এক.
টুক্ টুপ্ টুপ্ ব্লুপ্ টাক্…
অগ্রহায়ণের মাঝামাঝি, তদুপরি সাগরতীরের শহর। শীতের এমন ‘পৌষমাস’ ঠিক আশা করিনি। হিমালয় কি আরও দক্ষিণে নেমে এলো? রীতিমতো শব্দ করে বইছে তুন্দ্রা বাতাস। চাদরটা আরও ভালো মতোন গায়ে জড়িয়ে নিলাম। এখানে রাস্তাগুলো এমন নির্জন ছিল না। আজকের মতো বিকেলে দুপাশের দোকানপাট আরও জমজমাট আর রঙ ঝলমলে হয়ে থাকতো। নতুন আরও দুটি সৈকত দাঁড়িয়ে যাওয়ায় বোধ হয় ওদিকে বেড়াতে আসা মানুষের শোরগোল বেড়ে গিয়ে এই দিকটা নীরব হয়ে গেছে।
প্রায় নিভে আসা সূর্যের নিচে গোলাপি আঁধার, আধানির্জন সৈকত, একটা-দুটো পসরায় টিমটিমে হলুদ আলো। এর ভেতর হঠাৎ আনন্দের একটা ফুলকি আমার চোখে পড়লো। ছোট্ট একটি মেয়ে, বছর সাতেক বয়েস হবে বোধ হয়। গোল ছাঁটের চুলে নাচন তুলে সে কী দৌড়ঝাঁপ তার। পৃথিবী যে তার নিশ্চিন্ত খেলাঘর, এ নিয়ে মনে যেন কোনো সন্দেহ নেই। গায়ে রুপালি পশমের ঝিকিমিকি তোলা একটা হালকা নীল উলের সোয়েটার।
ছোটবেলার বন্ধু ইমার কথা মনে পড়লো। ইমারও ছিল এই মেয়েটির মতো এমনই গোল ছাঁটের চুল, ঘাড়ের কাছে ভেতর দিকে বাঁকা। ওর বাবা ছিল ট্রিভিয়ায়। ইওরোপার সেই সর্ব উত্তরের দেশ, যে দেশে তুষার ঝরে, আর ক’দিন পরপর যুদ্ধের হুমকিতে বাতাস থমথম করে। বাবা ওর আসি আসি করেও আসে না, তার বদলে অপূর্ব সব জামা আর খেলনা পাঠায়।
একবার শীত আসার আগে আরও অনেক কিছুর সঙ্গে ধবধবে সাদার ওপর নীল ঢেউয়ের নকশাতোলা একটা উলের সোয়েটার পাঠালো। সোয়েটারটা দেখলেই আমার মনে হতো, সাদা তুলোয় ছাওয়া জমিনের ওপর জাদুর নীল জল ঢেউ হয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। জলের বুঝি পা আছে!
সেই কবেকার কথা। কম হলেও কুড়ি শীতের বেশি পেরিয়েছে তারপর। দেখতে না দেখতেই ছোট্ট মেয়েটির আমার সঙ্গে একটা কপাটঝপাটি লেগে যায় আরকি। আগমুহূর্তে নিজেকে ও সামলে নিলো। পেছনের তরুণীটি বোধ হয় ওর মা; নাম ধরে চিৎকার করে উঠলো—অদিতি! মেয়েটি দৌড়ের আবহে তখনো ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে, আর অবাক হয়ে আমাকে দেখছে। অবাক হয়ে দেখার মতোই আমি বস্তু। বিশেষ করে ছোটদের কাছে।
ওর সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করলো। বললাম, ‘অদিতি তোমার নাম?’ মেয়েটি কিছু বললো না। বললাম, ‘দেবতাদের মা না কি তুমি?’
মেয়েটি প্রশ্ন চোখে চুপ করে থাকলো। এমন মন্তব্য বোধ হয় শোনেনি আর। ওর সামনে বসে পড়লাম হাঁটু গেঁড়ে। বললাম, ‘তুমি কি জানো, তুমি ভবিষ্যৎ মানুষের শিক্ষক, রক্ষক, শাসক, ভাগ্যনিয়ন্ত্রক, রানি, সম্রাজ্ঞী? দেবী, ঋষি। জানো তা?’
মেয়েটি হাঁ করে তাকিয়ে রইলো। তারপর দৌড়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় বলে উঠলো, ‘ওরে বাবা, পাগল!’
যা করতে চাই (আসলে কী করতে চাই আমি?), যদি করে যেতে পারি তো ভবিষ্যতে শৈশবের স্মৃতিচারণে অদিতি হয়তো পত্রিকায় বলবে, কী বলবে? হয়তো বলবে: ‘হ্যাঁ, একদিন অদ্ভুত এক লোকের সাথে আমার দেখা হয়েছিল। আমার মনের ভেতর সে কিছু বীজ বুনে দিয়েছিল। বয়েসের আগে আমি কোনোদিন বুঝতে পারিনি। কখনো বুঝব এমন আশাও ছিল না, কিন্তু হঠাৎ একদিন আলো এসে ডাকলো, ‘জাগো জাগো,’ আর তখন বীজটা ছিল বলেই ফুঁড়ে বেরুলাম। লোকটিকে পথে পথে কত খুঁজেছি! ওরা একবারই দেখা দেয়।’
-হা হা হা হা।
আমার গুরু বুধবারের সঙ্গে এ নিয়ে আলাপ করেছিলাম। বলেছিলাম, ‘গুরু, যা করতে চাই পারব?’
বুধবার বলেছিলেন, ‘নিশ্চয়ই পারবে। কিন্তু মনে রেখো, চিরকাল কিছুই টেকে না। চিরন্তন কোনো কর্ম, কোনো নীতি আসেনি মহাবিশ্বে। পরিবর্তনই মহানিয়ম। মহানিয়মই ঈশ্বর।’
পাশ থেকে অরবিন্দ জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তাহলে আমরা কী? মহানিয়মের বাধা, নাকি তার ক্যাটালিস্ট?’
প্রশ্নটা হয়তো বোকাটে ছিল, কিন্তু গুরুজনের কাছে বোকা-প্রশ্নের ফলও শুভ। বুধবার বললেন, ‘আমার সঙ্গে তোমাদের সেই প্রথম কথপোকথনের স্মৃতি মনে আছে? তার ভেতর আছে উত্তর।’
ফেনায়িত স্মৃতি থেকে অনেক উত্তরের বুদবুদ উঠে এলো।
(টুক্ টুপ্ টুপ্ ব্লুপ্ টাক্…)
ঠাণ্ডা বাতাস হাড় কেটে বয়ে গেলো আরেকবার। চাদর একটু শিথিল হয়ে যাওয়ায় আবার জড়িয়ে নিলাম।
চাদর বস্তুটা এক হিসেবে মহাবিরক্তিকর। চলার গতি কমিয়ে দেয়। হাত দুটো মুক্ত থাকে না, বাধো বাধো ঠেকে সারাক্ষণ। হঠাৎ বাসের হাতল ধরে ঝুলে পড়া যায় না, কারও বাড়িয়ে দেওয়া হাতের দিকে হাত বাড়ানো যায় না। সিগারেট ধরাতেও দরকার হয় বাড়তি সাবধানতা। আর একটা সেকেলে-সেকেলে ব্যাপার তো আছেই।
তবে-
চাদর আমায় শীত নিবারণের বাইরে আরও কী কী সুবিধা দেয় তা শুনলে হয়তো চাদর-বিরোধীদের হাসি বন্ধ হয়ে যাবে।
হিমালয় দক্ষিণে সরে আসায় যা হয়েছে, চাদর এখন সবখানে আমার সঙ্গী। শীত থেকে ছোট্ট গ্রীষ্ম সব ঋতুতে সে আমার সঙ্গে। হয়তো রংরাজের কোনো হোটেল ঘরের মেঝেতে শুতে হবে, চাকার মতো গোলক পাকিয়ে বালিশ বানিয়ে মাথা রাখলাম। চন্দ্রদ্বীপ যাচ্ছি, এক টুকরো শোওয়ার জায়গা পেয়েছি লঞ্চের ইঞ্জিনঘরের ওপর, বা নবদ্বীপ যাচ্ছি ছাদে চড়ে, পেতে শুয়ে পড়লাম। খোলা মাঠে বা কোনো ঘরের দাওয়ায় অথবা ভাঁড়ারে মাদুর পেতে ঘুমোতে হচ্ছে কাঁথা নেই; দিয়াজপুর কি শোভনা, দরিয়ারকুল কি ভূষণা; চাদরটা গায়ের ওপর চাপিয়ে ঘাড় গলা গুঁজে ওমে ঘুমিয়ে পড়লাম। লাগলো তো হলো দড়ি, প্রয়োজনে আহতের খাটিয়া, কখনো মাথার পট্টি, আবার প্রাণ বাঁচাতে ছদ্মবেশ।
আরও আছে।
চাদরে একটা রহস্যঘন মূর্তি তৈরি হয়। যখন আমি হাঁটি, দূর থেকে আমাকে খুব রহস্যময় দেখায়। ক্যাম্পাসে হিংসুটে বন্ধুরা বলতো, চাদরে আমায় হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়া তেলাপোকার মতো দেখায়। নারীদের ভাষ্য কিন্তু তা ছিল না। কোনো কোনো নারী তো বিভিন্ন সময় আমার চাদরের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত অনুরাগ প্রকাশ করেছে। কেবল, ‘বাহ, খুব মানিয়েছে’ বলায় সীমাবদ্ধ ছিল না।
আমার দেবী সেতু বলতো, ‘চাদর ছাড়া তোমায় দেখলে আমি চিনতেও পারব না মনে রেখো।’ও আমায় একটা সবুজ রঙের চাদর দিয়েছিল, খদ্দরের।
ওদের গাঁয়ের বাড়ি জপমালা। ওখানকার এক বুড়ো তাঁতীর হাতে তৈরি ওই চাদর। আমাদের বিয়ের পর জপমালায় গিয়েছিলাম, কিন্তু তাঁতীর সঙ্গে দেখা করতে পারিনি। তদ্দিনে তিনি স্বর্গে তাঁত চালাচ্ছেন।
আরেক নারী, সে আমায় কোনো চাদর না দিলেও ভালোবেসেছিল।
একসময় সে বেশ উদার দার্শনিক মনের অধিকারিণী ছিল। আমার অনেক উৎসব আনন্দের সে সাথী। হঠাৎ নিজেকে ভীষণ রকম ধর্মীয় অনুশাসনে বেঁধে ফেললো। আমি কেবল তার চোখ দেখতে পেতাম। সে আড়াল হয়ে গেলেও তার নামটি বলতে পারি। পাখির নামে নাম, দোয়েল।
আমি তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘অনুশাসনগুলো কি তোমার খুব বুদ্ধিদীপ্ত মনে হয়?’ সে বলেছিল, ‘জানি না ময়ূখ। আমাকে এসব আর জিজ্ঞেস কোরো না।’
সেই দোয়েল একদিন বলতো, ‘চাদর ছাড়লে আমার চোখে তুমি আর বিপ্লবী থাকবে না।’
আসল কথাটি হলো, বাবার প্রভাবের কারণে চাদর আমার স্বপ্নকল্পনার আচ্ছাদন। পরনে আজকের চাদরটা আমার বাবার।
বাবার হাতে কী করে এ চাদর এসেছিল তা নিয়ে একটা গল্প আছে।
তখন আমার শৈশব। এক সুফি সম্মেলনে বাবা দিল্লি গিয়েছিলেন। পরে সেখান থেকে কাশ্মির। বাবা আমার কপালে চুমু খেয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় আমি চৌকাঠ থেকে বলেছিলাম, ‘আমার জন্যে একটা ঘোড়া নিয়ে এসো কিন্তু!’বাবা বলছিলেন, ‘ঠিকাছে, যদি সুবিধা পাই, সুযোগ হয়, তো অবশ্যই আনব।’
বাবা এমন কোনো প্রতিশ্রুতি দিতেন না যেটা রাখতে পারবেন না, বা মন রক্ষার খাতিরে দিলেও এমন ভাবে দিতেন যেন সেই প্রতিশ্রুতি থেকে বেরিয়ে আসার পথ থাকে। দিল্লি কিংবা কাশ্মির থেকে আমার জন্যে ঘোড়া আনার সুবিধা বা সুযোগ কোনোটাই তার হয়নি, হওয়ার কথাও নয়। তাই কলকাতা থেকে আমার জন্যে কিনলেন দুই জোড়া রাবারের বল। মেটে লালরঙা বলগুলো পেয়ে আমি ঘোড়ার দুঃখ ভুলে গেলাম।
বাড়ি ফিরে, বাবার চাদরটা গায়ে জড়িয়ে নিলাম। পরবর্তী সময়ে ওটা আমার কাছে কোনো জড় কিছু বলে গণ্য ছিল না। একটা জীবন্ত পোষ্য হয়ে উঠেছিল। ওকে একদম কাছছাড়া করতাম না।
সেবার মায়ের জন্য এলো জরি চুমকি বসানো শাড়ি। এলো ঘরের জন্যে দুটো বিছানার চাদর। নিজের জন্য কখনো কিছু কিনতে দেখিনি তাকে। তার প্রায় প্রতিটি জিনিস আমার মায়ের কিনে দেওয়া।
সেবারই প্রথম দেখলাম, বাবার হাতে একটা ঘিয়ে রঙের চাদর উঠে এলো যেটা হাতে নিয়ে তিনি বললেন, ‘আর এটা আমার,’ এবং সেটা মায়ের দেওয়া নয়।
চাদরটা ছিল কাশ্মিরি এক ভিখারির।
ভুখার তো ছেঁড়া কম্বল মুড়িয়ে চলে যায়। চোঁ চোঁ পেটেই বরং তার কিছু দেওয়া দরকার। এই দারুণ চাদরটা গায়ে দেওয়া ভিখারি মহাশয় শুধু এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল, কার কাছে এ চাদর বিকিয়ে ভালো দাম পাওয়া যায়। এমন সময় আমার বাবাকে চোখে পড়লো তার।
বাবা কি তখন কোনো কাশ্মিরি বালিকার কলস থেকে জল ঢেলে খাচ্ছিলেন পথের একপাশে?
তার চেহারায় একটা রাজকীয় গাম্ভীর্য ছিল। হয়তো তাতে আকৃষ্ট হয়ে, উপরন্তু তাকে বিদেশি বলে আঁচ করতে পেরে ভিখারি এগিয়ে গেলো।
‘ওরে রাজার ছেলে, তোর বাড়ি কোথায়? তুই তামিল, আঁ?’
‘না। বাঙালি।’
‘আরিব্বাস! বাঙ্গালা মুল্লুকের লোক তুই? ভালো, ভালো, খুব ভালো। বাঙ্গালার মানুস খুব ভালো হোয়। তবে একটা ব্যাপার বুঝি না বাবা। সব্বাইকে দেখি একা একা আসে দল বেঁধে ফিরে যায়, কেবল এক বাঙ্গালার লোককে দেখি দল বেঁধে আসে কিন্তু একা একা ফেরে।’
এ কথার মানে কী, বাবা বুঝতে পারলেন না।
ভিখারি বললো, ‘তুই কি তোর দল হারিয়েছিস?’
বাবা বললেন, ‘না, আমি একাই এসেছি।’
‘তুই বড় লায়েক বাঙ্গাল আছিস। হামি তোকে একটা জিনিস দেখাতে চাই। হামার বিশ্বাস, ভুল লোকের কাছে আসিনি। লোভ দেখিয়ে এ জিনিস বিক্রি করার লোক হামি না। অনেকে আছে এমন, এই কাশ্মির মুল্লুকে, তোকে লোভ দেখাবে। কিন্তু আকবর? উঁহু। যা সাচ্, তাই বলবে তোকে, তুই মিলিয়ে দেখিস।’
ভিখারি সেই শীতের ভেতর তার গায়ের চাদর খুলে দুই পল্লায় ভাঁজ করে বাবার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, ‘খাসা জিনিস। তোর দেশে নিয়ে যা। নিজে পরিস। ছেলেকে দিস। এ চাদর তোর গৌরবের কারণ হোবে। তোর ছেলের গৌরবের কারণ হোবে। নিয়ে যা মুর্শিদ। পুরনো হতে পারে, কিন্তু এ বড় ভালো চাদর। তামাম মুল্লুকে এর মতো জিনিস কমই তৈরি হয়। দেখার চোখ আছে তোর। মালুম হয় পছন্দ হোবে।’
লোকটার চোখে একটা সরল আকুতি ছিল। বাবা চাদরটা নিজ হাতে নিলেন। সঙ্গে সঙ্গে মন ঠিক করে ফেললেন, এটা নেবেন তিনি।
একটা কাশ্মিরি চাদরের মূল্য, দাম দুটোই তিনি জানতেন। পুরনো বলে ভিখারি যদি কম করে চায়, তাই তিনি তাকে কোনো কথা বলতে দিলেন না। নতুন চাদরের দাম বের করে দিলেন। তিনি ধনীর দুলাল নন, টাকার কুমির নন। বিদেশে টাকা বড় দামি জিনিস। যতটা ভাবা যায় তার চেয়ে দামি। কারণ সেখানে অপরিচিত সমাজ, টাকা ছাড়া কোনো বন্ধু নেই। বাবার কাছে খুবই হিসাবের কিছু রুপি ছিল। তিনি হিসেব ভুললেন।
শরীর থেকে চাদর খুলে নেওয়ার পর থেকেই শীতে অল্প অল্প কাঁপতে শুরু করেছিল বৃদ্ধ। কাঁপা হাতে পয়সা গুনে অবাক হয়ে গেলো। তাকে অভিভূত করে দেওয়ার মতো দ্বিতীয় কাণ্ডটা ঘটালেন তখন বাবা। পুরু একটা উলের সোয়েটার ছিল তার পরনে, মহিপালপুরের ফুটপাথ থেকে কেনা। রঙ হলুদ, বুকের কাছে সোনালী কারুকাজ। সেই সোয়েটারটা খুলে ভাঁজ করে তিনি ভিখারির কাঁধে রাখলেন। তার বিহ্বল চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এটা আপনাকে উপহার দিলাম।’
চাদরটা আঁটো করে গায়ে জড়িয়ে বাবা ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। পেছনে ভিখারি চিৎকার করে অন্যদের বলে উঠলো, ‘কী, বলেছিলাম না? বাঙ্গালার লোক বড় ভালো? শরিফের সিলসিলা। শোন বাবা!’
বাবা হাসিমুখে ঘুরে দাঁড়ালেন।
‘বলুন?’
‘হায়াত মওত খোদার হাতে। যেদিন বুঝবি তোর দিন ফুরিয়েছে, সেদিন এ চাদর তোর ছেলেকে ডেকে হাতে তুলে দিস। ওর দিন ফিরবে। এ যে সে জিনিস নয়। মির পীরের দোয়া আছে এ চাদরে।’
বাঙালি লোকটির সত্যিই এক ছেলে ছিল। এ হলো সাদামাটা কাকতাল।
বাবা নিজে যখন এটা পরতেন, আমি এতই ছোট যে লুকিয়ে গায়ে জড়িয়ে হাঁটতে গিয়ে পায়ে বাঁধিয়ে পড়ে যেতাম। খুব আগ্রহ নিয়ে পরতাম এটা। বাবা বলতেন, ‘একদিন তোকে দিয়ে দেবো।’
আমি ব্যাকুল হয়ে বলতাম, ‘কবে, কবে!’
‘আরে দেবো, দেবো।’
কবে তার মতো বড় হবো সেই অপেক্ষা আর শেষই হয় না।
বড় হতে হতে কিন্তু এ চাদরের কথা আমি ভুলে গেলাম। কখন ওটা আলমিরায় ঢুকে পড়ল জানতেও পারলাম না।
মৃত্যুর ক’দিন আগের কথা। একদিন বাবা আমায় ডেকে চাদরটা দু’কাঁধে ছড়িয়ে দিলেন। আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘আরে, এটা কোথায় ছিল এতদিন? আর কী আশ্চর্য, আমায় দিচ্ছো কেন!’
বাবা কিছু বললেন না। আমি বললাম, ‘তুমি পরো না। আমার তো আছেই।’
আমার পরনে তখন সেতুর দেওয়া খদ্দরের সবুজ চাদর।
বাবা বললেন ‘আমায় নাহয় তোরটা দিস?’
আমি হেসে আমার চাদর খুলে বাবাকে পরিয়ে তারটা গায়ে জড়িয়ে দরজা দিকে হেঁটে গেলাম। স্মৃতির রহস্যময় বিজলি সেই মুহূর্তে আমাকে স্পৃষ্ট করলো।
ভিখারির শেষ কথাটা আমার মনে পড়ে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে তাকালাম।
‘অসম্ভব! এ চাদর আমি পরব না। কক্ষনো না।’
বাবার বিমূঢ় মূর্তির সামনে ক্ষুব্ধ আমি সে চাদর খুলে একপাশে ছুড়ে দিলাম। আমার চোখে জল আসছিল। বেরিয়ে গেলাম বাসা থেকে।
এর ক’দিন পর, এক শুক্রবার, তার প্রিয় দিনে, তিনি দেহ রাখলেন।
কবরে তাকে শুইয়ে দেওয়ার খানিক আগের কথা। সেতুর দেওয়া চাদরটা হাতে নিয়ে আমি তার মরদেহের পাশে দাঁড়িয়ে আছি। কাছেই লাল কবর। চারপাশে অনেক মানুষ, অনেক শোরগোল। আমি সব দেখছি কিন্তু কিছুই দেখছি না। সব শুনছি কিন্তু কিছুই শুনছি না। আমার দুই চাচাতো ভাই মাটির সিঁড়ি ধরে কবরে নেমে গেলো। আমি তখনো দাঁড়িয়ে। এমন সময় অচেনা একজন আমার কাঁধে হাত রেখে মৃদু হেসে বললো, ‘বাবাকে নামাবে না?’ তখন আমার বোধ ফিরে এলো।
কবরের সিঁড়ি ধরে নামলাম। বিমূঢ় দাঁড়িয়ে আছি। বাবার দেহটা তুলে আমার ভাই দুটির বাড়িয়ে দেওয়া হাতে নামিয়ে দিলো মানুষ। ঝটিতে দু’হাত বাড়ালাম। বাবাকে আমার শেষ আলিঙ্গন। তাকে মাটিতে শুইয়ে দিলাম।
যখন উঠে দাঁড়িয়েছি, এক ভাই বললো, ‘এ চাদর কেন এনেছিস। চাচাকে দিতে?’
আমি ‘হ্যাঁ-না’ কিছুই বলতে পারলাম না। ও আমার কাঁধ থেকে চাদরটা নিয়ে ভাঁজ খুলে বাবার সাদা কাফনের ওপর বিছিয়ে দিলো। আমি আজীবন তার কাছে কৃতজ্ঞ হয়ে থাকলাম।
তখন সেতুও নেই। ওর দেওয়া চাদরও কবরস্থ হলো।
বাড়ি ফিরে, বাবার চাদরটা গায়ে জড়িয়ে নিলাম। পরবর্তী সময়ে ওটা আমার কাছে কোনো জড় কিছু বলে গণ্য ছিল না। একটা জীবন্ত পোষ্য হয়ে উঠেছিল। ওকে একদম কাছছাড়া করতাম না।
হঠাৎ একদিন চাদরটা আমার কাছছাড়া হয়ে গেলো। আর তারপর, একদিন ফিরেও এলো।
জাদুকরী ভ্রম
হামিম কামাল
প্রকাশক: চন্দ্রবিন্দু প্রকাশন।
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি, ২০২০
স্টল নম্বর ৬০৭, বইমেলা