মার্গারেটের চোখে জল
তখন ফেব্রুয়ারি মাস। ২০০১ সাল। শাদা বরফের নিচে ডুবে আছে কসোভো। আমার অস্থিরতা ক্রমেই বাড়ছে। এভাবে আর চলতে পারে না। লিখছি কিন্তু সাহিত্যের কোনো আড্ডা হচ্ছে না, লেখাগুলো কারও সঙ্গে শেয়ার করতে পারছি না, কোনো বই বেরুচ্ছে না। কেবলই মনে হচ্ছে, সেজে-গুজে বসে আছি কিন্তু দেখার কোনো লোক নেই। রূপ-যৌবন হলো প্রদর্শনের জিনিস, দেখাতে না পারলে এই রূপ যৌবন থেকে কী লাভ।! এই অবস্থা আর কিছুদিন চলতে থাকলে আত্মহত্যাও করে ফেলতে পারি। দম বন্ধ হয়ে আসা এই অস্থির প্রবাস-যন্ত্রণা থেকে বের হয়ে আসার ক্ষুদ্র একটি জানালা আবিষ্কার করলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম, কসোভোতে অবস্থানরত স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক লেখক-কবিদের নিয়ে একটা আড্ডা গড়ে তুলব। আমার আহ্বানে সাড়া দিলেন জাতিসংঘ-কসোভো মিশনের স্টাফ রিক্রিয়েশন কমিটির দায়িত্বে নিয়োজিত দীর্ঘাঙ্গিনী অস্ট্রিয়ান তরুণী বারবারা। কমিটি হয়ে গেল, বারবারার জোরাজুরিতে সভাপতিও হলাম।
পোয়েটস ফোরামের প্রথম সভা হবে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ছয়টায়। দূর-দুরান্ত থেকে কবিদের চিঠি, ইমেইল আসতে শুরু করল। কেউ কেউ অতি উৎসাহী হয়ে আগাম কবিতাও পাঠিয়ে দিলেন। শুভ্র ডানা দুলিয়ে তুষারের পরীরা উড়ে বেড়াচ্ছে কসোভোর আকাশে, ফায়ার প্লেসে আগুন জ্বালিয়ে আমরা বসেছি কবিতার আড্ডায়। আফগানিস্তানের কবি বশির সাখাওয়ার্জ চমৎকার গান করেন। তিনি আমাদের ফার্সি ও হিন্দি ভাষায় গান শোনালেন। ভারতের কবি রমা ভট্টাচার্য শোনালেন ইংরেজি কবিতা। অন্যান্য কবিদের আর কারও নামই এখন মনে নেই। তবে এটি স্পষ্ট মনে আছে—দক্ষিণ আফ্রিকার এক শ্বেতবর্ণের কবি অসাধারণ একটি দীর্ঘ কবিতা শুনিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। এছাড়া এ আড্ডায় অংশ নিয়েছিলেন তিনজন আলবেনিয়ান ভাষার মহিলা কবি, একজন ব্রিটিশ কবি, একজন জার্মান কবি ও একজন রাশিয়ান কবি—যাদের নাম মনে করতে পারছি না বলে ভীষণ অস্বস্তি লাগছে।
পরদিন সকালে বারবারা টেলিফোন করে জানালো, তোমাকে একজন পাগলের মতো খুঁজছে। আমি বললাম, কে সে? বারবারা জানালো, তার নাম মার্গারেট, আইরিশ কবি। বারবারার ফোন রেখে মাত্র সোজা হয়ে বসেছি অমনি আইরিশ কবি মার্গারেটের টেলিফোন। তিনি আমাকে লাঞ্চে দাওয়াত করতে চান। একজন কবির আমন্ত্রণ, তাও আবার মহিলা কবি, না করার দুঃসাহস নেই আমার। তবে তাকে জানালাম, আজ না, পরের উইকে। রোববারটা কোনোরকমে পেরিয়েছে। সোমবার সকালে অফিসে ঢুকতেই মার্গারেটের ফোন। মনে আছে তো, আজ দুপুরে লাঞ্চের দাওয়াত? ঠিক ১২টা পনেরোতে চলে আসবে, টেরাসে, আমি অপেক্ষা করব।
একটি রেড ওয়াইনের বোতল সামনে নিয়ে বসে আছে মার্গারেট। বয়স পঁয়তাল্লিশ-ছেচল্লিশ হবে। তবে মেদহীন ঝরঝরে শরীর, মাথাভর্তি ঝাকড়া চুল। স্ট্র কালারের ফিনফিনে পাতলা শিফনের স্কার্ট আর ওপরে একটি শাদা শার্ট পরেছেন ভদ্রমহিলা। ওভারকোটটি রেস্টুরেন্টের কোট হ্যাঙ্গারে রাখতে রাখতে বললেন, তুমি রেড ওয়াইন পছন্দ করো তো? মার্গারেটের দুই হাতের দশ আঙুলে দশটি আঙটি। গলায় একটি এবনি কাঠের কুচকুচে কালো মসৃণ ও তেলতেলে মালা দেখে বুঝলাম, এই মহিলার মাথায় গণ্ডগোল আছে। প্রশ্ন করার আগেই সে গড়গড় করে নিজের পরিচয় দিতে শুরু করলো। মূলত আমি একজন স্কাল্পটর। পাথর কেটে কেটে শেইপ বের করি। পাথর কাটতে কাটতে একসময় মনে হলো, এবার শব্দ নিয়ে খেলব। তখন থেকেই কবিতা লিখছি। আর তুমি? ইন্ডিয়ান? আমি বেশ গর্বের সঙ্গে উচ্চারণ করলাম, না বাংলাদেশি। লক্ষ করলাম, বাংলাদেশ কথাটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে তার চোখ চকচক করে উঠলো। উপচেপড়া উৎসাহ তার বাংলাদেশ সম্পর্কে, বাংলাদেশের মানুষ, প্রকৃতি, কবিতা সম্পর্কে। লাঞ্চের অর্ডার দিয়ে মার্গারেট তার প্রকাশিত গ্রন্থ থেকে দুটি কবিতা পড়ে শোনালো। আমি তেমন কিছুই বুঝলাম না, শুধু বুঝলাম কৈশোরের কোনো এক আনন্দময় ঘটনার কথা বলতে চেয়েছে কবিতায়। বেশ কিছু ফুলের কথা এসেছে, এক কিশোর বন্ধুর কথা এসেছে। এবার আমার পালা। পোয়েটস ফোরামের জন্য তিন/চারটি কবিতার ইংরেজি অনুবাদ করেছিলাম। ওগুলো পড়ে শোনালাম। একটি কবিতা ছিল, বেনিয়ান ফল। এটা সম্পর্কে ও বেশ আগ্রহ দেখালো।
ও আমাকে অনুরোধ করলো আমি যেন কবিতাটি আমার মাতৃভাষায় আবৃত্তি করে শোনাই। কবিতার একটি লাইন ছিলো, ‘আমি ডাহুকের কান্না শুনি রোজ রাতে’—এইখানে এসে আটকে গেলাম। ও জানতে চাইলো ডাহুক কী? আমি বললাম, ডাহুক একটি পাখি, বাংলাদেশি পাখি। এই পাখি জলাশয়ের আশ-পাশের অরণ্যে, ঝোপ-ঝাড়ে থাকে। স্ত্রী ডাহুক ডিমে তা দিতে দিতে এক পর্যায়ে গলা ছেড়ে ডাকতে থাকে। একদিন ডাকতে ডাকতে ওর গলা দিয়ে রক্ত বের হয় আর তখনই ডিম ফুটে ডাহুকের বাচ্চা বেরিয়ে আসে। জনশ্রুতি আছে, যতক্ষণ ডাহুকের গলা দিয়ে রক্ত না আসে, ততক্ষণ ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয় না।
তাকিয়ে দেখি মার্গারটের চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।
আফটার এ লংওয়ে
পোয়েটস ফোরামের তৃতীয় সভাটি পার হওয়ার পরেই একটি সংকটে পড়ে গেলাম। আমাদের বসার কোনো জায়গা নেই। সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত অফিস, ছয়টায় যথারীতি সাহিত্যের আড্ডা। লোকজন চলে এসেছে কিন্তু পূর্বনির্ধারিত সভাকক্ষে অফিসিয়াল মিটিং চলছে। একটি মাত্র উপায় আছে, মিশন সদর দপ্তরের ছাদের ওপরে উন্মুক্ত ক্যাফেটেরিয়ায় বসা। সবাই রাজি হয়ে গেলো। আকাশ দেখব আর কবিতা পড়ব। কিন্তু ছাদে গিয়ে টের পেলাম, এখানে, এই উন্মুক্ত স্থানে, সভা করা পাগলামি ছাড়া আর কিছুই না। তাপমাত্রা তিন ডিগ্রি, চিন্ড ফ্যাক্টরের কারণে তা হিমাঙ্কের নিচে চার/পাঁচের মতো অনুভূত হচ্ছে। সবাই ওভারকোটের ভেতর গুটিশুঁটি মেরে মাঙ্কি ক্যাপে কান ঢেকে, মাফলারে গলা পেঁচিয়ে বসেছে। ভাব দেখে মনে হচ্ছে, কবিতা না শুনিয়ে কেউ বাড়ি যাবে না। বরফঠাণ্ডা সন্ধ্যায় একদল ওভারকোট পরা মাঙ্কি বসেছে কবিতার আড্ডায়। বান্দরের কাব্যসভা। ঢাকায় একটি কথা প্রচলিত আছে, কবিরা প্রয়োজনে পকেটের পয়সা খরচ করে চা খাইয়েও মানুষকে কবিতা শোনায়। দুর্বোধ্য আধুনিক গদ্য কবিতা শোনার মতো ভয়াবহ বিপদের হাত থেকে বাঁচার জন্য বন্ধুরা সবসময়ই কবিদের এড়িয়ে চলে। কারণ কবিরা নাছোড়বান্দা। দেখা হলেই কবিতা শোনাতে চায়। মাঝরাতে বাতি জ্বালিয়ে স্ত্রীর ঘুম ভাঙিয়ে কবিতা শোনায়নি, এমন কবি কজন আছে? এখানকার অবস্থাও প্রায় একই রকম, হিমাঙ্কের নিচে তাপমাত্রা, রক্ত জমে বরফ হয়ে যাচ্ছে, তবু ছাড়াছাড়ি নেই, কবিতা পাঠ চলবেই।
এই সভায় একটি সিদ্ধান্ত হলো, সপ্তাহে একদিন আমরা বসব বটে, তবে সারাসপ্তাহ ধরে ইমেইলে কবিতার আদান-প্রদান চলবে। কবিতার ভূত আমাদের ঘাড়ে ভালোভাবেই চেপে বসেছে। শিগগিরই এই পাগলের দলটি চাকরি হারাতে যাচ্ছে; এতে কোনো সন্দেহ নেই। আমি তৃতীয় বিশ্বের সামান্য কবি, চাকরি করে ডাল-ভাত জোটাই। কবিতা লিখে তো আর পেট ভরবে না। এই বাস্তবতা ওরা না বুঝলেও আমি বুঝি। এরই মধ্যে আমার বেশ কিছু কবিতার ইংরেজি অনুবাদ হয়ে গেছে। আর ঠিক সে সময়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সময়ের বাংলা সাহিত্যের ছাত্র, ভীষণ সাহিত্যরসিক মানুষ, বন্ধু নিজাম আহমেদ প্রস্তাব করলেন ৫০-৬০টা কবিতা অনুবাদ করে আমার একটি ইংরেজি কবিতার বই প্রকাশের। প্রস্তাবটি আমাকে প্রায় উন্মাদ করে তুললো। কবিতার আড্ডা-ফাড্ডা সব ভুলে গিয়ে দিন-রাত খেয়ে না খেয়ে কবিতা অনুবাদ করি। আমার স্ত্রী মুক্তি আমার এই উন্মাদনাকে আরও উস্কে দিলেন নিজেই তিনটি কবিতার অনুবাদ করে দিয়ে। এই ভদ্রমহিলার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। কবিতা লেখার মতো এই শৈল্পিক পাগলামিটা আজো বেঁচে আছে অনেকটা তার প্রশ্রয়েই। এক পাবলিক ফোরামে তিনি বক্তৃতা করতে গিয়ে বলেছেন, আমি কবি, শুধু এজন্যই আমাকে বিয়ে করেছেন। পাগলের সভায় মহাপাগলের দিগদারি। দুর্ভাগ্যবশত সেই অনুষ্ঠানে আমি যোগ দিতে পারিনি। তবে উপস্থিত আমার অন্য স্বজাতিরা তার এ বক্তব্য শুনে নাকি খুশিতে ডিগবাজি খেয়েছিলেন। তরুণ কবিদের হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। কবিদেরও বাজার ভালো।
শেষ পর্যন্ত আমার বইটি বের হলো। অতি সৌভাগ্যবশত বইটি বের হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসে। বইয়ের নাম দিলাম, ‘আফটার এ লঙ ওয়ে’। কসোভোতে কর্মরত ১৬/১৭ জন বেসামরিক কর্মকর্তা ছাড়াও ওখানে ছিলেন ১২৬ জনের একটি পুলিশ কন্টিনজেন্ট। আর একজন মিলিটারি অফিসার। মিলিটারি অফিসার মেজর আফজাল (পরে লে. কর্নেল সাভার টেঙ্ক রেজিমেন্টের কমান্ডার, তারপর চাকরিচ্যুত) অল্প ক’দিনের মধ্যেই অতিশয় ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে গেলেন। ২৬শে মার্চ উপলক্ষে পুলিশ কন্টিনজেন্ট বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের আয়োজন করেছে কসোভোর সবচেয়ে অভিজাত হোটেল, গ্রান্ড হোটেলে। বইয়ের প্রকাশক নিজাম আহমেদ উদ্যোগ নিলেন, স্বাধীনতা দিবস উদযাপনস্থলে একটি স্টল বসিয়ে বই বিক্রির। আমি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করছি, পাঁচ ইউরো দিয়ে ‘আফটার এ লংওয়ে’র প্রথম কপিটি কিনেছিলেন আজিজ ভাই (পরে র্যাব এর মহাপরিচালক অজিজ সরকার), অন্যান্যের মধ্যে যারা সেদিন বইটি কিনেছিলেন তাদের আরও কয়েকজনের নাম এই মুহূর্তে আমার মনে আছে, এসপি রুহুল আমিন, এসপি ওমর ফারুক, জাতিসংঘের ক’জন বেসামরিক অফিসার, আবু সেলিম, জহুরুল হক, মেজর মাহফুজুর রহমান, সিরাজউদ্দৌলা, আব্দুল ওয়াহাবসহ অনেকেই। একদিনেই ৭০ কপি বই বিক্রি হয়ে গেল। আমার আনন্দের আর সীমা রইলো না।
অবাক হওয়ার তখনো অনেক কিছু বাকি। এরা তো সবাই বই কিনলো বাংলাদেশি কবি, এই খাতিরে। জাতিসংঘের অনেক বিদেশি বন্ধু কিনলো সহকর্মী বলে। কিন্তু খুঁজে খুঁজে যারা বই কেনেন, প্রকৃত পাঠক, তারা কি আমার বই কিনবে? দুগাজিনি কসোভোর সবচেয়ে বড় বইয়ের দোকান। এক মাসের ছুটিতে দেশে যাচ্ছি। মার্গারেট বললো, দুগাজিনিতে তোমার বই দাও। আমি বললাম, এখানে কে আমাকে চেনে, তাছাড়া কবিতার বই পুশিং সেল ছাড়া বিক্রি হয় না। যাই হোক, মার্গারেটের কথায় দুগাজিনিতে ২০ কপি বই দিলাম।
ছুটি থেকে ফিরে এসে আর দুগাজিনিতে খোঁজ নিতে যাইনি। ঢাকার কোনো বইয়ের দোকানে এক মাসে অচেনা কোনো কবির এক কপিও বই বিক্রি হয় না, এই খবর তো আর আমার অজানা নয়। এর মধ্যে ফাইনান্স সেকশন থেকে আমার চাকরি প্রায় যায় যায় অবস্থা। আমার অপরাধ আমি কবি। কবিতার বই বের হয়েছে। সেই বইয়ের মুখবন্ধ লিখেছেন আমাদের ডেপুটি চিফ ফাইনান্স অফিসার এক ব্রিটিশ সাহিত্যপ্রেমিক মানুষ মাইকেল ওয়ার্ড। চাকরি শুধু আমারই যাচ্ছে না, যাচ্ছে মাইকেলেরও। এরইমধ্যে কিছু জনপ্রিয়তাও হয়ে গেল। মিশনের দুই হাজার দেশি-বিদেশি সিভিলিয়ান আর সাড়ে তিন হাজার পুলিশ প্রায় সবাই আমার নামটা অন্তত জানে। জনপ্রিয়তার সুবিধাটা কাজে লাগিয়ে একটি নতুন চাকরি জোগাড় করে ফেললাম প্রায় রাতারাতিই। নতুন অফিসের উল্টোদিকে, মাদার তেরিজা স্ট্রিটের ওপাশেই দুগাজিনি। অফিস থেকে বেরিয়ে একদিন গেলাম দুগাজিনিতে। গিয়ে কাউকে কিছু না জানিয়ে যেখানে আমার বইগুলো রাখা ছিল, শেলফের ওখানটায় ঘুরঘুর করছি। বইগুলো দেখতে না পেয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল। বোধ হয় অচল মাল বলে সরিয়ে ভেতরে কোথাও রেখে দিয়েছে। কাউন্টারে গিয়ে জর্জ বার্নার্ড শ সেজে গেলাম। ম্যাডাম, আপনাদের কাছে কি কাজী ইসলামের কবিতার বই আছে? কাউন্টারে বসা মধ্যবয়সী আলবেনিয়ান সুন্দরী আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করে, ‘আফটার এ লং ওয়ে?’ আমি শুধু চমকে উঠলাম, না আনন্দে ঘামতে শুরু করলাম। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, ওর কি আর কোনো বই আছে? সে জানালো, ‘আছে হয়ত, আমরা জানি না। তবে এই বইটাই আমাদের কাছে ছিল, শেষ হয়ে গেছে’।
রাস্তায় নেমে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছি, এখন কি মুখোশ পরে টাকা চাইতে যাব?
সবাই বাংলাদেশ কথাটি উচ্চারণ করেছিল
তিন বছরে হাঁপিয়ে উঠেছি। প্রবাস জীবন আর ভালো লাগছে না। যদিও বছরে অন্তত দুবার করে সপরিবারে দেশে যাচ্ছি তবুও অ,আ,ক,খ-র স্পর্শহীন এই জীবন আমার কাছে কেবলি ধূসর, কেবলি নিষ্প্রাণ হয়ে উঠছে। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, এবার পাত্তারি গুটাবো। এরই মধ্যে ঢাকাস্থ ইউএনডিপি অফিস থেকে একটি অফার এসে গেছে। কাজেই দেশে ফিরে বউ, বাচ্চা নিয়ে অন্তত পথে দাঁড়াতে হবে না।
তিন তিনটা বছর পূর্ব-ইউরোপের এক রক্তাক্ত জনপদ, কসোভোতে কাটিয়ে দেশে ফিরছি। যৎসামান্য লেখালেখির চেষ্টা করি, মনে মনেতো নিজেকে একজন লেখক দাবি করিই, অথচ নিজে একজন লেখক হওয়া সত্ত্বেও এখানকার কোনো লেখক কবি সম্মেলনে যোগ দিলাম না, কেমন যেন একটা অসম্পূর্ণতার কাঁটা বুকের ভেতর খচখচ করছে। ঠিক তখনি দরোজায় হাজির কসোভোর প্রভিশনাল ইনস্টিটিউট ফর সেলফ গভর্নমেন্ট-এর যুব, ক্রীড়া, সংস্কৃতি ও প্রবাসী বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রধান উপদেষ্টা আদেম গাশি। হাতে আমন্ত্রণপত্র, খামের ওপর ইংরেজীতে লেখা, মি. কাজী ইসলাম। আদেম গাশি কসোভোর লেখক ফোরামের সভাপতি এবং একজন দারুণ ছড়াকার ও কবি। ইতোপূর্বেও এমনি করে আদেম আমাকে অনেকবারই আমন্ত্রণপত্র দিয়েছে, সময়ের অভাবে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। একই মন্ত্রণালয়ের (জাতিসংঘের নিয়ন্ত্রণাধীন) কেন্দ্রীয় প্রশাসন বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি বলেই হয়ত রোজই এমন অসংখ্য আমন্ত্রণপত্র পেয়ে থাকি। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, এবার যাব।
সন্ধ্যা সাতটায় অনুষ্ঠান, চিরকালের অভ্যেসমতো একটু আগে-ভাগেই গিয়ে হাজির। এখন পৌনে সাতটা বাজে। পৃষ্টিনা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরির বিশাল পেটের ভেতর আমরা চারজন, আমার স্ত্রী মুক্তি শরীফ ছাড়া অন্য দুজন বাঙালি সহকর্মী হলেন ইস্তগ মিউনিসিপ্যালিটির অর্থ ও বাজেট কর্মকর্তা নিজাম আহমেদ এবং উনমিকের লিগ্যাল অফিসার ব্যারিস্টার আইজ্যাক রবিনসন। আমরা যেন কোনো এক পাজেলের প্যাচগির মধ্যে পড়ে গেছি। ডানে বাঁয়ে অসংখ্য হলরুম, সেমিনার কক্ষ, বড় বড় লাউঞ্জ, লোকে লোকারণ্য। এর মধ্যে কোথায় কবিদের সভা, কিভাবে খুঁজে বের করি? আমাদের আলবেনিয়ান ভাষাজ্ঞান তো ক অক্ষর গোমাংসের চেয়ে খুব একটা বেশি নয়। দলের অন্য তিনজন খানিকটা বিরক্ত হচ্ছেন বুঝতে পারছি। আমি অবশ্য শঙ্কিত এজন্য যে, শেষ পর্যন্ত ভেন্যুটা খুঁজে না পেলে ওদের তিনজনকে আজ রাতে রেস্টুরেন্টে ডিনার খাওয়াবো বলে কথা দিয়েছি। আমার পঞ্চাশ ইউরো বুঝি গেল। হঠাৎ ভিড়ের মধ্য থেকে স্যুট টাই পরা এক জম্পেশ সাহেব এসে আমার হাত ধরলো। তাকিয়ে দেখি আদেম। ওর ইংরেজিও তথৈবচ। কাজেই ও আর ইংরেজিতে কম্যুনিকেট করার ব্যর্থ চেষ্টা না করে আমাকে টানতে টানতে একটি হলরুমে নিয়ে গেল। অন্য তিনজন নীরবে আমাকে অনুসরণ করছে। দর্শক সারির প্রথম রো’তে আমাকে নিয়ে বসালো আদেম। সাতটা বাজতে এখনো পাঁচ মিনিট বাকি। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে অনুষ্ঠান শুরু হতে আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি অথচ এখনো হলে তেমন লোক সমাগম হয়নি, ফাঁকা অন্ধকারে ডুবে আছে একটি খোলা মঞ্চ। পেছনে তাকিয়ে দেখি আড়াইশ সীটের এই ছোট্ট হলটির এক-তৃতীয়াংশও এখনো ভরেনি। কিন্তু অতি আশ্চর্যজনকভাবে মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যে ভেল্কিবাজির মতো পুরো হল ভরে গেলো, হলের মূল দরোজা বন্ধ হয়ে গেল এবং মঞ্চের বাতি জ্বলে উঠলো।
ঠিক সাতটায় অনুষ্ঠান শুরু হলো। মঞ্চে এক অপূর্ব সুন্দরী আলবেনিয়ান তরুণী। না, এই মেয়েটি অনুষ্ঠানের ঘোষিকা নন, একজন মঞ্চাভিনেত্রী। শুরু হলো একক অভিনয়। আলবেনিয়ান ভাষার সংলাপগুলো না বুঝলেও অভিনয়ের একটি চিরন্তন ভাষা আছে, সেই ভাষাটি বুঝতে আমাদের কারোরই অসুবিধা হলো না। একটি আলবেনিয়ান ধর্ষিতা মেয়ে, যার পেটে জন্ম নিয়েছে ধর্ষক সার্বিয়ান মিলিটারির সন্তান। ধর্ষিতা হওয়ার করুণ কাহিনি, বাবা ও ভাই হারানোর নির্মম গল্প বলছিলো মেয়েটি এক যুদ্ধশিশুর মায়ের ভূমিকায় দাঁড়িয়ে। একবার নিজেকে ওর মনে হয় মমতাময়ী মা, আবার পরক্ষণেই মনে হয়, না এই শিশু এক শত্রুসন্তান, ওকে খুন করাই আমার কর্তব্য। এই দ্বৈতসত্তার মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের এক অভূতপূর্ব উপস্থাপন। ক্রন্দনরত শিশুটির দিকে তাকিয়ে মায়ের মন গলে যায়। সে তার স্তন উন্মুক্ত করে তুলে ধরে শিশুটির মুখে। এই দৃশ্যটিকে ফুটিয়ে তোলার জন্য মেয়েটি সত্যি সত্যি ওর আলখেল্লার ভেতর থেকে একটি স্তন বের করে এনে শিশুটির (কাল্পনিক) দিকে বাড়িয়ে দেয়। ত্রিশ মিনিটের এই নাটিকার যেটি ট্রাজেডি তা হলো শেষ পর্যন্ত শ্রেণী শত্রুতারই বিজয় হয়, মা তার শিশুটিকে শত্রুসন্তান বিবেচনা করে নিজ হাতে খুন করে।
এরপর শুরু হয় কবিতা পাঠের আসর। একজন মার্কিন কংগ্রেসম্যানকে মঞ্চে আহবান করা হলো। আদেম গাশি উপস্থাপকের ভূমিকায় এবং অনুষ্ঠানের সভাপতিও। সামনের সারিতে, আমার ডানে-বাঁয়ে, সব পক্ককেশ প্রবীণ সাহিত্য ব্যক্তিত্বরা বসে আছেন। শুরুতেই আদেম ছোটো ছোটো দুটি ছড়া শুনিয়ে বেশ হাস্যরসের সৃষ্টি করলো। এরপর কসোভোর দুজন প্রধান কবিকে আমন্ত্রণ জানানোর পরপরই ডাক পড়লো আমার। আলবেনিয়ান ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই আমার নাম ঘোষণা করা হলো। আমি ‘হোয়াইট ক্লাউড’ শিরোনামের একটি ইংরেজি (বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুদিত) কবিতা পড়লাম। হলভর্তি আলবেনিয়ান দর্শক-শ্রোতা ইংরেজি ভাষায় পুরো কবিতাটি না বুঝলেও এ কবিতায় ওদের মুক্তিযুদ্ধের নেতা আদেম ইয়াশরেকে যে আমি গ্রেট হিরো বলেছি এটা বুঝতে পেরেই করতালিতে ফেটে পড়লো। উল্লেখ্য, ১৯৯১ সালের মে মাসে কসোভোর সর্বোচ্চ মুক্তিযোদ্ধা আদেম ইয়াশরে তার পরিবারের ৫০ জন সদস্যসহ সার্বিয়ানদের গুলিতে নিহত হন।
আমি মঞ্চ থেকে নেমে আসতেই আদেম গাশি আমার কবিতাটির আলবেনিয়ান অনুবাদ পড়ে শোনালেন। আরও একবার পুরো হল করতালিতে ফেটে পড়লো। এরপর একে একে আরও প্রায় ত্রিশজন কবি মঞ্চে উঠেছিলেন কবিতা পড়তে। সকলেই তাদের কবিতার শুরুতে আমার নাম ও বাংলাদেশ কথাটি উচ্চারণ করেছিলেন।
শিল্পের সম্মান
ছোটোবেলা থেকেই পূর্ব ইউরোপের সাহিত্য সম্পর্কে একটি উচ্চ ধারণা পোষণ করতাম। আমার শৈশব কেটেছে রুশ উপকথার ইভান আর আনুশকার গল্প পড়ে। সেই ছেলেবেলা থেকেই স্বপ্নে বহুবার ওক গাছের মগডালে উঠে আকাশ ছুঁতে চেয়েছি। পরবর্তী সময়ে যখন ম্যাক্সিম গোর্কি,আলেকজান্ডার পুশকিন, লিও তলস্তয় প্রভৃতি লেখকের রচনার সঙ্গে কিছুটা পরিচয় ঘটে তখন এই ধারণা আরও বদ্ধমূল হয়। তবে পূর্ব ইউরোপের সাহিত্য বলতে আমার কাছে পরিচিত ছিল কেবল রুশ সাহিত্যই। পোলিশ, চেক, সার্বিয়ান এবং আলাবেনিয়ান সাহিত্যও যে অনেক সমৃদ্ধ এ সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই ছিল না।
দুই হাজার সালের গোড়ার দিকে যখন জাতিসংঘের পতাকা হাতে কসোভোতে কাজ করতে আসি, তখন পরিচয় ঘটে এই অঞ্চলের এক মহীরূহ সাহিত্যিক ইসমাইল কাদারের সাহিত্যকর্মের সঙ্গে। ত্রিশ ডয়েশমার্ক দিয়ে কসোভোর সবচেয়ে বড়ো বইয়ের দোকান দুগাজিনি থেকে কাদারের বিখ্যাত বই ‘দ্য কনসার্ট’ কিনে ফেলি। সম্প্রতি তিনি বুকার পুরস্কার পেয়ে সারা বিশ্বে বেশ পরিচিতি পেয়েছেন। আমি ধারণা করছি শিগগিরই সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাবেন ইসমাইল কাদারে। আমি যখন দুই হাজার সালের শেষের দিকে ছুটি নিয়ে ঢাকায় যাই, তখন কবি আল মুজাহিদী আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ভালো কোনো বই-টই এনেছো? আমি বললাম, ইসমাইল কাদারের ‘দ্য কনসার্ট’ এনেছি। তিনি ঠোঁট উল্টে বললেন, এটা আবার কে? মুজাহিদী ভাই পণ্ডিত মানুষ, প্রচুর পড়াশোনা। সেই তিনিই যখন জানেন না ইসমাইল কাদারে কে, তাহলে এটা ধরেই নেওয়া যায় যে আলবেনিয়ান সাহিত্য আমাদের এই অঞ্চলে ঢোকেনি। সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যাবস্থা সারা দুনিয়ায় ফেল মারলেও এই ব্যবস্থা শিল্প-সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করতে কার্পণ্য করেনি একটুও। তারই একটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরব এই রচনায়।
কসোভো অতি দ্রুত ধনতান্ত্রিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলাতে ব্যস্ত হয়ে উঠলেও এখানকার মানুষ দীর্ঘদিন সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় থেকে যে আচার-আচরণ রপ্ত করেছে, মানুষের রক্তের মধ্যে বংশপরম্পরায় যে সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে, তা-তো আর একদিনেই ধনতন্ত্রের পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলা যাবে না। একটু একটু করে মানুষের আচার আচরণও বদলে যাচ্ছে, একথা ঠিক। তবে কিছু জিনিস আছে যা ওরা বদলাতে চাচ্ছে না মোটেও। ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্পকলা ও সাহিত্যের প্রতি রয়েছে এখানকার মানুষের অগাধ শ্রদ্ধা, হোক সেটা সমাজতান্ত্রিক কিংবা সার্বিয়ান সংস্কৃতি।
একটি কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ পেয়েছি। আমার একটি কবিতার ইংরেজি অনুবাদ নিয়ে হাজির হলাম পৃষ্টিনা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরি মিলনায়তনে। এ আর নতুন কী? ঢাকায়তো হরহামেশাই এমন সাহিত্যসভা, কবিতা সন্ধ্যা হচ্ছে। এ রকম কত শত সভায় কবিতা পড়েছি। পুরস্কার তিরস্কারও পেয়েছি অনেক। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই টের পেলাম ঢাকার কবিতা সন্ধ্যার সঙ্গে পূর্ব ইউরোপের একটি কবিতা সন্ধ্যার গুণগত পার্থক্য অনেক। দুশ সিটের ছোট্ট একটি হল। কানায় কানায় পূর্ণ। ছড়া-কবিতায় হাস্যরস আছে বটে কিন্তু তা যেন সাহিত্যের গাম্ভীর্যকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে না একটুও। পিনড্রপ নীরবতা। যখনই কোনো কবি কবিতা পড়তে শুরু করছে সবাই চুপ করে গলাটা বাড়িয়ে দিয়ে উৎকর্ণ হয়ে কবিতা শুনছে। শ্রোতাদের নিমগ্নবতা দেখে মনে হচ্ছে সবাই যেন প্রতিটি শব্দের অর্থ হদয়ঙ্গম করার চেষ্টা করছে। একসময় কবিতা পাঠ শেষ হলো। শ্রোতারা অডিটরিয়ামের প্রধান দরোজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। আর আমরা যারা কবিতা পড়েছি তাদের ডাকা হলো মঞ্চের পেছনের ছোট্ট একটি কালো কাঠের দরোজার দিকে। দরোজা পেরিয়ে একটি অন্ধকার সুড়ঙের মতো সরু পথ। সে পথ ধরে নানান বাঁক পেরিয়ে এক ছোট্ট অফিস কক্ষে এসে পৌঁছলাম। ওখানে এক উর্বশী বালিকা টেবিল চেয়ার পেতে বসে আছে। কবিরা সুশৃঙ্খলভাবে লাইনে দাঁড়ানো। কী হবে এখানে? কসোভো লেখক ফোরামের সভাপতি আদেম গাশী আমাকে বললেন, আপনাকে লাইনে দাঁড়াতে হবে না। আসুন আমার সঙ্গে। বলেই হাত ধরে আমাকে টানতে শুরু করলেন।
মেয়েটি আমাকে একটি মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে বললো, সই করুন। বলেই একটি রেজিস্ট্রার বাড়িয়ে দিলো। আমি কিছু না বুঝেই সই করলাম। এরপর আমার দিকে একটি খাম বাড়িয়ে দিয়ে আবারো হাসলো উর্বশী। আদেম আমাকে পথ দেখিয়ে বাইরে নিয়ে এলেন। এরপর হ্যান্ডশেক করে ও বিদায় নিলে আমি খামটা খুললাম। দেখি, দশ ইউরোর তিনটি নোট। অর্থাৎ একটি কবিতা পড়ার সম্মানী ত্রিশ ইউরো। টাকাটা পেয়ে আমি যতোটা খুশি হয়েছি অবাক হয়েছি তার চেয়েও বেশি। কসোভোর স্থানীয় বেতন কাঠামোটাতো আমি জানি। একজন চতুর্থ শ্রেণীর সরকারি কর্মচারি বেতন পায় মাসে ৭৫ ইউরো। সচিবের বেতন ৩৫০ ইউরো, মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাদের বেতন ৪০০ ইউরো আর মন্ত্রীর বেতন ৬৫০ ইউরো। সেখানে একটি কবিতা পড়ার সম্মানী ৩০ ইউরো!
শিল্প-সাহিত্যের প্রতি এ জাতির পৃষ্ঠপোষকতার আরও কিছু নজির আমি দেখেছি। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার কারণে আমাকে প্রায়শই এর ২২টি ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট আর শত শত আঞ্চলিক ইনস্টিটিউট ভিজিট করতে হয়। প্রতিটি ইনস্টিটিউট দারুণ সব পেইন্টিংস, স্কাল্পচার দিয়ে সাজানো। মাদার তেরিজা স্ট্রিটে অবস্থিত কসোভোর প্রধান থিয়েটার হল, যেখানে সারা বছর ধরে চলে মঞ্চ নাটক। মঞ্চ নাটকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন গ্রেডের শিল্পী, কলা-কুশলীরা সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে গড়ে দেড়শ ইউরো করে মাসিক সম্মানী পান। প্রতিদিন বিভিন্ন মিউনিসিপ্যালিটির মোড়ে মোড়ে, চত্বরে চত্বরে একটি করে ভাস্কর্য দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। রোজ কোথাও না কোথাও পেইন্টিং এক্সিবিশন হচ্ছে। আর সেইসব এক্সিবিশনের পেইন্টিংগুলো সুডুৎ করে বিক্রিও হয়ে যাচ্ছে। পুরো কসোভো ঘুরে এমন একটি রেস্টুরেন্টও পাওয়া যাবে না, যার দেয়ালে অন্তত গোটা চারেক পেইন্টিংস নেই। চারশ বছরের পুরোনো হেরিটেজ, তুর্কি আমলে নির্মিত ইট মাটির ভবনসমূহ, যেগুলিকে কুলা বলা হয়, তার সংরক্ষণের জন্য লক্ষ লক্ষ ইউরো ব্যয় হচ্ছে। এইরকম একটি বিধ্বস্ত অর্থনৈতিক অবকাঠামোতে দাঁড়িয়ে শিল্প সাহিত্যের জন্য এ পরিমাণ অর্থ ব্যয়কে অর্থনীতিবিদরা হয়ত অপচয় বলতে পারেন কিন্তু আমার কাছে এর মূল্য অপরিসীম। যে জাতি তার হেরিটেজ সংরক্ষণের জন্য, শিল্প সাহিত্যের বিকাশের জন্য অর্থ ব্যয় করে না, সে জাতি সভ্যতার আলো থেকে বঞ্চিত। সে জাতির গন্তব্য এক অনন্ত অন্ধকারে নিপতিত।