কবি তপন বাগচীর পঞ্চাশতম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ করে বেশ কিছু গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে; তার শুভানুধ্যায়ীরা সেখানে লিখেছেন। আমি লিখতে চেয়েও নানা কারণে লিখতে পারিনি। এমন না যে তার সঙ্গে আমার সখ্য কম বা অল্পদিনের পরিচয়। খুব পরিচিত কবি গবেষক তপন বাগচী আমার খুব কাছের মানুষ, বয়সে কয়েক বছরের বড়। যদিও আমি তাকে দাদা ডাকি, তবু সম্পর্কটা বন্ধুর, নিবিড় বন্ধুত্বের। কাজেই দাদা মানে বন্ধু ধরেই ছোট এই লেখাটা শুরু করছি।
ড. বাগচী বিচিত্র কাজের মানুষ। হাজারো কাজ করেন, আর বেশিরভাগই অন্য মানুষের জন্য। তিনি কারও অনুরোধ কখনো প্রত্যাখ্যান করেছেন বলে মনে হয় না। কবি আসাদ চৌধুরীর লেখার বরাদ দিয়ে বলা যায়, নিজের পরিবারের লোকজনের কথা সব সময় রাখেন কি না বলতে পারি না। তারা সার্টিফিকেট দিলে সেটা আসল হবে। সত্যি কথা হলো তার সঙ্গে বন্ধুত্ব হতে সময় লাগে না। যেকোনো ধরনের মানুষ, যেকোনো বয়সের, ধর্মের জাতের বা গোত্রের সবার সঙ্গে তিনি জলের মতো মিশে যান। মিশে যান কোনো দূরত্ব না রেখে, কোনো ফাঁকিতে তিনি বিশ্বাস করেন না। সত্যিকারের কবি ও আড্ডাবাজ বলে কাউকে ফেরান না। সারা দিন অফিস করার পর আমরা একবার সন্ধ্যা সাতটার পর তাকে শিল্পকলায় নাটক দেখতে যাওয়ার প্রস্তাব দিলাম। তিনি সহাস্যে বললেন, অবশ্যই। মুখে সেই চিরপরিচিত হালকা হাসি। এই হাসিই তার অমূল্য সম্পদ সন্দেহ নেই। বাংলাদেশ ও ভারতে কত লোক (নারীও যোগ করতে হবে) যে এই মৃদু হাসির ফাঁদে পড়েছে, তা গোনাগাঁথা করা সম্ভব নয়।
তপনদা মানে আমাদের কবি, ছড়াকার, গীতিকার, কথাকার তপন বাগচীকে আমি নানা সূত্রে চিনি। কবে প্রথম পরিচয়, সে ইতিহাস ইতিহাসকারেরা খুঁজে দেখতে পারেন, আমার তাতে খুব আগ্রহ নেই। মনে হয় আমার বোধ বুদ্ধি হওয়া থেকে তপনদাকে চিনি। আমি থাকি রাজশাহীতে তিনি থাকেন ঢাকায়, তবে প্রায়শ দেখা হয়। আর যন্ত্রের কল্যাণে কথা হয় হরদম। আজ পর্যন্ত আমার কোনো অনুরোধ তিনি উপেক্ষা করছেন বলে মনে পড়ে না। তবে আমি তার অনেক অনুরোধ রাখতে পারিনি। সেটার দু’একটা না হয় পরে বলা যাবে।
তার সঙ্গে অনেক কথা হয়; অনেক ভ্রমণ হয় আর মাখামাখি বাড়ে। সামান্য হাসিমুখে তিনি অবিরাম তার বাগ্মিতা চালিয়ে যান। তিনি একটা উপন্যাস লিখেছিলেন, পুরস্কারও পেয়েছিলেন (জেমকন তরুণ লেখক পুরস্কার)। তবে সেটা বই হিসেবে ছাপেননি (এরজন্য আরেক বন্ধু হামীম কামরুল হক তার কাছে রীতিমতো লিখিত অভিযোগ করেছেন)। কেন ছাপেননি, তিনি জানেন আর তার ঈশ্বর জানেন। আমার ধারণা তার মুখে যেভাবে কথা অবিরাম বকযন্ত্রের মতো বের হয়, তাতে তিনি আরও গল্প বা নভেল লিখতে পারতেন। তবে তিনি প্রগলভ হলেও কলম সায় দেয় কি না, বলতে পারবো না। তবে আশা করি, মানে বন্ধুরা এখনো ছাড়িনি। কেউ কেউ তার বিরুদ্ধে বেশ জোর গলায় অভিযোগ করেন যে সব কাজ তিনি খুব মনোযোগ দিয়ে করেন না। একটা মানুষ হাজার গণ্ডা কাজ করলে, সবার কথা রাখতে চাইলে নিজের কাজে মন দেবেন কখন? তার বর্তমান দপ্তরে গেলে বোঝা যাবে, তিনি কত মানুষের সঙ্গে সব সময় থাকেন। একা থাকতে আমি তাকে কখনো দেখিনি। শুধু মাত্র ওপরওয়ালা ডাক দিলে সেখানে ছুটে যান, সেটা তো চাকরির শর্ত-ডাকা মাত্রই যাইতে হইবে।
এই ধারণা যারা করেন তারা বোকার স্বর্গে বাস করেন। অন্তত ভালো গান লেখা খুব সহজ কাজ নয়। গান লেখা কারও স্বভাবের মধ্যে হয়তো থাকে তবু তা কঠিন। আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই আমি এমনটা মনে করি।
দু-একটা স্মৃতির কথা বলতে পারি। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় আসেন। যেকোনো সেমিনার বা অনুষ্ঠান হলে আমরা তাকে ডাক দেই, তিনিও দৌড়ে আসেন। আবার ‘নিরিখ’ পত্রিকার লেখা জোগাড় করে দেওয়াও তার নিয়মিত কাজ, নিরিখের সম্মেলনেও আসেন। একবার জয়পুরে তিনি আমার সঙ্গে গেলেন সার্ক রাইটার্স কনফারেন্সে। অনুষ্ঠানে থাকার সময় তিনি আমাকে বার বার বলছেন, দাদা, কলকাতায় গিয়ে এক বাসায় যেতে হবে, একটা দাওয়াত আছে। না গেলে হবে না। বাংলাদেশ থেকেই কথা দিয়েছি, ইত্যাদি ইত্যাদি। সোজা কথায় যাওয়া ফরজে আইন। আমি বারবার বলি, আমি কখনো কারও বাড়ি যাই না। আমারও অনেক বন্ধু আছে, তবু যাই না। কেন যাই না, সে গল্প বা কারণ তাকে অল্পবিস্তার বললাম। আমরা খানিকটা বুনো মানুষ বাসায় গিয়ে ঠিক শান্তি পাই না, রাস্তায় রাস্তায় আমাদের জমে ভালো। তিনি বললেন, ধুর, বাদ দেন তো। চলেন। গেলাম, তার দাদার বাসায়। দমদম এয়ারপোর্টের মোটামুটি কাছেই বাসা। প্রায় চারটা পর্যন্ত সেই বাসায় ছিলাম। দুপুরে খেলাম। তার আগে তিনি আমাদের সঙ্গে নিয়ে বাজার সওদা করলেন। কলকাতার আতিথেয়তার তুলনা হয় না। বিশাল বিস্তারিত আয়োজন, দাদার কথা আরও বিস্তারিত।
অসাধারণ সাধাসিধে মানুষ তিনি। ভুড়িটা বাড়ন্তের দিকে বলেই হয়তো বা পাজামা পাঞ্জাবি পরেন সব সময়। কাঁধে একটা ঝোলানো কবি ব্যাগ (প্রায়শ বাংলা একাডেমির বার্ষিক সাধারণ সভায় পাওয়া)। তো এই সাধারণ জীবনযাপনের মধ্যে তার অসাধারণ জীবনবোধ লক্ষ করা যায়। তিনি মানুষকে উপকার করেন অকাতরে। হয়তো জীবন থেকে শিক্ষা নিয়েছেন; জীবনে তো কম কষ্ট পাননি। আজকের তপনদাকে দেখে হয়তো খুব ভালো আছেন মনে হয় যে, তিনি বাংলা একাডেমিতে চাকরি করছেন। কিন্তু বেশিরভাগ সময় তিনি অনিশ্চিত জীবনযাপন করেছেন। তবে ভরসা ছিলেন বৌদি। বৌদি সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করেন। দাদার খুব ইচ্ছে ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করবেন। হয়তো সেই কারণেই সাংবাদিকতার ক্ষতি করে গবেষণা কাজে যুক্ত হয়েছিলেন। পিএইচডি গবেষণার বাইরেও তার অনেক ভালো গবেষণা রয়েছে। তার গবেষণাকর্মের পরিধি ও মান তাকে বিশিষ্ট করেছে। নানা মাধ্যমে কাজ করলেও তার গবেষণার হাত পাকা ছিল। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদনও করেছিলেন। আমরা তাকে সহযোগিতা করতে পারিনি কোনোভাবেই। এদেশে চাকরি এখন কিভাবে হয়, সেটা অনেকেই জানেন।
তার হয়তো কোনো জায়গায় একটু খামতি ছিল, তবে তার চেয়ে কম ফলের অনেকেই তো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। আমি নিজেকে পরাজিত মনে করি এই কারণে যে, আমি তার জন্য তেমন কিছু করতে পারিনি।
ইদানীং তার সঙ্গে কথা হলেই গানের কথা আসে। আমাকে তার সম্প্রতি লেখা ও প্রচারিত গানের কপি বা লিঙ্ক পাঠান। আমি শুনি। আমি লক্ষ না করে পারি না যে, তিনি অসম্ভব সফলভাবে আঞ্চলিক ভাষায় লোকগান লিখছেন। প্রচুর পরিমাণে লিখছেন। গান তিনি আগেও লিখতেন। ইদানীং বেশি লিখছেন। কেউ কেউ হয়তো এনিয়ে খুব সন্তুষ্ট নন তার প্রতি। তবে আমি খুব খুশি আমার বন্ধুর কাজে। কারণ একজন সৃজনশীল মানুষ যেখানে আনন্দ পাবেন, যেখানে শতভাগ দিতে পারবেন, সেখানেই নিজেকে ব্যাপৃত রাখবেন, সেটাই স্বাভাবিক। আর বাংলাগানের সমৃদ্ধ ধারাকে বিকশিত করতে তার মতো কবি এগিয়ে এসেছেন, এটা তো আনন্দের বিষয়। কেউ কেউ হয়তো মনে করছেন, অন্য শাখায় তিনি সফলতা না পেয়ে গান লেখা শুরু করেছেন। আমার ধারণা অনেকে মনে করেন গান লেখা সহজ কাজ। এই ধারণা যারা করেন তারা বোকার স্বর্গে বাস করেন। অন্তত ভালো গান লেখা খুব সহজ কাজ নয়। গান লেখা কারও স্বভাবের মধ্যে হয়তো থাকে তবু তা কঠিন। আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই আমি এমনটা মনে করি। ছন্দে শুধু টনটনে জ্ঞান থাকলে গান লেখা যায় না; গানের অতটুকু শরীরের গভীর আবেগ বা বিষয় ব্যাপ্ত করে দেওয়া কঠিন। যাহোক, তপনদা ছন্দ বিষয়ে খুব প্রাজ্ঞ বলা যায়। তার কবিতায়ও সে নজির রয়েছে। গানে তিনি সফলতা পেয়েছেন এটা আমাদের শ্লাঘার বিষয়।
কোনো সন্দেহ নেই বাংলাদেশের মতো ছোট দেশে তপন বাগচী বেশ পরিচিত নাম; সাহিত্য মহলে, অ্যাকাডেমিক জগতে তার একটা পোক্ত অবস্থান রয়েছে।
তপনদা সহজ সরল মানুষ হলেও তার জীবনকে সবাই সহজ হতে দেননি সব সময়। আমরা অনেক ঘটনা জানি; দু’একটা উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি। কারও আঁতে যদি ঘা লাগে তার জন্য অগ্রিম ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। একদিন দাদাকে টেলিফোন করেছি একটা বিষয়ে; তিনি বললেন, আমি তো ঢাকায় নেই। তিনি আছেন মীর মশাররফ হোসেন স্মৃতি কেন্দ্রে। তাকে দেওয়া হয়েছে শাস্তিমূলক বদলি। তিনি হাসতে হাসতে বললেন, খুব মজায় আছি, কোনো কাজ কাম নেই, এসি রুমে থাকি। খাই দাই, ঘুমাই। কারও সঙ্গে দেখা হয় না। আপনি চলে আসুন ট্রেন ধরে (কুমারখালী)। আমি সত্যি যাবো যাবো করছি। একদিন শুনি তাকে ঢাকায় আবার পুনর্বহাল করা হয়েছে।
প্রয়াত কবি, সব্যবাচী লেখক সৈয়দ হক তাকে একটি বিষয় নিয়ে বহুবার বহু জায়গায় হেনস্তা করেছেন। কোনো অনুষ্ঠানে দেখা হলেই তিনি বলতেন, ‘তপন, ওপার থেকে কবে এলে?’ অর্থাৎ দাদা ওপারের মানুষ এখানে কবে বেড়াতে এসেছেন। তিনি প্রথমত রাগেননি। পরে সহ্য করতে না পেরে হক ভাইকে পাল্টা রূঢ় কথা বলে থামিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।
আমি কবি তপন বাগচী, বন্ধু তপন বাগচী, অগ্রজ তপন বাগচীকে খুব পছন্দ করি। তিনি কত বড় লেখক, সে বিচার করার ক্ষমতা আমার নেই, বা সে আলোচনা আমি এখানে করতে চাই না। সমালোচকেরা সেটা করতে পারেন। তিনি কবি, সেটা তার বড় পরিচয়। এটা তার গর্বের পরিচয়। ‘কবিরা ব্রাহ্মণ হয়’ নামে একটি কবিতায় তিনি লিখেছেন: ‘কবিরা ব্রাহ্মণ হয় এই কথা লেখা আছে মনুসংহিতায়/ তুমি তাকে অস্বীকার করো কোন নিরঙ্কুশ ক্ষমতার জোরে/ যেহেতু তুমিও কবি, তাই তুমি নিজে নিজে সেজেছ ব্রাহ্মণ/ তোমাকে প্রণতি আজ এই পোড়া কার্তিকের বৃহস্পতি-ভোরে।’ কবিতাটি কবি সুবোধ সরকারকে উৎসর্গ করে লেখা হলেও কবি হয়তো শ্লেষের মধ্য দিয়ে নিজেকে খানিকটা উপস্থাপন করেছেন। মনুসংহিতার কথাটির নতুন ব্যাখ্যা নিয়ে তিনি বলেছে যে ব্রাহ্মণরাই কবিতা লিখবে যদি এমন হয়, যিনি কবিতা লেখেন তিনিই তো ব্রাহ্মণ।
আমি মানুষ হিসেবে তাকে সব সময় অসাধারণ মনে করি। কখনোই যে তার সঙ্গে আমার তর্ক হয়নি, তা বলব না। সেটাও জীবন বা চরিত্রের ধর্ম। তবে তা ধর্তব্য নয়। তিনি মানুষকে যেভাবে গুরুত্ব দেন, মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসেন তা খুব কম মানুষই করেন। কোনো সন্দেহ নেই বাংলাদেশের মতো ছোট দেশে তপন বাগচী বেশ পরিচিত নাম; সাহিত্য মহলে, অ্যাকাডেমিক জগতে তার একটা পোক্ত অবস্থান রয়েছে। তিনি যা সৃষ্টি করেছেন তার পরিমাণ অনেক হলেও যথেষ্ট নয়। আরও অনেক শক্তিমান কাজ করার ক্ষমতা তার রয়েছে। বয়স তার হয়েছে, তাকে পরিণতই বলা যায়। কিছু নির্বাচিত কাজ বোধ হয় এখন তার করা প্রয়োজন।
খুব ভালোভাবে, আনন্দের সঙ্গে তপনদা আরও দীর্ঘদিন লেখার জগতে থাকবেন, সেরকম আশা করি।
আরও পড়ুন: তিনটি গীতিকবিতা ॥ তপন বাগচী