আপনি কোন ধরনের ছোটগল্প পছন্দ করেন, এমন প্রশ্ন অযৌক্তিক নয়। শিল্পের যেকোনো ক্ষেত্রেই শ্রোতা-পাঠকই শেষপর্যন্ত গন্তব্য বলে বিবেচিত হয়। এছাড়া সময় আর স্রোত সম্পর্কে সৃজনশীল মানুষ মাত্রই ওয়াকিবহাল। অনন্য সাধারণ ও অভূতপূর্ব চেতনাপুঞ্জের কল্যাণে মহৎ লেখকেরা খবর রাখেন মানুষের মনের, সর্বজনীন রুচির। ফলে কোন ধরনের গল্প পছন্দ করেন, তা পাঠকের জন্য যতটা ইতিবাচক বা আবশ্যম্ভাবী, ঠিক ততই তা দূরে থাকে লেখকের ভাবনা থেকে। কারণ, সেন্সর দিয়ে আর যাই হোক, সৃজনশীল সাহিত্য হতে পারে না। লেখক প্রথমত লেখেন নিজের জিজ্ঞাসু হৃদয়কে শান্ত করতে, নিজের দেখার চোখকে প্রসারিত করতে, নিজের ভাবনাকে অন্যের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে। থাকতে পারে ইতিহাসের পাঠ, ঐতিহ্যের মহান শিক্ষা। যদিও বা সাহিত্যের কাজ শিক্ষা দেওয়া নয়, মনোরঞ্জন করা। এক্ষেত্রে গল্প আমাদের সাহিত্যের নতুন সদস্য হলেও স্বীয় গুণে পাঠকের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে খুব তাড়াতাড়িই।
দাদির মুখের গল্প, রূপকথা-পরির গল্প, অতি মানবীয়-অবাস্তব গল্প এখন কেউই শুনতে চায় না। যুগের চাহিদা আর বৈজ্ঞানিক সুবিধাকে কোনো মানব সন্তান অস্বীকার করতে পারে না। গল্পকারের কাজ যেহেতু মানুষ নিয়ে, আরও স্পষ্ট করে বললে সমাজস্থিত মানুষ নিয়ে, তাই গল্পকারকে হতে হয় জনমুখী, জীবনঘনিষ্ঠ। মোটাদাগে মানবজীবনের নানা সমস্যা-সম্ভাবনা, কুটিলতা-মহানুভবতা, বিস্ময়-বাস্তবতা, হাসি-কান্না, ঘৃণা-ভালোবাসায় ভরা থাকে গল্পের শরীর—তা-ই পাঠক পছন্দ করে।
এখন বলতে হয়, রবীন্দ্রনাথ রচিত কবিতাকে বোদ্ধারা ছোটগল্পের সংজ্ঞা বলে এতকাল চালিয়ে গেলেও তা বদলানোর সময় এসেছে বোধ হয়। কোনো জীবনই কি সামান্য? কোনো প্রাণই কি ক্ষুদ্র? তা নিশ্চয়ই নয়। এছাড়া সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে ফ্রেমে বাঁধা রাস্তায় হাঁটা যায় না কোনোকালেই। রুচি বা প্রেম অবশ্যই আপেক্ষিক বিষয়—তা কারণে-অকারণে বদলও হতে পারে। তাই কোনো ধরনের গল্প পছন্দ—এমন প্রশ্নের তারতম্য হওয়ার সম্ভাবনাও বেশি। মনের ওপর জোর খাটে না কিন্তু একজন গল্পকার তার ভাবনাকে যেভাবে সর্বজনীন রঙে রাঙাতে সচেষ্ট থাকে। ভৌগলিক কাঁটাতারের বেড়া ভাগ করতে পারে না ব্যথার নীলাভ চাদর, সুখের রঙিন চাঁদোয়া। রক্তের রঙের মতোই গল্পের ব্যাখ্যা এক ও অভিন্ন দেশ-মহাদেশে, আর্য-অনার্যে। বলা যায়, আমরা সময়-পরিপ্রেক্ষিত ছোটগল্পই চাই, যা পাঠক পড়ামাত্রই মনে হবে—এ তো আমাকে নিয়ে লেখা! এ তো আমারই দুঃখ কিংবা হাসি!
ছোটগল্পের লেখকের কাছে প্রত্যাশার কিছু থাকে? প্রথম কথা তাকে শিল্পী হতে হবে। সংবেদনশীল মানুষ হিসেবে তাকে সাড়া দিতে হয়। জীবনের জন্য শিল্প না শিল্পের জন্য শিল্প এ তর্কে না গিয়ে বরং তাকে চিনতে হবে প্রকৃতি ও প্রকৃতির অন্যান্য উপাদানগুলো। চারপাশের মানুষেরা কী বলতে চায়, কেন চায়; যূথবদ্ধ হাসি কিংবা ছেঁড়া-ছেঁড়া দুঃখ—সবটার মানবিক এবং হৃদয়ছন্দিত দলিল এঁকে যায় একজন গল্পকার। চর্যাপদ আবিষ্কারের পর থেকেই আমাদের সাহিত্যের ইতিহাসে আসে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। মূলত স্ব-কালকে ধারণ করেন বলেই গল্পকারের গল্পজুড়ে থাকে বর্তমানের রূঢ়বাস্তবতা। বর্তমানের কঙ্কালকে অতীতের গৌরবগাঁথা অতীতের গৌরবগাঁথা-জামদানির জৌলুস কি রক্তাভ আন্দোলন-সংগ্রাম-মুক্তিযুদ্ধ, তৎপরবর্তী নানামুখী সংক্ষুব্ধতাজুড়ে থাকে গল্পে। অদূর ভবিষ্যতের বহুবিধ রঙ-রূপ-কল্পনা তাতে যোগ হতে থাকে মহান গল্পকারদের দূরদর্শী চোখে। মূলত গল্পকারের চোখ একজন পাঠকের চোখ হয়েও ঘোরে দৈশিক এবং বৈশ্বিক সাহিত্যসম্ভারে। গল্পের প্রয়োজনে তাকে জানতে হয় অপরাপর বিষয়সমূহ। সবচেয়ে বড় কথা তার কারবার যেহেতু মানুষের মন নিয়ে, হৃদয়বৃত্তির সুকুমার কর্ম নিয়ে তাই তাকে খাপ খেতে হয় সদা পরিবর্তনমান সময় এবং স্রোতে। জনপ্রিয়-ক্ল্যাসিক এসব বিষয় সমালোচক মহলে জমা দিয়েই গল্পকারকে ছেনে আনতে হয় মনিমুক্তো। মানবিক হৃদয় দিয়েই তাকে আলো ফেলতে হয় সর্বদিকে। এটা ভুলে যাওয়া উচিত নয়—গল্পটি প্রকাশ হওয়ার পরই আসে প্রতিক্রিয়া-আলোচনা-সমালোচনা। কিন্তু গল্প নির্মাণের পরিপ্রেক্ষিত, প্রসববেদনার দীর্ঘ সময় পেরিয়েই ঘটনা ও অন্যান্য মসলাগুলো একটি গল্পে রূপ নেয়। যে বুলেট বেরিয়ে যায় তা ফেরানো যায় না, যে গল্প পাঠকের দরবারে গিয়ে হাজির হয় যেকোনো প্রকাশমাধ্যমে তার দায় গল্পকারের—সে যেকোনো ধরনের প্রেক্ষাপটেই। কথাশিল্পী বস্তুত জীবনশিল্পীই—গল্পকার গল্পের সীমিত আয়তনে জীবনের খণ্ডিত অংশেরই বিশ্বস্ত ও বহুবিস্তৃত বয়ান শোনান আমাদের।
গল্প যেকোনোভাবেই হতে পারে। একটি বিষয়ের সূত্র ধরে গল্পের শরীর এগুতে পারে—তাতে ক্রমান্বয়ে যোগ হতে পারে একাধিক সম্ভাব্য কিংবা অকল্পনীয় যেকোনো যোগসূত্র। মানুষের মন ও জীবন কোনোটাই ব্যাকরণ মেনে চলে না। আস্তিক তো বটেই, অন্যরাও মূলত যা কপালের ফের বলে চালিয়ে দেয়, তা-ই মূলত জীবনের অনিশ্চয়তা। গ্যাপ ও অনিশ্চয়তা, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মিলহীন সময়ে গল্পকারকে ভাবতে হয় অনেক কিছু। তার অনুসন্ধিৎসু মনে সদা জাগরুক থাকে মানুষেরই অভাবনীয় যত কাণ্ডকারখানা। কিংবা একটি ঘটনাই বদলে দিতে পারে এতদিনের ছা-পোষা জীবনের রুটিন অথবা শৃঙ্খলাবদ্ধ মানুষটি দৈবাৎ দুর্ঘটনায় হয়ে যায় চরম বেপরোয়া। হতে পারে চরিত্রনির্ভর গল্প। গল্পে স্থিত চরিত্রগুলো মূলত সমাজ-সংস্কার ও প্রয়োজনীয়তার কল্যাণেই কথা বলে। একজন গল্পকার চরিত্রকে দিয়ে বলিয়ে নেয় তার ক্ষোভের কথা, বিশ্বাস আর আশাবাদের কথা। আধুনিক সাহিত্যে মানুষই মূখ্য, মানুষই উপজীব্য। গল্পের চরিত্রগুলো গল্পকারের মানসসন্তান হয়ে পাঠককে হাসায়-কাঁদায়-ভাবায়। চরিত্রের সংলাপই হয়ে ওঠে একেকটি শক্তিমান বুলেট, ভালোবাসার অপূর্ব নিদর্শন। গল্প কি বিষয়-কাহিনী প্রধান হবে, না চরিত্রপ্রধান হবে—তা নির্ভর করে গল্পকারের মেজাজ-রুচি আর ভাবনার ওপর। উত্তম পুরুষে বলা গল্প, সংলাপের মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়া গল্প কিংবা শুধু বিষয়কে সামনে রেখে একরৈখিকভাবে ধাবমান হওয়া—সবটাতেই অভ্যস্ত আমাদের পাঠকসমাজ। গল্পের স্টাইল, ভাষাশৈলী, অগ্রসরমান চেতনা ও স্বাতন্ত্র্যবোধই একজন গল্পকারকে আলাদা করে। ঝাঁকের কৈ অনেকেই হয় কিন্তু স্বোপার্জিত বৈশিষ্ট্য-ভাষায় এক লহমায় চিহ্নিত করার মতো গল্পকারের অভাবও কম নয় এ ভূগোলে। যুগে যুগে খুব কম সংখ্যক গল্পকারই এটা পারেন এবং তাদের আসন পোক্ত হয়ে যায় পাঠকের হৃদয়ে, সমসাময়িক সাহিত্যের ইতিহাসে।
আমাদের প্রধান গল্পকারদের গল্প-কিতাবে ডুব দিলে অনায়াসেই লক্ষ করা যায়, ভাষার তফাত। শক্তিমান লেখকদের মধ্যে প্রতেক্যেই আলাদা নিজেদের ভাষার কারণে। কারও ভাষায় আছে কাব্যময়তা, কারও ভাষা একেবারে শ্লথ, কারও ভাষা অলঙ্কারসমৃদ্ধ। কিংবা আমাদের কারও কারও ভাষার কথা উঠতে মনে আসে প্রবন্ধ-গল্পের অদ্ভূত ভাষা। এভাবেই মূলত গল্পকারেরা গল্পে বিষয়-বৈচিত্র্যতার সঙ্গে ভাষার বাহাদুরিও ফলাতে চায়। কমলকুমারের কাজ বা রবীন্দ্রনাথের কাজ, হাসান আজিজুল হকের কাজ বা সেলিনা হোসেনের কাজ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বা আহমাদ মোস্তফা কামালের কাজ প্রায় প্রত্যেকেই আলাদা ভাষাগুণে। পাঠক কী গ্রহণ করবে, তা নির্ধারণ করতে সময় বড় ফ্যাক্টর। রুচি কখন কেমন হতে পারে, তা যেমন আগে থেকে আন্দাজ করা যায় না তেমনি কোনো ধরনের ভাষা-বয়ান পাঠক নেবে তাও বলা যায় না হুট করে। প্রথম কথা, আগে গল্প আছে কি না, জীবন আছে কি না, জিজ্ঞাসা আর অনুরণন আছে কি না। হ্যাঁ, বড় অনেক শিল্পীই প্রথম জীবনে অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে কিন্তু সময়ের সঙ্গে সে নিজেই আয়ত্ত করতে পারে তার ভাষা। আবার অনেকেই ভাষার কারিশমা দেখাতে গিয়ে হারিয়ে গেছে কালের গহ্বরে। তাই ছোটগল্পের ক্ষেত্রেও আমাদের মনে হয়, একটা আদর্শ গল্প যদি দাঁড় করানো যায়, সে হোক আঞ্চলিক ভাষাযোগে, সংলাপে স্থানিক টোন ব্যবহার করে হোক কিংবা শহুরে নাগরিকপনায় ভরে থাক গল্পের শরীর তাতেও কোনো সমস্যা নেই।
ছোটগল্প নিয়ে আমাদের বাড়াবাড়ি রকমের উচ্ছ্বাস—তার কারণ অগ্রজদের সঙ্গে গল্পকারের মিছিলে যোগ হচ্ছে তরুণেরা। বয়সের তারতম্য হেতু দেখার চোখেও পার্থক্য থাকে, থাকতে পারে। জীবন যেখানে যেমন—যেভাবে জীবনের জয়গান গাওয়া যায় কিংবা খোঁচা দেওয়া যায়, বিদ্রূপ করা যায় তাই করছে আমাদের গল্পকারেরা। চলার পথে, কর্মের স্থলে, প্রতিবেশে কিংবা হাওয়ায়ও গল্প পাওয়া যায়। বিজ্ঞানমনস্ক রুচি আর বাস্তবতার মিশেলের কোনো ছোটগল্প পাঠের পর পাঠক বলে, অ্যা! এ তো আমারই কথা! আমার জীবন ও লোকটা জানলো কেমনে? তখনই স্বার্থক হয়ে উঠে একজন শিল্পীর হৃদয়, গল্পকারের দিনমান ভালোবাসার পবিত্র জায়গাটি।