এই যে দাশ বাবু, ওদিকে যাবেন না। দিনে-রাতে কত ট্রাম আসে যায়। উপরন্তু আপনি যাচ্ছেন ডাব হাতে! ঘটনা ঘটতে কতক্ষণ। ঘটাই হলো ঘটনার কাজ। ঘটেও ছিল তাই। কথা হলো—যে পথিক, যে পাঠক, যে ভক্ত এই সুরে সতর্ক করেছিলেন তার তো নাম-ধাম, ঠিকানা কিছুই জানি না আমরা। প্রশ্ন জাগে— তিনি কী ‘দাশ’ নাকি ‘দাস’ উচ্চারণে সতর্ক এই সাবধানবাণী ছুড়েছিলেন সেদিন কবির পানে? কেউ কথা রাখেনি’র মতো হয়তো কেউ মনেও রাখেনি তাকে।
ছোট্ট, খর্বাকায়, লাজুক আর ভীষণ অন্তর্মুখী এই মানুষটির কী ব্যক্তিজীবন কী কবিজীবন সবটাই নানান ঘাত-চড়াই-উৎরাই প্যাঁচ আর প্রশ্নে জর্জরিত। মা কুসুমকুমারী নিজের কবিতায় ‘দাস’-ই লিখতেন। বলি—চমকের শেষ কি এখানেই! আছে। আরও আছে। বাংলা ১৩৩৭ সনে কবি বিয়ে করেন লাবণ্য দেবীকে। লাবণ্যরচিত এক প্রবন্ধে তিনি স্পষ্ট বলছেন—এই যে মা এসো আলাপ করিয়ে দেই। এর নাম জীবনানন্দ দাশগুপ্ত। বুঝুন ঠ্যালা! আবেগের রসে টইটম্বুর এই কবি বোধকরি তিক্ত-বিরক্ত হয়েই তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরাপালক’ এ এসে চিরস্থায়ী করে লিখলেন—জীবনানন্দ দাশ।
সেই কবে—১৯৫৪ সালে দৈহিকভাবে চিরতরে হারিয়ে যাওয়া কবির ৫৫ বছরের জীবনপ্রণালির মধ্যে বেরিয়েছে মাত্র ৭টি কাব্য সংকলন। যা বাংলা সাহিত্যের ৭টি স্বর্ণখনি। কী সহজ কী সরল বাংলার যাপিত জীবনে প্রতিটি প্রাণের তরে এমন কাব্যভাষা মুহূর্তেই করে তোলে মোহাচ্ছন্ন। যে ভাষার নেশায় চুর হয়ে আজও আমরা হয়ে আছি নেশাগ্রস্ত। ১৯৫৪ থেকে ২০১৭ ধরা যাক ৬৩ বছর চলে গেলো। হায় কপাল! এ বাক্য লিখতে ভয় করে তবে কি একটুও আগায়নি বাংলা কবিতা। আলবৎ এগিয়েছে। যুগ আর যন্ত্রের সঙ্গে মন আর মননে পাল্লা দিয়ে অজস্র কবির কলমে জন্ম নিয়েছে লক্ষ লক্ষ কবিতা। নিচ্ছে প্রতিনিয়তই। তবু বলি—তারা যতই হীরকখণ্ড হোক না কেন, ঝিলিকে ঝলসে দিক অন্তর-বাহির। ভালো করে লক্ষ্য করুন, আমি, তুমি, আপনার কবিতায় আজো গোপনে গুপ্ত হয়ে কোথাও না কোথাও তিরতির করে কাঁপছে জীবনানন্দের বিস্ময়ধ্বনি।
জীবনানন্দকে নানান তকমার তালায় বন্দি, তথা আটকাতে চাই আমরা। বলি বটে ‘প্রেমের কবি’ ‘রূপসী বাংলার কবি’ কখনো ‘মহাপৃথিবীর কবি’। আসলে তিনি কি? বিভ্রান্তির চোরাগলির যেখানে শেষ সেখানেই শুরু কবির আলোকদীপ্ত পথচলা। বাংলার চিরসবুজ ঐতিহ্যকে নিবিড়ভাবে পরখ করে তিনি একের পর এক শব্দের দ্যোতনায় ফুটিয়ে তুলেছেন, গড়েছেন নতুন কবিতার বিশাল এক কাব্যকলোনি। যা এতটাই মাধুর্যমণ্ডিত যে, পাঠকমাত্রই তার চেতনাকে গ্রাস করতে বাধ্য। জীবনানন্দের কবিতা হলো তাই—ধরা যাক সবুজ কচুরিপানায় ভর্তি কোনো পুকুর। আপাত দৃষ্টিতে কোনো জাজমেন্টেই যার হিসাব মেলে না। ফলে ভয় হয়, যদি একবার পা পিছলে পড়ে যাই! নিচে তার কী আছে? কতটা গভীর? বোঝা বড় দায়! এই তল অতলের বিভ্রমে কেটে যায় সারাটা বেলা। চরম সভ্যতার মাঝেও টুপ করে ডুব দেয় গভীর এক অন্ধকার। নেমে আসে রাত। কখনো তা আশ্বিনের। কখনো হেমন্তের।
পঞ্চপাণ্ডবের ভাষাকে, রীতিকে এক ধাক্কায় চটকে দিয়ে কবিতার নতুন এক স্বরের উদ্ভব ঘটিয়েছিলেন এই কবি। জাস্ট প্রকৃতিকে কেন্দ্র করে কবিতার নতুন পথে সেইকালে—বলতে গেলে বিশাল এক ঝুঁকি নিয়ে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ট্রেন্ডআপ তাঁর নতুন অশ্ব নিয়ে। যে পথে হাঁটেনি আগে কেউ। জানে না তালগোল পাকানো অবুঝ সেই পথের অচেনা মতিগতি। জীবনানন্দ ঠিক-ই চিনেছেন। চিনিয়েছেন আমাদের। বলি আজো চেনাচ্ছেন। প্রেম ছিলো তাঁর অগাধ। প্রেম বিনে হয়না কবি। তাঁর মতে, তাঁর কবিতায় প্রেম হলো জীবনেরই নামান্তর। বলি রূপান্তরও নয়কি? কাব্যে তাঁর এতটাই ধ্রপদী গুণ—দিন যাবে নতুন নতুন আবেদন নিয়ে বাংলা সাহিত্যের সৎ সন্তানদের কাছে তিনি হবেন আরও প্রাসঙ্গিক। কালের প্রান্তে দাঁড়িয়ে মহাকালের ভবিষ্যৎকে চিনতে পারা চাট্টিখানি কথা নয়। দাশ বাবু পেরেছিলেন। তাঁর এই পারার মধ্যে লুকিয়ে আছে নির্ভেজাল প্রকৃতি, আছে অবাক করা নির্জনতা। কবিতার রন্ধ্রে রন্ধ্রে লুকিয়ে আছে তাঁর প্রেম, অচেনাকে চেনার, জানার বিচিত্র কৌতূহল। সদ্য জন্মানো শিশুর সারল্যে জগৎকে দেখেছেন, হয়েছেন মুগ্ধ। মায়া ছাড়া, মুগ্ধতা ছাড়া কাউকে আপন করা জটিল আর জম্পেস এক কাজ। সমাজ সময়ের গণ্ডিতে আবদ্ধ থেকেও বার বার তিনি কবিতায় খুঁজেছেন একাকিত্ব।
আকাশের মতো উদার তাঁর মহাভাষ্য। অন্ধকারে পেঁচা ডাকছে। সে কি লক্ষ্মী পেঁচা? না কি কবির হৃদয়! সব ব্যথার সঞ্চয়ে জমা পড়া প্রেম—তারা কাতরাতে কাতরাতে একবার ডাকছে বনলতাকে। ফের ডাকছে সুরঞ্জনাকে। কবির এই নারীরা হতে পারে শরীরী। ফের মন বলে অশরীরী। ভাবতেই অতর্কিতে সমস্ত শরীর ঢেকে যায় আবছায়ায়। তখন চারপাশে যা কিছু দেখি মনে হয়—এ যেন ভূতের ভাতৃভূমি। বাংলার আলাভোলা ঘাসে শিশিরের টুপ করে ঝরে পড়া—এ শুধু জীবনানন্দই জানে এ তাঁর কতটা নিসর্গভরসা। অক্ষরধামে এই যে হিজল, তমাল, চিলের চরিত্র নিয়ে এত যে টানাটানি—কবি মাত্রই আমরা জানি অক্ষরতুলির সব কাক, সব বক কবে কোথায় কিভাবে লুকিয়ে ছিল জীবনানন্দের অস্থিমজ্জায়। কেউ কি জানে? যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ। মরিবার নয় ধাতুচিহ্নে এইসব লিপিবদ্ধ করতে আমাদের বড়ো সাধ হয়। জানি, কবি মাত্রই আত্মবৃত্তে বিচরণ করতে ভালোবাসেন। জীবনানন্দও এর ব্যতিক্রমী ছিলেন না। তবে তাঁর মৃত্যু নিয়ে যে খটকা সেখানে তাঁকে উদাসীন বলা বোধ করি ভুল হবে। কেননা সতত জাগ্রত ছাড়া ফাঁকি দিয়ে জীবনানন্দের কবিতা লেখা অনেকটাই টাফ। যেমন বনভোজনের শেষে ভাতঘুম দিয়ে যে কবিতা রচিত হবে তার ভাগ্যে পুরস্কারের চেয়ে তিরস্কারের পাল্লাই যে ভারী হবে সে কথা সামান্য একটি ভাঁটফুলও জানে।
জীবনানন্দের কবিতায় একবার ঢুকতে পারলে দেখবেন, সেখানে লুকিয়ে আছে ধ্যান, সমগ্র বিষয়বস্তুজুড়েই ছড়িয়ে থাকে এক জাগতিক আত্মমগ্নতা। যেন এইমাত্র ঘুমিয়ে দিয়েছে মা চঞ্চল তার শিশুকে। মনে হবে হাজার বছরের পুরনো সেই ঘুমের ঘ্রাণে বিহ্বল পাঠক আপনিও ঘুমের অনুরণনে ঝরাপাতার মতো হয়ে যাবেন অচেনা কোনো ঝোপবাসী। সন্ধ্যামেঘের মতো বিবিধ সৃজনে আবৃত তাঁর কবিতা কখনো আলোয় অতিরঞ্জিত কখনো বা আলোছায়াময়। মনে হবে এই তো আমারই ভাতৃরক্তে নিমজ্জিত তার প্রতিটি চরণ ভেসে যাচ্ছে, উড়ে যাচ্ছে মেটো ইঁদুরকে সঙ্গী করে। মনে হবে পরশে পাগল করে দেই। ভয় হয়, যদি হুঙ্কার ছাড়ে! আর ঠিক তখনই জেগে ওঠে অবাঞ্ছিত অট্টহাসি। বলে—আমি বাঘ বটে, তবে সার্কাসসজ্জিত।
বাংলার রূপ, প্রকৃতিকে বিষয় করে তিনি কবিতার আউটলাইনকে এমন একটা পরিমিতির অবয়ব দিতে পেরেছিলেন যা সেকালে অনেক ইন্টেলেকচুয়ালের শুধু মাথা নয়, স্বয়ং মগজকেও কাঁপিয়ে তুলেছিলো। আগুনের কাজ যজ্ঞের। হতে পারে তা গৃহদাহের। তবুও জলন্ত রূপেরও থাকে এক নিজস্ব মহিমা। তাঁর হাঁসগুলো, শালিকের ঠ্যাংগুলো কী নিরুত্তাপ আর নৈঃশব্দের প্রতুল ভান্ডার নিয়ে হাজির হয়েছে কবিতায়। ঘাই হরিণীর অমন ছুটে চলা আর থেকে থেকেই ডুকরে ডুকরে মৃত্যুকে ডেকে আনা— চেতন অচেতনের বিচিত্র রহস্যের মাঝে জীবনানন্দ অভিমানের বৃষ্টিপানে কাত হতে হতে বাঁশের ঝাড়ে জোনাকির জামানায় সঁপে দেন নিজেকে। সেখানে কত রঙের নৃত্য। কত রাজ্যপাট। কত গুপ্তধনের হাহাকার। অথচ কবি নির্মেদ, নিরুদ্বেগ সেখানেই তাঁর উল্টো সাঁতার। তাঁর সব ঘুঘুর অশ্রুতে ঝড়ে পড়ে বসন্ত বাহার। আমরা তাঁর কবিতা পড়ি। পড়ি বন্ধুবেষ্টিত হয়ে। পড়তে পড়তে অজান্তেই কোনো এক দূর ভিখারির মাথায় হাত বুলিয়ে দেই। বলি—ধরো ধরো, ওই তো চলে যাচ্ছে। আরে! ওটা কোনো খড়কুটো নয়। দিস ইজ ম্যাজিক রিয়েলিজম।
তাঁর মতে মানুষ মরে গেলে প্রকৃত মানব হয়ে ওঠে। মৃত্যু তাঁকে আজীবন কেবল উপহাস করে গেছে। সত্যের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে গেছে জীবনের সমস্ত ভুলভ্রান্তি। আর এর থেকে পরিত্রাণ পেতে পৃথিবীর আলো বাতাসে নিয়তই খুঁজেছেন তিনি তাঁর স্বপ্নের মানবীকে। কে জানে কতটুকু শান্তি দিয়েছিলো অরুণিমা সান্যাল, অদেখা সুদর্শনরা! আনন্দকে সঙ্গী করে কবিতায় তাঁর এফোঁড়-ওফোঁড় ছুটে চলা। অথচ দিন শেষে ক্লান্তি তাঁকে এতটুকু মুক্তি দেয়নি। জীবনানন্দ— কবিতায় যার এত ঠাঁট, ধারের ধামাকা, ধাঁচের ধ্বজা উড়েছে পতপত করে। কবিতার পাকদণ্ডী বেয়ে উঠে আসা তাঁর শব্দের ব্যবহার, উপমা-উৎপ্রেক্ষার প্রশ্নাতীত প্রয়োগ। ধাপে ধাপে বিষণœতার শৈলী তাঁকে এক বাক্যে আখ্যায়িত করেছে এ্যাজ এ পাওয়ারফুল পোয়েট হিসেবে।
কবিতায় তিনি প্রয়োগ করেছেন জ্ঞানের সঙ্গে অবচেতন কুহেলী। আলোর সঙ্গে ছায়া আচ্ছন্নতা। ঋতুরঙ্গের নানান ব্যঞ্জনা ফুটে ওঠে নিজ নিজ ঋতুতে। জীবনানন্দকে কেন জানি অতিমাত্রায় হন্ট করেছে কেবল ‘হেমন্ত’। হেমন্তের এত নির্যাস তাঁর কবিতার আনাচে-কানাচে লুকিয়ে আছে ভাবলে অবাক হতে হয়। সেই সাথে আদিম রহস্যের মতো রং এক ‘ধূসর’। এই ধূসর লাগাতার ধাওয়া করেছে তাঁকে কখনো ব্যক্তিসত্তা কখনোবা কবিতাসত্তার ওপরে। এ ধাওয়া উপর্যুপরি। আহা! কি মিস্টিক দূর দেশে সেই এক হাওয়াকল কোথাও কখনোই যে স্থির হতে শেখেনি। অসহায়ের আভাসকে আড়াল করে তাঁর কবিতায় বারে বারে ফিরে এসেছে আশ্বাস, আশ্রয়ের ইঙ্গিতবার্তা। জীবনানন্দের কবিতা পাঠান্তে মনে হবে এ যেন ইন্দ্রিয়াতীত স্তরকে ভেদ করে অতীন্দ্রিয় বা বলা যায় তুরীয় জগতের এক একটি আলাদা নিজস্ব নীহারিকা। যার আলো এসে পড়েছে মেঘের উপরে। ভাসতে ভাসতে মেঘ নিমিষেই তা পাঠাচ্ছে পৃথিবীর সমস্ত চরাচরে। বনের ধর্ম হলো সে তার নিজের ছায়া দিয়ে ডেকে আনে মেঘকে। বলে—এবার বৃষ্টি ফলাও আমার ওপরে। জীবনানন্দের কবিতাও ঠিক তাই পড়তে পড়তেই সবুজ থেকে পলকেই ধূসর হয়ে যাচ্ছি আমরা। শিশিরের ‘টুপ’ শব্দটুকু কান হতে মিলিয়ে না যেতেই শুরু হয় ঝমঝম বৃষ্টির বিচিত্র শব্দের পালক ভেজানোর পাশা খেলা।
প্রকৃত অর্থে কবি হবেন বহুদিশাময়। ঝরনার মতো অনর্গল ঝরবে তার কলম থেকে শব্দের ফুলঝুরি। তিনি হবেন বিস্তৃত। দেখায়, ভাবনায়, স্পর্শেবর্ণে হবেন বহুমাত্রিক লীলাময়। কবিতা কখনোই হুট করে লেখার বিষয় নয়। টাটকা বীজসত্তা নিয়ে প্রথমে তাকে কবির গর্ভেই পুষ্ট হতে হয়। সময় হলে সে জানান দেবে। ঠিক তখনই কবি তার আপন ভাষায়, নিজস্ব ডিকশন দিয়ে পৃথিবীর আলো বাতাসে ছাড়ার অনুমতি দিয়ে করবে তার আত্মপ্রকাশ। চালের ধূসর গন্ধ, নরম জামের মতো চুল তার, বেবিলনে ছিলাম আমি, বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে, কুলোর বাতাসে উড়ে খুদের মতোন, তোমার মাদকতাময় মিশরীয় কলসি, উচ্ছ্বাসে নদীর ঢেউ হয়েছে সফেন, বিচূর্ণ থামের মতো দাঁড়কাক, আমরা হেঁটেছি যারা নির্জন খড়ের মাঠে, অঘ্রাণের অন্ধকারে হয়েছে হলুদ, পুরুষ হরিণ শুনিতেছে শব্দ তার, বনের আড়াল থেকে ডাকিতেছে জ্যোৎস্না। এ রকম অজস্র রূপবান ফ্রেজের ফিকশনে ভর্তি জীবনানন্দের কবিতা। সময় আর স্পেসের টানটান রিলেরেসেওে কবিতা তার ক্লান্ত নয়, বিরক্ত নয় বরং পাঠককে করেছে আরো উজ্জীবিত।
দাশ বাবুর কবিতায় আবেগ আছে তবে তা কখনোই কবিতার বেসিক প্রভাবকে জিম্মি করে নয়। আছে হতাশা, যন্ত্রণা, আর্তি, কাতরতা—যা কিছুই সব তাঁর ডুমুরের মতো পৃথিবীর তাবৎ স্বাভাবিক স্থলভূমি থেকে সামান্য ডুবন্ত। খুব সাধারণ কনসেপ্ট দিয়ে শুরু হওয়া অধিকাংশ কবিতাই তাঁর অনায়াসে বাঁক নেয়, তৈরি করে ভয়াবহ শূন্যকল্পতা। জীবনানন্দ সেখানেও এতটাই নির্মম জাত-পাত ছিন্ন করে মিথের মার্বেল ছুড়ে টেনে আনে ফের। স্থিতিচিহ্নের ব্যারিকেড দিয়ে ফের পড়তে বলে। আর এভাবেই মৃত্যুর ফাঁদ কেটে বাঁচার নব নব কৌশলে নিজেকে বের করে আনে। তরল থেকে রূপান্তরিত হয় প্রস্তরীভবনে।
হেমন্তের এই হীম হীম ভোরে দাশ বাবু, তুমি আর কতটা দুর্ভেদ্য হবে? ধাবমান ধাঁধার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তোমার মতো আমরাও আজ অতীব ক্লান্ত, শ্রান্ত। দর্শনের দানবকে আটকে রেখে বলি—রাখো তো পরিপ্রেক্ষিত! সমকালের অভিঘাতে আমাদের সব ক্ষতচিহ্ন, সব দায়বদ্ধতাকে ভ্যানিশ করে স্রেফ অনুমতি দাও তোমাকে উন্মোচনের। জানি সবাই, বিশরূপ দর্শন কালে অর্জুন বার বার প্রশ্ন করেছিল— ‘তুমি কে?’ একাধিক উত্তরেও যখন অর্জুন সন্তুষ্ট হলো না, তখন শ্রীকৃষ্ণ বললেন: আমি একজন কবি। সাহসের সংজ্ঞা ধরে বলি—সব ডিসিপ্লিনকে ডিসঅর্ডারে রেখে, সব চিন্তাতন্ত্রকে মুক্তি দিয়ে, কোনো রুলবুক ফলো না করে, জীবনানন্দ—তুমি একজন কবি।