একটি ঘটনা আমার জীবনটাকে পাল্টে দিলো।
আমি বদলির আদেশপত্রটি ছিঁড়ে ফেললাম। অফিস থেকেও ফরমাল ফেয়ারওয়েল নিলাম না। শুধু রেজিগনেশন লেটার দেওয়ার জন্য যা যা করার তাই করে অফিস থেকে বের হয়ে এলাম। ওই যে বের হয়ে এলাম তারপর তো জীবনের গতিপথটাই বদলে গেলো।
এখন এই পঞ্চান্ন বছর বয়সে আবার জীবনের গতিপথ কোনদিকে যায় কে জানে! মানুষ যতই সচেতন হোক, যতই লজিক্যাল হোক কিছু বিষয় ঘটে যায় তাতে পৃথিবীর কোনো সূত্রই খাটে না। আমি শঙ্কিত এরকম কোনো কিছু আমার জীবনে আসে কিনা।
আমি নাবিলাকে ফোন করি না। নাবিলাও কয়েকদিন ফোন করে না।
তারপর আচমকা একদিন নাবিলার ফোন। আমি খুব দ্রুত ফোন রিসিভ করি। কেন করি জানি না। কিন্তু আমি অপ্রস্তুত হয়ে যাই। কারণ ও প্রান্তে নাবিলা কাঁদছে। আমি কী করব বুঝতে পারছি না। কাঁদতে কাঁদতেই নাবিলা বললো, ‘আপনি এ রকম কেন?’
আমি বললাম, ‘কী রকম?
নাবিলা বললো, ‘এ কয়েকদিন আমার একটু খোঁজ নেবারও প্রয়োজন মনে করলেন না? আমার ওপর দিয়ে কী ঝড়টাই না বয়ে গেলো?’
‘কেন কী হয়েছে তোমার? সরি। আমার খোঁজ নেওয়া উচিত ছিল।’
‘আম্মু অসুস্থ। স্কয়ার হসপিটালে ভর্তি। স্ট্রোক করেছিল। এখন ভালো। দুই-একদিনের মধ্যেই ছেড়ে দেবে। ডক্টর বলেছে মাইনর অ্যাটাক। তবে সাবধানে থাকতে হবে।’
আমি হায় হায় করে উঠি। ‘বলো কী! আমাকে আগে বলোনি কেন?’
‘আমাকে একটা প্রশ্নের উত্তর দেবেন? আমার ধারণা আপনি এই প্রশ্নের উত্তর জানেন।’
‘তুমি যদি জেনেই থাকো আগে থেকে যে, আমি তোমার প্রশ্নের উত্তর জানি, তাহলে প্রশ্ন করার দরকার কী?’
‘দরকার আছে। আমি জানি আপনি প্রশ্নটির উত্তর জানেন। কিন্তু উত্তরটা কী, তা তো আমি জানি না।’
আচ্ছা ঠিক আছে বলো তোমার কী জানার ইচ্ছা?
‘আম্মু আপনার লেখা বই তিলোত্তমা বিষয়ক পাপ বইটি পড়ছিল। বইটা পড়তে পড়তেই অসুস্থ হয়ে পড়লো। আমার প্রশ্ন হলো একজন সুস্থ মানুষ একটা বই পড়তে পড়তে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গেলো কেন? আম্মু হয়তোবা গল্প-উপন্যাস পড়েন না তেমন কিন্তু অন্য পড়া তো ঠিকই পড়েন। সত্যি করে বলবেন কি অম্মু এই বইটা পড়ার সময়ই কেন হার্ট অ্যাটাক করলো? আমার আম্মুর হার্ট অ্যাটাক করার জন্য কি আপনি বইটি লিখেছিলেন?’
আমি বলি, ‘বই পড়ে হার্ট অ্যাটাকের কথা বলছ। বই পড়তে পড়তে মৃত্যুবরণ করার উদাহরণও আছে। সম্রাট হুমায়ুন বই পড়তে পড়তে মারা যান’।
নাবিলা এবার চিৎকার দিয়ে ওঠে, ‘রসিকতা করবেন না মিস্টার লেখক। আম্মুর হার্ট অ্যাটাক নিয়ে নিয়ে রসিকতা অশ্লীলতার পর্যায়ে পড়ে। আপনার এই সেন্স আছে বলে আমি শুধু আশা নয়, বিশ্বাস করতে চাই। আমার বিশ্বাসকে অমর্যাদা করবেন না।’
আমি কিছুক্ষণ নীরব থাকি। এ প্রশ্নের উত্তর কী হবে আমার জানা নেই।
নাবিলা এবার হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে, ‘আমার সুস্থ আম্মুটা আপনার বই পড়তে পড়তে অসুস্থ হয়ে গেলো। তারপর যা ঘটল তা তো আরো রহস্যময়। সত্যি করে বলবেন কি, কে এই তিলোত্তমা!’
আমি বললাম, ‘আমি তোমার অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি। কিন্তু এই প্রশ্নের নয়। তুমি জোরাজুরি করলে আমি ফোন রেখে দেবো।’
‘তা তো দেবেনই। ওই তো এক অস্ত্র আপনার। আপনার অস্ত্রগুলো মর্মান্তিক। যেমন আপনি আপনার নিজের পরিচয় গোপন করে শোয়েব চৌধুরী হয়ে গেছেন মিস্টার এমরান কবির।’
এবার আমার বিস্মিত হওয়ার পালা শুরু হলো। নাবিলা এই নামটি জানলো কেমন করে! নিশ্চয়ই তার মা বলেছে।
আমি চুপ করে থাকি। নাবিলা বলতে থাকে, ‘চুপ করে থাকবেন না মিস্টার এমরান কবির। আমি আপনাকে চিনে ফেলেছি’
আমার বুকের ভেতরটা ধ্বক করে ওঠে। নাবিলা কি সব জেনে গেলো। তাহলে!
নাবিলা আরও বলতে থাকে, ‘আম্মু সুস্থ হয়ে আমাকে অনেক তথ্য দিয়েছে। বলেছে তিনি আপনাকে চেনেন। আপনার আসল নাম এমরান কবির। এই নামে বিশ বছর আগে লেখা আপনার বইও আছে। তারপর কী এক রহস্যময় কারণে আপনি ওই নাম ছেড়ে শোয়েব চৌধুরী হয়ে গেছেন। আমি আম্মুর কথা বিশ্বাস করিনি। কিন্তু তিনি আরও কিছু তথ্য আমাকে দিয়েছেন। আমি খুব বিস্ময়ের সাথে সেগুলো শুনেছি। তারপর প্রমাণ করার জন্য এখানে সেখানে গিয়েছি। তারপর নিশ্চিত হয়েছি।’
আমি রীতিমতো ঘামতে শুরু করেছি। নাবিলা কী বলছে এসব! তাহলে এ কথাই সত্য যে পৃথিবীর কোনো কিছুই চাপা থাকে না! আমি নাবিলা নামীয় সদ্য যুবতীর কাছে ধরা খেযে গেলাম!
নাবিলা আবারও বলতে শুরু করল, ‘আম্মু বলেছে আপনি আগে কবিতা লিখতেন। আপনার প্রথম কবিতার বইয়ের নাম কী সুন্দর মিথ্যাগুলো। প্রকাশনীর নামও বলেছে। ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ। আমি বিশ্বাস করিনি। পরে বাংলাবাজার গিয়ে খুঁজেছি এই প্রকাশনী। এবং পেয়ে গেছি। এর কর্ণধার হলেন আদিত্য অন্তর। আমি তাকে ঘটনা বলেছি। তিনি বিস্মিত হয়েছেন। বলেছেন, ঘটনা সত্য কিন্তু আপনি কে? আমিও তো তাকে অনেকদিন খুঁজছি। আমার প্রকাশনী থেকে তার প্রথম কবিতার বই বেরিয়েছিল। নানান ব্যস্ততার কারণে তাকে রয়্যালিটির টাকাটাও দেওয়া হয়নি। বইতো বেশ চললো। তারপর উনি নিখোঁজ হলেন। কেউ বলে আত্মগোপন, কেউ বলে বিদেশ চলে গেছে, কেউ বলে মারা গেছে। কিন্তু আসলে যে কী হয়েছে কেউ জানে না। অথচ আমি নিজে রিস্ক নিয়ে তার প্রথম বইটি করেছি।’
আমি চুপ করে নাবিলার কথা শুনছি। এর এক বর্ণও তো মিথ্যা নয়! নাবিলার নিঃশব্দ কান্নার শব্দ পাচ্ছি। আমার হৃদয় ঝরছে। আমি পরাজিত হয়ে যাচ্ছি।
নাবিলা নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, ‘আপনি কেন এরকম করেছেন? নিজেকে কেন আড়াল করে করে দুঃখ দিয়েছেন নিজেকে? আমি জানি আত্মগোপন করে থাকা কত কষ্টের। কেন এত কষ্ট করে করে জীবনটাই শেষ করে দিলেন? এক জীবনে এই সাড়ে সাতশত কোটির পৃথিবীতে আপনি একজনকেও খুঁজে পাননি, যিনি আপনাকে স্বাভাবিক জীবন দান করতে পারেন?’
নীরবতা।
‘আপনি কি জানেন আমি আপনাকে অনেক আগে ভালোবেসে ফেলেছি! আপনাকেই ধ্যান জ্ঞান করেছি। মনে মনে আমি এত দূর এগিয়েছি যে, সেখান থেকে ফিরে আসা সম্ভব নয়! আমি জানি এর জন্য চরম বিপর্যয় নেমে আসবে। আম্মু এটা মেনে নিতে পারবেন না। সমাজ মেনে নিতে পারবে না। কিন্তু আমি অদম্য সাহস সঞ্চয় করেছি। আমি সারাজীবন আপনার সাথেই কাটাতে চাই। জীবন আপনাকে যা দেওয়ার কথা ছিল, দেয়নি। আমি তা দিয়ে আপনার জীবন পূর্ণ করতে চাই।’
নীবরতা।
নীরবতা।
নীরবতা।
‘আপনি আমার আম্মুকে দেখতে আসবেন না? ’
আমি ছোট করে উত্তর দেই, ‘আসব’।
তিলোত্তমা বিষয়ক পাপ
এমরান কবির
প্রকাশনী: অক্ষরবৃত্ত
প্রচ্ছদ: আল নোমান
মূল্য: ১৫০ টাকা