সময়টা, শ্যাওলাডোবা মায়াবী স্মৃতির সরোবর। কাকের চোখের মতো স্বচ্ছ কালো জলে ফুটে থাকা অসংখ্য জীবন-কুসুমের মধ্যে একটি উন্মুখ কুসুম সর্বক্ষণ আমার হাতটি ছুঁয়ে থাকতো আলতো করে। শৈশবে পাওয়া এই সম্পর্কের নাম নানি-মা। নাম তার বেগম হায়াত-উন-নেসা। যৌবনে যথেষ্ট সুশ্রী ও সুন্দরী ছিলেন, তার একহারা ছিপছিপে গড়ন, ফুটন্ত কাঁঠালীচাঁপা রঙ ও শুভ্র চুলের সৌরভ দেখেও বোঝা যেতো।
ওই সময়ে অবশ্য তার আকার, আকৃতি কিংবা কায়া বোঝার বয়স নয় আমার। কিন্তু সুগভীর কুয়োর জলের মতো শীতল তার স্বচ্ছ স্নেহ-মায়া অনুভব করেছি শিশুকাল থেকেই। তার অফুরন্ত ভালোবাসার যজ্ঞ থেকে নতুন এক লেখক জন্ম পেয়েছিলাম বলেই ভাবি আজ। আমার জন্যে তিনি ছিলেন অপরূপ এক ভালোবাসা শিরোনামের গাছ-পাথর।
সারাদিনের কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়ার মধ্যে থেকে সে আমাকে খুঁজে নিতেন সাঁঝের বেলা। গরম পানি দিয়ে হাত-পা ধুয়ে দিয়ে তবে তার বিছানায় নিয়ে তুলতেন। একাকী শূন্য বিছানায় তার নরম তুষারের মতো পেটে হাত রেখে ঘুমিয়ে যেতাম ধীরে। ঠাকুর মায়ের ঝুলি থেকে বেছে বেছে রহস্য গল্প বলা নানি-মা নয় সে। আকাশের মতো চুপচাপ। তাকে দেখেই শিশুকালেই নির্বাক উদাসীনতার মানে বুঝে গেছিলাম।
প্রকৃতির মতো ছায়াচ্ছন্ন, দখিনা বাতাসের মতো রোমান্সিত ও সর্বোপরি মমতাময়ী এক অবিনশ্বর আত্মার মানুষ কেমন হয়, তাকে দেখেই বুঝেছিলাম। চারপাশের কোলাহলময় হল্লা করা মানুষের পাশে তিনি ছিলেন নতমুখ দেবদারুর মতো সন্ত-বৃক্ষ। তার নির্জীব বিছানায় আমি যেন সবুজ তৃণ, তারই ত্বকের উষ্ণতা শুষে নিয়ে বড় হয়েছি একটু একটু করে। সেই সময়ে আমার মাকে বিস্তার করে আছে তার বহুল কাঙ্ক্ষিত প্রথম শিশুপুত্র। অনাকাঙ্ক্ষিত আমি ছিলাম নানি-মায়ের বুকের মধ্যেখানে এক সহিষ্ণু-বিধুর প্রাণ। অনেক পরে বুদ্ধদেব বসুর কবিতার একটি চরণে আমাদের সম্পর্কের সূত্র খুঁজে পেয়েছিলাম, ‘নাতনীর যৌবনে হাত সেঁকে নেন মাতামহী।’ আমার মাতামহী কি সেরকম কিছু অনুভব করতেন? কখনো জানতে পারিনি।
তবে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করেছি, তখনো কোনো চাকরি হয়নি। অনিশ্চিত উদ্ভ্রান্ত এক সময় পার করছিলাম, একটা চাকরির প্রত্যাশায়। গ্রামে গিয়ে বিয়ের আশায় বসে থাকার বয়স নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ এক স্বাধীন মানুষ আমি। শামসুন্নাহার হলের নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে আজিমপুরে একটা বাসা নিয়েছি, একাকী থাকি, আমার সঙ্গে থাকে পৃথিবীর যাবতীয় উদ্বেগ, উৎকণ্ঠাময় শব্দসম্ভার। মাঝে-মধ্যেই আমি তাদের মুক্ত করে দেই শব্দের পরে শব্দ সাজিয়ে।
আমার একাকী যাপনে উদ্বিগ্ন হয়ে প্রায় ৯০ বছর বয়েসী আমার নানি-মা হঠাৎ ঢাকায় চলে এলেন সঙ্গ দিতে। আগে থেকেই জানতাম, তিনি আমার জন্য সর্বস্ব উজাড় করে দেওয়া এক ভালোবাসার নাম। বাংলাদেশ রেডিওতে তখন বিভিন্ন ধরনের স্ক্রিপ্ট রাইটার হিসেবে বিচিত্র ধরনের কাজ করি। পাশাপাশি কবিতার খাতা টইটুম্বর কিন্তু কোথাও ছাপতে দেই না। লিখি তো নিজের ভালোবাসা ও ভালোলাগার জন্যে। নিজেকে খুশি রাখার সাধনায়। কাজেই নিজেকে প্রকাশের জন্যে এত তোড়জোড়ের কী আছে?
সুধীন্দ্রনাথ দত্তের মতো আমিও ভাবি, আগে সিদ্ধিলাভ হোক, তারপর না হয় প্রকাশিত হবো! মনের মধ্যে এমনতর ভাবনা আগেও ছিল, এখনো আছে। দুর্মরভাবে এমন প্রচারের যুগেও শিল্প-সাহিত্য নিয়ে আমার ভাবনা একই রকম। একদিন ইচ্ছে করলো নাটক লিখবো। কয়েকদিনের মধ্যেই পাঁচ অঙ্কের একটি নাটক লিখে ফেললাম মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজে এইচএসসি পড়ার সময়ে। তারপরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে কোন ফাঁকে তা হারিয়েও ফেললাম। প্রায়ই মনে হয়, বায়বীয় এই শিল্পের পেছনে আয়ুক্ষয় করে এই যে, দীর্ঘায়িত লেখক জীবন—তা যেন গ্রিক পুরাণের অভিশপ্ত, ভাগ্যাহত সেই সিসিফাসের মতো। বার বার পাহাড়ের চূড়ায় ভারী পাথর তোলার সংকল্প নিয়ে জীবনের অনিঃশেষ এক অভিনব যাত্রা।
চাকরির খোঁজ-খবর করে, ফিরতে কোনো কোনোদিন দেরি হলে, বাসায় ফিরে দেখি নানি-মা তখনো না খেয়ে বসে আছেন আমার জন্যে। নারিকেল গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আকাশের দিকে।
জানা-অজানায় নির্বান লাভের অলৌকিক এক বাসনার আরাধনা। চারপাশের অসুর উজিয়ে চিরন্তন সুরের সাধনার এই অঙ্গীকার আদৌ কোথাও পৌঁছে দেবে কি না—সে কথা ভেবে নিশ্চয় এমন অনিশ্চিত পথে কেউ আসে না। হতে পারে তা ‘পদব্রজে নয়তো পায়ে হেঁটে’। ‘এই পথ চলাতেই যেন আনন্দ’—যারা তা অনুভব করে হৃদয়ের গভীর তন্ত্রীতে, তারাই এই শিল্পের পথের চিরন্তন পথিক।
এক সময় সুরের সাধনায় আমারও খুব মন মজেছিলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে পঁচিশখানা গান লিখে জমা দিয়েদিলাম রেডিওতে। তার জন্যে যে তদবির করতে হয় জানি না। রেডিওতে দুটো নাটকে অভিনয় করেছি।পরে মনে হলো, নাহ। লেখাই আমার কাজ। এখনো মনে পড়ে, খেলা শেষ করে সেদিন সখিরা সব চলে চলে গেছে যে যার গৃহে। আমাদের বহির্বাটির বেলতলায় একাকী বসে তর্জনিকে কলম করে মাটির খাতায় প্রথম চার পঙ্ক্তির একটি সমিল ছড়া লিখে নিজেই যেন আনন্দে আত্মহারা। সেই আনন্দ শেয়ার করতেই দৌড়ে গিয়ে তা খাতায় লিখে মাকে প্রথম দেখালাম। কেন? মা যে আমার প্রতিদিন দুপুরে শুয়ে শুয়ে বই পড়ে। কাজেই সেই হোক আমার প্রথম পাঠক এবং বিচারক। মা দু’বার পড়ে বললেন, খুব ভালো হয়েছে।
মায়ের উৎসাহে ও অনুপ্রেরণায় সেই যে যাত্রার শুরু আজও তা অব্যাহত। সেই লেখার অভ্যাস থেকেই নানা বিষয়ে লিখতাম তখন। রেডিওর স্ক্রিপ্ট লেখার একটি কাজ পেয়েছি। এতেই খুশি আমি। মানে আমি লেখক! লিখি, কখনো আবার তাতে কণ্ঠ দেই, এসব কাজেই প্রায় প্রতিদিন শাহবাগের রেডিও অফিসে যাই। চাকরির খোঁজ-খবর করে, ফিরতে কোনো কোনোদিন দেরি হলে, বাসায় ফিরে দেখি নানি-মা তখনো না খেয়ে বসে আছেন আমার জন্যে। নারিকেল গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আকাশের দিকে।
অনাবিল হৃদয়ে উদাসীন মমতা মেখে তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতেন আমার অপেক্ষায়। আজ মনে হয়, তিল তিল করে তার সঙ্গেই গড়ে উঠেছিল আমার প্রথম প্রেমের সম্পর্ক। অলৌকিক এক টেলিপ্যাথিও ছিল সেই সম্পর্কে। অসংখ্য ঘটনার মধ্যে একটি ঘটনা খুব মনে পড়ে আজ।
খবর না দিয়ে হঠাৎ একদিন শামসুন্নাহার হল, ঢাকা থেকে বাড়ি গেছি, মা সেদিন তিলের ময়ান দিয়ে তিলকুলি পিঠা বানিয়েছিলেন। এই পিঠা আমার যে খুব পছন্দের, তা নানি-মা এবং মা দু’জনেই জানেন।
লেখাটিকে সাধনা মনে করি। তবু প্রিয় পাঠকেরা দয়া করে যেটুকু পড়বেন, সেইটুকু আমার লেখক হওয়ার গল্প। এরচেয়ে বেশি কিছু ভাবি না।
সাধারণত, পিঠা বানালেই বড় পরিবারের সব সদস্যের মধ্যে বিলিবণ্টন করে দিনের পিঠা দিনেই শেষ হয়ে যেতো, সেদিনও তাই হয়েছে। নানি-মা সেদিন কী মনে করে যেন তার জন্যে নরম করে সেঁকা পিঠাগুলো আলাদাভাবে তুলে রেখেছেন। তার মনে হয়েছে হঠাৎ আমি চলে আসতে পারি বাড়িতে। আমাকে পেয়েই নানি-মা তার পিঠাগুলো খাওয়াতে পেরে কি যে আনন্দ আর পরিতৃপ্তিতে ভেসেছিলেন, আজও মনে পড়ে সেদিনের মুখখানা তার।
এই দৃশ্যান্তর দেখে আমার মাও খুব অবাক হলেন এবং একটু যেন বিব্রতও হলেন এই ভেবে যে, আমি তার প্রথম সন্তান—তার কেন মনে হলো না মেয়েটি হঠাৎ আসতে পারে ছুটে। মায়ের মমতা, আমার মাকেও যেন ক্ষণিকের জন্যে আবেগ বিহবল কাঠগড়ায় দাড় করিয়ে দিয়েছিল সেদিন। বহুদিন সন্ধ্যার পরে নানি-মার পাশে শুয়ে শুয়ে পথের পাঁচালির দুর্গার মতো আমার সাধ চলে যেতো দূরগামী ট্রেনের মতো ঝিকঝিক শব্দ করে। আমার মায়ের পড়া উপন্যাসগুলো চুপিচুপি এনে নানি-মার বিছানায় শুয়ে-বসে পড়তাম প্রায়ই। কেমন যেন করে যেন বুঝে যেতেন আমি অপাঠ্য বই পড়ছি।
তখন বলতেন, আসল থুয়ে নফল পড়তেছো, ঠিক হচ্ছে না। আগে আসল পড়া শেষ করো বইনডি। পাঠ্য, প্রয়োজনীয় বই ছাড়া বাকি সব বই পড়াকে তিনি নফল নামাজের সঙ্গে তুলনা করে কথা বলতেন। আজ মনে হয়, ছোটবেলায় নানি-মার থেকে পাওয়া অখণ্ড ওই তীব্র ভালোবাসা এবং মায়ের থেকে পরিপূর্ণ ভালোবাসা না পাওয়ার তীব্র ক্ষোভ ও দ্বৈরথ আমাকে লেখার জগতে ঠেলে দিয়েছে দুই হাতে।
বাল্মীকির শ্লোকের মতো হঠাৎ সেদিন যে শব্দ-অঙ্কন শুরু হলো সমিল ছড়ার দেহসৌষ্ঠব নিয়ে—পরবর্তী সময়ে তাই হলো কবিতা—কবিতা, শুধুই কবিতা।শত জনমের এক নিরুদ্দেশ যাত্রা,আরাধ্য জীবনদেবতার পানে।
সমসাময়িক জীবনের চেয়েও শাশ্বত এই শিল্প-সাধনাকে গভীরভাবে ভালোবেসেছি বলেই একজন অপরিনামদর্শী কবির সঙ্গেজীবন জড়িয়ে ফেলেছি। উদ্দেশ্য কিন্তু একটাই, অমৃতকুম্ভের সন্ধান। আটপৌরে বাস্তব জীবনের মধ্যেও আমি শিল্পের সোনালিজীবন চাই, ঐশ্বরিক উৎযাপন চাই।
চব্বিশ ঘণ্টার সেই জীবনকে আমি শিল্পের পরশে মহিমান্বিত করে কাটাতে চেয়েছি। আর তো বেশি কিছু চাইনি। ধরম না জেনে তাই রফিক আজাদের সঙ্গে মরম বাখানে দুই কবির যৌথ-শিল্প যাত্রায় জমা হয়েছে জীবনের সাঁইত্রিশ বছরের আলেখ্য।নিত্য অনিত্যের বিসম্বাদ। কবির প্রয়াণের পরে জাগ্রত বিরহের কবিতার পাশাপাশি এখন গদ্যও আমাকে উদ্দীপ্ত করে রেখেছে তুমুলভাবে। তবে, আমি লেখক হয়েছি, একথা কখনো ভাবি না। সময়ই শিল্প-সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ বিচারক।
সমসাময়িক কালের বিচার অনেক সময়ই ধোপে টেকে না।চিন্তাসূত্রের অনুরোধে এই লেখাটি লিখতে একটু বেশি সময় নিয়েছি। কেননা, নিত্য অনিত্যের বিচারে নিজের অবস্থান নির্ণয় করতে আমি আসলে এখনো অপারগ। কাজেই, লেখক হওয়ার মতো আমার কোনো গল্প নেই। আমি প্রচার-স্রোতের বিপরীতে দাঁড়ানো মানুষ ছিলাম সব সময়ই। লেখাটিকে সাধনা মনে করি। তবু প্রিয় পাঠকেরা দয়া করে যেটুকু পড়বেন, সেইটুকু আমার লেখক হওয়ার গল্প। এরচেয়ে বেশি কিছু ভাবি না।