কিছু মানুষ আপন গুণেই শ্রদ্ধাশীল হয়ে ওঠেন, অন্তরের মানুষ হয়ে ওঠেন, আপনজন হয়ে ওঠেন। এ জন্য বাড়তি কোন যোগ্যতা বা বাড়তি কোন অহংবোধের প্রয়োজন পড়ে না। মাটির মানুষ বলতে আমরা যা বুঝে থাকি—সহজ সরল কৃত্রিমতাহীন নিরাহংকার—এসবের সমন্বয়ে গড়ে ওঠেন এসব মানুষ। প্রথম দেখাতেই বা প্রথম পরিচয়েই প্রাণের ভেতর একটা আপনগন্ধ সুবাসিত হয়ে ওঠে—যা চিরকালের হয়ে হৃদয়ে প্রণম্যবসতি স্থাপন করে।
আমার কাছে তপন দা—বহুমাত্রিক লেখক তপন বাগচী—এরকমই এক মাটির মানুষ—মনখোলা মানুষ। কতো বছর আগে তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা বা পরিচয় হিসাব করে বললে দেড় যুগের বেশি। আমার শিক্ষক প্রখ্যাত গবেষক আবুল আহসান চৌধুরী বিশেষ একটা প্রয়োজনে তপন বাগচীর কাছে আমাকে পাঠিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে এর আগে আমার দেখা বা কোন পরিচয় ঘটেনি। নামটির সঙ্গে অনেক আগে থেকেই পরিচয় ছিল। তাঁর লেখালেখি সম্পর্কেও আমার জানাশোনা ছিল। তখন তিনি পিআইবির অফিসে চাকরি করতেন। ফোন করে এক দুপুরে তাঁর অফিসে গিয়ে হাজির হই। কী যে আন্তরিকতার সুবাস ঢেলে বললেন, রকিব, বসো। কেমন আছ? তোমার অর্থবিত্ত পত্রিকা কেমন চলছে? এখন কি লিখছো? কতো কিছু জিজ্ঞেস করলেন। জানতে চাইলেন।
কথা বলতে বলতেই বললেন, চলো, ক্যান্টিনে বসি। কিছু তো খেতে হবে। আমি আপত্তি করলাম না। আমি মুগ্ধ হয়ে তাঁর স্নেহ আদর আন্তরিকতা অনুভব করছি। প্রথম দেখাতেই একজন মানুষ এতো আপন হয়ে কথা বলতে পারেন! এতো আপন করে গ্রহণ করতে পারেন! কোন কৃত্রিমতা নেই—কোন অহংবোধ নেই—নিজের লেখালেখি নিয়েও কোন কথা নেই। পুরো দুপুর পেরিয়ে বিকাল ছুঁই ছুঁই। সাহস করে বললাম, ‘দাদা, আমার ‘পথের কথা’ বইয়ের প্রকাশনা উৎসব হবে। জাতীয় প্রেস ক্লাবে। সে উপলক্ষে আপনি যদি বইটি নিয়ে দু লাইন লিখে দিতেন।’ অবাক হওয়ার মতো ঘটনা—মুহূর্তকাল কোন চিন্তা না করে—কোন কিছু না ভেবে বললেন, ‘বইটা সাথে আনছো?’ বললাম, না।
আগামীকাল সকালে কাউকে দিয়ে বইটা পাঠিয়ে দিও। দুদিন পরেই লেখাটা পেয়ে যাবে। বলেই আবুল আহসান চৌধুরী স্যারের পঞ্চাশ বছর পূর্তি সংবর্ধনাগ্রন্থ ‘সুবর্ণরেখার আলপনা’ আমাকে দিলেন। এই বইটির জন্য আমি মূলত গিয়েছিলাম। বইটি হাতে নিয়ে মন ভরে গেলো। সুবৃহৎ একটি গ্রন্থ। স্যারের সাহিত্যকর্ম বহুমাত্রিকতায় মূল্যায়িত হয়েছে। বইটি নিয়ে ফেরার পথে ভাবছি, দাদা, আদৌ আমার বই নিয়ে লিখবেন তো! নাকি কথার কথা বললেন! একরকম দ্বিধা থেকেই গেলো। পরের দিন আমার অফিসের একটা ছেলেকে দিয়ে বইটি পাঠিয়ে দিই। তার দুদিন পরে তপন দা আমাকে ফোন করে বললেন, ‘রকিব, তোমার ছেলেটাকে পাঠিয়ে দাও। লেখা হয়ে গেছে।’
আমি সত্যি বিস্মিত হয়েছিলাম। এর পর দীর্ঘ সময় তাঁর সাথে পথ চলছি—বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা হয়—বিভিন্ন বিষয়ে কথা হয়—আলোচনা হয়—সত্যিকারের একজন আদর্শিক বড় ভাই। বাংলা একাডেমিতে তাঁর রুমে গেলে শত ব্যস্ততার ভেতরেই জোর করে বসিয়ে রাখবেন—এটা ওটা খাওয়াবেন। লেখালেখির খোঁজ নেবেন। কি পড়ছি—কেমন লাগছে—বিশ্ববিদ্যালয় কেমন চলছে—খুঁটে খুঁটে সব জানতে চাইবেন। ব্যস্ততার অজুহাত নেই—গম্ভীর ভাব নেই—এড়িয়ে যাবার অপকৌশল নেই। তাঁর কাছে গেলেই অফুরন্ত স্নিগ্ধ প্রশান্তিতে মন ভরে ওঠে—লোহা-লক্কড়ের প্রাণহীন স্বার্থ-অন্ধ নগরীতে এমন সাদাসিধে মাটির মানুষ বিরল এক ব্যাপার।
আমি যখন বিষয়টি জানালাম, তিনি প্রাণখোলা একটা হাসি দিয়ে বললেন, এটা কোন কথা হলো! তোমার ওয়েবিনারে তুমি শুধু দর্শক হিসেবে থাকতে বললেও আমি থাকবো।
স্নেহের অধিকারে মাঝেমধ্যে আমি অত্যাচারও করি। তিনি নীরবে হাসিমুখে সে-অত্যাচার গ্রাহ্য করেন। আমি যখন সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান ছিলাম, সে-সময় একবার কবিতাপাঠের অনুষ্ঠান করি। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে। সেই অনুষ্ঠানে বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনেত্রী কবরী প্রধান অতিথি ছিলেন। অনুষ্ঠানে কবিতাপাঠের জন্য কবি খালেদ হোসাইন, বিলু কবীর, মাহুমুদ হাফিজ, তপন বাগচী, শাহানারা ঝর্না, আকিল চৌধুরী (করোনায় মৃত্যুবরণ করেছেন ২০২০ সালে), হামিদ কায়সার, ওবায়েদ আকাশ, জুনান নাশিত, নাসরিন মুন্নী, তুষার কবিরসহ অনেক কবিকে আমন্ত্রণ জানাই। সবার স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি আর কবিতাপাঠে পুরো দিন কাব্যিকময় হয়ে উঠেছিল। এ অনুষ্ঠানে বিভিন্ন রকমের পিঠার আয়োজন ছিল।
তপন দা’র মিষ্টি খাবারে সমস্যা আছে আমি জানতাম না। দাদা আমাকে কিছুই বুঝতে না দিয়ে সারাটা দিন না খেয়ে ছিলেন। এখানে একটু বলি, সেদিন কবরী আপা প্রায় সারাদিন ছিলেন। কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে আনন্দময় সময় কাটিয়েছিলেন। সবার আগ্রহকে সম্মান জানিয়ে, সবার সঙ্গে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ছবি তুলেছিলেন। করোনায় কবরী আপার আকস্মিক মৃত্যুর পরে অধিকাংশ তরুণ কবির সঙ্গে কবরী আপার যে ছবিগুলো ফেসবুকে ভেসে বেড়াচ্ছে, তা এই অনুষ্ঠানের ছবি।
তপন দা বাসায় ফিরে রাতে আমাকে ফোন করে বললেন, তোমাদের অনুষ্ঠান ভালো হয়েছে। আমি তো অনেক কাজ ফেলে শুধু তোমার জন্য গিয়েছিলাম। আর তোমরা তো শুধু মিষ্টি জাতীয় খাবারের অয়োজন করেছিলে। আমি তো না খেয়েই দিন পার করে এলাম। আমার তো মিষ্টি খাবার খাওয়া নিষেধ। আমার আর কোনো কথা থাকে না। খুব খারাপ লাগছিল। বললাম, দাদা, আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত।
-আরে না। অনুষ্ঠানে এসব হয়ই। অনুষ্ঠানটা ভালো করেছ, এটাই বড় কথা। তুমি ছোট ভাই—ডাকলে তো আমাকে যেতেই হয়।
এ সময়ে এ রকম বিনয় ও উদারতার বড় দৃষ্টান্ত হতে পারেন তিনি।
করোনার কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা প্রদানের ধরন পরিবর্তন হয়ে গেছে। আমি নর্দার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি ও গবেষণা অনুষদের ডিন এবং বাংলা বিভাগের প্রধানের দায়িত্বে থাকায় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে আমাকে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকতে হয়। আগে যে পাঠদান শ্রেণিকক্ষে সম্পন্ন হতো, এখন হয় ভার্চুয়ালে। একইভাবে সেমিনারগুলোও বর্তমানে ভার্চুয়ালে অনুষ্ঠিত হয়। সেমিনারের নাম এখন ওয়েবিনার। বাংলা বিভাগ থেকে কয়েকটি ওয়েবিনার করার পর একদিন ‘করোনাকালে শিল্প-সাহিত্য চর্চা’ শিরোনামে ওয়েবিনারে তপন দা’কে আমন্ত্রণ জানালাম। ওয়েবিনারে সভাপতি উপাচার্য প্রফেসর ড. আনোয়ার হোসেন, প্রধান অতিথি শিল্পোদ্যোক্তা এএসএম কামালউদ্দিন, আলোচক কবি বিলু কবীর, প্রফেসর ড. শহীদ ইকবাল, ড. তপন বাগচী, ড. জ্যোৎস্না লিপি ও বাঁকুড়া থেকে ড. সত্যজিৎ দত্ত। এ কথাগুলো বলার একটা কারণ আছে।
আমি খুব ভয়ে ছিলাম দাদা শুধু আলোচক হিসেবে ওয়েবিনারে থাকতে সম্মত হবেন কি না! আমি যখন বিষয়টি জানালাম, তিনি প্রাণখোলা একটা হাসি দিয়ে বললেন, এটা কোন কথা হলো! তোমার ওয়েবিনারে তুমি শুধু দর্শক হিসেবে থাকতে বললেও আমি থাকবো।
কতটা আন্তরিক—কতটা স্নেহপ্রবণ-নিরাহঙ্কারী হলে এতটা বিনয়ী হওয়া যায়, এতোটা মহৎ হওয়া যায়, সবকিছুকে এতোটা স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে উপস্থিত থাকা যায়—এর উত্তর আমার জানা নেই। শুধু তাঁকে দেখি আর বিস্মিত হই—একই সঙ্গে তাঁর কাছ থেকে নীরবে শিখি—শেখার চেষ্টা করি।
তপন বাগচী কতবড় লেখক—কত বড় গবেষক—কত বড় গীতিকার—এসবের থেকে সাদাসিধে একজন মাটির মানুষ তপন বাগচী—যাকে আমি সবসময় সম্ভোধন করি ‘দাদা’; তিনি আমার কাছে অনেক বড়—অনেক শ্রদ্ধা ও সম্মানের—আমার চিরপ্রণম্য।
তপন দা বছর দুয়েক আগে গীতিকার হিসেবে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক ও ডেইলি স্টার প্রথম পুরস্কার পান। আমি এটা শুনেই সেই অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম আনন্দঘন সেই মুহূর্তটা নিজের চোখে ধরে রাখবো ভেবে। সেই অনুষ্ঠানে আরও যে দুজন পুরস্কার পেয়েছিলেন, রানা মাসুদ ও মোহসিন—তারাও আমার ঘনিষ্ঠজন। সেদিন সেই একই অনুষ্ঠানে চলচ্চিত্র অভিনেত্রী কবরীও আজীবন সম্মাননায় ভূষিত হন। তপন দাকে অভিনন্দন জানাতেই কী যে সুন্দর একটা হাসি দিয়ে বললেন, ‘আরে আমি পাওয়া আর তুমি পাওয়া তো একই কথা।’ সেদিন বলেছিলাম, দাদা, আমার উপলব্ধিও তাই—মনে হচ্ছে পুরস্কারটা আমিই পেয়েছি। দাদা তখন আদর করে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। সেই মধুর ও স্বর্গীয় স্পর্শ-সান্নিধ্যের এ-লেখার সময় অনুভব করছি।
শেষে আর একটা বিষয় বলেই লেখাটির সমাপন করবো। আমি বিপ্লবী বাঘা যতীন নিয়ে কাজ করি। এটা দীর্ঘদিন ধরেই করছি—বাঘা যতীনকে নিয়ে লেখালেখি এবং তাঁর জন্মভিটায় বাঘা যতীন কলেজ প্রতিষ্ঠা বিষয়ে আন্দোলন সংগ্রাম। বাঘা যতীনের বালেশ্বরের যুদ্ধে তাঁর চারজন সহযোগীর তিনজন ছিলেন মাদারীপুরের বীর-সন্তান—চিত্তপ্রিয় রায় চৌধুরী, নীরেন্দ্রনাথ দশ গুপ্ত ও মনোরঞ্জন। চিত্তপ্রিয় রায় চৌধুরী ১৯১৫ সালে বুড়িবালঅমের যুদ্ধে ৯ সেপ্টেম্বর ইংরেজবাহিনীর গুলিতে নিহত হন। নীরেন্দ্রনাথ গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত অবস্থায় ৯ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার হন। বুড়িবালামের যুদ্ধের মামলায় তাঁকে ১৯১৫ সালের ৩ ডিসেম্বর ফাঁসি দেয়া হয়। মনোরঞ্জন সেনগুপ্তকে ১৯১৫ সালের ৩ ডিসেম্বর ফাঁসি দেয়া হয়। এঁরা সবাই বাঘা যতীনের নেতৃত্বে যুদ্ধ করেছিলেন। বাঘা যতীনের আর একজন সহযোগী ছিলেন কুষ্টিয়ার জ্যোতিষচন্দ্র পাল।
তপন দাদা, একদিন হুট করে বললেন, মাদারীপুরে যাবা না কি? ওখানে তো বাঘা যতীন আর তাঁর তিন সহযোগীকে নিয়ে বড় অনুষ্ঠান হচ্ছে। তুমি কুষ্টিয়াতে বাঘা যতীনকে নিয়ে কাজ করছো, আমি মাদারীপুরে করছি। তুমি আর আমি তো একই সূত্রে বন্দি। কথাটার গভীরতা অনুভব করে সেদিন নীরবে আমার দুচোখ ভিজে উঠেছিল। চেতনা ও আদর্শের জায়গা তো আমাদের একই।
তপন বাগচী কতবড় লেখক—কত বড় গবেষক—কত বড় গীতিকার—এসবের থেকে সাদাসিধে একজন মাটির মানুষ তপন বাগচী—যাকে আমি সবসময় সম্ভোধন করি ‘দাদা’; তিনি আমার কাছে অনেক বড়—অনেক শ্রদ্ধা ও সম্মানের—আমার চিরপ্রণম্য।
শঙ্ঘ ঘোষের কবিতায় বাংলাদেশ ॥ তপন বাগচী