একটি স্বাধীন দেশে বারবার মুক্তমনা মানুষ হত্যা দেশটির জন্য অশনি সংকেত বৈকি! হুমায়ন আজাদকে দিয়ে প্রগতিশীল লেখক সাহিত্যিকদের খুন শুরু। এরপর রাজিব-অভিজিৎ-ওয়াশিকুর—সব শেষে দীপন হত্যা বলে দেয়—এ দেশ মুক্তমনাদের জন্য নয়! এ সরকার যতই চিৎকার করুক, তারা প্রগতির পক্ষে, আসলে তা মোটেই নয়। যদি হতো তাহলে একটি প্রগতিশীল সরকারের আমলে এভাবে উপর্যুপরি খুন সংঘটিত হতো না। খুনিরা সশস্ত্র এবং সংগঠিত। তাদের পরিকল্পনা সুশৃঙ্খল। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় টিকতে না পেরে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে আত্মসমর্পণ করে। সে ক্ষতি আজও আমরা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। এখনো দেশে কোনো প্রগতিশীল কবি-সাহিত্যিক মাথা তুলে দাঁড়াতে গেলেই, তাকে খুন করা হয়। এর দ্বারা প্রমাণিত হয়—দেশ এখনো স্বাধীন হয়নি কিংবা স্বাধীনতা উপভোগ করার সময় হয়নি।
সরকার যদি ইচ্ছা করে, যেকোনো অপরাধীকে মুহূর্তেই ধরতে পারে। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় সরকারের রয়েছে পুলিশ-র্যাব-গোয়েন্দা সংস্থা । ছোট্ট এ দেশে কোথায় কী হচ্ছে, সব কিছুই সবার নখদর্পণে আছে। তাহলে কি বলব, পুলিশ-র্যাব কিংবা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো নিজেরাই সুশৃঙ্খল নয়! তাদেরই চেইন অব কমেন্ড নেই?
যেকোনো খুনের দায় পরস্পর বিরোধী দুটি দল একে অন্যের প্রতি দোষারোপ করে কিছু দিন চিল্লাপাল্লা করে টিভি চ্যানেলগুলো গরম করে। পত্র-পত্রিকা সরগরম হয়ে ওঠে। এ সময় মিডিয়া-ব্যবসায়ীরা চুটিয়ে ব্যবসা করে। তারপর ঝিম মেরে যায়, আরও পরে ভুলে যায়।
বাংলাদেশে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এসব হত্যাকাণ্ডের কতগুলো কারণ রয়েছে। এগুলো হলো—
১। ক্ষমতায় টিকে থাকা
২। ক্ষমতায় যাওয়া
৩। অর্থনৈতিক সংঘাত
৪। পারিবারিক কলহ
৫। সামাজিক সংঘাত
৬। ধর্মীয় উন্মাদনা
৭। প্রগতিশীল চিন্তার সঙ্গে সংঘর্ষ
দেশে সরকারি দল থাকে, বিরোধী দল থাকে। আরও ছোটখাটো দলও থাকে। রাজনীতি কেন করে মানুষ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাজনীতি করেছেন মানুষ ও দেশকে ভালোবেসে। তাই জীবন দিয়েছেন, মান দেননি। জনগণের কাছে গিয়েছেন, পাশে ছিলেন, সুখে-দুঃখে। মানুষই তাঁকে নেতা বানিয়েছে, মানুষই তাকে বন্ধু বানিয়েছে। কারণ তিনি বুঝতেন মানুষের দুঃখ-ব্যথা। একজন রাজনীতিবিদের তাই হওয়া উচিত। তিনি কখনো সরকার গঠন করবেন, কখনো বিরোধী দলে থাকবেন। থাকতেই হবে এটাই নিয়ম। কিন্তু তিনি থাকবেন জনগণের বন্ধু হয়ে। মত-পথ দুটোকেই তাঁর সম্মান করতেই হবে। তাহলে জনগণই তাঁকে কাছে টানবে । কিন্তু জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেই ভয়। ক্ষমতা হারানোর কিংবা ক্ষমতায় যাওয়ার লোভ। তখনই দরকার পড়ে জঙ্গিগোষ্ঠীর। অকারনে খুন-খারাবি, শান্তি নষ্ট করা। এখন তাহলে ভেবে দেখা দরকার— আসলে ক্ষমতাসীনরা না কি ক্ষমতায় যাওয়ার লোভে ক্ষমতার বাইরে থাকা শক্তি ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য এসব ঘটাচ্ছে!
____________________________________________________________________________________________________________________
মাহবুবুল আলম হানিফের কাছে নিজের পুত্রের চেয়েও দল বেশি? তিনি কি তাই মনে করেন? তাহলে এ খুনের আসামি তিনি বের করবেন। দেখিয়ে দেবেন বাবা নয়, দীপনকে কে হত্যা করেছে। কতটা যন্ত্রণা বুকে পুষে থাকলে ছেলেহত্যার বিচার চান না বাবা? সরকার, বিরোধী দল দেখিয়ে দিক—আনসার আল ইসলাম কোথায়? নেপথ্যে কারা কাজ করছে?
___________________________________________________________________________________________________________________
ধরে নিই, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য হচ্ছে। তাহলে সরকারকেই তার দায়িত্ব নিতে হবে। কারণ প্রশাসন ব্যবস্থায় হত্যা খুব বন্ধ হচ্ছে না । আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হচ্ছে না। হয় সরকারকে আরও বিচক্ষণ হইতে হবে, নয় সারেন্ডার করতে হবে। জনগণের সামনে দাঁড়িয়ে বলতে হবে—আমরা তোমাদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ।
ধর্মীয় উন্মাদনা মানুষের রক্তের সঙ্গে মিশে আছে। ধর্ম পালন করুক আর না করুক, তারা ধর্ম নিয়ে কথা বললেই অমনি হুমড়ি খেয়ে পড়ে। খুন-জিহাদ কত কি নামে মানুষকে ঘায়েল করা হয়! সরকারের উচিত এসব উন্মাদনা কঠোর হস্তে দমন করা। সুশিক্ষিত মাওলানা মুফতি দিয়ে প্রকৃত ইসলামের পরিচয় অন্যধর্মের মানুষদের কাছে তুলে ধরা। কারণ মানুষ পড়ে না। জানে না। যেখানে পবিত্র কোরানেই অন্য ধর্মের স্বীকৃতি আছে, যেখানে পারস্পরিক শ্রদ্ধা বজায় রেখে চলতে হবে। কেউ ধর্ম না মানলে, না মানুক। কিন্তু সে যেন আরেকজনের বিশ্বাসে আঘাত না করে। বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে শান্তিপ্রিয় দেশ। এ দেশের জনগণের অন্য দেশ দখল করার অভ্যাস নেই। কারও ওপর আধিপত্য বিস্তারের ক্ষমতা নেই। হিন্দু-মুসলিম সবাই এখানে মিলে-মিশে বাস করে। খোদ আমেরিকায় এখনো বর্ণবৈষম্য রয়েছে। নারী-পুরুষের বেতন-বৈষম্য রয়েছে। বৃটিশ রাজপরিবার এখনো সাধারণের সঙ্গে একই আসনে বসে না, খাবার খায় না। কোলকাতায় মুসলিম হওয়ার কারণে আমার বন্ধুকে হিন্দু মালিকের বাড়ি ছাড়তে হয়েছে। আমাদের তো এসব চিন্তায়-ই নেই। আমরা ধনী-গরিব একসঙ্গে বাস করছি। ননী আমার কাছের বন্ধু। সে হিন্দু, দেব আমার আরেক প্রিয় মানুষ। সে বৌদ্ধ। জেরীন প্রিয় ছাত্রী, সে খৃস্টান। স্যালি আমার খৃস্টান বন্ধু। কই আমাদের সমস্যা তো হয়নি, হচ্ছে না! শুধু আনসার আল ইসলাম আর আনসারুল্লার সমস্যা হয়!
সব ব্লগার হত্যার দায় স্বীকার করেছে আনসারুল্লা, আনসার আল ইসলাম নামক জঙ্গি সংগঠন। প্রশ্ন হলো—এ সব সংগঠন গড়ে উঠলো কী করে। কিভাবে তাদের মাথা গজাল? আমি একটি সাহিত্য পত্রিকার জন্য আবেদন করে দিনের পর দিন ঘুরছি, ওরা ক করে এত সহজে সংগঠন করার অধিকার পেলো?
যুগ-যুগ ধরে মানুষ বিভিন্ন ধর্ম-মত মেনে নিয়েই জীবন-যাপন করছে এবং তখনো কিছু মানুষ বৃত্তের বাইরে গিয়ে চিন্তা করেছে। করতেই পারে। মানুষের এই উন্নত চিন্তার ফসলই হলো তাওরাত-জবুর-ইঞ্জিল—সর্বশেষ কোরআন। না হয় গুহাবাসী মানুষ গুহাতেই থাকত। এখন যদি কেউ সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আরও কিছু বেশি চিন্তা করে, তবে সে করতেই পারে। এতে ইসলামের কিছুই ক্ষতি হবে না। একদিন ফেসবুকে দেখেছি—একজন মুহাম্মদের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করছে। তাতে আমার ভেতর কোনো প্রতিক্রিয়াই সৃষ্টি হয়নি। কারণ, মুহাম্মদ এমনই এক ব্যাক্তিত্ব, যাঁর ভয়ে পুরোবিশ্ব শঙ্কিত। কেউ যদি ইসলামকে অবজ্ঞা করে কিংবা মুহাম্মদকে লেংটা বানিয়ে ছাড়ে, সেটা তারই মূঢতা। এর জন্য মারতে হবে কেন? ধর্ম মানুষের চলার পথ রুদ্ধ করে দেয়—এটা যেমন সত্য, তেমনি ধর্ম না থাকলে মানুষের ভেতর শৃঙ্খলা থাকত না, এটাও সত্য। ধর্ম মানা-না মানা—ব্যক্তিবিশেষের ব্যক্তিগত ব্যাপার। এখানে জোর জবরধস্তি চলে না।
আনসারুল্লাহ হোক, আর আনসার আল ইসলাম হোক, যদি ইসলামে বিশ্বাসী হয়, তাহলে এই খুনের জন্য জের টানতেই হবে।
___________________________________________________________________________________________________________________
সরকারের প্রতি আহবান দুধকলা দিয়ে সাপ না পুষে, সাপ আসলে কোথায় আছে, খুঁজে বের করে বিষদাঁত উপড়ে ফেলতে হবে। না হয় আখেরে সব দায়-দায়িত্ব সরকারকেই বহন করতে হবে। বিরোধী দলকে সরকার, সরকারকে বিরোধীদল পাল্টাপাল্টি দোষারোপ করে বহিঃবিশ্বে নিজেদের খাটো করে কী লাভ! তারচেয়ে আসুন প্রগতিশীল পাশে দাঁড়ান, আপামর মানুষের পাশে দাঁড়ান।
____________________________________________________________________________________________________________________
সরকার যদি মনে করে, এমনই করে এক একজন বুদ্ধিবৃত্তিক লোক মরবে আর কিছু দিন হইহই করে থেমে যাবে সব। তাহলে সেটা হবে সরকারের ভুল। মাহবুবুল আলম হানিফ কি জানেন পৃথিবীতে সব চেয়ে ভারী জিনিস কী? তিনি কি কখনো দাদী-নানীর কাছেও শোনেননি বাবার কাঁধে ছেলের লাশ পৃথিবীর চেয়ে ভারী বস্তু? প্রফেসর আবুল কাশেম ফজলুল হক এখন তাই বয়ে বেড়াচ্ছেন। অভুক্ত সন্তান এগারোটায় বাসা থেকে বেরিয়ে আর বাসায় ফেরেনি। ছেলের সন্ধানে নেমে বাবা পেলেন রক্তাক্ত লাশ। এ দেশে তিনি কার কাছে বিচার চাইবেন! যেখানে মাহবুবুল আলম হানিফ তাঁর দিকেই ইঙ্গিত করছেন। ধিক রাজনীতিবিদ ! ধিক মাহবুবুল আলম হানিফ!!
মাহবুবুল আলম হানিফের কাছে নিজের পুত্রের চেয়েও দল বেশি? তিনি কি তাই মনে করেন? তাহলে এ খুনের আসামি তিনি বের করবেন। দেখিয়ে দেবেন বাবা নয়, দীপনকে কে হত্যা করেছে। কতটা যন্ত্রণা বুকে পুষে থাকলে ছেলেহত্যার বিচার চান না বাবা? সরকার, বিরোধী দল দেখিয়ে দিক—আনসার আল ইসলাম কোথায়? নেপথ্যে কারা কাজ করছে?
এভাবে দিনে-দুপুরে দীপন হত্যাকাণ্ড প্রশ্নবিদ্ধ সরকারের উপস্থিতিকে। সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দায়িত্ব পালনে সৎ-সচেতন হলে এমন হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে না। যে দিন অভিজিৎ খুন হয়েছেন, সে দিন কিছুক্ষণ আগে ওই জায়গায় আমি নিজেও ছিলাম। আমাদের পরেই অভিজিৎরা ওখানে প্রবেশ্য করে। অদূরেই ছিল ‘গাঁটটি-গাঁটটি’ পুলিশ। কুপিয়ে হত্যা করতে সময় তো লেগেছে। এতটা সময় ধরে ওইসব পুলিশ সেখানে কী করেছিল ?
দেশের কোথায়, কখন জঙ্গিরা সংগঠিত হচ্ছে, তার খবরা গোয়েন্দারা আঁচ করতে পারে না? তাহলে তার কী করে? এছাড়া প্রাণনাশের আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও মানুষ এখন সহজেই পুলিশের কাছে যেতে চায় না। কেন?
পাঁচ জানুয়ারির নির্বাচনের পর টানা তিনমাসের অবরোধ-হরতালকালে পেট্রোলবোমা হামলায় শতশত মানুষ প্রাণ দিয়েছেন। এরপর সরকার কঠোর হস্তে ওই নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড বন্ধ করেছে। তাহলে এখন কেন দিনের পর এসব হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে পারছে না? এমন হাজারো প্রশ্ন জনমনে ঘুরপাক খাচ্ছে। ইতিহাস বলে—কিছুই চিরস্থায়ী নয়। একদিন গণজোয়ারে টানে সবাইকেই ভাসতে হবে। প্রকৃতি নিজের নিয়মে মানুষকে শায়েস্তা করে।
কথায় বলে—সাপ কখনো পোষ মানে না!
তাই সরকারের প্রতি আহবান দুধকলা দিয়ে সাপ না পুষে, সাপ আসলে কোথায় আছে, খুঁজে বের করে বিষদাঁত উপড়ে ফেলতে হবে। না হয় আখেরে সব দায়-দায়িত্ব সরকারকেই বহন করতে হবে। বিরোধী দলকে সরকার, সরকারকে বিরোধীদল পাল্টাপাল্টি দোষারোপ করে বহিঃবিশ্বে নিজেদের খাটো করে কী লাভ! তারচেয়ে আসুন প্রগতিশীল পাশে দাঁড়ান, আপামর মানুষের পাশে দাঁড়ান। দীপনের মৃত্যু বাকি দুজনের কোপ খাওয়া কবি-সাহিত্যিকদের জন্য সুখকর নয়। এটা জাতির জন্য লজ্জাজনক! দীপনের খুনিরা দ্রুত ধরা পড়ুক। সন্তানহারা মা-বাবার সমবেদনা রইল।