করোনা দিয়েছে বাধ্যতামূলক অবসর। ঘরবন্দি বিস্তৃত অবকাশ। জীবন থেকে ঝরে যাচ্ছে শত-শত সুন্দর পাওয়া-না পাওয়ার সেকেন্ড, মিনিট! এমন করে করে ঘণ্টা পেরিয়ে দিন-মাস। আবার মাস পেরিয়ে অর্ধবছরে পড়েছে আমাদের মহামারি করোনাযাপন। এই অবকাশে নয় কোনো সমুদ্র জলরাশির সঙ্গে মিতালি, নয় কোনো সুদূরে যাত্রা, কিংবা পরিবার পরিজন নিয়ে কয়েকটা দিন বনে-বাদাড়ে ঘোরা। ঘরের চৌহদ্দির মধ্যে সীমিত পরিসরে ছোট্ট মোবাইলফোনের আয়তক্ষেত্রের ডিসপ্লেতে আর কত অবসর কাটানো যায়?
জনসমুদ্রে চার হাত-পায়ে নীল তিমির মতো সাঁতার না কাটলে জীবনে কিসের ভাসি-ডুবি? আর কিসের সুখ-শান্তি? মানুষের মহামিলন বিছিন্ন করে এই আগাগোড়া অসামাজিক অসুখটি চরমভাবে শিশু, কিশোর-কিশোরী, যুবা ও বৃদ্ধা সবাইকে মানসিক পীড়নে ফেলেছে। যে পীড়নের চাপে সবাই নিজেকে জগতের সবচেয়ে বড় অসহায় প্রাণী ভাবতে শুরু করেছে। দুর্দমনীয় মানুষ আজ চুপসে গেছে। করোনা তাপে জীবন এখন আধপোড়া। প্রখর চৈত্রে যেমন চাষের জমি অর্ধপোড়া ইট হয়, এক ফোঁটা জলের কণার জন্য শতজনমের অপেক্ষা; তেমন করে সুস্থ ধরণীর অবারিত বাতাসে নাক ডুবিয়ে শ্বাস নেওয়া-না পাওয়া দিনগুলো কবে বিদায় নেবে?
আর কত না পাওয়া যুক্ত হলে সমীকরণের সাম্যাবস্থা আসবে; জানি না আমি, জানে না কেউ। শুধু এখন এটাই জানি, করোনা জলের নিচে জীবনের উতালি-পাতালি ঢেউ!
অসুখটি প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের একটি বৈরিতাকে জিইয়ে দিচ্ছে। প্রকৃতির বিশুদ্ধ অক্সিজেন নিতে জমের মতো বাধা হয়েছে করোনা। দীর্ঘদিন ঘরে আবদ্ধ থেকে সবাই একেবারেই যারপরনাই হাঁপিয়ে উঠেছে। কেউ কেউ হয়তো সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছে, জীবনকে ভিন্ন আঙ্গিকে রাঙিয়ে তুলবে; কেউ হয়তো ভাবছে, আগে নিজের ফেলে আসা নিখাদ ভালোবাসার সম্পর্কগুলোতে আবার একবার নতুন করে ডুব দেবে; আরেকজন ভাবছে, জীবনের অর্থ খুব তুচ্ছ। মানুষ হিসেবে আত্মপরিচয়কে সব সময় মনে রাখা জরুরি। অনেকে হয়তো সোনালি শৈশবের মৌ মৌ কড়া স্মৃতিকে আরেকবার এপিঠ-ওপিঠ করে বারবার ওল্টাচ্ছে।
এই মহামারির অবকাশ আসলেই একটি যোগসাধনা। যে সাধনায় বর্তমানের জীবন সংকটের সঙ্গে বারবার চলে আসছে অতীতের সুখস্মৃতি আর হারিয়ে যাওয়া আখরগুলো। মন কখনো উচুঁতেও উঠতে চায় আবার নিচুঁতে নেমে সুখ-দুঃখের সমীকরণ মেলায়। কখনো মেলে কখনো বা আবার নতুন সূত্রে নতুন বিকীরণ ঘটে। এই নতুনে কেউ যুক্ত হয় আবার কেউ হারিয়ে যায় নিঃশব্দে। যুক্ত হওয়া আর বিযুক্ত হওয়ার নামই জীবন। জীবন থেকে বিযুক্ত হয়েই যাচ্ছে মাসের পর মাস। আর কত না পাওয়া যুক্ত হলে সমীকরণের সাম্যাবস্থা আসবে; জানি না আমি, জানে না কেউ। শুধু এখন এটাই জানি, করোনা জলের নিচে জীবনের উতালি-পাতালি ঢেউ!