সৈয়দ শামসুল হক (১৯৩৫-২০১৬) মন ও মননে সম্পন্ন-আধুনিক। বাংলা সাহিত্যের সব শাখায় তার সমান পদচারণা ছিল। তিনি দুই শতাধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। সমকালীন লেখকদের মধ্যে কবিতা, উপন্যাস, গল্প, গান, নাটক রচনায় তিনি অনন্য।
তার বেশিরভাগ কবিতায় নারী, প্রেম, দুঃখ, কষ্ট, শরীরী কামনা-বাসনার চিরন্তন রূপ ফুটে উঠেছে। তেমনই একটি কাব্যগ্রন্থ ‘পরাণের গহীন ভিতর’। এই কাব্যে প্রমিত ভাষার সঙ্গে সঙ্গে তিনি আঞ্চলিক শব্দও বুনে দিয়েছেন, পরম মমতায়। ভাষা-চরিত্র-কাহিনির খণ্ডাংশ ও বর্ণনায় এই কাব্য আবহমান বঙালির প্রেমের চিত্রের ক্যানভাস হয়ে উঠেছে।
এই কাব্যের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সৈয়দ শামসুল হক নারী হৃদয়ের আকুতি এঁকেছেন। এজন্য কখনো চিত্রকল্প-কখনো উপমার প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। কথকের ভূমিকায় রেখেছেন নারী চরিত্রকে। আর এর পরতে পরতে ছড়িয়ে দিয়েছেন লৌকিক উপাদানের বিভিন্ন অনুষঙ্গ। নারী-পুরুষের প্রেম-কাম-সৌন্দর্য চেতনা, মান-অভিমানকে গেঁথেছেন চিরায়ত মানবহৃদয়ের আকুতি দিয়ে। একইসঙ্গে ছন্দের প্রয়োগেও দেখিয়েছেন জাদুকরি শক্তি।
এই কাব্যে রয়েছে মোট ৩৩টি সনেট। আর শব্দ নির্বাচন, গঠন ও প্রয়োগে আঞ্চলিকতার প্রাধান্য দিয়েছেন কবি। প্রথম পর্বে প্রথম পঙ্ক্তি স্মরণ করা যাক, ‘জামার ভিতর থিকা যাদুমন্ত্রে বারায় ডাহুক’। এই পঙ্ক্তিতে গ্রামীণ হাটেরে জাদুকরের নৈপুণ্যের প্রসঙ্গ টেনেছেন কবি। চতুর প্রেমিকের প্রতারণা বিরহী প্রেমিকার হৃদয়ে কী পরিমাণ ক্ষতের সৃষ্টি করে, তাই ফুটে উঠেছে এখানে।
নারীর জবানিতে কবি বলছেন, বাজিকর যেমন এক নিমিষেই ভোল পাল্টে ফেলতে পারে, প্রেমাষ্পদও তার রূপের পরিবর্তন করতে পারে। বুকের ভেতরের সব শান্তি নষ্ট করে যদিও মনকে নিবিড়ভাবে আগলে রাখার চেষ্টা থাকলেও তা পারে না। সবসময় এই যে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে প্রাণে যে আবেগের সৃষ্টি করে, সেটাকেই বোঝানো হচ্ছে।
এ বড় দারুণ বাজি, তারে কই বড় বাজিকর
যে তার রুমাল নাড়ে পরানের গহীন ভিতর।”
এখানেও প্রিয়জনকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাই ব্যক্ত হয়েছে। মনের গহীনে যে অন্ধকার, সেখানে সারাদিন খোঁজ করেও মিলছে না। তাই বলছেন, সরল পথ তবুও পাথরে টক্কর! নর-নারীর প্রেমকে সাদাচোখে যেমন মাধুর্যপূর্ণ মনে হয়, সেটা শুধু বিষের বালি!
নর-নারীর প্রেমকে পাওয়া না পাওয়ার গভীরতর ব্যাঞ্জনা সৃষ্টি হয়েছে। বুকের ভেতর থেকে চিক্কুর দিয়ে ওঠে হাহাকার! এই বেদনাকে কালঘাটে শূন্য কলসের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।
কবি বলছেন, কোথাও আসলেই এমন বৃক্ষস্বরূপ প্রেমিক নেই যে, ওই বৃক্ষের মতো নির্ভেজাল ভালোবাসায় তাকে পরিতৃপ্ত করবে! এমন একটি নদী যে শুয়ে বয়ে চলবে তার ছন্দে। দ্বিতীয় পর্বে কবি বলেছেন,
আন্ধার তোরঙ্গে তুমি সারাদিন করো কী তালাশ?
মেঘের ভিতরে তুমি দ্যাখো কোন পাখির চক্কর?
এমন সরল পথ তবু ক্যান পাথরে টক্কর?
প্রেমের যে ব্যাধি, সেটা শত কষ্ট দিলেও মানুষ তাকে বুকে জিইয়ে রেখে দুঃখের মাঝে সুখ খোঁজার চেষ্টা করে। প্রিয়পুরুষখকে বাংলার লীলাভূমির মাঝে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেও বিরহী প্রেমিকা ব্যর্থ। তবু সে প্রেমের নিরাময় অসম্ভব। কবি বলছেন,
তয় কি অচিন বৃক্ষ তুমি সেই ভুবনে আমার,
আমারে দিয়াছো ব্যাধি, নিরাময় অসম্ভব যার?
এই অংশে মনে হয়েছে, এটা প্রেমিকের প্রেমিকার হৃদয়ের আকুতি! যাকে পাওয়ার জন্য শত রাত বিনিদ্র থেকেও একবার তাকে পেলে তার মূল্য কমে যায়! ঘুমের ভেতরেও দিনের পর দিন যার জন্য স্বপ্নের জাল বুনে চলেছিল, সেই সোনার মোহর একসময় নিতান্ত মাটির মতো মনে হয়! শুকনা পাতার মতো সে উঠানে গড়াগড়ি খায় যার কোনোই মূল্য নেই। এই অবদমন শুধু যে কবি হৃদয়ের রক্তক্ষরণ তা নয় বরং প্রতিটি মানুষের মনের গহীনে লালিত বেদনা, সে নারী বা পুরুষ যেই হোক! যে সংসার ফুলেফুলে ভরে ওঠার কথা ছিল, সেখানে শুধুই অযত্নে অবহেলায় ইঁদুরের ঢিপি দেখা দেয়! কবিতায় পাই,
মানুষ এমন তয়, একবার পাইবার পর,
নিতান্ত মাটির মনে হয় সোনার মোহর।
প্রিয় পুরুষ দূরে চলে গেছে। তবু প্রেয়সী ভাবছে, মানুষ দূরে গেলেও তো ফিরে আসে! কত লোক দূরে কত কামে যায়, ফিরা আসে বাড়ি! কিন্তু তার প্রেমাস্পাদ আর ফিরে আসে না! এখন সে কোথায় যাবে! এই যাওয়া তার একার নয়, এটা বাঙালির চিরন্তন যাওয়া! মানুষ নিজেই তাজ্জব হয়ে যায়, আজ যা তার, ঠিক তাই আগামীকাল অন্য কারও! মানুষ পাল্টায়। সবাই যায়-আসে। কিন্তু সেই চিরচেনা মানুষটির আর সাক্ষাৎ পাওয়া যায় না!
কত লোক কত কামে দূরে যায়, ফিরা আসে বাড়ি
আমার আসন নাই, যাওনেরও দারুণ সঙ্কট।
আসুম? আসার মতো আমি কোনো ঘর দেখি নাই।
যামু যে? কোথায় যামু, বদলায়া গ্যাছে যে বেবাক।
যেই প্রেমিক পুরুষ তার খুব কাছে ছিল, বুকের মাঝে ছিল, সেই আজ হারিয়ে গেছে! অস্থির খেলায় পানির মধ্যে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে মনের অজান্তেই। কিন্তু থেকে যায় মনের গহীনে। বুকের ভেতর ‘চিন’ দিয়ে উঠলেও তাকে পাওয়া হয়ে ওঠে না! জগৎ বদলে যায় খনিক আলোর ঝলকানিতে! যমুনার কিনারের মতো তার মনও ভাঙে।
তোমারে পরাণ দিছি তাই বইলা দেই নাই হুঁশ,
আমি তো তোমারে নিতে চাই নাই ঘরের বিছনে।
আঙিনার পাশে ফুল লাগালেই যে সেটা সৌরভ ছড়াবে এমন নয়! প্রেমিক পুরুষের ভিন্ন ভিন সময়ে ভিন্ন রূপ। এই পুরুষ কখনো প্রেমিক, কখনো স্বামী। দুঃখের কুসুম ঘিরে থাকলেও সংসার নিয়ে সে বাড়াবাড়ি করে।
একবার চাই এক চিক্কুর দিবার, দিমু তয়?
জিগাই কিসের সুখে দুঃখ নিয়া করো তুমি ঘর?
এই কান্না তাকে ছাপিয়ে আবহমান বাঙালির হৃদয়ের কান্নাকে প্রকাশিত করেছে! নর-নারীর প্রেমকে পাওয়া না পাওয়ার গভীরতর ব্যাঞ্জনা সৃষ্টি হয়েছে। বুকের ভেতর থেকে চিক্কুর দিয়ে ওঠে হাহাকার! এই বেদনাকে কালঘাটে শূন্য কলসের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। প্রেমিকের দেখা যদি না-ই মেলে, তবে তার চোখের আর কী দরকার?
১৮ মাত্রার অক্ষরবৃত্তে রচিত এই কাব্যে চিত্রকল্প-উপমার প্রয়োগ ঘটিয়েছেন আশ্চর্য কুশলতায়। শব্দে-ছন্দে কবি জীবনের নানা অভিজ্ঞতা, দার্শনিক চেতনা ফুটিয়ে তুলেছেন অবলীলায়।
সচ্ছল দেশের মতো নারীর মনও পরিপূর্ণ জহরতে কিন্তু সেটা বিরান সড়ক আজ! ভালোবাসার অনুভূতির টান অনুভব করলে আচনক অস্থির হয়ে ওঠেন কবি হৃদয়! পরানের গহীনে কোন সে শিকড়, যে শিকড়ের কারণে সবকিছু ফিকে মনে হয়! যমুনার তল খুঁজে পায় না। সুখের সব মন্ত্র তার কাছে অচেনা মনে হয়।
নারী তার পুরুষের কাছে জানতে চায়, কী আছে তার? তার তো দেশ নেই, ঘর নেই, নেই কোনো পরিজন! তার হৃদয় খালি, সেখানে কিছু নেই। তাদের সহাবস্থানের কারণে তাদের মধ্যে প্রেমের আদান-প্রদান ঘটতে পারে!
আমার বেড়ায় খালি ইন্দুরের বড় বড় ফোক,
আমার বেবাক ফুল কাফনের ইরানি আতর।
তোমার কি সাধ্য আছে নিয়া যাও এইখান থিকা,
আমার জীবন নিয়া করো তুমি সাতনরী ছিকা?
এই কবিতার বিপুল অংশজুড়ে আবহমান নারী হৃদয়ের চিরন্তন অভিযোগের সুর ধ্বনিত হয়েছে। যে নারী ভালোবাসা পায়নি। যে নারীর গহীন হৃদয়ের সন্ধান পেলেও প্রেমিক তার মূল্যায়নে ব্যর্থ। কখনো তাকে সুন্দরী বলে আখ্যা দেয়নি। তাই এই প্রেমিকার অভিযোগ, তাকে হারিয়ে কি সত্যিই প্রেমিক জমিহারা চাষীর মতো তড়পাবে? প্রেমের এই গভীর প্রকাশ নর-নারীর প্রত্যেকের কামনা-বাসনার রূপায়ণ!
শরীল পাথর হয়া যায় কিনা পানের ছোবলে,
আমারে হারায়া দেখি জমিহারা চাষী হও কিনা?
এমন দেখতে বড় সাধ হয় আল্লার কসম।
পুরো কবিতায় প্রেম-বিরহ একাকার হয়ে উঠেছে। এখানেই সৈয়দ হকের সাফল্য। এক নারীর জবানিতে মূলত চিরকালের প্রেমিক হৃদয়ের আকুতি প্রকাশ করা হয়েছে। এই কাব্যে প্রেম এসেছে ভিন্ন ভিন্ন ধারায়। ‘পরানের গহীন ভিতর’ কাব্যে বাঙালির চিরন্তন কামনা-বাসনার রূপায়ণ ঘটেছে। অবদমনজনিত চেতনা ক্রিয়াশীল থেকেছে সর্বদা। ১৮ মাত্রার অক্ষরবৃত্তে রচিত এই কাব্যে চিত্রকল্প-উপমার প্রয়োগ ঘটিয়েছেন আশ্চর্য কুশলতায়। শব্দে-ছন্দে কবি জীবনের নানা অভিজ্ঞতা, দার্শনিক চেতনা ফুটিয়ে তুলেছেন অবলীলায়।