কী নেই ছড়ায়? নিয়ম মেনে লেখার উত্তেজনা যেমন আছে, ঠিক তেমনি আছে নিয়ম ভাঙার উন্মাদনাও। অর্থবহ ভাবের গভীরতা যেমন আছে, তেমনি আছে অর্থহীন ভাবের সরলতাও। এ জন্যেই কি ছড়া এত বৈচিত্র্যময়! এই আলোচনায় আমরা জানব ছড়ার এমনই এক বৈচিত্র্যময় শাখা ‘ননসেন্স রাইম’ সম্পর্কে।
প্রাচীনকাল থেকে ইংরেজি ভাষায় ননসেন্স রাইম প্রচলিত রয়েছে। ইংরেজি সাহিত্যে এর অবস্থান অনেক শক্ত। ‘ননসেন্স রাইম’কে বাংলা করলে এর অর্থ দাঁড়ায় কাণ্ডজ্ঞানহীন ছড়া। সহজ করে বললে, অর্থহীন ছড়া। পড়তে ভালো লাগে, মজা লাগে, অর্থ একেবারেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, এমন ছড়াকেই ননসেন্স রাইম বলে।
অনেকেই এই ধরনের ছড়া লিখে গেছেন। বাংলা ভাষায় সুকুমার রায় প্রথম এই ধরনের ছড়া লিছেখেন। পরবর্তীকালে সুকুমার রায়ের যোগ্য সন্তান সত্যজিৎ রায়ও বেশ কিছু ননসেন্স রাইম লিখেছিলেন। বাংলা ভাষায় খুব বেশি এ ধারায় লেখা হয়নি। কিন্তু লেখা না হলেও মানুষের মুখে মুখে আজব আজব সব ছড়া চালু আছে। যেগুলাকে প্রচলিত ননসেন্স রাইম ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। কয়েকটি পড়ে আসি:
ওয়ান টু থ্রি
পাইলাম একটা বিড়ি
বিড়িতে না আগুন
পাইলাম একটা বেগুন
বেগুনে নাই বিচি
পাইলাম একটা কেচি
কেচিতে নাই ধার
পাইলাম একটা হার
হারে নাই লকেট
পাইলাম একটা পকেট
পকেটে নাই টাকা
কেমনে যামু ঢাকা
ঢাকাতে নাই গাড়ি
কেমনে যামু বাড়ি
বাড়িতে নাই ভাত
দিলাম একটা পাদ
পাদে নাই গন্ধ
হাইস্কুল বন্ধ
হাইস্কুলে যামু না
বেতের বাড়ি খামু না
বেত গেল ভাইংগা
স্যার দিলো কাইন্দা।’দুই.
ওপেন টু বাইস্কোপ
নাইন টেন টেলিস্কোপ
সুলতানা বিবিয়ানা
সাহেব বাবুর বৈঠকখানা
সাহেব বলছে যেতে
পান সুপারি খেতে
পানের আগায় মরিচ বাটা
স্প্রিংয়ের চাবি আঁটা
যার নাম মনিমালা
তাকে দেবো মুক্তার মালা।তিন.
এলোনা বেলোনা
ঝুমকা লতায় ঝুম,
আজি সালেকা মালেকা
সালা মালাই কুম।
সবাই চুপ…চার.
ন্যাইড়া মাথা চাইর আনা
চাবি দিলে ঘোরে না
একটা চাবি নষ্ট
ন্যাইড়া মাথার কষ্ট।পাঁচ.
চড়ুই পাখি বারোটা
ডিম পেড়েছে তেরোটা
একটা ডিম নষ্ট
চড়ুই পাখির কষ্ট!ছয়.
আকাশ থেকে নেমে এলো ছোট্ট একটা প্লেন,
প্লেনের ভেতর বসে ছিল ছোট্ট একটা মেম,
মেমকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, হোয়াট ইজ ইউ নেম?
মেম আমাকে উত্তর দিলো, মাই নেম ইজ সুচিত্রা সেন।
( কেউ কেউ এরপরে আরও দুই লাইন ব্যবহার করতো:
সেনকে আমি জিজ্ঞেস করলাম উত্তম কুমার কই?
উত্তম কুমার খেতে গেছে মরনচাঁদের দই।)সাত.
সালাম কালাম দুই ভাই
পথে পাইলো মরা গাই
সালাম কয় খাইয়া যাই
কালাম কয় লইয়া যাই।আট.
ইন পিন সেপ্টিপিন
বাবু খায় ভিটামিন
ভিটামিনে পোকা
ডাক্তার সাহেব বোকা।
এই ননসেন্স রাইমগুলো অধিক জনপ্রিয় ও লোকমুখে প্রচলিত। কেউ জানে না, এসব ছড়ার লেখক কে? জানার কোনো উপায়ও নেই। কিভাবে এ ছড়াগুলোর উৎপত্তি, তাও জানা সম্ভব নয়। ধারণা করা হয়, এই ধরনের ছড়াগুলো ইঁচড়েপাকা বাচ্চাদের মাধ্যমেই বাচ্চামহলে জনপ্রিয়তা পায়। স্বাভাবিকভাবেই ছড়াগুলোর গঠনপক্রিয়া খুবই দুর্বল। এ রকম ছড়ার প্রধান দাবি, ধ্বনিময়তা ও সুরঝংকার, অর্থ নয়।
ননসেন্স রাইম সবসময়ই শুধু এলোমেলো শব্দ দিয়েই তৈরি হয় না। সাজানোগোছানো শব্দের সমন্বয়েও তৈরি হতে পারে। সুকুমার রায়ের ‘কত বড়’ শিরোনামের একটি ননসেন্স রাইম পড়ে আসি:
ছোট্ট সে একরতি ইঁদুরের ছানা,
ফোটে নাই চোখ তার, একেবারে কানা।
ভাঙা এক দেরাজের ঝুলমাখা কোণে
মার বুকে শুয়ে শুয়ে মার কথা শোনে।
যেই তার চোখ ফোটে সেই দেখে চেয়ে-
দেরাজের ভারি কাঠ চারিদিক ছেয়ে।
চেয়ে বলে মেলি তার গোল গোল আঁখি-
‘ওরে বাবা! পৃথিবীটা এত বড় না কি?’
বর্তমান সময়ে রচিত ননসেন্স রাইমগুলোর গঠনপক্রিয়া খুবই সবল। উপস্থাপনা উন্নত ও যত্নমাখা। কয়েকটি পড়ে আসি। ছড়াকার জগলুল হায়দারের তিনটি ননসেন্স রাইম:
০১। খাইদাই
বোঝা পেলে ডাংকি
কলা পেলে মাংকি
ভুলে যায় সহসাই
হাংকি ও পাংকি।
তেল ছাড়া টাংকি
জল ছাড়া গাঙ কি
দেখেছেন কোন দিন
বোম্বের চাংকি?
চাংকি তো পাণ্ডে
বসে খায় আণ্ডে
খেয়েই যে পার তার
সানডে ও মানডে।
সানডের সান্ডি
খেতে খেতে খায় দ্যাখ
পাতিল আর হাণ্ডি!০২। সেন্ডু বানা
লাওয়া লুলু টাঙ্গে তানা
পুডুম পুডুম পাতালা
পেন্টোগনার ডেন্টোবাজি
নিরাক নখর খাত আলা।
আন্তারাসু কান্তা রামা
ডাণ্ডি লুপুন গাণ্ডিবেরা
জিংগালালার ঝিংগা তুরু
গাজং গুজং ভাণ্ডি ভেড়া।
লিপুই দিমার ভাঞ্জে কাতা
কাণ্ডা বেনের সেন্ডু বানা
উবান তেরো চুবান দিয়া
ইয়ংপিয়ং পেন ডুবানা।
শুঁটকি পুঁটি ভেন্ডি ভাজি
ঘ্যাচাং গিলান চাঁই রাঁদে
ইপিলিপে সাঙ্গা সাদু
গপাং গপাস মাইরা দে।০৩। দিলকি বাত
ইলকি গিলকি দিলকি বাত
মুরগি ছানায় চিলকি বাত
বড়ই গাছে ঢিলকি বাত
ইলকি গিলকি দিলকি বাত।ইলকি গিলকি দিলকি বাত
মাসের শেষে বিলকি বাত
বিপদকালে মিলকি বাত
ইলকি গিলকি দিলকি বাত।ইলকি গিলকি দিলকি বাত
চোরের পিঠে কিলকি বাত
দেয়ায় দেয়ায় জিলকি বাত
ইলকি গিলকি দিলকি বাত।ইলকি গিলকি দিলকি বাত
দোর জানালায় খিলকি বাত
শুকনা লেক আর ঝিলকি বাত
ইলকি গিলকি দিলকি বাত।ইলকি গিলকি দিলকি বাত
ক্যামেরাতে রিলকি বাত
ভোটের নামে সিলকি বাত
ইলকি গিলকি দিলকি বাত।
ছড়াকার পলাশ মাহবুবের একটি ননসেন্স রাইম:
০১। ইশ!
মুরগিতে দুধ দেয়
ডিম পাড়ে গরু,
ইয়া বড় হাতিটাও
লিকলিকে সরু।শেয়ালের মাথা মোটা
পণ্ডিত গাধা,
হরিণের খোঁয়াড়েতে
বাঘ থাকে বাঁধা।পুঁটিদের উৎপাতে
বোয়ালেরা ভীতু,
বছরের বারো মাস
একটাই ঋতু।দোয়েলের ভাঙা গলা
কাকে দেয় শিস,
কোকিলের কা কা ডাকে
ঘুম ভাঙে ইশ!
ছড়াকার রেবেকা ইসলামের একটি ননসেন্স রাইম:
০১। গুড় খাঁ
নাম ছিল নুর খান
চা’র সাথে গুড় খান
খুব প্রিয় তার মিঠে গুড় চা,কেউ চায়ে দিল চিনি
ফুলিয়ে দুগাল তিনি
রাগ-অভিমানে যান মূর্ছা।তারপরে হলে হুশ
নিজেকেই মেরে ঘুষ
ভেঙে দেন দরোজার হুড়কা,এইসব দেখে লোকে
কথা কয় চোখে চোখে
পাল্টিয়ে নাম দিল গুড় খাঁ।
ননসেন্স রাইমের এতটুকু আলোচনা করে আমরা দুটি ধাঁচের ছড়া পেয়েছি। একটি হচ্ছে প্রচলিত ধাঁচ, যা মানুষের মুখে মুখে টিকে আছে। অন্যটি আধুনিক ধাঁচ, যা বর্তমানে রচনা করা হয়। প্রচলিত ননসেন্স রাইমগুলো পড়ে আমরা, প্রচলিত ননসেন্স রাইমের এই বৈশিষ্ট্যগুলো দাঁড় করাতে পারি:
১। ধ্বনিময়তা ও সুরঝংকারকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, অর্থকে নয়।
২। পড়তে মজা লাগে।
৩। ছন্দের নিয়মে লেখা হয়নি।
৪। এলোমেলো শব্দ বাছাই করা হয়েছে।
৫। অন্ত্যমিলে যত্ন নেওয়া হয়নি। দুর্বল অন্ত্যমিল চোখে পড়ে।
বর্তমান সময়ে রচিত ননসেন্স রাইমগুলো পড়ে আমরা, আধুনিক ননসেন্স রাইমের এই বৈশিষ্ট্যগুলো দাঁড় করাতে পারি-
১। ধ্বনিময়তা ও সুরঝংকারকে প্রাধান্য দেওয়া হলেও গোছালো শব্দ বাছাই করা হয়। অর্থ প্রাধান্য পায় না।
২। উদ্ভট, কৌতুকধর্মী, পড়তে মজা লাগে।
৩। ছন্দের নিয়মে লেখা হয়।
৪। অন্ত্যমিলে যত্ন নেওয়া হয়। দুর্বল অন্ত্যমিল থাকে না। সুস্থ, সুন্দর, সবল ও নতুন নতুন অন্ত্যমিল বাছাই করা হয়।
বর্তমান সময়ে রচিত ননসেন্স রাইমগুলো সব দিক থেকেই স্ট্যান্ডার্ড। সুতরাং আমরা যদি ননসেন্স রাইম লিখতে চাই, অবশ্যই আধুনিক ননসেন্স রাইমের বৈশিষ্ট্যগুলো মাথায় রেখেই লিখবো।