বড় ঘোরলাগা সেই সময়। কিসের ঘোর? কবিতা, কবিতা শুধু কবিতা। তখন কবিতার নেশায় চুর আমাদের সকাল-সন্ধ্যা, দিনরাত্রি, জীবনযাপন। কবিতার সঙ্গে মিলিয়ে নিচ্ছি প্রতিটি যাপিত মুহূর্ত। যদিও কবিতার সঙ্গে সখ্য হয়েছে সুদূর শৈশবে। হাশেম খানের চিত্রশোভিত পাঠ্যবইয়ের কবিতাগুলো সে সখ্য করেছে আরও নিবিড়। যদিও রাজধানীর সবচেয়ে নিকটবর্তী জেলা শহরে বাস ছিল। তবু ত্রিশ বা পরবর্তী কবিদের কাব্য হাতে এসেছে কলেজে ওঠার পর। মনে আছে এসএসসি পরীক্ষার সময় পাওয়া সেলামির টাকা দিয়ে কিনেছিলাম কাজী নজরুল ইসলামের ‘সঞ্চিতা’। সে-ই প্রথম আমার কবিতার বই কেনা।
এসএসসি পরীক্ষার পর অবসর সময় কেটেছে ‘সঞ্চিতা’র সঙ্গে স্বপ্নের মতো। আরও কিছু সময় পর যখন একের পর এক কবির দেখা পেতে লাগলাম, আমাদের কাছে উন্মোচিত হতে লাগলো নতুন নতুন দিগন্ত। বিস্মিত হতাম, দুঃখবোধ করতাম এই জন্যে আমাদের মনের নিগূঢ় কথাগুলো, গভীর বেদনাগুলো, হিরন্ময় আনন্দগুলো আমার জন্মের আগেই বাণীরূপ পেয়েছে বাংলা ভাষায়—বাংলা কবিতায়।
যৌবনের অঙ্কুরোদ্গমের সঙ্গে সঙ্গে কবিতার জোয়ারে ভেসে যেতে যেতে কত কবি, কত কবিতা, কত পঙ্ক্তির প্রেমে পড়েছি, মজেছি, তার ইয়ত্তা নেই। ইতোমধ্যে মায়াবতী নদীতে কত জল বয়ে গেলো, কতবার জন্মান্তর ঘটলো মাঠের সবুজ দূর্বাদলের, কাছের বন্ধু চলে গেছে দূরে কিন্তু সেই কবিতা, মহার্ঘ্য পঙ্ক্তি’র প্রতি ভালো লাগা, ভালোবাসা, দুর্বলতা অটুট এখনো। চৈত্রের বেলাশেষে চির তরুণ, চির নতুন এক অখণ্ড আকাশের দিকে তাকিয়ে অজান্তেই বিড়বিড় করে বলে উঠি:
প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস
তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ।
নৈশ ভ্রমণে যখন মাঝরাস্তায় গাড়ি থেমে একটুখানি জিরোতে গিয়ে আমাদের দেয় চা পানের অবসর, মনে নিয়তির মতো ভেসে ওঠে,
পথের বিরতি ছিল রাতজাগা কোন চায়ের দোকানে
আকাশে চাঁদ ছিল না
তারাদের লজ্জা ছিল কম…।
জীবনের প্রাত্যহিক মুহূর্তে এরকম শত-সহস্র পঙ্ক্তি কারণে, অকারণে এসে মগজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ভ্রমরের মতো গুণ গুণিয়ে যায়, তার লেখাজোখা নেই। যেসব কবিতা ভরিয়ে রেখেছে আমার ক্ষুদ্র এ জীবন, সে-সব কবিতা প্রথম পাঠের অনুভূতিও কম রোমাঞ্চকর নয়।
তবে যে-দুটি কবিতা প্রথম পাঠের পর আমি মোহগ্রস্ত হয়েছিলাম, বিস্মিত হয়েছিলাম, আমার মনাকাশে এখনো সেই স্মৃতি নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করে; তার একটি কবিতা আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘জ্যোৎস্না’। কবিতাটি তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ’-এ অন্তর্ভুক্ত। এ কাব্যটি যখন ১৯৬৭ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়, তখন আমি তো ভালো, আমার বাবাও শৈশবের সিঁড়ি পেরোয়নি। তারপরও মান্নান সৈয়দের ‘জ্যোৎস্না’ পাঠ করার পর কেমন চমকে উঠেছি, এর সঙ্গে আমার ভাবনার, চিন্তার বৈপরীত্য দেখে।
জ্যোৎস্নাকে নিটল সৌন্দর্যের, রোমান্টিকতার অনুষঙ্গ হিসেবেই জেনেছিলাম, জেনেছিলাম জ্যোৎস্না যেমন প্রেমিক-প্রেমিকার মুহূর্তকে আরও মধুর করে, তেমনি মনও জ্যোৎস্নার স্পর্শে এতটাই পরিশুদ্ধ, পবিত্র হয়ে ওঠে যে, রাজসিংহাসনও তখন তুচ্ছ মনে হয়। এই পাঠ নিয়ে যখন বেড়ে উঠছি, তখন মান্নান সৈয়দ বললেন,
‘জ্যোৎস্না কী?—না, জ্যোৎস্না হয় জল্লাদের ডিমের মতো চুলহীন জলবায়ুহীন মুণ্ডু, জোড়া জোড়া চোখ, সাতটি আঙুলের এক মুষ্টি হাত, রক্তকরবীর অন্ধকার, এবং একগুচ্ছ ভুল শেয়ালের সদ্যোমৃত যুবতীকে ঘিরে জ্বলজ্বলে চিৎকার।’
কবিতাটি আমার দিন-রাত অধিকার করে নিলো।
যখন তখন বন্ধুদের সঙ্গে একা খোলা কণ্ঠে আবৃত্তি করতাম।
জ্যোৎস্নার এই বিভৎস, ভয়ঙ্কর রূপ দেখে চমকে উঠি। তীব্রভাবে আগ্রহ অনুভব করি তার প্রতি, তার কবিতাসহ সব সাহিত্যকৃতির প্রতি। এ-সময়ে অনেকেই মান্নান সৈয়দের অনেক লেখা, রচিত চিত্রকল্পকে অর্থহীন, ব্যঞ্জনাহীন বলে অভিহিত করে থাকেন। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, কবিতা পড়ে চমৎকৃত হলেও জ্যোৎস্নার এই রূপ, ঠিক স্বীকার করতে পারিনি। কিন্তু অল্পকাল পরেই একদিনের কথা, মাঠের বুকে এক বৈকালিক আড্ডা যখন রাতের পাড়ে গিয়ে ঠেকল তখন শুক্লা দ্বাদশীর চাঁদ দেখে আঁৎকে উঠলো এক বন্ধু। আত্মহননের দিকে এগিয়ে যাওয়া এক বন্ধু বললো, চাঁদকে কেন্দ্র করে যৌথ স্বপ্ন বুননের কথা। কিন্তু প্রণয়ে ব্যর্থ হয়ে আজ যখন দর্শন করে চাঁদ-মুখ, তখন একদিনের সুখ স্বপ্ন-ই দুঃসহ স্মৃতির বোঝা হয়ে ফিরে আসে ওর মনে, বীভৎস প্রেতের মতো মুখ বিকৃত করে। তখন বুঝলাম, ‘কবিতা বুদ্ধিবৃত্তি দিয়ে নয়, বুঝতে হয় জীবন খরচ করে।’
দুই.
‘ভালোবাসা মোরে করেছে ভিখারী ’—ভালোবাসা বিষয়ক সব কবিতা, গান যেন জগন্ময় মিত্রের গাওয়া এই গানের-ই পাঠান্তর। ভালোবাসা যেন নিজেকেই নিঃস্ব করে, ধ্বংস করে—এ যেন এক আত্ম-বিধ্বংসী খেলা। কিন্তু কবি ত্রিদিব দস্তিদার বদলে দিলেন আমার এই ভাবনা-ভূগোল। দরাজ কণ্ঠে বললেন, ‘ভালো বাসতে বাসতে ফতুর করে দেবো।’ যদিও বেদনার বিষয় কবিতার এই লাইনটি পড়ে ছিলাম ত্রিদিব দস্তিদারের মৃত্যু-সংবাদের প্রথম লাইনে। কিন্তু লাইনটি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে তখন কবির পুনর্জন্ম হয়েছে। ‘জ্যোৎস্না’ আমার মনে তৈরি করেছিল চমক, ‘ভালোবাসতে বাসতে বাসতে ফতুর করে দেবো’ কবিতাটি তৈরি করলো ঘোর। কিছুদিন আগে প্রিয় কবি আবু হাসান শাহরিয়ারকে কথাটি বলতেই, তিনি বললেন, ‘ত্রিদিবও সব সময় কবিতার ঘোরে থাকতো।’ ‘ভালো বাসতে বাসতে ফতুর করে দেবো’ কবিতাটি আমার দিন-রাত অধিকার করে নিলো। যখন তখন বন্ধুদের সঙ্গে একা খোলা কণ্ঠে আবৃত্তি করতাম:
ভালোবেসে কি ফতুর করা যায়?
ভালোবাসা ফতুর হয় না কখনো
তবে আমি তোমাকে ভালো বাসতে বাসতে
ফতুর করে দেবো
তোমার ভালোবাসা এক সময় ফুরিয়ে যাবে
আমার ভালোবাসার আজন্ম উত্তাপে
বাষ্পায়িত হবে তোমার ভালোবাসা
আমার ভালোবাসার গতি ও তীব্রতায়
ম্রিয়মাণ হবে
জলে, অন্তরীক্ষে
ভালোবাসা-স্থলের অতি ব্যবহারে
হবে তুমি প্রাচীন কোন নৃতত্ত্বের সন্ধান
নতুন প্রেমিকের কাছে
ভালো বাসতে বাসতে তোমাকে
ফতুর করে দেবো
ফতুর করে দেবো
ভালো বাসতে বাসতে বাসতে…
ফেব্রুয়ারির বই মেলায় ত্রিদিব দস্তিদারের ‘কবিতা সমগ্র’ বেরুতেই কিনে পড়লাম অন্য কবিতাগুলোও। প্রেমে আকণ্ঠ নিমগ্ন এক কবি—যার প্রেমিকা কখনো নারী, কখনো বা দেশ।
কিছুদিন আগে এক আড্ডায় বইটির প্রকাশক ম্যাগনাম ওপাসের কর্ণধার আনোয়ার ফরিদীকে বইটির কথা জিজ্ঞেস করতেই জানালেন, ত্রিদিব দস্তিদার যখন হাসান হাফিজুর রহমানের সহকারী হিসেবে ‘মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র’ সম্পাদনায় ব্যস্ত, তখন ফরিদী তরুণ সাংবাদিক। কবিকে বললেন, ত্রিদিবদা আমি যদি কখনো প্রকাশক হই, তবে আপনার হাতের লেখা দিয়ে একটি কবিতার বই করবো। দুই দশক পরে আনোয়ার ফরিদী যখন প্রকাশক, ত্রিদিব দস্তিদার একদিন স্মরণ করিয়ে দিলেন পুরনো কথা। ফরিদী ও আবু সিদ্দিক ম্যাগনাম ওপাস থেকে প্রকাশ করলেন, ‘ভালোবাসতে বাসতে ফতুর করে দেবো’।
বইপাড়ায় আলোড়ন তুলেছিল সুদৃশ্য বইটি, কারণ এর আইডিয়াটি ছিল খুবই অভিনব। এছাড়া কাব্যগুণে বইটি পেয়েছিল পাঠকপ্রিয়তা। ত্রিদিব দস্তিদারের মৃত্যুর পর কিছুদিন পত্রিকায় তার কবিতা নিয়ে আলোচনা, তাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ হলেও মৃত্যুর একদশক পরেই তিনি চলে গেছেন বিস্মৃতির অন্তরালে। আবদুল মান্নান সৈয়দকেও বিশেষ দলভুক্ত করে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হচ্ছে। একজন কবি, লেখক বা শিল্পীকে মূল্যায়ন করা উচিত, তার সৃষ্টি দিয়ে, অন্য কিছুই তার মূল্যায়নের মাপকাঠি হওয়া উচিত নয়। আমাদের দীন সমালোচনা সাহিত্যে অন্ধের হাতি-দর্শন পদ্ধতি ব্যবহার করে এর দীনতা আরও প্রকট করে তুলছে; যা আত্মঘাতী। কিন্তু সত্যিকার প্রতিভার স্ফুলিঙ্গ অবহেলা, অনাদরে নিভে যায় না। অনুসন্ধিৎসু সহৃদয় সংবেদী পাঠকের মনে তা ঠিকই দাবানল আকারে ছড়িয়ে পড়ে, এমনকি কবির মৃত্যুর ছয় শতক পড়েও তার সাহিত্য আলোচিত হওয়ার নজির বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে বিরল নয়।