যিনি ‘বল বীর/চির উন্নত মম শীর’—মন্ত্রে মাথা তুলে দাঁড়ানোর সাহসী উচ্চারণে শোনালেন বিদ্রোহের বাণী, তিনি আর কেউ নন; আমাদের প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তার বিদ্রোহের কেন্দ্রবিন্দুতে সাম্যবাদ, নারীর মর্যাদা ও মানুষে মানুষে গড়ে ওঠা প্রেম। একজন কবির দৃষ্টিভঙ্গি নির্ভর করে তার সমসাময়িক অবস্থা বা প্রেক্ষাপটের ওপর। কোনো সচেতন শিল্পী তার সময় ও সমাজকে কখনো অস্বীকার করতে পারেন না। কাজী নজরুল ইসলাম তার ব্যতিক্রম নন। তিনি দেশের এমন এক সংকটময় মুহূর্তে আবির্ভূত হয়েছেন; যখন মুক্তি সংগ্রামের স্লোগান আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত হচ্ছে। ফলে এ আন্দোলন-সংগ্রামের প্রভাব পড়েছে তার কাব্যে। দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পাওয়ার নেশায় তিনি হয়ে উঠেছিলেন প্রতিবাদী। দেশমাতৃকাকে ভালোবেসে হয়েছেন মহাবিদ্রোহী। কিন্তু তারপরও মানব মনের চিরন্তন প্রেমের বহিঃপ্রকাশও ঘটেছে তার কাব্যে—কখনো তার বিদ্রোহের মাঝে প্রেম, কখনো প্রেমের মাঝে বিদ্রোহ। সবমিলিয়ে একাকার হয়ে যায় সাম্যবাদে। এসবই অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়েছিল প্রিয়তমার মতো।
নজরুল ইসলাম স্বমহিমায় বাংলাসাহিত্যে চির ভাস্বর হয়ে আছেন। তার ‘অগ্নিবীণা’, ‘বিষের বাঁশী’, ‘ঘুমভাঙার গান’, ‘ফণিমনসা’, ‘সর্বহারা’, ‘জিঞ্জির’, ‘সন্ধ্যা’, ‘প্রলয় শিখা’, ‘সাম্যবাদী’ ইত্যাদি কাব্যের মাধ্যমে তিনি জাগরণের গান শুনিয়েছেন মানুষকে। জাতির বন্দিত্ব মোচনের জন্য তার প্রচেষ্টা ছিল অকৃত্রিম। তিনি বিক্ষুব্ধ হয়ে বলেছেন—‘লাথি মার ভাঙরে তালা/যতসব বন্দীশালা/আগুন জ্বালা আগুন জ্বালা।’
তার এ বিদ্রোহ অনাসৃষ্টির জন্য নয়। পুরাতনকে ভেঙে নতুন করে গড়ার বিদ্রোহ। দেশ-জাতি-সমাজকে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। তার বিদ্রোহ ছিল শাসক, যাজক ও সমাজপতিদের বিরুদ্ধে। তার এ বিদ্রোহ নিরন্তর। যতদিন না এর কোনো প্রতিকার হবে। তাইতিনি বলেছেন—‘মহাবিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত/ আমি সেই দিন হব শান্ত/যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না/অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না/বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত/ আমি সেই দিন হব শান্ত।’
‘অগ্নিবীণা’র অন্তর্গত ‘বিদ্রোহী’ কবিতার জন্যই তিনি আজ সর্বত্র ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে সমাদৃত। বিদ্রোহী অভিধায় অভিসিক্ত হলেও কাজী নজরুল ইসলাম একজন খাঁটি প্রেমিকও। প্রেমের মহিমার ক্ষেত্রে তিনি বেশি সমুজ্জ্বল। অন্তরে প্রেম না থাকলে কখনো বিদ্রোহ আসে না। ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি আর হাতে রণতূর্য’—এ যেন কবি নজরুলের অন্তরের কথা। এছাড়া নারীর প্রতি তার অগাধ ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও ভক্তি প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন গানে ও কবিতায়। নারীকে সর্বোচ্চ মর্যাদার আসনে বসিয়েছেন তিনি। নারীকে যথাযথ মর্যাদা দিতে গিয়ে কবি বলেছেন—‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের এ কথা আমরা কখনো অস্বীকার করতে পারি না।
‘আলগা করো গো খোঁপার বাঁধন’ কিংবা ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রানী, দেব খোঁপায় তারার ফুল’—এ ধরনের গানে তার অপার্থিব প্রেমের উৎসরণ লক্ষ করা যায়। এ ক্ষেত্রে তাকে প্রেমিক কবি হিসেবে আখ্যায়িত করলেও অত্যুক্তি হবে না। বিদ্রোহী রূপের আড়ালে তার চিরায়ত কামনা-বাসনা-প্রেমকে ঢেকে রাখার সাধ্য আছে কার? কবি এ-ও বলেছেন—‘নারীর বিরহে, নারীর মিলনে, নর পেল কবি প্রাণ/যত কথা তার হইল কবিতা, শব্দ হইল গান।’
মূলত নারীর উৎসাহ-প্রেরণা ও প্রেমের মহিমা তাকে বিদ্রোহী হতে উৎসাহ জুগিয়েছে। ‘বিদ্রোহী’ কবিতায়ও তার প্রেম প্রকাশিত হয়েছে। নারী হৃদয়ের ব্যর্থতা, ক্ষোভ ও বাসনাকে কবি নিজের বিদ্রোহের উপাদান হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
আগেই বলা হয়েছে—কাজী নজরুল ইসলাম একদিকে যেমন বিদ্রোহী; অন্যদিকে আবার রোমান্টিক কবিও। দীর্ঘাকৃতির ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মধ্যেও প্রেমের মহিমাকে তিনি উচ্চকিত করে তুলেছেন। কবির ‘মানুষ’, ‘সাম্যবাদী’ ও ‘আমার কৈফিয়ত’ প্রভৃতি কবিতায় বিদ্রোহ ফুটে উঠলেও সেখানে অত্যাচারিত, নিপীড়িত, অবহেলিত, অসহায় মানুষের প্রতি ছিল তার সীমাহীন দরদ, স্বার্থহীন ভালোবাসা। ‘সিন্ধু হিন্দোল’ কাব্যগ্রন্থে প্রেমের নিবিড়তা, চিরন্তনতা এবং বিচ্ছেদের তীব্র জ্বালার প্রকাশ দেখা যায়। সিন্ধুর অশান্ত রূপ কবিচিত্তের বিচ্ছেদ জ্বালা পথিকের মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। কবি বলেছেন—‘এক জ্বালা, এক ব্যথা নিয়া/তুমি কাঁদ আমি কাঁদি, কাঁদে মোর হিয়া।’
কাজী নজরুল ইসলামের কাব্যে প্রেম বা রোমান্টিসিজম সম্পর্কে বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেছেন, ‘‘প্রকৃতির মাঝে আত্মভাবের বিস্তার এবং একই সাথে প্রকৃতির উপাদান সান্নিধ্যে অন্তর ভাবনার উন্মোচন রোমান্টিক কবির সহজাত বৈশিষ্ট্য। ‘চক্রবাক’ কাব্যে নজরুলের এই রোমান্টিক সত্তার প্রকাশ বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ইতোপূর্বের কাব্যগুলোয়ও আমরা নজরুলের প্রকৃতি চেতনার পরিচয় পেয়েছি কিন্তু ‘চক্রবাক’-এ এসে লক্ষ করছি, এখানে প্রকৃতি নজরুলের প্রজ্ঞাশাসিত ও অভিজ্ঞতালব্ধ মানসতার স্পর্শে এসে হয়ে উঠেছে সংযত, সংহত এবং শূন্যতা তথা বেদনার প্রতীকী ধারক।’’
নজরুল কবিতা ছাড়াও বহুবিচিত্র গান রচনা করেছেন। প্রেম-বিরহ, বিদ্রোহ-বিপ্লবের ওপর তার অসংখ্য গানও রয়েছে। গানে কী কবিতায় মানুষের কল্যাণে কবি পুরাতনকে ধ্বংস করতে চেয়েছেন। ধ্বংসের ভেতর থেকেই তিনি দেখেছেন নব সৃষ্টির উন্মাদনা। কবি সমস্ত অসুন্দরকে ধ্বংস করতে চেয়েছেন। তাই তো বিদ্রোহের পাশাপাশি আবার প্রেম সৌন্দর্যের সমন্বয় করেছেন। বিদ্রোহ করেছেন অন্যায়কে ধ্বংস করার জন্য, আর প্রেমের কথা বলেছেন মানবতাকে মজবুত করার জন্য। শুধু কি বিদ্রোহই ধরা পড়ে তার কবিতায়? না, তিনি প্রেমের কবিও বটে। সর্বোপরি মানুষের কবি। অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনায় লালিত একজন উদারপন্থী মানুষ। নারী তার কবিতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। শুধু কি কল্পনার নারী? না, বাস্তবতার নিরিখেও নারীকে তুলে এনেছেন পরম যত্ন আর মমতায়। নারীকে কন্যা, জায়া ও জননী—সব রূপেই লক্ষ্য করা যায় তার কাব্যে। এমনকী বীর নারী, বেশ্যা নারী, প্রেমিকা নারী, আশাজাগানিয়া নারী, লোভী নারী ও হতাশাদায়িনী নারীও ধরা পড়েছে তার কলমে।
নারী ছাড়া কবি নজরুলের কবিতা কল্পনা করা প্রায় অসম্ভব। তিনি নারী চরিত্রগুলো নিজের দুঃখে, অশ্রুজলে, হাসিতে, কান্নায় সৃজন করেছেন আবার নিজেই ভেঙেছেন, নিজেই গড়েছেন। তিনি ‘নারী’ কবিতায় লিখেছেন—‘বিশ্বে যা-কিছু এল পাপ-তাপ বেদনা অশ্রুবারি/অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী।/নরককুন্ড বলিয়া কে তোমা’ করে নারী হেয়-জ্ঞান?/তারে বলো, আদি পাপ নারী নহে, সে যে নর-শয়তান।’
‘বিদ্রোহী’ কবিতায়ও তিনি নারীর প্রসঙ্গ এনেছেন শৈল্পিক ভঙ্গিমায়। বিদ্রোহের প্রেরণা হিসেবে কল্পনা করেছেন নারীকে। কবির উচ্চারণ—‘আমি বন্ধনহারা কুমারীর বেণি, তন্বী নয়নে বহ্নি/আমি ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম উদ্দাম, আমি ধন্যি!/আমি উন্মন, মন-উদাসীর/ আমি বিধবার বুকে ক্রন্দন-শ্বাস, হা-হুতাশ আমি হুতাশীর।’
কবি আরও বলেছেন—‘চিত চুম্বন-চোর-কম্পন আমি থর থর থর প্রথম পরশ কুমারীর!/ আমি গোপন-প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল ক’রে দেখা অনুখন,/আমি চপল মেয়ের ভালোবাসা, তাঁর কাঁকন-চুড়ির কন্-কন্।’
নারীর বিরহ-মিলন পুরুষের কাছে একটি দুর্বোধ্য প্রেমের পাঠ। সেই নারীর বিরহে-মিলনে কবিপ্রাণও জেগে ওঠে। তাই তো ‘নারী’ কবিতায় কবি বলেছেন—‘নারীর বিরহে, নারীর মিলনে, নর পেল কবি প্রাণ/যত কথা তার হইল কবিতা, শব্দ হইল গান।’
রমণীর ভালোবাসায় নজরুল কবি হয়ে উঠেছেন। এমন স্বীকারোক্তি লক্ষ করা যায় তার ‘কবি-রাণী’ কবিতায়। কবিই তো অন্যত্র বলেছিলেন, ‘প্রেমের পরশে প্রত্যেকেই কবি হয়ে ওঠে’। এ কথারই মিল খুঁজে পাওয়া যায় তার কবিতায়। কবি বলেছেন—‘তুমি আমায় ভালোবাসো তাইতো আমি কবি।/আমার এ রূপ- সে যে তোমার ভালোবাসার ছবি।’
পাশাপাশি নারীর মর্যাদাও উচ্চকিত হয়েছে তার কবিতায়। পুরুষের যাবতীয় কৃতিত্বের অংশীদার করেছেন নারীকে। এমনকী সমাজের অস্পৃশ্য নারীকেও পরম শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখেছেন নজরুল। একজন বেশ্যার জন্মও সতী মায়ের গর্ভে হতে পারে। বেশ্যা বলে তাকে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখা হবে কেন? ভাগ্যবিড়ম্বিত এ নারীর উদ্দেশ্যে কবির দৃঢ় অভিব্যক্তি—‘কে তোমায় বলে বারাঙ্গনা মা, কে দেয় থুতু ও-গায়ে?/হয়তো তোমায় স্তন্য দিয়াছে সীতা-সম সতী মায়ে।’ তিনি ‘বারাঙ্গনা’ কবিতায় ‘বারাঙ্গনা’কে মা বলে অভিহিত করেছেন। বারাঙ্গনা মায়ের সন্তানদের স্বীকৃতির জন্য তিনি হিন্দু পুরাণসহ বিভিন্ন শাস্ত্র উল্লেখ করেছেন—‘স্বর্গবেশ্যা ঘৃতাচী-পুত্র হ’ল মহাবীর দ্রোণ,/কুমারীর ছেলে বিশ্ব-পূজ্য কৃষ্ণ-দ্বৈপায়ন/ কানীন-পুত্র কর্ণ হইল দান-বীর মহারথী/ স্বর্গ হইতে পতিতা গঙ্গা শিবেরে পেলেন পতি/বিস্ময়কর জন্ম যাহার-মহাপ্রেমিক সে যিশু!’
সামগ্রিকভাবে নজরুলের নারী এক স্বতন্ত্র স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত তার কাব্যে। তিনি বহুবর্ণ, বহু বিচিত্র নারী চরিত্রের সংস্পর্শে এসেছেন। তাদের ভালোবেসেছেন, ভালোবেসে দুঃখে কাতর হয়েছেন, অশ্রুবিসর্জন করেছেন; কিন্তু ভালোবাসার পাত্রীকে অভিশাপ দেননি। বরং সেই ব্যথাতুর অভিজ্ঞতা দিয়ে রচনা করেছেন একের পর এক কবিতা।
কবি বলেছেন—‘বিদায় সখি, খেলা-শেষ এই বেলা-শেষের’ খনে!/ এখন তুমি নতুন মানুষ নতুন গৃহকোণে।’ নজরুল নিজের অস্থির জীবন, আত্মত্যাগ এবং নারীর প্রতি বিশ্বস্ত থেকে সাহিত্যচর্চা করেছেন। নারীর প্রতি সহানুভূতি, সহমর্মিতা প্রদর্শনের পরিবর্তে নারীর অন্তর্গত অমিত শক্তিকে উন্মোচিত করে তিনি প্রকান্তরে সময়কেই অতিক্রম করেছেন। কবির ভাষায়—‘হে মোর রাণী! তোমার কাছে হার মানি আজ শেষে/আমার বিজয় কেতন লুটায় তোমার চরণ-তলে এসে।’
কখনো বা নারীকে তিরস্কারও করেছেন প্রচণ্ড ক্ষোভে। নারীর অস্থিরতাকে দায়ী করেছেন কবি। নারীর লোভকেও ধিক্কার জানিয়েছেন কবিতার ভাষায়। কবির উক্তি—‘নারী কভূ নাহি চায় একা হতে কারো/এরা দেবী, এরা লোভী, যত পূজা পায়/ এরা চায় তত আরো।’
তাই বলে নজরুল ইসলাম নারীবিদ্বেষী নন। নারীর প্রতি ক্ষোভের চেয়ে তার ভালোবাসার দুর্বলতাই বেশি উচ্চকিত হয়ে উঠেছে। তিনি নারীকে সম্মান দেখিয়েছেন। জাগ্রত হওয়ার মন্ত্র শিখিয়েছেন। যেহেতু বলতে গেলে কবিদের প্রেরণাই হচ্ছে নারী। নজরুলও তাদের চেয়ে ব্যতিক্রম নন। কেননা বিপরীত লিঙ্গের প্রতি মানুষের আকর্ষণ সহজাত প্রবৃত্তি বা সৃষ্টিগত ব্যাপার। সর্বোপরি কাজী নজরুল ইসলাম নারীদের সমানাধিকার, নারীর প্রতি অবিচারের প্রতিবাদ, প্রেয়সীর প্রেমের অনিবার্যতা ও মাতৃভক্তির পদতলে যে পরিপূর্ণতা শ্রদ্ধা ও সম্মানের সাক্ষর রাখতে পেরেছেন তা-ই নজরুলকে নজরুল করেছে।
তবে, বিদ্রোহ-প্রেম-সাম্যবাদের মশাল হাতে আবির্ভূত হয়ে যুদ্ধ বিধ্বস্ত পৃথিবীতে যখন মানবতা ধুলায় লুণ্ঠিত তখন তার কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে সাম্যবাদের গান। একই কণ্ঠে হামদ-নাত এবং শ্যামা সংগীতের সুরের মূর্ছনায় মানবজাতিকে উপহার দিয়েছেন সাম্যবাদের মূলমন্ত্র। মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসায় কবি হয়ে উঠেছেন মানবতাবাদী।
নজরুলের সাম্যবাদের প্রধান ক্ষেত্র মানুষ। কে কুলি-মজুর আর কে সাহেব? সবাই তার দৃষ্টিতে সমান। আশরাফ আর আতরাফের কোনো ভেদাভেদ নেই এখানে। সবাই সৃষ্টির সেরা। সবাইকেই তিনি গভীরভাবে ভালোবেসেছেন। নজরুলের সাম্যবাদ তার অন্তরের প্রেরণালব্ধ বস্তু। কবি কল্পনার রঙে রঙিন। মানবতাবোধই তার সাম্যবাদের ভিত্তি। তিনি সব ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে মানবধর্মকেই উচ্চাসনে বসিয়েছেন। মানবের মাঝে তিনি স্রষ্টাকে আবিষ্কার করেছেন। তার সাম্যবাদ স্রষ্টাকে অস্বীকার করে নয়। কাল মার্কসের মতো তার সাম্যবাদ নাস্তিক্য সাম্যবাদ নয়। তার সাম্যবাদ আস্তিক্য সাম্যবাদ। অসাম্প্রদায়িক হলেও তিনি পুরোপুরি আস্তিক ছিলেন।
নজরুলের সাম্যবাদ প্রকাশ পেয়েছে তার ‘সাম্যবাদী’ কাব্যগ্রন্থে। ১৯৫২ সালে এটি প্রথম প্রকাশিত হয়। ‘সাম্যবাদী’ কাব্যগ্রন্থে মোট ১১টি কবিতা স্থান পেয়েছে। যেমন- ‘সাম্যবাদী’, ‘নারী’, ‘মানুষ’, ‘বারাঙ্গনা’, ‘রাজা-প্রজা’, ‘ঈশ্বর’, ‘পাপ’, কুলি-মজুর’, ‘চোর-ডাকাত’, ‘সাম্য’ ও ‘কান্ডারি হুঁশিয়ার’। মূলত ‘সাম্যবাদী’ কাব্যের কবিতাগুলোয় কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের প্রভাব রয়েছে।
তার ‘সাম্যবাদী’ কাব্যের ‘নারী’ কবিতাটি বহুল প্রশংসিত। ‘নারী’ কবিতায় কবি নারী-পুরুষে সাম্যের বাণী উচ্চারণ করেছেন। কবি নারী-পুরুষের ভেদাভেদ অস্বীকার করেছেন। আর ‘বারাঙ্গনা’ কবিতাটি অধিক সমালোচিত। কবিতায় কবি বলেছেন— ‘কে তোমায় বলে বারাঙ্গনা মা, কে দেয় থুতু ও-গায়ে?/ হয়তো তোমায় স্তন্য দিয়াছে সীতা-সম সতী মায়ে।’ তিনি মন্দির-কাবার চেয়ে মানুষের হৃদয়কে বড় জ্ঞান করেছেন। কবি বলেছেন, ‘এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোন মন্দির কাবা নাই।’ ‘সাম্য’ কবিতায় কবি স্রষ্টাকে মহিমাময় এবং মানুষের দেহ মনকেই তার ভজনালয় রূপে বিবেচনা করেছেন— ‘হেথা স্রষ্টার ভজন আলয় এই দেহ এই মন/ হেথা মানুষের বেদনায় তার দুঃখের সিংহাসন/সাড়া দেন তিনি এখানে তাহারে যে নামে যে কেহ ডাকে/যেমন ডাকিয়া সাড়া পায় শিশু যে নামে ডাকে সে মাকে।’
নজরুল মানুষের কবি। সাম্যের কবি। তার বড় পরিচয় তিনি সাম্যবাদী কবি। নজরুলের সাম্যবাদ সকল মানবের মহামিলন। কবি মানবতার জয়গান গেয়েছেন। মানুষকে কখনো তিনি ঘৃণার চোখে দেখেননি। তাই কবি বলেছেন—‘বন্ধু, তোমার বুক ভরা লোভ, দু’চোখে স্বার্থ ঠুলি/ নতুবা দেখিতে, তোমারে সেবিতে দেবতা হয়েছে কুলি।’
মানুষকে তিনি সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান কারও আসল পরিচয় হতে পারে না। আসল পরিচয় হলো, আমরা সবাই মানুষ। ‘কান্ডারি হুঁশিয়ার’ কবিতায় বলেছেন—‘হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?/কান্ডারি! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার।’
এছাড়া তার কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে—‘জাতের চাইতে মানুষ সত্য/ অধিক সত্য প্রাণের টান/প্রাণ ঘরে সব এক সমান।’
‘ঈশ্বর’ কবিতায় নজরুল ইসলাম ঈশ্বর অন্বেষণের ব্যাপারে বলেছেন, বনে-জঙ্গলে, পর্বত চূড়ায় ঈশ্বর অন্বেষণের কোনে প্রয়োজন নেই। ঈশ্বর মানব মনেই অধিষ্ঠিত। আর শাস্ত্র অন্বেষণে না গিয়ে সত্যের সন্ধানে অগ্রসর হতে বলেছেন। ঈশ্বর মানুষের মধ্যেই বিরাজিত, তাকে বাইরে না খুঁজে নিজের মধ্যে ডুব দিতে হবে। কবি বলেছেন, ‘স্রষ্টারে খোঁজোথ আপনারে তুমি আপনি ফিরিছ খুঁজে।’
সর্বোপরি কবি ‘সাম্য’ কবিতায় স্বপ্নের দেশ—আদর্শ দেশের কথা বলেছেন। এমন দেশ যেখানে রাজা-প্রজা নেই, ধনী-দরিদ্রের ভেদাভেদ নেই। ‘সাম্যবাদী’ এ স্থানে বর্ণবৈষম্য নেই, এখানে সাদা ও কালোদের জন্য আলাদা গোরস্তান বা গির্জা নেই। এখানে কোনো ধর্মের বা শাস্ত্রের ভেদ নেই, নেই কোলাহল। সেখানে পাদ্রী পুরুত মোল্লা এক পাত্রে জল খেলেও জাত যাবে না, স্রষ্টা বাতিল হবে না।
বিদ্রোহ, প্রেম, নারী ও সাম্যবাদ বাংলা সাহিত্যে নতুন কোনো বিষয় নয়। কিন্তু কাজী নজরুল ইসলাম যে মমতায় মানবতা মিশ্রিত এ বিষয়গুলোর প্রসঙ্গ তুলে এনেছেন, তা একান্তই অভিনব। এখানেই নজরুলের কবি চেতনার নতুন মাত্রা সংযোজিত হয়েছে।