আজ পৃথিবীর মানুষের একমাত্র পরিচয়, নগণ্য তারা, অসহায়। মুহূর্তে পাল্টে যাওয়া অসহায়ত্বের রূপ অভিজ্ঞতার সমষ্টিতে ভরিয়ে তুলছে জীবনের নবতম সংজ্ঞা। কাগজে-কলমে, ধ্যানে-জ্ঞানে, নীরবতায়-মুখরতায় অসহায়ত্ব বোঝার চেষ্টা অনভ্যস্থ আমাকে বিপর্যস্ত করে তুলছে। প্রাচুর্যের ভাণ্ডার থেকে তুলে আনা ভারী শব্দসমষ্টিও মেলাতে পারছে না বেঁচে থাকার সর্বজনীন চুক্তির সরল হিসাব।
সমবেত সমৃদ্ধির বিনিয়োগে, একটু একটু করে গড়ে তোলা পরিব্যাপ্ত সমাজের রূপ আজ অসার। মানবতার সীমানায় আজ হাহাকার করছে শত কণ্ঠের অসহায়ত্বের গান রচিত হয়েছিল, যা কন্ঠহীনের দীক্ষায়। তাই কণ্ঠ আমার ভীতিময়। শুধরে নিতে নীরবতাই শেষ আশ্রয় আজ। নীরবতার চেতনাকে বাড়িয়ে তুলতে হঠাৎ উচ্চারিত মন্ত্র!
অসীম নীরবতা ছেয়ে যায় শ্রেণীকক্ষের বেঞ্চজুড়ে, রাজপথের জনারণ্যে, অফিস পাড়ার লিফটে আর প্রগতির বারান্দায়! দৃষ্টি ধ্যানস্থ করার নতুন পদ্ধতিতে মেতেছি, শিখছি-বুঝছি অস্পৃশ্যতার মন্ত্র, শেখাচ্ছি, আমাকে, আমি। আমিহীন হওয়ার বাজারজাতকৃত নতুন অ্যাপস আমাকে ক্রমশ আরও করবে গ্লোবালাইজড। এর একটা জুতসই নাম হতে পারে, একাকিত্বের সঙ্গে একা! কিংবা একার সঙ্গেথে একাকিত্ব! এই এক মজার খেলা। মগ্নতা ভেঙে নয়, ঘোর কাটিয়ে চোখ খোঁজে ল্যুভর মিউজিয়াম বা উফিজি গ্যালারির চিত্রকর্ম। তেমন ছবি পৃথিবীর কোনো শিল্পী আঁকার কথা ভাবেনি একটি বারও। পাঁচশ বছর আগের নিজের আকাশের ছবি একেঁছেন তিনি স্বয়ং, পৃথিবী তার নাম! ‘নিজের’, কেননা বোঝাপড়া সবসময় দ্বিধান্বিত করে মন, এ কি ভারসাম্যের সঙ্গে ভারসাম্যহীনতা নাকি সাম্যের জন্য সম্মিলন!
তবু তার খোঁজে ছুটি উপাসনালয়ে! তৈরি হয় কৃত্রিম শান্তির সীমানাপ্রাচীর।
নিপুণ ভারসাম্যের জন্যে ফিরে চলি পথ ধরে সবুজের অভিবাসনে। আজ না হোক, কাল, কিংবা অন্য কোনোদিন, অন্য কোনো ক্ষণে, ফিরে যেতেই হবে একদিন। ভুল যা কিছু, তাকে সঁপে দেই ভীতিহীন নির্ভরতার রেখায়। আর এক্ষেত্রে আশান্বিত করছে আমাকে অদৃশ্য সেই শিল্পী, যিনি এঁকেছেন এমন ছবি নিউইয়র্ক থেকে ইউরোপের ঝলমলে নির্মল আকাশজুড়ে, বিশ্বময়। আর ডলফিনের ফিরে আসা বালুচরের জলে, নাচের মুদ্রায় ভেনিস থেকে কক্সবাজার। তাকে বলি, পৃথিবীময় এই এক অন্য রকম বসন্ত! সময়ের এক নাটকীয় বিজয়। যুক্তিতে ঠাসা তরুণের মস্তিষ্কে সজোরে ধাক্কা দিচ্ছে হঠাৎ জেগে ওঠা এক নতুন বিস্ময়, তার মনে জাগিয়ে দিচ্ছে অচেনা এক অচলায়তনের অনুভব। নিশ্চিত জানি, তরুণ হৃদয় বুঝে নেবে হঠাৎ, নীরবতার ছবি আঁকতে হবে, ফেলে আসা সুনিপুণ রঙে। এটাই ভবিতব্য!
আশাকে তবু বাঁচিয়ে রাখি সম্ভবনার খোঁজে। বিশুদ্ধ সম্ভাবনা। হিমালয় সাদা হবে আরও, ফেননিভ শুভ্রতার রঙে। ঘরে ফেরার আগে পরিযায়ী পাখি ডানা ঝাপটানোর শব্দে শুনিয়ে যাবে পথ ফিরে পাবার গান। এক পৃথিবী, এক আকাশ, এই আমাদের জন্মগত যৌথতার উত্তরাধিকার। তবু সংশয়, নিরাপদ সমাজের রূপ এক হওয়ার নয়। নগণ্য বর্তমান আমি-তুমি, তুমি-আমি মিলে নবতর মানবিক পৃথিবী গড়ার যুদ্ধে নিরাপরাধ মনের দৃঢ়তম সংকল্পে। ঘরের কোণে পড়ে থাকা পুরনো সময়ের গালিচায় ফুঁ দিয়ে ধুলো সরাই, আর উড়িয়ে দেই পুরনো অভ্যাস। বন্ধন ঝেড়ে শুকোতে দেই চৈত্রের খররোদে। সেই কবিতা-গান বা মুখ-মুখোশের পুরনো অ্যালবাম খুঁজি, যেখানে আছে বেঁচে ওঠার প্রেরণা।
আগামীর পথ যেন সামনের নয়, সাম্যের। পথ ধরে ফিরে আসি প্রান্তরে। ক্ষুধাকাতর পেট আর পিঠের দূরত্বের সংগ্রামে রোদে পোড়া এক রিকশাঅলা। তার পরিচয় মানুষ! তার পিঠে রাষ্ট্র উপহার স্বরপ বসিয়ে দিচ্ছে বেতের ঘা! আজন্ম পরিচিত ভাইরাস, ক্ষুধা, প্রান্তিক সমাজের হাত ধরে প্রগতির রাজপথে ক্রমশ বেড়ে ওঠা ভীতিকে করছে প্রগাঢ় আলিঙ্গন। টেলিভিশনের পর্দায় সবশেষ আপডেট, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে যাচ্ছে দেশ, কাল, জাতি! এই গ্রহের অন্বেষা কী–জাতি না রাষ্ট্র? উত্তর মেলাতে বিতর্ক যখন পথ আগলে দাঁড়ায়, তখন অদৃশ্য স্মরণে প্রতিধ্বনি ওঠে, ‘তিনি সর্বত্র বিরাজমান’। তবু তার খোঁজে ছুটি উপাসনালয়ে! তৈরি হয় কৃত্রিম শান্তির সীমানাপ্রাচীর। গোলাকার এই গ্রহটিতে শুরু হয় বাস্তব উপযোগহীন সম্প্রীতি সম্প্রীতি খেলা। কে যেন বলে ওঠে, শুধরে নাও! আবার যেন দেখা না হয় একশ বছর পর। পৃথিবীর ইতিহাস লেখা হচ্ছে একই শব্দে, বারবার, মানুষ আজও অসহায়!