শায়খ আব্দুর রহমান আর বাংলাভাই কাঁপিয়ে তুলছেন সারাদেশ। বিশাল মিছিল প্রকম্পিত করে যায় বড় রাস্তা পার হয়ে সরুগলি পর্যন্ত। জোশনে জলুসে বেগবান সেসব স্লোগান। ‘নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবার। আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান’। বিশেষ করে কওমি মাদ্রাসার কিশোর-তরুণদের কণ্ঠে এই স্লোগানটি উচ্চারিত হতো খুব দৃঢ়তার সঙ্গে। ২০০৬-৭ এর দিকে বাংলাদেশের প্রকটতম দৃশ্যগুলো ছিল এমনই সহজ ও বিস্ময়কর!
আমিরুল মোমেনীন মানিকের সঙ্গী হয়ে জঙ্গিবাদবিরোধী সচেতনতামূলক নিউজ প্রোমোশনাল তৈরির এসাইনমেন্ট হলো। আইডিয়াটা কার ছিল? মানিকের নাকি তৎকালীন বার্তা বিভাগ প্রধান আনিস আলমগীরের?
আমিরুল মোমেনীন মানিক। বিনয়ী ও বন্ধুবৎসল মানুষ। দরদভরা কণ্ঠ। চমৎকার গায়। হামদ-নাতসহ আধুনিক গানের ভারি মিষ্টি গলা। সাধারণ কথাবার্তাও অসম্ভব সুরেলা করে তোলাতে তাঁর জাদুকরি দক্ষতা।
মানিক ইসলামী ছাত্র শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয় ছিল। শিবিরের ইসলামী সাংস্কৃতিক শাখা ‘সাইমুম শিল্পী গোষ্ঠী’র শৈল্পিক ও সক্রিয় সদস্য সে। ঢাকায় অনুষ্ঠিত কোনো একটি সংগীতানুষ্ঠানে বৈশাখী টেলিভিশনের চেয়ারম্যান মীর্জা আব্বাস তাঁর গান শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন। সেই থেকে সংবাদকর্মী হিসেবে বৈশাখীতে কর্মযাত্রা। তবে পেশাগত বিবেচনায় মানিক সবসময় উত্তীর্ণ —এ কথা স্বীকার করবেন সবাই, যারা তাঁর সঙ্গে কর্মক্ষেত্রে যুক্ত ছিলেন।
নির্ধারিত অ্যাসাইনমেন্ট অনুযায়ী জনপ্রিয় চিত্রনায়িকার সঙ্গে যোগাযোগ হলো। তিনি সম্মতি দিলেন। আমরা ছুটে গেলাম এফডিসিতে। কোনও একটি সিনেমার শ্যুটিং শুরু হবে। প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। এর মধ্যে আমাদের উপস্থিতি তাঁকে খানিকটা উৎসুকও করে তুলল। মিডিয়াবান্ধব অভ্যর্থনাই বলতে হবে। কথা বলার জন্যে মেকাপ রুম থেকে হাসিমুখ করে বের হয়ে আসলেন। কুশল বিনিময়ের ফাঁকে ইউনিটের কেউকে দু’কাপ চা’য়ের ব্যবস্থাও করতে বললেন।
ক্যামেরা অন হলো। মনিটরে চেহারা কতটা রূপসী হয়ে ফুটছে এ নিয়ে তাঁর উৎকণ্ঠার শেষ নেই। আয়নায় বেশ কয়েকবার মুখ দর্শন করে নিলেন। চুলের পরিপাটি বিন্যাস শেষ হলো। এবার বক্তব্যের পালা।
বিষয়বস্তু শুনে নায়িকার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার দশা! কিছুক্ষণ নির্বিকার বসে থেকে ক্যামেরা অফ করতে বললেন। অফ দ্য রেকর্ডে তিনি যা বলে গেলেন, তাতে তাঁর মাথায় ভেঙে পড়া আকাশ আমাদের মাথায় এসে ঠেকল। ‘জঙ্গি যাদের বলছেন, তারা তো বাংলাদেশে অনেক, তাই না? তারাও তো আমার সিনেমা দেখে। অনেকে আমার ভক্ত থাকতে পারে। তারা তো সবাইকে মারে না। তাদের শত্রু যারা তাদের মারে। আমার সঙ্গে কারও শত্রুতা নেই। সুতরাং তাদের বিরুদ্ধে আমি কোনও কথা বলতে চাই না’।
নায়িকা শিরোমণিকে বোঝানো গেলো না কিছুতেই। বিষণ্ন মুখে হাল ছেড়ে দেওয়া ছাড়া উপায় কি! তবে ক্যামেরা টার্ন অফ হলো না। রেকর্ড সিগন্যাল অফ রাখা হয়েছিল। নায়িকার এ বক্তব্য এখনও বৈশাখী টেলিভিশনের আর্কাইভে জমা থাকার কথা। তবে তা খুব প্রয়োজন ব্যতীত প্রদর্শনের জন্য না নিশ্চয়। কেননা নিরর্থক কেউকে সম্মানহানী করা বা করানো মিডিয়ার কনসেপ্ট হতে পারে না।
সে যাত্রায় আমাদের বিষণ্নতা কাটাতে চমৎকার ভূমিকা রাখলেন টিভি অভিনেত্রী শমী কায়সার। চিত্র নায়ক রিয়াজ ও অভিনেতা দিলদার। প্রমোশনালের পাশাপাশি কয়েকটি ধারাবাহিক প্রতিবেদনও প্রচার হলো। মানিকের প্রাণবন্ত ভয়েসওভার ও রিপোর্টিং ছিল প্রশংসনীয়।
চিত্রনায়িকার ঢের ব্যস্ততা। মেকাপ নেওয়া। মেকাপ তোলা। রং বাহারি ড্রেস-আপ। দেশ-বিদেশের বিউটিশিয়ানদের দ্বারস্থ হওয়া। শ্যুটিং-ডাবিং। স্ক্যান্ডাল। পার্টি। বিশ্রাম। কতোসব আয়োজন! বই-পুস্তকে মনোযোগ দেয়ার সময় কোথায়? পত্রপত্রিকা বা নিউজ মিডিয়া? নায়িকা নিজেই তো নিউজ—আমরা তাঁকে পাঠ করি। তাঁর চুল চোখ ভ্রূ নাক-কান, গলা থেকে গলার নিচে বড় গলার ব্লাউজ। আঁটসাঁটো কামিজ-শেমিজ-টিশার্ট-ডিভাইডার। হাঁটুর নিচে বা ওপরের ফাঁড়া স্কার্টসহ আরও কত্ত কি!
চিত্র নায়িকার কোনো শত্রু থাকতে নেই। শত্রুতা তাঁর ভালোলাগে না। শত্রু থাকে রূপালী পর্দায়। ভিলেন আঙ্কেল বনে জঙ্গলে নিয়ে বস্ত্রহরণ করে ফেলে! তখন ফ্লাইং সসারে হিরো এসে তার জুতা মোজা শার্ট প্যান্ট খুলে হিরোইনকে সেফটি দেয়। হিরো পরে বনের রাজা টারজান হয়ে যায়!
বাস্তবে তিনি নিরাপদ, নির্বিবাদী মানুষ। সকলকে তাঁর ভক্ত অনুরাগী রূপে কামনা করেন। ফলে পক্ষে বিপক্ষে কথা বলে কারও বিরাগভাজন হওয়াটা শোভন বিবেচনা করেন না কোনোভাবেই।তবে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, এ দেশের অনেক খ্যাতিমান লেখক সাহিত্যিকও কারও বিরোধিতা বা সমালোচনার স্বীকার হতে চান না সহসায়। তাঁরা সর্বজনগ্রাহ্য হয়ে থাকতে ভালোবাসেন। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে তাঁদের স্পর্শকাতরতা মুগ্ধ হওয়ার মতো। এমনকি মৌলবাদী খুনি জঙ্গি রাজাকার প্রশ্নে আপনি কাউকে শালা-সমন্ধী পর্যায়ের গালমন্দ করে দেখতে পারেন। অনেক একাডেমি বিজয়ী লেখকের তাতে মৃদু থেকে মাঝারি মানের গাত্রদাহ শুরু হবে! এর কারণ কি ফাইন্যান্সিয়াল? নাকি আরও দূর-প্রসারী? অথবা হতে পারে নেহায়েৎ আবালসুলভ বহুগামিতা। সবার দ্বারে-দ্বারে গমনেই যত সুখ।
বৈশাখী টেলিভিশনের নিউজ ভয়েসওভারে প্রথম ‘জাতির জনক’ উচ্চারণটি ছিল মানিকের কণ্ঠে। অভিবাদন জানানোর মতো ঘটনা বটে। সুদূরপ্রসারী চিন্তা সন্দেহ নেই। রাজনৈতিক পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করেছে। বৈশাখী টেলিভিশন একটি ‘বিশেষ ভবন’র কবল থেকে মুক্ত হওয়ার পথে। মীর্জা আব্বাস চেয়ারম্যান পদ থেকে সরে দাঁড়ালেন। বন্ধুপ্রতিম আমিরুল মোমেনীন মানিক একদিন স্বমহিমায় প্যান্টের ঝুল খাটো করে চলে গেলেন দিগন্ত টিভিতে!
সন্ধ্যার আজিজ সুপার মার্কেট। শহরের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসা কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীদের অবাধ বিচরণের স্বপ্নাতুর জংশন। সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পার করা সে এক তুমুল জীবন। বুক ভরতি ব্যথাতুর নিঃশ্বাস আর স্বপ্ন ভাঙা-গড়ার অনবদ্য কারিগরি সর্বোত্র। বেসমেন্ট থেকে প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় তলা পর্যন্ত চলে অবিরল আড্ডা। সামনের খোলা বারান্দাতো আছেই।
এক সন্ধ্যায় কামু ভাই এর সঙ্গে সিনেমা বিষয়ে দীর্ঘ বাতচিত হলো। কামরুজ্জামান কামু। খ্যাতিমান কবি ও হৃদয়ছোঁয়া বহুসংখ্যক গানের গীতিকার। কামু ভাই একটি সিনেমা বানাতে চান, এ নিয়ে তখন তাঁর প্রবল উচ্ছ্বাস। বলছিলেন, ‘টোটালি ডিফরেন্ট, প্রচলিত ধারণার বাইরে একজন পরিচালকের পার্সপেক্টিভকে প্রেজেন্ট করব। চিত্রনাট্য থেকে শুরু করে আনুষাঙ্গিক প্রস্তুতি আছে। নায়ক মারজুক রাসেল। তবে নায়িকা চূড়ান্ত হয়নি। একজনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি, দেখা যাক।’
নায়িকা নির্বাচনে কামু ভাই এর পছন্দের শীর্ষে আছে পূর্ব অভিজ্ঞতা লব্ধ সেই ‘জনপ্রিয় নায়িকা’। মন সায় দিতে চাইছে না কিছুতেই। এর কী কারণ? তবে কি সেদিনের তিক্ত অভিজ্ঞতাটি মনের মধ্যে সামান্য হলেও ক্ষোভের সঞ্চার করে রেখেছিল? যা সুযোগে সক্রিয় হয়ে উঠতে চাইছে। পরোক্ষেই হোক আর প্রকাশ্যেই হোক সম্ভবত মানবমনের এটাই সহজাত প্রবৃত্তি। এ দায় নিজেকে দিযে স্বীকার করে নিতে কার্পণ্য নেই।
অনুরোধটি বিবেচনায় নিলেন। ‘দ্য ডিরেক্টর’ সিনেমার গল্প অনুসারে নতুন প্রস্তাবিত ‘প’ আদ্যক্ষরের নায়িকার যৌক্তিকতা যথেষ্ট, তাতে কামু ভাই শেষ পর্যন্ত একমত হলেন।
‘দ্য ডিরেক্টর’-এর শ্যুটিং শুরু হলো। ৩৬মি.মি. এর বদলে ব্যবহার করা হলো ডিজিটাল-ফোর হানড্রেট ক্যামেরা। সাধ্যের চেয়ে স্বপ্ন বড়! অর্থের যোগান না থাকায় থেমে থেমে চলতে হয়েছে সে বন্ধুর পথ। ফলে শুরুটা যথাসময়ে হলেও শেষ হতে পেরিয়ে গেছে বেশ কয়েকটা বছর। তবু লক্ষ্যে পৌঁছানোর দায়তো কবিকে বহন করতেই হবে। ‘মানুষ কখনো-কখনো তার স্বপ্নের চেয়ে বড় হয়ে যায়’। উক্তিটা কার?
সব বাধা পেরিয়ে সেন্সরে পৌঁছালো ‘দ্য ডিরেক্টর’। প্রবীণ ও দীর্ঘ ক্যারিয়ারের পরিচালকরা কিছুতেই প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শনের যোগ্য বলে বিবেচনা করতে চাইলেন না। মোটাদাগে অভিযোগ, ‘ডিরেক্টর’ চরিত্রটি অশালীন ও বিতর্কিত।
আশার কথা, বহু চড়াই-উৎরাই পার হয়ে ‘দ্য ডিরেক্টর’ ছাড়পত্র পেয়েছে। সময় সুযোগ মতো তা এখন দর্শকের চোখে পৌঁছে যাওয়ার অপেক্ষায়। একজন তরুণ পরিচালকের স্বপ্নের ফসল হেসে উঠবে, নবান্নের উৎসব যেমন।