমাকে এমন দুটো প্রশ্ন করেছে। যাদের উত্তর হাওয়ায় উড়ে গেছে।
মিতালি বললো, আমি ওনার প্রশ্নগুলো নিতে পারছি না। ও আবেগী হয়ে পড়েছে।
-উত্তরটা দাও। আমাকে বলে ও নিজেই উত্তর করলো। সেই একই উত্তর ও নিজেই যেটা বহন করতে পারছে না।
-বিনয় শুনুন। আপনারা দেশের নাগরিক। তবে অসুররা সেটা জানে না। কিন্তু একটা কথা মনে রাখবেন তা হলো, কিচ্ছু যায় আসে না তাতে। ওদের সুর নষ্ট হয়ে গেছে। ওরা বাঁচবে না বেশিদিন। আর যদি বাঁচে একদিন জানবে।
পথের দুপাশে অসংখ্য শরণার্থীরূপী মানুষদের পাশ কেটে কেটে আমাদের ভ্যানটা ক্রমশ আখিরা নদীর দিকে চললো। টিপটিপ বৃষ্টি আবার পড়তে শুরু করেছে। বাতাসে একটা নষ্ট ছাইপাশ গন্ধ। টিপটিপ বৃষ্টি ঘরপোড়া সেই গন্ধকে আরও ঘনিয়ে তুলছে।
ছিপছিপে নদীটার ধারে বিনয়ের ভ্যান থামলো। এখান থেকে সার ধরে পূর্বপশ্চিম চলে গেছে রহমপুর জেলেপল্লী। তখনো জানি না, এই পল্লীর পশ্চিমে এক পুরোহিতের কাছে আমরা এমন এক বিবরণ শুনবো যেটা একাত্তরের কথা মনে করিয়ে দেবে।
পুরোহিত
করিমপুরের যে রাধাগোবিন্দ মন্দিরটা আছে, ওখানকার তাণ্ডবের ভেতর খানিক বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। প্রতিমাগুলো ভেঙেছে, যথারীতি। বিরাট এক ঢাক ছিল, তুবড়ে ভেঙে পড়ে আছে মেঝেতে। আরও বহু ভগ্নাবশেষ ছিল, কিন্তু সরিয়ে ফেলা হয়েছে। ইনফ্যাক্ট ভাঙা প্রতিমাও মণ্ডপলগ্ন পাশের ঘরে গিয়ে আমাদের দেখতে হলো।
মিতালি কিছু স্ন্যাপ নিলো। কিন্তু লাইট আর অ্যাঙ্গেল খাপ খাচ্ছিল না। আবার নিজের মতো সাজিয়ে নেওয়ারও উপায় নেই। ওর মুখে একটা নিরুপায় হাসি। শেষে আমরা বাইরে বেরিয়ে এলাম।
ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টির ভেতর গোলগাল মুখের এক ভদ্রলোক আমাদের পথ দেখিয়ে তার বাড়ি নিয়ে গেলেন। পরনে সাদা ধুতি আর গেরুয়া ফতুয়া। শ্যামলা গায়ের রঙ। কামিয়ে নেওয়া মাথার পেছনে টিকি। বিশেষ লক্ষ্মণীয় তার চোখ দুটি। এমন টলটলে, যেন জড়িয়ে ধরেলেই কেঁদে ফেলবেন। তিনিই যে এই রাধাগোবিন্দ মন্দিরের পুরোহিত তা জানলাম তার দাওয়ায়ে গিয়ে বসার পর। তিনি উঠানের এক কোণে একটা খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে ঝুঁকে কথা বলছিলেন। খুঁটিটা তার মনের অবলম্বনের মতো ছিল।
-কোনো ধর্মে কি এমন লেখা আছে বাবা? আমার কিন্তু জানা নাই।
তিনি যেন আমাদের প্রতিউত্তর শোনার অপেক্ষায় আছেন এমনভাবে তাকিয়ে রইলেন। তার মুখের গড়ন আর উত্তরের আশায় এমনি করে তাকিয়ে থাকাটা অবিকল আমার বন্ধু অরবিন্দ চক্রবর্তীর মতোন। মনে মনে বললাম, কাকা, আপনি পুরোহিত, আপনি একটা কথা হয়ত খুব ভালো করে জানেন, ধর্ম সূক্ষ্ম। ধর্মে এমন অনেক কথা আছে যা থেকেও নেই। এমন অনেক কথা নেই যা নেই বলেই আছে।
-জীবনে কারো কোনো ক্ষতি করেছি, কোনো ধর্মকে অসম্মান করেছি এমন কোনোদিন কেউ বলতে পারবে না বাবা। তারপরও আমাদের উপর এই শাস্তি নামি আসল কেন? আমি এর কোনো তল পেলাম না।
বাড়ির ভেতর থেকে তার স্বজনেরা এসে দাঁড়ালো।
-যুদ্ধের সময় এমন হয়েছে, সেই একাত্তর সালে। আমার বাপ দাদারা ভুগেছে সেই সময়। তখন যা যা হয়েছে, আজ এতো বছর পর স্বাধীন দেশে আমাদের সাথে আবার ঠিক তাই তাই হইলো বাবা। সুযোগ মিললেই এমন হয়। একেবারে কোনো অমিল নাই। আমরা কি এই দেশের মানুষ না?
বিনয়ের সহজ প্রশ্নটাই এলো।
-বুকের ভেতর কেমন ভয় ঢুকি গেছে বাবা বুঝায় বলতে পারি না। এই দু চোখের পাতা এক করতে পারি না সেই রাত থেকে আজ পর্যন্ত। চোখ বুজলেই আগুন। চোখ বুজলেই নারায় তাকবির।
-কী হয়েছিল একটু বলতে পারবেন?
-ঈশ্বর আমি কিভাবে তার স্মৃতি জাগাতে চাইতে পারলাম?
-আপনারা শুনতে আসছেন, আমি বলবো।
সেদিন আগে একবার মাইকিং করে এমাথা ওমাথা ওরা বলে গেছে এরকম- কয়েকঘর হিন্দুর কী করে এতো বড় সাহস হয় আমাদের ধর্মের অবমাননা করে, মুসলিম ভায়েরা এক হও।
-আমি ভাবি কী হইলো। এর ভেতর বিদ্যুৎ চলে গেল। তখন শুনি অনেক মানুষ এক হয়ে চিৎকার করতে করতে ঘরে পাড়ায় ঢুকছে। একেক বাড়িতে ঢোকে আর মানুষের চিৎকার, আগুন। কোনো হিন্দু ঘর থেকে বের হবে না খবরদার। সবকটাক মেরে ফেলব।
-সবাই ঘরে থেকে গেলেন?
-ভয় পেয়েছিলাম। ঘরে বাচ্চারা আছে মহিলারা আছে, কী করি। প্রথমে সবাই ঘরে থাকলাম। কিন্তু যখন একেকটা ঘরে মানুষের চিৎকার, মারপিট চলছে, তারপর আগুন দিতে থাকল, সবাইরে বললাম, ‘দৌড়ে গিয়ে ধানক্ষেতে লুকাও।’ বউ ছেলে মেয়ে এটা ওটা নিয়ে যেতে চাচ্ছিল বললাম, ‘আগে জীবন বাঁচুক, তারপর ওইসব দেখা যাবে। আমি থাকব, কিছু হবে না, তোমরা যাও।’ অনেক অনুনয় বিনয় করার পর ওরা গেল। ততক্ষণে আমার উঠানের দরজায় ওরা চলে এসেছে। দমাদম বাড়ি, ‘এই ঠাকুর বাড়িতে আছিস?’ একজন বলল, ‘এইখানে এক নম্বর হিন্দু। দরজা ভাঙ!’ পলকা টিনের দরজা। আমি খুলে দেওয়ার আগে ওরা ভেঙে ঢুকলো।
-কয়জন হবে অনুমান?
-ত্রিশ-পয়ত্রিশ জন।
-চিনতে পারলেন কাউকে?
-না। কালো কাপড়ে নাকমুখ ঢাকা। মাথায় কালো টুপি। হাতে মশাল। এসে ঢুকে প্রথমে একদল গেল ঘরের ভিতরে। তছনছ করতে শুরু করল। সাথে অশ্রাব্য ভাষা। হাতে দা শাবল ছিল, সব ভাঙতে শুরু করল। দেয়াল, চেয়ার টেবিল, সিন্দুক। সব লুটপাট শুরু করে দিলো। আর নারায় তাকবির, আল্লাহু আকবর।
একটা দল তাঁকে ঘিরে ধরল, শুরু করল মার।
-আমি সামনের জনার পায়ে ধরলাম। বললাম, তোমরা আমার ছেলে, তোমরা কী করতেছ এগুলা। তোমরা আমাদের ছাড়ে দাও। আমি হাত জোড় করলাম। একজন আমার আমার গোয়াল থেকে একটা শাবল নিয়ে আসল। আমাকে গেঁথে ফেলবে।
আমি নিজের নৃশংসতায় নিজেই স্তব্ধ হয়ে গেলাম। কিন্তু তখন আর ফেরার পথ নেই। আমি জানি এসব কথা কেউ না শুনলে হয়তো চিরতরে হারিয়ে যাবে একদিন। কেবল কোনো পারিবারিক সন্ধ্যায় চলবে যেমন একাত্তরের স্মৃতি।
-প্রথমে শাবল তুলে আমাকে গেঁথে ফেলতে গেলো। কিন্তু আমার গায়ে লাগল না। লাগলো বুকের একপাশে।
ভদ্রলোক জামা সরিয়ে দেখালেন। একটা লম্বা গভীর ক্ষত। ক্ষতের ভেতর কাঁচা লাল।
-ঘরের ভেতরে যারা, তারা ততক্ষণে আমার সিন্দুক জাজিম সব বাইরে ছুড়ে ছুড়ে ফেলছে। সব এক করছে আগুন ধরিয়ে দেবে। ততক্ষণে আগে যা টাকাপয়সা ছিল সব লুট করে নেওয়া শেষ।
পূজা চলে। ঘরে কুটুম। পূজায় খরচের জন্যে নিজেদের জমা ছিল কিছু টাকা, কুটুমদের আনা টাকা মালামাল, সব ওরা নিলো।
-সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেলাম আমার মেয়ের টাকাটা নিয়ে গেলো যখন।
-মেয়েও এসেছিল বেড়াতে?
-না। মেয়ে বেড়াতে আসে নাই। সে ছিল শ্বশুর বাড়ি। কিন্তু আগের দিন এসে ওর অনেক দিনের জমা কিছু টাকা বাড়িতে এসে রেখে গেছিল। আমার হাতে দিয়ে বলেছিল, ‘এইখানে আমার জন্য একটা ধানি জমি রাখিও বাবু।’ আমি ওর টাকাটা নিয়েছিলাম, যে পূজার পর খোঁজ করব জমির। তা আর হলো না। আমার মেয়ের না খেয়ে জমানো টাকা। ওরা নিয়ে গেলো।
-কত টাকা?
-পঁচানব্বই হাজার।
-ওরা সব জানে, মিতালি বললো।
-পূজার সময়। লুটপাটের জন্যে এরচেয়ে উপযুক্ত সময় আর কী হতে পারে? শুধু একটা উসকানির দরকার।
আমি থ হয়ে আছি।
সমাজের এই অংশের মানুষেরা এখনো বড় লেনদেন হাতেহাতেই করে থাকে। অনুমান, ব্যাংকগুলোর ওপর ওরা আস্থা রাখতে দ্বিধা। নিয়ত নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ভেতর এই প্রবণতা বেশি না কম, এ নিয়ে কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও সাদা চোখে বেশি বলেই মনে হয়। আর তার পেছনে সঙ্গত কারণ আছে কি নেই খুঁজে বের করতে নিপীড়ন আর বিতাড়নের খুব বেশি ঘটনা খোঁড়ার প্রয়োজন হয় না।
-উঠানে সব এনে এক করেছে, আগুন জ্বালায় দেবে। যে মুহূর্তে আমার নতুন একটা জাজিমখানা এনে ফেলল, আর পারলাম না। একটা ভালো জাজিম। পূজা, কুটুমেরা আসবে তাই টাকা জমিয়ে শখে বানানো। ওইটা যখন এনে ফেলল, আমি হাত তুলে দাঁড়ালাম। ‘বাবারা আগুন দিয়েন না আপনাদের পায়ে পড়ি। কী ক্ষতি করেছি আপনাদের আমি বলতে পারব না। কেউ যদি কোনো ক্ষতি করে থাকে, আমাদেরকে কেন শাস্তি দেন? আমরা তো চিরটাকাল মিলেমিশে আছি।’ আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে তেল ঢেলে আগুন জ্বালায়ে দিলো। আমার এই উঠান সূর্যের মতো জ্বলছে। হঠাৎ…
আমি চোখের দিকে তাকিয়ে আছি। চোখ দুটো অপমানে জলে ভরে উঠল। ঠোঁট কাঁপছে। খুব ইচ্ছে হলো উঠে তাকে জড়িয়ে ধরি।
-হঠাৎ একজন বললো, এ এক নম্বর হিন্দু, এরে আগুনের মধ্যে ফেল।
ভগবানকে বললাম, আমার বউ সন্তানকে রাখলাম তোমার হাতে। ধানক্ষেতটা তুমি পাহারা দিয়ো। আমার ছোট একটা মেয়ে, যদি বাবু বলে ছুটে আসে আর উপায় নাই। হঠাৎ দুইজন আমার হাত আর পা ধরে তুলে ফেলল। ছুড়বে এমন সময়ে আমি শুনলাম কে জানি চিৎকার করে উঠল। ‘জানে মারবেন না বড় ভাই, আল্লার দোহাই! জানে মারবেন না!’
আমার আর কিছুই বাকি নাই। একসময় আমি দূর থেকে হাত জোড় করে ক্ষমা চাই। ওরা বলে, ক্যান খালি আমার বেলায় ক্যান? কী পাপ করছিলাম ভগবানের কাছে?
ছোট মেয়েটার সেই রাতে জ্বর। জ্বর গায়ে সে সারারাত ভেজা ধানক্ষেতে ডুবে মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁপছিল। সঙ্গে জেলেপল্লীর আরো কত মানুষ। কেউ টু শব্দ করছে না। প্রার্থনা করছে মশাল হাতে ওদের কেউ যেন এদিকে চলে না আসে৷ প্রকৃতি ওদের প্রার্থনা শুনেছে। বিনিময়ে জেলের অবলম্বন সব জাল পুড়েছে। গরুগুলো বাঁধা ছিল, জ্যান্ত পুড়েছে। সে কি মা মা ডাক! ওই উঁচুতে উঠল আগুন। জ্যান্ত গাছের পাতাগুলো ঝরে ডালগুলো অঙ্গার হয়েছে।
-এই বাড়িতে আমি আর কোনোদিন চোখ বন্ধ করতে পারব না। এই দেশ যদি আমার না হয়, কোনটা আমার দেশ। আমরা তো এইখানে জন্মেছি এইখানেই বড় হয়েছি। তাহলে যাওয়ার সময় কেন বলে গেল ওই কথাটা?
কথাটা উহ্য থাক।
-যখন পাকসেনারা আগুন দিয়েছে তার একটা যুক্তি পেয়েছিলাম। ওরা বিদেশি। কিন্তু পরশুর যুক্তি কী?
পাশের বাড়িতে ওরা হয়ত লুকাতে পেরে ওঠে নাই। নবমীর রাত। কুটুমে ভরা বাড়ি। ওদের একটা মেয়েকে কাঁধে তুলে নিয়েছিল, নিয়ে যাবে। মেয়েটা কামড়ে ঝটকা দিয়ে অন্ধকারে পালিয়ে গেল। আরেকটা মেয়ে পালাতে পারে নাই। সে অন্য ঘরের।
পুরোহিত আবার অরবিন্দের মতো তাকিয়ে রইল, যেন কী শুনতে চায়। কারো ক্ষমতা নেই তাকে বলে।
মিতালীর পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন গৃহকর্ত্রী, তার চোখে জল। আমি বললাম, আমাকে একটু পানি খাওয়াতে পারেন? ভদ্রমহিলা ভেতরে চলে গেলেন। দাওয়ার খুঁটি ধরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পুরোহিত। আরো কত প্রশ্ন তার মনে সাগরের ঢেউয়ের মতো ভাঙছে। যাদের উত্তর আমার কাছে নেই।
আমরা পানি খেয়ে উঠতে না উঠতেই উঠানে সুবেশি কিছু মানুষ প্রবেশ করে ক্ষয়ক্ষতির কথাগুলো ছক কাগজে তুলে নিতে লাগলেন। বাড়ির মানুষগুলো ওদের দেখে খুশি হয়ে উঠেছে দেখতে পেলাম। সুবেশি মানুষগুলো একটা বেসরকারি সংস্থার লোক। হয়ত ওঁরা কোনো সহায়তা করতে চান। ঈশ্বর। তাই যেন হয়।
টিপ টিপ বৃষ্টি কখন বিদায় নিয়েছে। আমরা উঠে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে বললাম, আমি হাসান। আপনি?
-আমি রামশরণ গোঁসাই।
-রামশরণ কাকা, এই দেশ আপনাদের। এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই। এই ভিটা মাটি সব আপনাদের পূর্বপুরুষের। এবং তাদের স্মৃতি এই মাটিকে পবিত্র করে রেখেছে। এই পবিত্রতা কোনো শত চেষ্টাতেও কেউ কোনোদিন নষ্ট করতে পারবে না।
আমার এই অন্তসারশূন্য রেটোরিকে পুরোহিত ভদ্রলোক বিভ্রান্ত হলেন না। দুর্বল হেসে হাত জোড় করে বললেন, আপনারা ভালো থাকবেন। নিরাপদে থাকবেন।
পরিশিষ্ট
যখন বের হয়ে আসছি, পথের পাশে একটা আমড়া গাছের নিচে জুবুথুবু বসে থাকা এক বৃদ্ধাকে দেখে নমস্কার করলাম। বৃদ্ধার সঙ্গে অল্পস্বল্প কথা হলো। তার বিস্ময় কাটে না। এই রহমপুরের ছোট এই জেলেপল্লীতে তো কোথাও কিছু হয়েছে বলে তার জানা নেই, যার কারণে এমন ঘটতে পারে। তাহলে হঠাৎ এমন বিপর্যয় কোথা থেকে এলো, কেন এলো। কারা ছড়াল, কিভাবেই বা। জীবনে নাম শোনেনি এমন জায়গা থেকে মানুষ আসছে। রংপুর সদরে তার নাতিন থাকে, সেই জানে না সারারাত কী তাণ্ডব হলো, কিন্তু ঢাকা থেকে লোক চলে এলো। বৃদ্ধা মেলাতে পারেন না। শেষে হেসে বললেন, ও নাতি একটা কথা।
-দিদিমা বলেন।
-তোমরা কি মোসলমান?
আমি আর মিতালি পরস্পরের দিকে তাকালাম।
মিতালী বলল, আমরা মানুষ দিদিমা। আর তাই থাকতে চাই। আশীর্বাদ রাখবেন।
-আশীব্বাদ নাতিন। চূড়ামণি হও।
বৃষ্টির পর বৃষ্টি নামছিল, পথ হচ্ছিল পিচ্ছিল। সংবাদকর্মীরা ব্যস্ত ভীষণ। আর ব্যস্ত রেড ক্রিসেন্টের স্বেচ্ছাসেবীদের দল। বেলা বাড়তেই ওরা চলে এসেছে তাঁবু নিয়ে, খাবার নিয়ে। সার ধরে আসছে বিডিআর। বৃষ্টি থামলে মিতালী একজনের ছবি তুলতে গেলে সেই জওয়ান হাত তুলে নিষেধ করল। পাশের জওয়ান বলল, থাক না, তুলুক। বেলা আরও বাড়তেই রাজনীতির স্থানীয় চাঁদ সূর্যরা আসতে শুরু করল। তাদের সঙ্গে পুলিশ।
নবমীর রাতে যখন দাউদাউ আগুন জ্বলছে, লুটপাট চলছে, গ্রামের কয়েকজন সাহায্যের জন্য লোক সংগ্রহের আশায় লুকিয়ে পাশের গ্রামে চলে যায়। কারণ টেলিফোনে পুলিশের সঙ্গে কার্যকর কোনো যোগাযোগ করা যাচ্ছিল না। পাশের গ্রাম পিছপাড়া। সাহায্যপ্রত্যাশীদের লক্ষ ছিল পিছপাড়ার ধুপধুপিয়া বাজার। ধুপধুপিয়া বাজারে পা রেখে ওরা যেন চাঁদ পেল। বাজারের মধ্যমণি দুশো বছরের পাকুড় গাছটার নিচে নীল এক গাড়ি পুলিস নিশ্চল বসে আছে।
পুলিশ তাদের সাথে ঝামটে ওঠেনি। তবে ছড়ি হাতে তড়িঘড়ি পথও দেয়নি। সাদা রুমালে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বারবার ঘড়ি দেখছিল অসহায় ইন্সপেক্টর। বাজারে লোকজন তেমন ছিল না। সাহায্যপ্রত্যাশীরা কেবল দুঃসংবাদ পৌঁছে দেওয়া ছাড়া আর কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। পরে যখন আগুন নিভে গেল, লুটপাট শেষ হলো, আক্রমণকারীরা মিলিয়ে গেল হাওয়ায় আর ধানক্ষেত থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করল মানুষ, জেলেপাড়ার পোড়া কাঠ জ্বলা অন্ধকারে পুলিশ তখন আবির্ভূত হলো।
মন্দিরের পূর্বপাশে এক রাজনীতিকের সৌজন্যে শামিয়ানা টাঙিয়ে বিরাট বিরাট হাড়ি থেকে দৈত্যাকার কাঠের হাতায় খিচুড়ি দেওয়া হচ্ছে। মলিন ভেজা মানুষদের সারি ভেঙে যাচ্ছে বারবার। বেসরকারি ব্যাঙ্কের কর্মীরা হাতের সাদা পাতায় যাবতীয় ক্ষতির খতিয়ান নিয়ে ছাউনির নিচে মাথা বাঁচাচ্ছে। বাইরে ছোট ছোট শিশুরা কাদামাখা হাফপ্যান্ট নিয়ে সুড়ুৎ খাচ্ছে কাদায়। কী আনন্দ! আতঙ্কের সেই রাতের কোনো চিহ্ন ওদের চোখেমুখে নেই।
গোটা গ্রাম আমরা হেঁটে হেঁটে আমরা দেখে গেলাম। ভুগে নয়, কেবল দেখেই বিক্ষত আমাদের ভেতরটা আর নিতে পারছিল না। হৃদয় এতো ক্লান্ত হয়নি আর অনেকদিন। স্তব্ধতা কাটেনি যাদের এমন নারীরা হঠাৎ আমাদের দেখে চেতনায় আসছিল। হাত তুলে বলছিল, আমার বাড়িটা একবার দেখি যাও, দেখি যাও! আমার আর কিছুই বাকি নাই। একসময় আমি দূর থেকে হাত জোড় করে ক্ষমা চাই। ওরা বলে, ক্যান খালি আমার বেলায় ক্যান? কী পাপ করছিলাম ভগবানের কাছে?
আমরা চলে আসতে থাকি, আমাদের ওপর অভিশাপ বর্ষিত হতে থাকে।