বিষয়ভিত্তিক নাটক-চলচ্চিত্রের প্রথা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। তবে বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে—এদেশের স্বাধীনতা বা বিজয় অর্জন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত হয় বাংলাদেশ। দীর্ঘ নয় মাসের এই যুদ্ধের ঘটনাবলিকে বিভিন্ন কাহিনী বা দৃশ্যের ভেতর দিয়ে উপস্থাপন করাটা দেশের লেখকদের জন্য নৈতিক দায়িত্ব হয়ে ওঠে। সেই দায় থেকেই প্রেক্ষাগৃহ, মঞ্চ ও টেলিভিশনেও উপস্থাপিত হয়ে আসছে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র-নাটক। মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগের কাহিনী বারবারই দেশের প্রেক্ষাগৃহ, মঞ্চ ও টিভি নাটকে উঠে এসেছে আবেগঘন হয়ে।
বাংলা সাহিত্যে নাটকের স্থান বেশ গুরুত্বপূর্ণ। দৃশ্যকাব্য হিসেবে নাটকের আবেদন দিন দিন বেড়েই চলছে। শুধু মঞ্চকেন্দ্রিক নাটকই নয়; টেলিভিশন আবিষ্কারের পর নাটকের প্রয়োজনীয়তা ভিন্ন মাত্রায় রূপান্তরিত হয়েছে। সে হিসেবে মঞ্চ বলি আর রেডিও বা টেলিভিশন বলি- নাটকের চাহিদাও বেড়েছে। জাতির ক্রান্তিলগ্নেও নাটককে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে। প্রতিবাদ-প্রতিরোধ-সচেতনতা-সংগ্রামে নাটক হয়ে উঠেছে সমাজ বা রাষ্ট্র বদলের হাতিয়ার। তারই ধারাবাহিকতায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে শ্রুতি নাটক, মঞ্চ নাটক এবং টিভি নাটক বিশাল ভূমিকা রেখেছে। এমনকি মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং চেতনা নতুন প্রজন্মের ভেতরে ছড়িয়ে দিতে নাটকের সবিশেষ প্রচেষ্টা উজ্জ্বল আভা হিসেবে পরিগণিত হয়েছে।
সাহিত্যের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, বাংলা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাসের ক্রমবিকাশে দুশ’ বছরেরও বেশি সময় অতিক্রম করেছে বাংলা নাটক। সে যাত্রার অংশ হিসেবে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের অনুপ্রেরণা হিসেবে তৎকালীন মঞ্চ নাটক ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। তবে এ কথা সত্য যে, মঞ্চ নাটক স্বাধীনতার আগে যতটা এগিয়েছে, তার চেয়েও অনেক বেশি বিকশিত হয়েছে স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে। কারণ ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধকে অবলম্বন করে প্রায় অর্ধশতাধিক নাটক রচিত হয়েছে। যেগুলোতে স্থান পেয়েছে রণাঙ্গনের মুক্তিযুদ্ধ, পাকিস্তানি সেনাদের হাতে নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, ধর্ষিত ও নির্যাতিতের আর্তনাদ, বাঙালির অকুতোভয় সংগ্রাম, মুক্তির নেশায় অবিরাম পথচলা আর বীরত্বগাথাসহ বাঙালির চিরশত্রু ঘৃণিত রাজাকার, আল বদর, আল শামস তথা পাকিস্তানি নরপশুদের অমানবিক নিষ্ঠুরতার লোমহর্ষক নানা চিত্র। তখন দেশি নাট্যকারদের পাশাপাশি বিদেশি বহু নাট্যকারের বিপ্লবী নাটক অনুবাদ ও রূপান্তরের মাধ্যমে উপস্থাপন করে মুক্তিকামী বাঙালিকে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে।
বলতে গেলে, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে বিকশিত শিল্পমাধ্যম হচ্ছে মঞ্চ নাটক। যুদ্ধ ফেরত একদল তেজী তরুণের পদভারে মুখরিত হয়েছিল নাট্যাঙ্গন। তাঁদের অকৃত্রিম শ্রম, সৎসাহস এবং নিবিড় পরিচর্যায় একের পর এক অসাধারণ নাটক সৃষ্টি হয়েছে। তখন থেকে নব্বই দশক পর্যন্ত মঞ্চ নাটকে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধ। তবে সে সময়ে দু’একটি মুক্তিযুদ্ধের নাটক আলোচিত হলেও সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের চেয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট নিয়ে নাটক হয়েছে তুলনামূলক বেশি।
বাংলাদেশের নাট্যমঞ্চে বিভিন্ন সময়ে আলোড়ন তুলেছে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক নাটক। সেসব নাটকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাটক হচ্ছে— পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়, সময়ের প্রয়োজনে, কথা ৭১, লাল জমিন, বিদেহ, আমি বীরাঙ্গনা বলছি, টার্গেট প্লাটুন, ক্ষ্যাপা পাগলার প্যাঁচাল, জিয়ন্তকাল, যুদ্ধ এবং যুদ্ধ, জয় জয়ন্তী, একাত্তরের পালা, মুখোশ, কিংশুক, যে মরুতে, বিবিসাব, সময়ের প্রয়োজনে, খারন্নি, বলদ প্রভৃতি। তবে নূরলদীনের সারাজীবন, কোর্ট মার্শাল, সাতঘাটের কানাকড়ি ইত্যাদি নাটককেও মুক্তিযুদ্ধের নাটক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এতে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের কথা না থাকলেও চেতনা প্রবাহমান রয়েছে।
পাশাপাশি পরবর্তী সময়ে মামুনুর রশীদ রচিত ‘সমতট’, মমতাজ উদ্দিন আহমদের ‘কি চাহ শঙ্খচিল’, ও ‘রাজা অনুস্বারের পালা’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘তোরা জয়ধ্বনি কর’, আবদুল্লাহ আল মামুনের ‘তোমরাই’ ও ‘দ্যাশের মানুষ’, মান্নান হীরার ‘একাত্তরের ক্ষুদিরাম’ ও ‘ফেরারি নিশান’, নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর ‘ঘুম নেই’, নীলিমা ইব্রাহিমের ডায়েরি অবলম্বনে ‘শামুক বাস’, শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’ থেকে নির্বাচিত অংশ অবলম্বনে শ্রæতি নাটক ‘স্মৃতিসত্তা ভবিষ্যত’, হুমায়ূন আহমেদের ‘১৯৭১’, শান্তনু বিশ্বাসের ‘ইনফরমার’, সেলিম আল দীনের ‘নিমঞ্জন’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এসব নাটকে শুধু বাংলাদেশের মুক্তির কথাই বলা হয়নি; সমগ্র পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষের ইচ্ছার কথা বলা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, বিশ্বজুড়ে গণহত্যার দলিল উপস্থাপিত হয়েছে। এছাড়াও যুদ্ধের আগে মঞ্চস্থ হওয়া ‘এবারের সংগ্রাম’ ও ‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’ নাটকও উল্লেখযোগ্য।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কেটে গেছে চারটি দশক। সব মিলিয়ে এই চার দশকে সারা দেশের বিভিন্ন নাট্যদল মঞ্চে এনেছে আনুমানিক পাঁচ শতাধিক মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক। শুধু তা-ই নয়, কেবল ২০১৩ সালেই বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির পৃষ্ঠপোষকতায় সারা দেশে কলেজ পর্যায়ে মঞ্চে এসেছে শতাধিক মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক। বাংলা নাটকের ইতিহাসে এটি একটি যুগান্তকারী অধ্যায়। এ ছাড়া সরকারি অনুদানে বিভিন্ন নাট্যদল মঞ্চে এনেছে ত্রিশটির মতো নাটক। এছাড়া বিভিন্ন নাট্যদল সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই নিজেদের অর্থায়নে অনেক নাটক মঞ্চে এনেছে শুধু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য।
এত কিছুর পরও কেউ কেউ বলেছেন নাটকে মুক্তিযুদ্ধ শৈল্পিকভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে না। মুক্তিযুদ্ধের আবেগকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে নাটক হয়ে উঠেছে স্লোগাননির্ভর। কেউ আবার বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধ তো স্লোগানেরই ফসল। নাট্যজনদের বক্তব্যে উঠে এসেছে মঞ্চ নাটকে জাতি গঠনের যুদ্ধ ও তার রূপায়নের সঙ্গে শিল্পমানের সম্পর্ক নিয়ে। ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইন্সটিটিউটের সাম্মানিক সভাপতি রামেন্দু মজুমদার বলেছেন, ‘চার দশকের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাট্যচর্চা যেমন সমৃদ্ধ হয়েছে; তেমনি আমাদের স্বপ্ন বিস্মৃতও হয়েছে। আমাদের প্রত্যাশা বেড়েছে। আমরা মনে করছি, আরও শৈল্পিকভাবে নাটকে মুক্তিযুদ্ধ আসতে পারে। এ প্রজন্মের অনেক নির্দেশকের হাতে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটকের নবরূপায়ণ ঘটছে।’ নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য আতাউর রহমান বলেছেন, ‘বাংলাদেশের নাট্যচর্চা একটা অহংকার করার মতো পর্যায়ে এসেছে। তবে চুয়াল্লিশ বছরে নাট্যচর্চায় মুক্তিযুদ্ধ কতোটা শিল্পোত্তীর্ণ হতে পেরেছে; সেই বিচার করাটা কঠিন। মুক্তিযুদ্ধ একটি মহাকাব্য। তার সবটুকু কোনো কালেই নাটকে তুলে আনা সম্ভব নয়। ভিন্ন ভিন্ন গল্প নিয়ে এখন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক তৈরি হচ্ছে। এভাবেই মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাট্যচর্চা আরও সমৃদ্ধ হচ্ছে।’
নাট্যবোদ্ধারা মনে করেন, এ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের ওপর যে সব নাটক লেখা হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নাটক হচ্ছে সৈয়দ শামসুল হকের ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’। নাটক হিসেবে এটি সফলতম একটি নাটক। মুক্তিযুদ্ধের ওপর এমন সাহিত্য-শিল্পমানসম্পন্ন নাটক বা সাহিত্যকর্ম এর আগে বা পরে দৃষ্টিগোচর হয়নি। সুসাহিত্য হতে হলে উপমা, রুপক, চিত্রকল্প, প্রতীকীব্যঞ্জনা ইত্যাদির প্রয়োজন। নাট্যকার সফলভাবে তা ব্যবহার করেছেন। নাটকটির আরও একটি বিশেষ দিক হচ্ছে— যা নাট্যকার শেষ দৃশ্যে নিজেই আলোর নির্দেশনা দিয়েছেন, যা বিশেষ ইঙ্গিত বহন করে। সবশেষে আলো স্থির হয় পতাকার ওপর। কারণ এই পতাকার জন্যই যুদ্ধ। আর যুদ্ধের বিভীষিকা নিয়েই এ অমর নাটক। পাশাপাশি মমতাজ উদ্দীন আহমেদের ‘স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা’, ‘এবারের সংগ্রাম’, ‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’ এবং ‘বর্ণচোর’ নাটকেও পাকিস্তানি শোষকদের অত্যাচার-নির্যাতনের কথা তুলে ধরা হয়েছে। ‘বর্ণচোর’ নাটকে তিনি রাজাকার, আল বদরদের বিশ্বাসঘাতকতার চিত্র সুনিপুণভাবে অঙ্কন করেছেন। তাঁর ‘কি চাহ শঙ্খচিল’ নাটকটিও পাকিস্তানি হায়েনাদের নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের নিষ্ঠুর বর্বরতা নিয়ে রচিত।
আবদুল্লাহ আল মামুনের ‘তোমরাই’, ‘দ্যাশের মানুষ’ ও ‘বিবিসাব’ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক। তিনি তাঁর নাটকের মধ্যে বিপথগামী তরুণদের স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে সচেষ্ট ছিলেন। স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকারদের বিরুদ্ধে তার ক্ষোভ ফুটে উঠেছে। তাদের প্রতিহত করার জন্য তিনি সচেতন মানুষের আরেকটি সংগ্রামের আহ্বান জানিয়েছেন নাটকের মধ্য দিয়ে। তাঁর নাটকের বিষয়বস্তু এখনও মানুষকে উদ্বুদ্ধ করছে। তাই আশা করা যায়, ভবিষ্যতেও মানুষের চেতনাকে জাগ্রত করবে। ফলে বলাই যায় যে, আব্দুল্লাহ আল মামুন জনগণকে অনুপ্রাণিত করতে সফল হয়েছেন।
সমকালে এসেও মামুনুর রশীদের ‘সমতট’ ও ‘জয় জয়ন্তী’ নাটকে মুক্তিযুদ্ধ এবং তৎকালীন প্রেক্ষাপটের চিত্র পাওয়া যায়। তবে সেগুলো পরিপূর্ণ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক বলা যায় না। কারণ তিনি নাটকে শ্রেণী বৈষম্যের কথা বলতে চেয়েছেন। বলতে চেয়েছেন ১৯৭১ পরবর্তী জনজীবনের নানাবিধ ঘটনা। যেখানে বামপন্থী কোন রাজনৈতিক ভাবধারার ইঙ্গিত সুস্পষ্ট। জয় জয়ন্তীতে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত চিত্র আঁকতে চেয়েছেন। তাই দুটি নাটকেই তিনি অনেক ঘটনার সমাহার করতে গিয়ে কোনটিই শক্তিশালীরূপে দাঁড় করাতে ব্যর্থ হয়েছেন। অপরদিকে নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু রচিত ‘একাত্তরের পালা’ একটি পূর্ণ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক। যদিও নাটকটি সাহিত্য হিসেবে সমৃদ্ধ নয়। তবুও বিষয়বস্তুগত দিক থেকে এটি জনগণকে সচেতন করার জন্য যথেষ্ট। তাঁর আরেকটি নাটকের কথা বলা যায়, তা হলো ‘ঘুম নেই’। এতে তিনি শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্নের কথা বলেছেন। শহীদদের জাগিয়ে তুলেছেন। তবে মুক্তিযুদ্ধ ও প্রতিবাদী নাটকের ক্ষেত্রে সম্প্রতি মান্নান হীরা রচিত ‘লাল জমিন’, মামুনুর রশিদের ‘টার্গেট প্লাটুন’ ও ‘ভঙ্গবঙ্গ’, বাবুল বিশ্বাসের ‘পোড়ামাটি’ নাট্যাঙ্গনে ব্যাপক আলোড়ন তুলতে সক্ষম হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন নাটকে বিভিন্নভাবে উঠে এসেছে মহান মুক্তিযুদ্ধ তথা দেশাত্মবোধের অপার চেতনা।
মঞ্চ নাটকের পাশাপাশি তাকালে দেখতে পাই- আমাদের দেশে টেলিভিশনের সম্প্রচার শুরু হয় ১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর। সম্প্রচারের কিছুদিনের মধ্যেই অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে টিভি নাটক বেশি জনপ্রিয় হতে থাকে। তবে সে সময়ের নাটকে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করা যায়নি। তারপরও ইশারায় বা প্রতীকীভাবে এসেছে বাঙালির অধিকার বা স্বাধিকারের মূলমন্ত্র।
১৯৭১ সালে যখন মানুষ শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, তখন টেলিভিশনে সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানেও বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ৭১ সালের ২১ মার্চ ঢাকা টেলিভিশন কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয় ‘আবার আসিব ফিরে’ নাটকটি। সৈয়দ মাহমুদ আহমেদের কাহিনীতে প্রয়াত আবদুল্লাহ আল মামুনের নাট্যরূপে প্রচারিত হয় এ নাটক।
১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচার হওয়া প্রথম নাটকটি মুক্তিযুদ্ধের। ‘বাংলা আমার বাংলা’ নাটকটি লিখেছিলেন ড. ইনামুল হক, প্রযোজনা করেছিলেন আবদুল্লাহ আল মামুন। ১৯৭২ সালের মধ্যবর্তী সময়ের আলোচিত মুক্তিযুদ্ধের নাটক ‘জনতার কাছে আমি’। আমজাদ হোসেনের লেখা নাটকটি মুস্তাফিজুর রহমানের পরিচালনায় প্রচারিত হয়। এ সময়ের আরেকটি উল্লেখযোগ্য নাটক ‘এরা ছিল এধারে’। মোর্শেদ চৌধুরীর লেখা নাটকটি প্রযোজন করেছিলেন মোহাম্মদ বরকতউল্ল্যাহ। ১৯৭৩ সালে জেসমিন চৌধুরীর লেখা ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ নাটকটি প্রযোজনা করেন আবদুল্লাহ ইউসুফ ইসাম। শুধু তা-ই নয়, ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে টিভি নাটকে মুক্তিযুদ্ধ এসেছে বহুবার।
একটা সময়ে এসে দেশের একমাত্র টেলিভিশন বিটিভিতে মুক্তিযুদ্ধের নাটক স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবসকে কেন্দ্র করে নির্মিত হতে থাকে। আশির দশকের কাছাকাছি সময়ে এসে আরও কিছু চেতনাসমৃদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের নাটক বিটিভিতে প্রচারিত হয়। এরমধ্যে জিয়া আনসারীর ‘কোনো এক কুলসুম’, আতিকুল হক চৌধুরীর ‘কম্পাস’, রাবেয়া খাতুনের ‘বাগানের নাম মালানীছড়া, জোবেদ খানের ‘একটি ফুলের স্বপ্ন’ এবং রাজিয়া মজিদের ‘জোৎস্নার শূন্য মাঠ’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
বলতে গেলে, আশির দশকেই বেশি চেতনাসমৃদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের টিভি নাটক নির্মিত হয়েছে। হাবিবুল হাসানের রচনায় ও আবদুল্লাহ আল মামুনের প্রযোজনায় ‘আমার দ্যাশের লাগি’ নাটকটি সে সময়ের দর্শককে মুগ্ধ করেছে। এছাড়া মমতাজ উদ্দীন আহমেদের লেখা মোস্তফা কামাল সৈয়দের প্রযোজনার ‘এই সেই কণ্ঠস্বর’ নাটকটি দর্শকপ্রিয়তা লাভ করে। সে সময়ের আলোচিত মুক্তিযুদ্ধের টিভি নাটকের মধ্যে আবদুল্লাহ আল মামুনের ‘আয়নায় বন্ধুর মুখ’ ও ‘একটি যুদ্ধ অন্যটি মেয়ে’, আসাদুজ্জামান নূরের ‘এ মোর অহংকার’, রাহাত খানের ‘সংঘর্ষ’, আল মনসুরের ‘শেকল বাঁধা নাও’ ও ‘নয়ন সমুখে তুমি নাই’, আতিকুল হক চৌধুরীর ‘যদিও দূরের পথ’ ও ‘স্বর্ণতোড়ন’, মামুনুর রশীদের ‘খোলা দুয়ার’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
খণ্ড নাটকের পর আশির দশকের শেষের দিকে মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী ও চেতনা নিয়ে ধারাবাহিক নাটক নির্মাণ শুরু হয়। সাইফুল বারীর লেখায় জিয়া আনসারীর প্রযোজনায় ‘জোনাকী জ্বলে’ এবং আমজাদ হোসেনের লেখায় ফখরুল আবেদীনের প্রযোজনায় ‘জন্মভূমি’ নামে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ধারাবাহিক নাটক বিটিভিতে প্রচারিত হয়।
বিটিভির পর দেশে বেসরকারি টিভি চ্যানেলের যাত্রা শুরু হয়। ফলে টিভি মিডিয়া বিস্তৃতি লাভ করতে সক্ষম হয়। তবুও নব্বইয়ের দশকে বিটিভিতে প্রচারিত মুক্তিযুদ্ধের নাটকই সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। এরমধ্যে হাবিবুল হাসানের ‘মেঘের ছায়ার নিচে’, আখতার ফেরদৌস রানার ‘সেই এক গায়েন’, মোস্তফা কামালের ‘পোড়া মাটির গন্ধ’, বুলবন ওসমানের ‘পুষ্পের পবিত্রতা’, নাসির আহমেদের ‘কোনো এক বুলা গল্প’, মুহম্মদ রওশন আলীর ‘নীল নকশা’ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। এছাড়া বিটিভিতে প্যাকেজের আওতায় ফেরদৌস হাসানের ‘ঠিকানা’ এবং রেজানুর রহমানের ‘পতাকা’র নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়।
২০০১ সালে বিটিভিতে প্রচারিত তারিক আনাম খানের ‘জেরা’ নাটকটিও ভালো নাটক হিসেবে স্বীকৃতি পায়। সে সময়ে আবুল হায়াতের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক টেলিফিল্ম ‘পিতা’ দর্শকের কাছে প্রশংসিত হয়। এটিএন বাংলা সাইদুর রহমান জুয়েলের পরিচালনায় ‘কোন সীমানায় মুক্তি’ নামের একটি মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিক নাটক প্রচার করে। একই চ্যানেলে ২০০৫ সালে মামুনুর রহমানের নাটক ‘অচেনা বন্দর’ আলোচিত হয়। এটিএন বাংলার আলোচিত নাটকের মধ্যে ‘একটি আত্মহত্যা’ ও ‘তুফান আলীর ভূত’ অন্যতম।
চ্যানেল আই প্রচারিত ‘বিজয় নিশান’, ‘গল্পের শেষ আছে’, ‘ধূসর অ্যালবাম’, ‘স্মৃতি সপ্তাহ’, ‘অগ্নিদিনে তাহারা’, ‘খোঁজ’, ‘স্পার্টাকাস ৭১’, ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি’ নাটকগুলোতেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রবলভাবে ফুটে ওঠে। একুশে টিভিতে প্রচারিত হয় ‘পাপপূণ্য’, ‘বলাকা’, ‘জন্ম’ প্রভৃতি। এনটিভিতে দেখানো হয় ‘শেকড়’, ‘মুক্তি’, ‘পেছনে তখন’ ইত্যাদি। এছাড়া আরটিভি, বাংলাভিশন, বৈশাখী টিভি, মোহনা, বিজয় ও দেশ টিভি প্রচার করে একাধিক মুক্তিযুদ্ধের নাটক।
২০০৮ সালে আলোচিত হয় ফেরদৌস হাসানের নাটক ‘দাগ’। একই বছর সৈয়দ শামসুল হক রচিত ও আশরাফী মিঠু পরিচালিত ‘ম্যাজিক’ নাটকটিও বেশ প্রশংসা অর্জন করে। ২০১০ সালে তাহের শিপনের ‘কক্ষপথের যুদ্ধ’ মুক্তিযুদ্ধের একটি ভালো নাটক হিসেবে প্রশংসিত হয়েছে। ওই বছরের ডিসেম্বরকে কেন্দ্র করে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক প্রচার করা হয়। এরমধ্যে ১৬ পর্বের প্রতিদিনের ধারাবাহিক ‘মুক্তিযুদ্ধ-১৯৭১’ নাটকটি উল্লেখযোগ্য। ২০১১ সালে ‘ট্রানজিস্টার’ নামের নাটকটিও আলোচনায় আসে।
২০১৪ সালে প্রচারিত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক নাটকগুলোর মধ্যে ‘গুডবাই কমান্ডার’, ‘পেজ সিক্সটিন’, ‘সাক্ষাৎকার’, ‘বাংলাদেশ’, ‘জনক ৭১’, ‘শহীদ মোসাম্মৎ কুলসুম বেগম’, ‘পালকি’ এবং ‘ডায়রী-৭১’ বিশেষভাবে সমাদৃত হয়। এরপর থেকে দেখা যায়, প্রতিবছর স্বাধীনতা বা বিজয় দিবস এলে টিভি চ্যানেলগুলো প্রচার করে মুক্তিযুদ্ধের বিশেষ নাটক। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৫ এবং ২০১৬ সালে আমরা পাই ‘সেলিব্রেটি ৭১’, ‘একজন দুর্বল মানুষ’, ‘ঋণ শোধ’, ‘আলোর মিছিলে ওরা’, ‘একটি লাল শাড়ির গল্প’, ‘বীরমাতা’, ‘…এবং অতঃপর’, ‘কাঁটা’, ‘মুক্তিযুদ্ধ ৭১’, ‘এ কোন ভোর’, ‘অলিভ গাছ, ক্রিস্টাল নদী’, ‘রক্তস্নান’, ‘ছোট বাড়ি বড় বাড়ি’, ‘আলোর পথে’, ‘বীরাঙ্গনা’, ‘বৈঠা’, ‘ফসিলের কান্না’, ‘একজন মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে’, ‘পতাকা’, ‘একাত্তরের দিনগুলি’, ‘অবশিষ্ট বুলেট’, ‘অবহন’, ‘শুক্লপক্ষের আহ্বান’, ‘ক্ষুদিরামের ফাঁসি’ প্রভৃতি। এছাড়া ফরিদুর রেজা সাগরের ছোটকাকু সিরিজের মুক্তিযুদ্ধের একটি বিখ্যাত গল্প নিয়ে আফজাল হোসেনের নির্মাণ এবং অভিনয় ব্যাপক আলোচিত হয়েছে।
বিগত বছরগুলোর মতো এবছরও নির্মিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক টিভি নাটক। বিজয়ের মাস ডিসেম্বর উপলক্ষে অনেক চ্যানেলে প্রচারও শুরু হয়েছে। কোনো কোনোটি প্রচারের অপেক্ষায় রয়েছে। গত ৯ ডিসেম্বর রাত ৯টায় বিটিভিতে প্রচারিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক ‘জননী’। নাটকটি রচনা করেছেন রেজাউর রহমান ইজাজ, প্রযোজনায় ছিলেন মাহফুজা আক্তার। নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন মোমেনা চৌধুরী, সাজ্জাদ সাজু, সুষমা সরকার, মোহাম্মদ বারী, আঞ্জুমান আরা বকুল প্রমুখ। এছাড়াও নির্মিত হয়েছে ‘লাল শার্ট’। ইরানি বিশ্বাসের রচনা ও পরিচালনায় নাটকটির শুটিং শেষ হয়েছে কিছুদিন আগে। ১৩ ডিসেম্বর বিকেল ৩টা ৫ মিনিটে চ্যানেল আইয়ের পর্দায় নাটকটি প্রচারিত হয়। বরাবরের মতো ফরিদুর রেজা সাগরের গল্পে এবারও নির্মিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের নাটক ‘স্মৃতির বাড়ি’। এর নাট্যরূপ ও পরিচালনা করেছেন অরুণ চৌধুরী। তার ‘বাড়ি’ সিকোয়েন্সের এটি ১২তম নাটক। নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন আবুল হায়াত, রাইসুল ইসলাম আসাদ, আল মনসুর, নরেশ ভুঁইয়া, ইরফান সাজ্জাদ, অর্ষা, একে আজাদ, তিনু করিম, ফরহাদ, মম আলী প্রমুখ।
স্বাধীনতার চার বছর পর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রবর্তন করা হয়। যা বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের একমাত্র রাষ্ট্রীয় ও সর্বোচ্চ পুরস্কার। ১৯৭৫ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রবর্তনের পর ৪০ বছরে ১৩টি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে।
১৯৭৫ সালে প্রথম চলচ্চিত্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখার জন্য পুরস্কার দেওয়া শুরু হয়। প্রতি বছর বিজয়ীদের নির্বাচন করে সরকার নিযুক্ত জাতীয় প্যানেল। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রদানের প্রথম অনুষ্ঠানিকতা ১৯৭৬ সালের ৪ এপ্রিল সম্পন্ন হয়। এর পরের বছর ১৯৭৬ সালে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘মেঘের অনেক রং’ শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের পুরস্কার পায়। চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেছেন হারুনর রশীদ। রত্না কথাচিত্রের ব্যানারে এটি প্রযোজনা করেছেন আনোয়র আশরাফ ও শাজীদা শামীম। এতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন মাথিন, ওমর এলাহী, রওশন আরা, আদনান প্রমুখ।
১৯৭৭ সালে ‘বসুন্ধরা’ চলচ্চিত্রটি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে নির্বাচিত হয়। ঔপন্যাসিক আলাউদ্দিন আল আজাদের উপন্যাস ‘তেইশ নম্বর তৈলচিত্র’ অবলম্বনে চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সুভাষ দত্ত। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ কল্যাণ ট্রাস্ট প্রযোজিত ছবিটির প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন ববিতা, ইলিয়াস কাঞ্চন, নূতন, সৈয়দ হাসান ইমাম, শর্মিলী আহমেদ প্রমুখ। এটি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রসহ মোট ৬টি বিভাগে পুরস্কার অর্জন করে।
১৯৯০ সালে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের পাশাপাশি ‘শ্রেষ্ঠ স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র’ হিসেবে ‘আমরা তোমাদের ভুলব না’ পুরস্কার পায়। ১৯৯২ সালে ‘শঙ্খনীল কারাগার’ চলচ্চিত্রকে শ্রেষ্ঠ কাহিনীর জন্য পুরস্কার দেওয়া হয়। এতে শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার হিসেবে পুরস্কার পার নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। তার একবছর পর হুমায়ূন আহমেদের ‘আগুনের পরশমণি’ শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে নির্বাচিত হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রটি হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মাণ করা হয়। এটিই তার পরিচালিত প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। এতে অভিনয় করেন বিপাশা হায়াত, আসাদুজ্জামান নূর, আবুল হায়াত, ডলি জহুরসহ অনেকে। বাংলাদেশ সরকারের অনুদানের ছবি আগুনের পরশমণি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রসহ আটটি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে।
১৯৯৫ সালে তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক বাংলা প্রামাণ্যচিত্র ‘মুক্তির গান’ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে। প্রামাণ্যচিত্রটি দক্ষিণ এশিয়া চলচ্চিত্র পুরস্কারে বিশেষ উল্লেখযোগ্য পুরস্কার এবং ২০তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ‘শ্রেষ্ঠ স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র’ বিভাগে পুরস্কার লাভ করে।
১৯৯৭ সালে সেলিনা হোসেনের উপন্যাস ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ অবলম্বনে নির্মিত ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ চলচ্চিত্রটি ৩টি বিভাগে পুরস্কৃত হয়। এটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র। এই ছবিটি পরিচালনা করেছেন বাংলাদেশের বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার চাষী নজরুল ইসলাম। ছবিতে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন সুচরিতা, সোহেল রানা, অরুণা বিশ্বাস, অন্তরা, ইমরান, দোদুল ও আশিক প্রমুখ। হাঙর নদী গ্রেনেড সিনেমার জন্য শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসেবে চাষী নজরুল ইসলাম, শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে সুচরিতা এবং শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার হিসেবে সেলিনা হোসেন পুরস্কার অর্জন করেন।
‘বীর সৈনিক’ ২০০৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত যুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র। ছবিটি রচনা ও পরিচালনা করেছেন দেলোয়ার জাহান ঝন্টু। এসডি প্রডাকশন্সের ব্যানারে ছবিটি নির্মিত ও পরিবেশিত হয়। এতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন মান্না, মৌসুমী, সাথী, নাসির খান, হুমায়ুন ফরীদি, রোজী আফসারী প্রমুখ। মান্না এই চলচ্চিত্রে দ্বৈত ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। চলচ্চিত্রটি ২৮তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে দুটি বিভাগে পুরস্কার লাভ করে। মান্না শ্রেষ্ঠ অভিনেতা এবং সাথী শ্রেষ্ঠ পার্শ্বচরিত্র (অভিনেত্রী) বিভাগে পুরস্কৃত হন।
২০০৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘জয়যাত্রা’ ছবিটি সে বছর শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের পুরস্কার পায়। বিখ্যাত সম্পাদক, কাহিনিকার ও চলচ্চিত্র পরিচালক আমজাদ হোসেনের কাহিনি নিয়ে সংলাপ, চিত্রনাট্য ও পরিচালনা করেছেন তৌকির আহমেদ। এটি তার পরিচালিত প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবিটি প্রযোজনা ও পরিবেশনা করেছে ইমপ্রেস টেলিফিল্ম। ‘জয়যাত্রা’ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন একদল মানুষের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, মৃত্যু ও বেঁচে থাকার সংগ্রামের গল্প। ছবির বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন বিপাশা হায়াত, আজিজুল হাকিম, মাহফুজ আহমেদ, হুমায়ুন ফরীদি, তারিক আনাম খান, আবুল হায়াত, মেহবুবা মাহনূর চাঁদনী। ছবিটি শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ ২৯তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র, শ্রেষ্ঠ পরিচালক ও শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকারের পুরস্কার লাভ করে। এছাড়া ছবিটি শ্রেষ্ঠ কাহিনিকার, শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক, শ্রেষ্ঠ পার্শ্বচরিত্রে অভিনেত্রী ও শ্রেষ্ঠ চিত্রগ্রাহক বিভাগে পুরস্কার লাভ করে।
‘গেরিলা’ ছবিটি ২০১১ সালে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে পুরস্কার লাভ করে। নাসির উদ্দীন ইউসুফ পরিচালিত চলচ্চিত্রটি মূলত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে নির্মিত। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের ‘নিষিদ্ধ লোবান’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মাণ করা হয়েছে চলচ্চিত্রটি। এর চিত্রনাট্য করেছেন যৌথভাবে নাসির উদ্দীন ইউসুফ ও এবাদুর রহমান। গেরিলা ছবিতে অভিনয় করেছেন সহস্রাধিক শিল্পী। প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন জয়া আহসান, ফেরদৌস, এটিএম শামসুজ্জামান, রাইসুল ইসলাম আসাদ, পীযুষ বন্দ্যোপাধ্যায়, শতাব্দী ওয়াদুদ, শম্পা রেজা, গাজী রাকায়েত প্রমুখ। এছাড়াও সিনেমাটি ২০১১ সালে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে অংশগ্রহণ করে। এমনকি ১৭তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে নেটপ্যাক পুরস্কার জিতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
২০১৪ সালে মাসুদ পথিক পরিচালিত ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ’ প্রাথমিকভাবে পাঁচটি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের জন্য ঘোষিত হয়। পরে ‘বৃহন্নলা’ চলচ্চিত্রের বিরুদ্ধে গুল্প চুরির অভিযোগ উঠলে নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র বিভাগেও পুরস্কৃত হয়। অন্য বিভাগগুলো হলো—শ্রেষ্ঠ গীতিকার, শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক, শ্রেষ্ঠ সুরকার, শ্রেষ্ঠ নারী কণ্ঠশিল্পী, শ্রেষ্ঠ রূপসজ্জাকার। কবি নির্মলেন্দু গুণের ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ’ কবিতা অবলম্বনে সিনেমার চিত্রনাট্য লিখেছেন মাসুদ পথিক। সংলাপ লিখেছেন রাজিব আহসান ও মাসুদ পথিক। সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রটি প্রযোজনা ও পরিবেশনা করেছে ব্রাত্য চলচ্চিত্র। এতে নামচরিত্রে অভিনয় করেছেন জুয়েল জহুর এবং ফাতেমা চরিত্রে অভিনয় করেছেন শিমলা। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চরিত্রে মামুনুর রশীদ, প্রবীর মিত্র, রানী সরকার, বাদল শহীদ, রেহানা জলি প্রমুখ। এছাড়া অভিনয় করেছেন কবি নির্মলেন্দু গুণসহ পনেরো কবি। চলচ্চিত্রে কাহিনীচিত্রের পাশাপাশি তথ্যচিত্রের আবহকে ধারণ করার চেষ্টা করে প্রেম, প্রকৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের গাথা সূত্রে-তথ্যের ইমেজ ধরে আবহমান বাংলার নিবিড় সংস্কৃতি, জীবনের অন্তর্গত দর্শন তথা জীবনবোধকে তুলে ধরা হয়েছে।
২০১৫ সালে ‘অনিল বাগচীর একদিন’ ও ‘বাপজানের বায়স্কোপ’ যৌথভাবে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র বিভাগে পুরস্কার লাভ করে। দুটিই মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র। ‘অনিল বাগচীর একদিন’ পরিচালনা করেছেন মোরশেদুল ইসলাম। প্রযোজনা করেছে বেঙ্গল ক্রিয়েশন্স। ছবিতে অনিল বাগচীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন নবাগত অভিনেতা আরেফ সৈয়দ। অন্যান্য চরিত্রে গাজী রাকায়েত, তৌফিক ইমন, জ্যোতিকা জ্যোতি, ফারহানা মিঠু এবং মিশা সওদাগর অভিনয় করেন। মোরশেদুল ইসলাম এরআগে খেলাঘর (২০০৬) এবং আমার বন্ধু রাশেদ (২০১১) নামে দুটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন।
অনিল বাগচীর একদিন চলচ্চিত্রের উদ্বোধনী প্রদর্শনী হয় ২০১৫ সালের অক্টোবরে শ্রীলঙ্কার কলম্বো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে। পরে ২০১৫ সালের ১১ ডিসেম্বর ছবিটি মুক্তি পায়। ছবিটি ২০১৫ সালে ২৩ ডিসেম্বর কলকাতায় উপ হাইকমিশনে এবং ২০১৬ সালের ২৮ মে কানাডায় মন্ট্রিলে প্রদর্শিত হয়। ছবিটি ৪০তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে যৌথভাবে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র ও শ্রেষ্ঠ পরিচালক পুরস্কারসহ ছয়টি বিভাগে পুরস্কৃত হয়। এছাড়া ১৮তম মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারে তিনটি মনোনয়নের মধ্যে দুটি বিভাগে পুরস্কৃত হয়।
একই বছর রিয়াজুল রিজু পরিচালিত ও প্রযোজিত ‘বাপজানের বায়স্কোপ’ সিনেমাটিও শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রসহ আটটি বিভাগে পুরস্কার লাভ করে। কারুকাজ ফিল্মসের ব্যানারে নির্মিত চলচ্চিত্রটি রিয়াজুল রিজু পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র। ছবির কাহিনি লিখেছেন মাসুম রেজা। চিত্রনাট্য লিখেছেন মাসুম রেজা ও রিয়াজুল রিজু। এতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন শহীদুজ্জামান সেলিম, শতাব্দী ওয়াদুদ ও সানজিদা তন্ময়। চলচ্চিত্রটি ২০১৫ সালের ১৮ ডিসেম্বর মুক্তি পায়। ৪০তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ছবিটি যৌথভাবে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রসহ আটটি বিভাগে পুরস্কার লাভ করে।
সুতরাং বলা যায়, মঞ্চে বা টেলিভিশনের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটকগুলো আমাদের দেশপ্রেমকে সমুন্নত রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে আসছে। আশা করি ভবিষ্যতেও এ যাত্রা অব্যাহত থাকবে। তবে চল্লিশ বছরে মাত্র ১৩টি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়ার সংখ্যাটি খুব বেশি বলে মনে হয় না। আমরা চাই, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রের সংখ্যা আরও বাড়ুক, সেই সঙ্গে বাড়ুক চলচ্চিত্র পুরস্কারে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রের সংখ্যাও। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, যতদিন পৃথিবী থাকবে, যতদিন মানুষ থাকবে।