নির্মাতা তারেক মাসুদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি ‘মাটির ময়না’ চলচ্চিত্র। এটি ঠিক আত্মজৈবনিক ছবি নয়। বলা যায় শৈশবের স্মৃতি অভিজ্ঞতাভিত্তিক ছবি। এখানে তারেক মাসুদ ও ১২-১৪ বছরের আনুর মধ্যে সম্পর্কটা হচ্ছে শৈশবের সঙ্গে বয়ঃপ্রাপ্ত মানুষের বোঝাপড়ার বিষয়। ছবিতে আনু প্রধান চরিত্র নয়। তার চরিত্রটি অনেকটা লেন্সের মতো। অর্থাৎ সে সবকিছু দেখছে এবং দর্শক আনুর চোখ দিয়ে তার আশপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনা এবং চরিত্রগুলো দেখছে। আনু যখন বিশ্বকর্মা পূজায় নৌকাবাইচে যাচ্ছে, আমরা তখন নৌকাবাইচ দেখছি। আনু যখন মাদ্রাসায় যাচ্ছে, তখন আমরা মাদ্রাসা দেখতে পাচ্ছি। আবার সে যখন শহরে আসছে, বাজারে যাচ্ছে সেখানে মিটিং-মিছিলের সেই উত্তাল রাজনীতি, সেটা তাকে স্পর্শ করছে। যখন সে গ্রামে আসছে, তার পরিবারের মধ্যে যে টানাপড়েন চলছে বাবা-মায়ের সম্পর্কের মধ্যে, সেগুলো আনুর চোখ দিয়েই আমরা দেখি।
আনুর চেয়ে আনুর বন্ধু রোকন এখানে অনেক নাটকীয় চরিত্র। ফলে তারেক মাসুদ এখানে আনুকে প্রধান চরিত্র না করে সেটাকে একটা ক্যাটালিস্ট চরিত্র হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। তারেক মাসুদ ‘মাটির ময়না’র পটভূমি নিয়ে বলেছেন, ‘ছবিতে আনুর যে বয়সটা, যাকে বলা হয় কামিং অব এজ বা বয়ঃসন্ধিকাল, ব্যক্তিজীবনেও আমি আমার ক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে পার হচ্ছিলাম এবং কাকতালীয়ভাবে এটা বাস্তব যে আমাদের জাতিও একটা ক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে পার হচ্ছিল। ওটাও একটা কামিং এজ অব নেশন; এই দুটোর একটা সমন্বয় ঘটেছে। আমি যখন বড়ো হচ্ছি তখন একটি জাতির বিকাশোন্মুখ সময়; ঊনসত্তর, সত্তর, একাত্তর যেটা আমার ছবির পটভূমি।’
তারেক মাসুদ একাধিক মাদ্রাসায় পড়েছেন। কাকরাইল, যশোরের মধুমতী নদীপাড়ের বাহিরদিয়া মাদ্রাসায় পড়েছেন। এছাড়া তার জন্মস্থান ফরিদপুরের ভাঙ্গার মাদ্রাসায় পড়েছেন। এমন বিভিন্ন মাদ্রাসায় পড়ার অভিজ্ঞতাকে তারেক মাসুদ ‘মাটির ময়না’য় ব্যবহার করেছেন। ছবির মাদ্রাসার একেকটা জিনিস তারেক মাসুদ একেক জায়গা থেকে নিয়েছেন। তারেক মাসুদের প্রথম ভর্তি হওয়া ভাঙ্গার মাদ্রাসাসংলগ্ন একটা বিরাট দিঘি ছিল, যেটা শিক্ষার্থীরা ব্যবহার করতো। তারেক মাসুদ যখন প্রথম মাদ্রাসায় গেলেন, সেদিন রাত তিনটা সাড়ে তিনটার দিকে তাকে তুলে সেই ঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কুয়াশার মধ্যে সামান্য আলো-আঁধারিতে দেখা যাচ্ছিল সবাই মেছওয়াক করছে। তারেক মাসুদকেও মেছওয়াক করা শেখানো হলো। কুয়াশার সেই ভোরবেলায় সেই সিঁড়িটাকে তারেকের অনেক বড় মনে হয়েছিল। ছোটোবেলার সিঁড়ি স্মৃতিতে অনেক বড় মনে হয়, পরে তারেক মাসুদ দেখেছেন সিঁড়িটা আসলে অতটা বড় নয়। এটাই তারেক মাসুদের মাদ্রাসা জীবনের প্রথম স্মৃতি। ফলে সেটা তার স্মৃতিতে একেবারে গেঁথে গেছে। এই কারণে তারেক মাসুদ এই দৃশ্য দিয়েই ‘মাটির ময়না’ ছবিটি শুরু করেছেন।
‘মাটির ময়না’কে উৎসবের উদ্বোধনী ছবি হিসেবে নির্বাচন করা হয়। শুধু তাই নয়, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ইতালীয় ও ফরাসি ঘোষণার পাশাপাশি রোকেয়া প্রাচীর কণ্ঠে বাংলায় ঘোষণা করা হয়।
এই ছবিতে তারেক মাসুদ সিঁড়িটা নিয়েছেন ছোটোবেলার ভাঙ্গার সেই মাদ্রাসা থেকে। বিল্ডিংটা হচ্ছে লালবাগ মাদ্রাসার বড় আর্কিটেকচারটা। ব্যাক ইয়ার্ডটা নিয়েছেন কাকরাইল মাদ্রাসার পেছন থেকে। কাকরাইল মাদ্রাসার পেছনের অংশে তারেক মাসুদ তার বন্ধুদের সঙ্গে খেলতেন। যদিও সেখানে খেলার পাশাপাশি অনেক কিছুই নিষিদ্ধ ছিল। তারেক মাসুদ ‘মাটির ময়না’ ছবিটিতে প্রচুর জায়গা, লোকেশনের স্মৃতিকে সমন্বয় করেছেন, যেন এক মাদ্রাসাতেই সবকিছু। তারেক মাসুদের একজন বন্ধু ছিল, যে খুবই রুগ্ণ ও দুর্বল এবং অপুষ্টিতে ভুগতো। অন্য সব ছেলে তাকে খুব জ্বালাতো। আরেকজন ছিল স্মার্ট, এমন স্মার্ট ও বাকপটু যে শিক্ষকদের কথার প্রত্যুত্তরে সে এমন সব কথা বলতো, শিক্ষকরা বোকা হয়ে যেতেন। ফলে শিক্ষকরা তার ওপর প্রায় খেপে যেতেন এবং মারতেন। আর একজন বন্ধু ছিল যার আসলেই হয়তো সিজোফ্রেনিয়া ছিল, অনেকটা পাগলের মতো। এবং সে দাবি করতো তার স্পেশাল একটা বন্ধু আছে। সেই বন্ধুর দেওয়া মিষ্টি তারেক মাসুদকে সে খাইয়েছিল সত্যি সত্যি। অথচ বোয়ালমারী বাহিরদিয়া মাদ্রাসার ১২ মাইলের আশপাশে কোনো মিষ্টির দোকান ছিল না। সেখানে সে কিভাবে মিষ্টি জোগাড় করতো, তারেক মাসুদের কাছে তা আজীবন বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল। তারেক মাসুদ ‘মাটির ময়না’ ছবিতেও এর ব্যাখ্যা দেননি।
তারেক মাসুদের বন্ধুটি বোয়ালমারী রেলস্টেশনের দূরবর্তী জায়গায় দীর্ঘদিন ধরে পড়ে থাকা একটা রেলের বগিতে, যেটাতে ঘাস, পাতা, আগাছা জমেছিল ওটার মধ্যে চমৎকার একটা বাসা বানিয়েছিল। ‘মাটির ময়না’ ছবিতেও আনুর বন্ধু রোকন তার নিজস্ব ভুবন তৈরি করেছে একটি পরিত্যক্ত ঘরে। তারেক মাসুদ তার এই তিন বন্ধুর সমন্বয় করে আনুর বন্ধু রোকন তৈরি করেছেন। ‘মাটির ময়না’ ছবিতে যেসব চরিত্র চিত্রিত হয়েছে, তার প্রায় সবাই বাস্তবে ছিল। এ ছাড়া ‘মাটির ময়না’ ছবির লোকসংস্কৃতি, পুথি, লোকগান, নৌকাবাইচ বা চৈত্রসংক্রান্তির মেলা; এগুলোর মধ্য দিয়েই তারেক মাসুদ বেড়ে উঠেছেন। তারেক মাসুদ বলেন, ‘বিষয়গুলো উপস্থাপন করার জন্য চিত্রনাট্য আমাকে বানাতে হয়নি, এ যেন সব সময় আমার সঙ্গেই ছিল।’
‘মাটির ময়না’ সিনেমার শুটিং করার সময় আনুর একবার জ্বর হলো। তারেক মাসুদ তখন ভীষণ অস্থির হয়ে গেলেন। বন্ধ করে দিলেন শুটিং। তিনি তার শিল্পীদের প্রতি অত্যন্ত মনোযোগী ছিলেন। সবার ভালো-মন্দের খোঁজ রাখতেন। আনুর সাধারণ জ্বর ছিল অথচ তারেক মাসুদ অস্থির হয়ে সবাইকে ফোন করে জেনে নিলেন আনুকে কী খাওয়াতে হবে, কিভাবে সেবা করতে হবে এবং সে অনুযায়ী সেবা করতে শুরু করলেন। শীতের কনকনে ভোরে শুটিং করতে গিয়ে আর্টিস্টরা যখন চিন্তায় পড়ে গেলেন, কিভাবে তারা শুটিং করবেন; তখন তারেক মাসুদ তাদের ঘুম ভাঙার আগেই সবার জন্য গরম পানি রেডি করে রাখতেন। আর্টিস্টরা কোথায় থাকবেন, কিভাবে থাকবেন, শত ব্যস্ততার মধ্যেও তারেক মাসুদ সেটা ভুলতেন না। তিনি শিল্পীদের সন্তানের মতো আগলে রাখতেন।
‘মাটির ময়না’ সিনেমাটিতে আনুর বোনের চরিত্রে অভিনয় করে অভিনেত্রী রোকেয়া প্রাচীর মেয়ে রিমঝিম। রিমঝিম প্রতিটি শটের আগে তার কখনো মুরগির বাচ্চা লাগবে, কখনো আইসক্রিম লাগবে। এসবের কোনো কিছুতেই তারেক মাসুদ বিরক্ত হতেন না। তারেক মাসুদের কথায় ইউনিটের লোকজন ছুটছে মুরগির বাচ্চা জোগাড় করতে। রিমঝিম মুরগির বাচ্চা নিয়ে শট দিতে যেতো। তারেক মাসুদ রিমঝিমের জন্য আইসক্রিম আনতে গাজীপুর ছুটতেন। একটা ভালো শট দেওয়া হলে রিমঝিমকে ঘাড়ে তুলে ঘুরে বেড়াতেন।
২০০২-এর মে মাসে কান চলচ্চিত্র উৎসবে তারেক ও ক্যাথরিন মাসুদ যখন ছবিটা প্রদর্শন করছিলেন, সে সময় তারা জানতে পারেন ধর্মীয় স্পর্শকাতরতার কথা চিন্তা করে সেন্সর বোর্ড ছবিটিকে ছাড়পত্র দেয়নি। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ‘মাটির ময়না’ ২০০২ সালের জুলাই মাসে সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র পায়।
২০০২ সালের ১৬ মে থেকে অনুষ্ঠিত কান উৎসবে তারেক মাসুদ ‘মাটির ময়না’র টিমসহ অংশগ্রহণ করেন। কান উৎসবের জৌলুস, বৈভব এতটাই বিশাল ও বিপুল যে, ‘মাটির ময়না’য় শিশু আনু যেমন অভিভূত বিস্ময়ে নৌকাবাইচ প্রত্যক্ষ করে, তেমনি বাংলাদেশের একজন নির্মাতা হিসেবে কানে গিয়ে তারেক মাসুদের ওই অবস্থা হয়েছিল। তবে তারেক মাসুদ ও তার টিম ঠিক সেভাবে আনন্দ করতে পারেনি। কারণ দেশে ঠিক সে সময়েই সিনেমাটি সেন্সর বোর্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। উৎসব শেষে ‘মাটির ময়না’ একটি গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার পায়। এই পুরস্কারটি তারেক মাসুদকে শক্তি জুগিয়েছে। তিনি আশা করেছিলেন, ছবিটি যে অবিচারের মুখোমুখি হয়েছে, এই পুরস্কারের ফলে তার একটা প্রতিকার ঘটবে। তারেক মাসুদের প্রত্যাশা অনুযায়ী সাংবাদিক এবং সাধারণ মানুষ ছবিটির পাশে দাঁড়িয়েছিল এবং এতে করে নিষিদ্ধ হওয়ার লেভেলটি সহজেই মুছে যায়।
কান উৎসবে নির্মাতার পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্রের একটি প্রতিযোগিতা বিভাগ ছিল। তাতে অংশগ্রহণের জন্য অবশ্যই যোগ্য ছিল ‘মাটির ময়না’। কিন্তু ‘মাটির ময়না’র আগে তারেক মাসুদ দুটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছিলেন,‘মুক্তির গান’ ও ‘মুক্তির কথা’। সেই প্রামাণ্যচিত্র দুটিকে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বিবেচনা করার অজুহাতে অত্যন্ত অন্যায়ভাবে ‘মাটির ময়না’কে ওই প্রতিযোগিতা থেকে বঞ্চিত করা হয়। তবে বিষয়টি প্রমাণ করার এবং প্রয়োজনীয় আপিল জানানোর জন্য যে দেশের ছবি, সে দেশের সরকার ও দূতাবাসের ভূমিকা থাকা অত্যন্ত প্রয়োজন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ছবিটি তখন দেশে নিষিদ্ধ ছিল, তাই তারেক মাসুদ সরকারি কোনো সহযোগিতা পাননি। ‘মাটির ময়না’ কান চলচ্চিত্র উৎসবের মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার ও ইতিবাচক সমালোচনা পেয়েছে। ওই বছর কানে আর কোনো ছবি অতটা পায়নি। লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকার পিটার রাডশর সমালোচনা, লা মঁদ টেলেরামার প্রচ্ছদ কাহিনি, এরকম অনেক ইতিবাচক সমালোচনা ও প্রচারের কারণে তখন ‘মাটির ময়না’কে নিয়ে একটি রব উঠেছিল এবং এর ফলেই ফ্রান্সজুড়ে ৪৪টি সিনেমা হলে দীর্ঘ চার মাস ধরে ‘মাটির ময়না’ প্রদর্শিত হয়েছে। সেখানকার সংগীতের দোকানে সিনেমাটির গানের সিডি বিক্রি হয়েছে।
কান চলচ্চিত্র উৎসব শেষ হওয়ার দুদিন আগেই তারেক মাসুদ টিমের সকলকে নিয়ে ফ্রান্সের অভিন্যতে বেড়াতে চলে যান। সেখানে তারেক মাসুদের বন্ধু সিলভান ও গেতানের প্রায় তিন-চারশ বছরের পুরোনো এক প্রাসাদের মতো বাড়ি আছে। তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ প্রত্যাশা করেছিলেন গোল্ডেন ক্যামেরা বা প্রথম কাহিনিচিত্রের পুরস্কার পাওয়ার। কিন্তু সেটা থেকে যখন অন্যায়ভাবে বঞ্চিত করা হলো তখন উৎসবের শেষ দিনে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে না থেকে তারা বেড়াতে চলে গেলেন। সেদিন বিকেল তিনটায় পরিবেশক এম কে টুর প্রেস অ্যাটাসে মনিকা ফোনে জানতে চাইলেন তারেক মাসুদ ও তার টিম কোথায় আছে।
তারেক মাসুদ দক্ষিণ ফ্রান্সের কথা জানান। তখন তিনি বলেন ‘মাটির ময়না’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি পুরস্কার পেয়েছে। আর সেটা হলো ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রিটিকস পুরস্কার’। সারা পৃথিবীর চলচ্চিত্র সাংবাদিক ও সমালোচকদের যে আন্তর্জাতিক সংগঠন তাদের পুরস্কার হচ্ছে ইন্ট্যারন্যাশনাল ক্রিটিকস প্রাইজ। ৬টার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে দক্ষিণ ফ্রান্স থেকে এসে যোগ দেওয়া প্রায় অসম্ভব ছিল। তারেক মাসুদ নিজেদের নিয়ে আসা গাড়িটি রেখে সিলভার ও গেতানের ফোর হুইলার গাড়ি নিয়ে যখন রওনা দিলেন তখন তাদের হাতে ছিল মাত্র আড়াই ঘণ্টা। অনুষ্ঠান শুরুর ঠিক ১০ মিনিট আগে ক্যাথরিন মাসুদ, তারেক মাসুদ এবং জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় পুরস্কার বিতরণী সভায় গিয়ে পৌঁছান। এই পুরস্কারপ্রাপ্তির ফলে রেডিয়ো, টিভি ও ভ্যারাইটি টেলেরামা ইত্যাদি পত্রিকায় ব্যাপক ইতিবাচক সমালোচনা পায় ‘মাটির ময়না’। ‘মাটির ময়না’কে উৎসবের উদ্বোধনী ছবি হিসেবে নির্বাচন করা হয়। শুধু তাই নয়, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ইতালীয় ও ফরাসি ঘোষণার পাশাপাশি রোকেয়া প্রাচীর কণ্ঠে বাংলায় ঘোষণা করা হয়। অপ্রত্যাশিতভাবে এত বড়ো সম্মান পেয়ে সকলে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েন।
‘মাটির ময়না’ তারেক মাসুদকে আরও একটি মূল্যবান উপহার দেয়। তা হলো বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার আব্বাস কিয়েরোস্তামির সঙ্গে দেখা হওয়া। তারেক মাসুদ তাঁর টেন ছবির ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার দেখলেন একসঙ্গে বসে। এবং তার সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করলেন যেটা পরবর্তীসময়ে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। কান উৎসবের পরে তারেক মাসুদ মারাকেশ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে আমন্ত্রিত হয়ে যান। মারাকেশ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব মরক্কোর বাদশাহ ষষ্ঠ মোহাম্মদের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতায় আয়োজিত হয়। ‘মাটির ময়না’ ছবিটি কিছুটা হলেও মাদ্রাসা ও ইসলাম নিয়ে তাই তারেক মাসুদ উৎসুক হয়ে রইলেন যে ইসলামবিরোধী ছবি হিসেবে যেটি বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হয়েছে, সেটি মরক্কোর মুসলমান সমাজ কিভাবে নেয়, সেটা দেখার জন্য।
‘মাটির ময়না’ অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডেলেড, সুইজারল্যান্ডের ফ্রিবুগ, স্পেনের সিটগেজসহ ইতালি ও কায়রো চলচ্চিত্র উৎসবে আমন্ত্রিত ও প্রদর্শিত হয়েছে।
বিখ্যাত অভিনেত্রী জ্যঁ মরো ছিলেন জুরি বোর্ডের সভাপতি। সে দেশের সবচেয়ে প্রবীণ ইসলামি চিন্তাবিদ যিনি, তিনি ছিলেন জুরি বোর্ডের সদস্য। ‘মাটির ময়না’র দুটি প্রদর্শনী হয় ব্যাপক আয়োজনে, দর্শকদের ব্যাপক সাড়া পাওয়া যায়। দর্শকদের আরবি প্রশ্ন ইংরেজি করে দেওয়া হয় তারেক ও ক্যাথরিন মাসুদের কাছে, তারা সেগুলোর উত্তর দেন। স্থানীয় পত্রিকাগুলোতে ‘তায়েরে ত্বিন’ মূল শিরোনামে প্রচুর লেখা ছাপা হয় (তায়ের মানে পাখি আর ত্বিন শব্দের অর্থ মাটি)।
মারাকাশে ‘মাটির ময়না’ শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যের জন্য পুরস্কার পায়। মরাকাশ উৎসবে তারেক মাসুদ প্যালেস্টাইনের নির্মাতা সুলাইমান, শাদের পরিচালক হারুন, মোরিতানিয়ার আব্দুর রহমান সিসাকু এবং আফ্রিকার বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার কোস্তাগারাসের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের সাথে পরিচিত হন এবং বন্ধুত্ব হয় তাদের সঙ্গে। তারেক মাসুদের মরাকেশ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে চমৎকার সব স্মৃতির সঙ্গে দুঃখের একটি স্মৃতি রয়েছে। তারেক মাসুদ ওই উৎসবের প্রায় আড়াইশর মতো ছবি তুলেছিলেন। কাসাব্লাঙ্কায় তাদের ফ্লাইট থেকে ক্যামেরাটি চুরি হয়ে যায়। আর ব্যস্ততার কারণে তিনি ছবিগুলো কম্পিউটারে ডাউনলোডও করতে পারেননি। এই ঘটনায় প্রচণ্ড দুঃখ পেয়েছিলেন তিনি। পুরস্কার পাওয়ার পর বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় পাঠাতে হয়েছিল বলে জ্যঁ মরো ও আমির খানের কাছ থেকে পুরস্কার নেওয়ার তিনটি ছবি তখন ডাউনলোড করা হয়। সেই ছবি তিনটিই ছিল শুধু তার কাছে।
মারাকাশের পর তারেক মাসুদরা যান এডিনবার্গ চলচ্চিত্র উৎসবে। সেখানে বিশাল বাণিজ্যিক সিনেমা হলে দুটি প্রদর্শনী হয়। প্রতিবার ছবি শেষে এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে দর্শকদের সাথে প্রশ্নোত্তর পর্ব চলতে থাকে। দর্শকরা আগ্রহের সাথে ‘মাটির ময়না’ নিয়ে আলোচনায় যে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেন, তাতে তারেক মাসুদ আশান্বিত হোন। এই উৎসবের কারণেই যুক্তরাজ্য জুড়ে ‘মাটির ময়না’ সম্পর্কে এক ধরনের ইতিবাচক গুঞ্জন তৈরি হয়। এরপর তারেক মাসুদ পৃথিবীর বৃহত্তম উৎসবগুলোর অন্যতম ‘মন্ট্রিয়ল বিশ্ব চলচ্চিত্র উৎসবে’ আমন্ত্রিত হয়ে যান।
‘ব্রেকফাস্ট টক’ নামে উৎসবে অংশগ্রহণকারী সব চলচ্চিত্র সাংবাদিকের সাথে প্রায় তিন ঘণ্টাব্যাপী উৎসবে এক দীর্ঘ আলোচনায় ‘মাটির ময়না’র পরিচালক হিসেবে শুধু তারেক মাসুদ সুযোগটি পেয়েছিলেন। ফরাসিভাষী অঞ্চল হওয়ায় ‘মাটির ময়না’ ফরাসি সাব টাইটেলসহ প্রদর্শিত হয়। সেখানে দুটো প্রদর্শনী হয় এবং দুটোই হাউজফুল। একটি প্রদর্শনী ছিল রোববার নয়টায়। মন্ট্রিয়ল ক্যাথলিক প্রধান শহর হওয়ায় তারেক মাসুদ ভাবলেন শোতে তেমন কোনো দর্শক আসবে না। কিন্তু তারেক মাসুদ বিস্মিত হয়ে দেখলেন যে সেই শোটিও হাউজফুল করেছে শহরের সিনেমাপাগল দর্শকরা।
এরপর তারেক মাসুদ পাম স্প্রিংস চলচ্চিত্র উৎসবে যোগ দেন। লস অ্যাঞ্জেলস থেকে দুই আড়াই ঘণ্টার পথ। এই উৎসবকে মূলত অস্কারের ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজ ফিল্ম বিভাগে মনোনয়নের জন্য নির্বাচিত ছবিগুলোর ড্রেস রিহার্সেল হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। অস্কারের জন্য সেবার রেকর্ডসংখ্যক ৫৪টি বিদেশি ভাষার ছবি এই বিভাগে মনোনয়নের জন্য প্রতিযোগিতা করে। এর আগে এর সংখ্যা ছিল ৩৫। ৫৪টির মধ্যে ৪০টি ছবি আমন্ত্রিত হয়। ‘মাটির ময়না’ বাংলাদেশ থেকে প্রথমবারের মতো নির্বাচিত ছবি হিসেবে সেখানে আমন্ত্রণ পায়।
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ছবিটি সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র পেয়ে তিন সপ্তাহ মধুমিতা হলে প্রদর্শিত হওয়া সত্ত্বেও সেই উৎসবে ছবিটি সেখানকার দূতাবাসের কোনো পৃষ্ঠপোষকতা বা কোনো সহযোগিতা পায়নি। সেখানে ‘মাটির ময়না’র মার্কিন প্রিমিয়ার হলো। প্রদর্শনীর পর তারেক মাসুদ অনেক আলোচনা-প্রশংসা পান। প্রদর্শনীর এক ঘণ্টা পরে তারেক মাসুদ অন্য সবার সাথে একটা শপিংমলে গেছেন। এক মধ্যবয়স্ক মহিলা তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললেন তিনি ‘মাটির ময়না’ ছবিটি দেখে এতটাই আবেগপ্রবণ হয়ে গিয়েছিলেন যে ছবি শেষ হওয়ামাত্র তিনি হল থেকে বেরিয়ে আসেন। তাই আলোচনা ও প্রশ্নোত্তর পর্বে তিনি থাকতে পারেননি। তিনি আরও বললেন, সত্য বলতে কি বাংলাদেশের মতো দেশে প্রচলিত মাদ্রাসা অথবা ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে আমি তেমন কিছু জানি না বলে খুবই লজ্জিত।’
আরেকজন ফরাসি তরুণ বলেন, ‘সুন্দর দেশ, সুন্দর মানুষ।’ তারেক মাসুদ এমন মন্তব্যে ভীষণ খুশি হন। কারণ ‘মাটির ময়না’র কারণে পুরো বাংলাদেশ প্রশংসিত হয়েছে। তারেক মাসুদ বিভিন্ন পত্রিকার সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘অনেক পুরস্কারের চেয়ে এই মন্তব্যটির মূল্য আমার কাছে কোনো অংশেই কম নয়।’ ‘মাটির ময়না’ অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডেলেড, সুইজারল্যান্ডের ফ্রিবুগ, স্পেনের সিটগেজসহ ইতালি ও কায়রো চলচ্চিত্র উৎসবে আমন্ত্রিত ও প্রদর্শিত হয়েছে। কিন্তু সময়ের অভাবে এবং কখনো অন্য উৎসবের সঙ্গে একই সময় পড়ে যাওয়ায় তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ সেগুলোতে যোগ দিতে পারেননি। এরপর ‘মাটির ময়না’ মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট ও লিংকন সেন্টারের যৌথ উদ্যোগে প্রদর্শিত হয়। ততদিনে ইরাক যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। যেদিন ‘মাটির ময়না’ প্রদর্শন করা হয় সেদিন মার্কিং ট্যাঙ্কের বহর বাগদাদে ঢুকছে। ২৩-২৫টি ছবি ছিল উৎসবে এবং ‘মাটির ময়না’ ছিল উৎসবের শেষ দিনে। ছবিটির টিকিট এক সপ্তাহ আগেই বিক্রি হয়ে যায়।
তাঁকে চিনতে না পারার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে বললেন, ‘আপনার ব্রুটালিটি অব স্টোন থেকে শুরু করে বিখ্যাত সব ছবি দেখেছি।
প্রবাসী বাঙালিরা ভেবেছিলেন, দু-একদিন আগে গেলেই টিকিট পাওয়া যাবে। সুতরাং তাদের প্রায় সবাই ছবিটি দেখা থেকে বঞ্চিত হোন। তারেক ও ক্যাথরিন মাসুদ প্রদর্শনীর কয়েক সপ্তাহ আগেই নিউইয়র্কে যান। নিউইয়র্কের যুদ্ধবিরোধী মানুষের প্রতিবাদ-বিক্ষোভ তারা দেখেন এবং অংশগ্রহণ করেন। এমন অবস্থায় তারেক মাসুদের মনে এক মিশ্র অনুভূতি কাজ করেছিল যে, এই উৎসবে তাদের অংশগ্রহণ করা ঠিক হবে কি না বা এটা তারা বয়কট করবে কি না। তবে তারেক মাসুদ প্রদর্শনী শুরুর আগে তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেবার সময় কিছু কথা বলেন যাতে তার অন্তর্দ্বন্দ্বের পীড়ন কিছুটা দূর হয়। তিনি বলেন, ‘আমি খুবই আনন্দিত যে আজ আমি আমার দ্বিতীয় শহর নিউইয়র্কে আপনাদের ছবিটি দেখাতে পারছি। আমি বিশেষভাবে আবেগাপ্লুত এবং খুশি এই কারণে যে, এই ছবিটির চিত্রনাট্যের প্রাথমিক ধারণাটি আমি ধারণ এবং বিশদ করতে পেরেছিলাম এই শহরের মিশ্র সংস্কৃতি ও মিশ্র ধর্মের জীবন প্রবাহের অনুপ্রেরণায়। এ জন্য আমি আমার পাঁচ বছরের নিউইয়র্ক জীবনের অভিজ্ঞতার কাছে আমি ঋণী। তাই এ শহরে ছবিটি দেখাতে পেরে আমি এক ধরনের পুলক ও সম্মান বোধ করছি। কিন্তু একই সঙ্গে এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক যে, এমন একটা সময় ছবিটি দেখাতে হচ্ছে, যখন অন্যায় যুদ্ধের কারণে ঠিক এই মুহূর্তে মারা যাচ্ছে হাজার হাজার নিরীহ মানুষ যে যুদ্ধ পশ্চিম ও মুসলিম বিশ্বের মধ্যে আরও দূরত্ব ও দেয়াল তৈরি করছে। এমন অন্যায় যুদ্ধের সময় ছবিটি দেখাতে হচ্ছে, এটা দুর্ভাগ্যজনক এবং আমি এই অন্যায় যুদ্ধের প্রতিবাদ জানাচ্ছি।’
এই উৎসবে ‘মাটির ময়না’র অভিনেত্রী রোকেয়া প্রাচী এসেছিলেন। সস্ত্রীক এসেছিলেন মুক্তির গান-এর মূল চিত্রগ্রাহক লিয়ার লেভিন। অনেক গুরুত্বপূর্ণ মানুষ এ প্রদর্শনীতে ছবিটি দেখেছিলেন, তাঁদের মধ্যে বিখ্যাত লেখক অমিতাভ ঘোষ প্রশংসাসূচক একটি ইমেইল পাঠিয়েছিলেন। ২০০৪ সালে পুরো যুক্তরাষ্ট্র ও ইংরেজি ভাষাভাষী কানাডায় ‘মাটির ময়না’ বাণিজ্যিকভাবে প্রদর্শিত হয়।
মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট উৎসবের প্রায় সমসাময়িক আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসবে যাওয়ার অভিজ্ঞতা হয় তারেক মাসুদের। সেটা হলে টরেন্টো আন্তর্জাতিক উৎসবের স্পেশাল শো-কেস। এই উৎসবে বছরের সবচেয়ে আলোচিত তিনটি ছবি বেছে নেওয়া হয় এবং দু-তিন মাসের মধ্যে আলাদাভাবে এদের প্রদর্শনী হয়। ‘মাটির ময়না’র সাথে অন্য দুটি ছবি ছিল কান ও অস্কার পুরস্কার পাওয়া রোমান পোলানস্কির ছবি ‘পিয়ানিস্ট’ এবং জ্যাক নিকলসনের ছবি ‘অ্যাবাউট স্মিট’। এটি ‘মাটির ময়না’র জন্য একটি বিরল সম্মান। তারেক মাসুদ ‘মাটির ময়না’ নিয়ে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব ‘মিউনিখ চলচ্চিত্র উৎসব’-এ যোগ দেন। প্রতিযোগিতামূলক এই উৎসবে ‘মাটির ময়না’ প্রশংসিত হয়। এবং তারেক মাসুদের জীবনে অত্যন্ত সৌভাগ্যজনক কিছু অভিজ্ঞতা হয়। আলেকজান্ডার ক্লুগে যেসব আদর্শ চলচ্চিত্র নির্মাতার ছবি দেখে এবং তাদের সম্পর্কে পড়ালেখা করে বড়ো হয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম একজন।
এই আলেকজান্ডার ক্লুগো তারেক মাসুদের টেলিভিশন সাক্ষাৎকার নেন। তবে মজার বিষয় হলো, সাক্ষাৎকার শেষ হওয়ার আধঘণ্টা পর তারেক মাসুদ তার পরিচয় জানতে পারেন। তারেক মাসুদ এই সাক্ষাৎকার এড়িয়ে রাইনার হাউফ ও আদুর গোপকৃ ষ্ণাণের সঙ্গে তাদের নৈশভোজের ব্যাপারে বেশি উৎসাহী ছিলেন। দীর্ঘ এক ঘণ্টা পর সাক্ষাৎকার শেষে তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে তারেক মাসুদ যখন রেস্টুরেন্টে পৌঁছালেন তখন তারা জানতে চাইলেন, কার সঙ্গে তারেক মাসুদ সাক্ষাৎকার বাদ দিতে চাইছিলেন। তারেক মাসুদ বললেন তিনি জানেন না। যখন তারা আলেকজান্ডার ক্লুগোর নাম বললেন তারেক মাসুদ তখন দ্রুত খাবার শেষ করেই দৌড়ে স্টুডিওতে গেলেন। তাঁকে চিনতে না পারার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে বললেন, ‘আপনার ব্রুটালিটি অব স্টোন থেকে শুরু করে বিখ্যাত সব ছবি দেখেছি। সেগুলো থেকে কত শিখেছি, আর তিনিই আমার সাক্ষাৎকার নেবেন, এটা আমার কাছে ছিল অপ্রত্যাশিত।’এছাড়া এই উৎসবে বিখ্যাত ইরানি নির্মাতা মামিরা মাখমলবাফের সঙ্গে তারেক মাসুদের পরিচয় এবং ঘনিষ্ঠতা হয়।