ঢাকা জেলার ধামরাই থানার ছয়বাড়িয়া গ্রামে ১৩২১ বঙ্গাব্দের ৫ আশ্বিন (১৯১৫ইং) এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন জারিয়াল দারোগ আলী বয়াতি। দারোগ আলী বয়াতি ছোটবেলা থেকেই ছিলেন সবকিছু সম্পর্কেই উদাসীন। গ্রামীণ পরিবেশ, নদীর তীর, সবুজ গাছপালা, গানের সুর দারোগের শিশুমনে গভীরভাবে প্রতিফলন ঘটাত। পড়ালেখা ৪র্থ শ্রেণী পর্যন্ত। আর স্কুলে দিকে যাননি। ছোটবেলা থেকেই দারোগের গান-বাজনার দিকে মনোযোগ ছিল। কিন্তু বাবা একজন ধার্মিক ব্যক্তি হওয়াই তিনি দারোগের গান-বাজনাকে মেনে নিতে পারেননি। তাই দারোগ এ সময় লুকিয়ে লুকিয়ে গান শিখতেন। প্রথমদিকে তিনি বাকুর বয়াতির নিকট খঞ্জনি বাজিয়ে গানের দোহারি দিতেন। বাবা শেখ রোস্তম আলী গান-বাজনাকে মেনে না নেওয়াই দারোগ সারারাত গান-বাজনা শিখে আবার ভোরে বাড়িতে এসে সাংসারিক কাজে সামান্য হলেও মনোযোগী হতেন। কিন্তু এভাবে আর কতকাল। অবশেষে গ্রাম ছেড়ে ধামরাই থানার দেপাশাই গ্রামের লোকসংগীত শিল্পী আফাজ উদ্দীনের কাছে গিয়ে দীক্ষা নেন। তাঁর সঙ্গে ঘুরে-ঘুরে গান পরিবেশন করেন।
কথিত আছে যে, দারোগ আলী একবার দীক্ষাগুরু আফাজ উদ্দীনের সঙ্গে তৎকালীন নদীয়া জেলার ‘শান্তিশান্তিপুরে’ গান গাইতে যান। সেই গানের অনুষ্ঠানে গান গাইতে গাইতে গুরু আফাজ উদ্দীন হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে যান। এমতাবস্থায় বাধ্য হয়েই দারোগ আলীকে অনুষ্ঠানে গান পরিবেশন করতে হয়। এ অনুষ্ঠানে দারোগ গুরু আফাজের আশীর্বাদে শ্রোতাদের অপরিসীম প্রশংসা পেয়েছিলেন। এ গানে খুশি হয়ে গুরু তাকে বয়াতি নাম নেওয়ার অনুমতি দেন। সেদিন থেকেই দারোগ আলী বয়াতি নাম ধারণ করেন এবং গেরুয়া লালসালু কাপড় পরে থাকেন। দারোগ আলী একজন লোকধারায় বিমোহিত আপাদমস্তক কবিয়াল। তিনি মাথায় বাবরী চুল রাখতেন, তাঁর মুখে ছিল বসন্তের দাগ এবং চোখ দুটি বড় বড় সুঠাম দেহের অধিকারী। শিল্পী দারোগ আলী একজন লোক কবি, বয়াতি, কবিয়াল। অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী। দারোগ আলী যে সময় কালে গান গাইতেন, সেই সময় গ্রামের কিছু মওলানা, তাঁর ওপর ক্ষেপে যান। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তাকে নিয়ে এক জায়গা বসার সিদ্ধান্ত নেয়। দিনক্ষণ ঠিক করা হলে সবাই সেখানে উপস্থিত হন। এমন জনসভায় কোনো মওলানা তাদের কথার জালে দারোগকে আবদ্ধ করতে না পারাই সেদিন থেকে গ্রামের সবাই দারোগ আলীর গান শুনতে শুরু করেন।
দিন-দিন দারোগের গানের কথা চারিদিকে ছড়িয়ে গেলে বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকজন এসে তাঁকে গানের বায়না করে নিয়ে যেত। এভাবে গান করেই তিনি বাবার সংসার চালাতেন বলেই বাবা তাঁকে ‘চৈতালীপোলা’ বলতেন। দারোগের দীক্ষাগুরুর মৃত্যুর পর তিনি গুলবদনের শাহ সাহেব নামে খ্যাত ইলিয়াস শাহের মুরিদ হন। এখান থেকেই তিনি তরিকা লাভ করেন। শরিয়ত মারেফত, তরিকত, হকিকত সব তরিকারই তিনি বিশ্বাসী ছিলেন। এ সময় কালে তিনি এক বস্ত্রে বাড়ি ছেড়ে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোয় ঘুরে বেড়িয়েছেন। এ সময় ঘুরে ঘুরে তিনি আধ্যাত্ম সাধনা করেন। কবি জসিমউদ্দীনের সঙ্গেও বয়াতি দারোগের গভীর খাতির ছিল। তাই জসীমউদ্দীন তাঁকে ‘কবিয়াল’ উপাধিতে ভূষিত করেন। শুধু জসিমউদ্দীই নয়, আব্বাস উদ্দীনের সঙ্গেও দারোগের গভীর সম্পর্ক ছিল। যার অনুরোধে তিনি ‘বুলবুল ললিতকলা’ একাডেমিতে আন্তঃপাকিস্তান শিল্পী সম্মেলনে সংগীত পরিবেশন করেন। এই বয়াতি, রেডিও, টেলিভিশনেও অসংখ্য বার বাংলার লোকসংগীত পরিবেশন করেছেন। তিনি মূলত একজন জারিয়াল, জারিগানের জন্যই তার দেশজোড়া খ্যাতি। তিনি ফাতেমা, কুলসুমের জারি, পিতা-পুত্র, হাসান-হোসেন, ইসমাঈলের কুরবানির জারি পরিবেশন করতেন। তাঁর সুমধুর কণ্ঠ অনায়াসে যে কাউকে ইন্দ্রের মায়ার আবদ্ধ করে তুলতে পারত। জারিগান ছাড়া তিনি আধুনিক, লালন, পাঞ্জু, বিচার-গানও পরিবেশন করতেন। তিনি নিজেও অনেক গান রচনা করেছেন। যার অধিকাংশই আজ বিলুপ্তের পথে। দারোগ আলীর বড় ছেলে মোহাম্মদ আলী। তিনি বাবার চাওয়া থেকেই গান করতে আসেন। মোহম্মদ আলী বর্তমানে একজন পরিচিত জারিয়াল।
দারোগ আলী বয়াতি কবিগানও করেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি জারি, ভক্তিমূলক, ভাবসংগীত, ভাটিয়ালি, ধূয়া, ভাওয়াইয়া গানও গেয়েছেন। তাঁর ছেলে বর্তমান মনে করেন তাঁর বাবার ২৫০-৩০০ টি গান থাকতে পারেন। তবে লিখিতভাবে আছে ২০-৫০ টি। তিনি জানেন ৭০-৮০টি। ধামরাই থানাসহ বিভিন্ন জায়গা এসময় দারোগের বিভিন্ন ভক্ত, শিষ্য সৃষ্টি হয়। তাদের শিষ্যদের মধ্যে আমির আলী বয়াতি, বাছের উদ্দীন বয়াতি, মোহাম্মদ আলী বয়াতি, ইউসুফ আলী বয়াতি। তাদের মধ্যে অধিকাংশই আজ মৃত, শুধুমাত্র মোহাম্মদ আলী বয়াতিই বেঁচে আছেন। মোহাম্মদ আলীর দীক্ষাগুরু বাবা দারোগ আলী। তিনি গুরু দারোগ আলীর একটি গান গেয়ে আমাদের শোনান। এ গানে এত হৃদয় জোড়ানো বাণী আর দরদীসুর দিয়ে গান গাওয়ার সময় বয়াতির চোখ দিয়ে দরদর করে জল গড়িয়ে পড়ছিল। গানটি হলো—‘স্বরূপে যায় মন মজেছে / ভবে তার কি পারের ভাবনা আছে।। / আমার গুরুর নামও মূল্যনিধি / তাদের সাধন করে নিরবধি / মনরে ভব পারে যাবি যদি / আগে যায়ে বাট্টা কর গুরুর কাছে।। / আমার গুরু হলো জ্ঞানের দাতা / (আরে) জ্ঞান বিনে ভবে ভজন বিথা / (ওরে) কর্মের লেখন লেখে বিধাতা / (আরে) বিধি যার কর্মেতে যা লেখেছে।। / বাউল দারোগ আলী ভেবে বলে / আমার মানব জনম যায় বিফলে / হইলো না মন সাধন ভজন / আমি কি জবাব দিব মওলার কাছে।।’
দারোগ আলী জারি গানের শিল্পী হলেও এসব গুরুভক্তিমূলক আধ্যাত্ম সাধন তত্ত্বেও গান রচনা করেছেন। তিনি ১৯৮৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন ফোকলোরবিদ প্রফেসর হেনরি গ্লাসি ও তাঁর স্ত্রী গেন্দু বয়াতির সঙ্গে পালামূলক গান পরিবেশন করেছেন। দারোগ আলী বয়াতি যখন আধ্যাত্ম সাধনায় মনোনিবেশ করেন, তখন তিনি রচনা করেন মুর্শিদীগান। যে গানের ফলে জানান দিয়েছেন গুরুতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, ভক্তিমূলক মাটির গান। যে গান শুনলে মাটির গন্ধ পাওয়া যায়। তাঁর কিছু বিরহ সংগীতও রয়েছে। গানের মাধ্যমে তিনি জানান দিয়েছেন—কাম, লোভ, মোহ, ক্রোধ থেকে বিরত থেকে একমাত্র গুরুরই আজ্ঞাপালন করতে হবে। যার মধ্য দিয়ে নিজের জীবন পবিত্র হবে।
মোহাম্মদ আলীই বাবার একমাত্র জীবন্ত শিষ্য হিসেবে বেঁচে আছেন। তিনিও মাটির গান করেন। রচনাও করেছেন অনেক গান। তাঁরও বয়স হয়েছে এ অবস্থায় এসেও বাবাকে নিয়ে তাঁর অনেক আফসোস। বাবাকে জাতীয় ভাবে এখনো সম্মানিত করা হয়নি। যে মানুষটা জীবন ধরে মাটির মানুষের জন্য গান করে গেলেন, তাঁর কি কোন মূল্য নেই। এই দারোগ আলী বয়াতি শেষ জীবনে অনেক আধ্যাত্মিক শক্তির অধিকারীও হয়েছিলেন বলে অনেকে মনে করেন। তিনি ২৮ পৌষ ১৩৯৯ বাংলা (১১ জানুয়ারি ১৯৯৩) সালে সোমবার সন্ধ্যা ৭:৩০ মিনিটে ইহধাম ছেড়ে চলে যান।
এ বয়াতির গ্রাম ছয়বাড়িয়া হলেও তাঁর মাজার বর্তমান চাকলগ্রামে অবস্থিত। প্রতি বছর তাঁর নামে এখানে বিশাল পৌষ মেলা হয়। চলে বাউল সংগীত, জারি, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া। দারোগ আলী বয়াতির কিছু গান প্রবন্ধকার তাঁর ছেলে মোহাম্মদ আলী বয়াতির নিকট থেকে সংগ্রহ করেছেন। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—
১.
কিবা যাদু জানে বন্ধুরে
কিবা যাদু জানে
লাগাইয়া প্রেমের জুড়ি
ঘরে বইসা টানে রে।।
ও বন্ধুরে মনে টানে, প্রাণে টানে
আর টানে যৌবনে।
আমার মনেরে বুঝাইয়া রাখি
বুঝে না দারুণ প্রাণেরে।।
বন্ধুরে বয়স কালে স্বামী মিঠা
পান মিঠা হয় চুনে
বন্ধু তোর সনে করিয়া পিরিত
আমার অন্তর ধরলো ঘুনেরে
কি বা যাদু জানে বন্ধুরে।।
২.
মানুষ যে ধরেছে তারে ধর
ধর ধর মানুষ
ঠিক করিয়া ধর।।
মাতা-পিতার রূপ হৃদে রেখে
দুই দেহ একত্র কর
মুর্শিদের রূপ সামনে রেখে
ঐ চরণ সাধনা কর।।
সামুদ্রতে বাণ উঠেছে
কিনারায় নৌকা চাইপা ধর
মুর্শিদের নামের বাদাম* দিয়া
হাইলের বৈঠা আইটা ধর
দেহের মধ্যে যেদিন তোমার
উঠবেরে ঘর ঘর
সেদিন দালান কোঠা ফুলশয্যা
তোমার সকলি হইয়া যাবে পর।।
৩.
দয়াল মুর্শিদগো
তুমি হইও পারের কান্ডারি
আমি তোমার নাম লইয়া
এই ভবনদী ধরলাম পাড়ি।।
তুমি বাদাম, তুমি বৈঠা
তুমি হও পানশের** দড়ি
আগায় পাছায় হইলা তুমি
এই নৌকার প্রহরী।।
তুমি মাতুর তুমি জাঙ্গা
এই নৌকা তোমারই
তুমি নিজ গুণে বাইয়া
নৌকা কইরা নিবা পার।।
৪.
সুখ নাই আমার দুঃখেরই কপাল
পাগলা মনাই রে।
সুখ নাই আমার দুখেরই কপাল
মনে বড় হাউস কইরা ঘর বাধিলাম
সেই ঘরে থাকবো চিরকাল
ঘরের চার বেড়া
উইয়ে খাইল
পিঁপড়ায় দেয় যোগান
মনরে আমার,
এরাইতে না পারলি মন তুই
এই ভবের জঞ্জাল
যাইবার বেলা খালি হাতে
সাজবা সেদিন যাত্রাপথে
পথেরই কাঙ্গাল।।