সা.
সব মানুষেরই কোনো না কোনো গল্প থাকে। মহাবীর আলেকজান্ডারের বিশ্বজয়ের যেমন বিরাট গল্প আছে, তেমনি ক্ষুদ্র হলেও একজন ভিক্ষুকেরও রয়েছে পেছনের গল্প। প্রথমটি লিখিত, বিশ্ব ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য কাহিনি, কোটি কোটি মানুষ সেটা জানে; দ্বিতীয়টি ইতিহাসে থাকে না, মানুষের কাছে এর কোনো গুরুত্বও নেই। এ-দুই আকাশ-পাতাল দূরত্বমানের বাইরেও অসংখ্য মানুষ আছে, যাদের জীবনে আছে ছোট-বড় সার্থকতা; আছে সেই সার্থকতার কিছু গল্পও। সেই গল্পগুলোই তার হয়ে ওঠার, যা কিনা একান্ত নিজের হয়েও হয়ে উঠতে পারে অন্যেরও। কিন্তু আমি কি আদৌ কিছু হতে পেরেছি, যার কোনো গল্প থাকতে পারে?
তুমি একটা মুচি হও, কিন্তু ভালো মুচি হও; যেন লোকে তোমার কাছে আসে। আমার শিক্ষক ও গবেষণা তত্ত্বাবধায়ক প্রফেসর খোন্দকার সিরাজুল হক প্রায় কুড়ি বছর আগের এক সন্ধ্যায় তার রাজশাহীস্থ নিজবাড়িতে বসে একথা বলেছিলেন আমাকে। স্যারের মুখে একথা শোনার আগেই আমি অবশ্য অনুধাবন করতে শিখেছিলাম, সমাজের কাজটি কত বড় না কি ছোট, এটা কোনো বিষয় নয়, সেই কাজে উপযুক্ত হয়ে ওঠাই আসল বিষয়। আমি জানি না, পঁচিশ বছর ধরে লেখক হওয়ার যে আকাঙ্ক্ষা নিজের ভেতরে জিইয়ে রাখার সাধনা করে চলেছি, তাতে কতটুকু ‘ভালো মুচি’ হওয়ার গুণ রয়েছে। গুণ কিছু থাক না-থাক, ব্যক্তিক-পারিবারিক ও পারিপার্শ্বিক প্রতিকূলতার বিবিধ স্রোত উজিয়ে হয়ে ওঠার চেষ্টা যে করে চলেছি, সেটুকু অন্তত বলতে পারি। সেই হয়ে ওঠার চেষ্টার ভেতরে যৎসামান্য কিছু গল্পও রয়েছে বৈকি। সবিস্তরে না হোক, সামান্য পরিসরে সেগুলোর শেয়ার তো করতেই পারি।
রে.
লেখালেখি নামের বৃক্ষটি কবে কোথায় জন্মেছিল, তার কোনো নির্ধারিত ঠিকুজি নেই; কিন্তু এখন মনে হয় এর বীজ অঙ্কুরিত হচ্ছিল বইয়ের প্রতি টান থেকেই। শৈশব থেকেই সিলেবাসের বাইরের বইপড়ার প্রতি আমার বিশেষ টান। দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের বড়ো সাইজের একটি ঠাকুরমার ঝুলি ছিল আমাদের বাড়িতে। এই বইয়ের এক-একটি গল্প যে কত বার করে পড়েছি! রাজকন্যা আর ফুলপরি-জলপরিদের মুক্ত করে আনার রহস্যময় কাহিনিগুলো কী যে আচ্ছন্ন করে রাখতো আমাকে! শুধু আমাকে কেন, আমার গ্রামের দু-একজন এমন মানুষ ছিল যারা পড়তে পারে না বলে আমার কাছে আসতো গল্পগুলোর পাঠ শোনার জন্যে। এছাড়া নানারকমের রূপকথা পড়ারও সময় ছিল সেটা। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর (নাকি অন্য কোনো লেখকের? আজ আর মনে নেই।) ছোটদের রামায়ণ ও ছোটদের মহাভারত এনে দিয়েছিলেন বাবা। রঙিন ছবিওয়ালা সেই বই দুটো বারবার পড়ে ও দেখে রাম-রাবণ-লক্ষণ-হনুমান-কুম্ভকর্ণ কিংবা ভীম-অর্জুন-ভীষ্ম-দ্রোণ-কর্ণ প্রমুখের চেহারা ও কর্মকাণ্ডগুলো মাথার ভেতরে গেঁথে ফেলেছিলাম। হনুমানের পর্বত তুলে নিয়ে উড়ে আসা, দশমাথাওয়ালা রাবণের ভয়ঙ্কর মূর্তি কিংবা ভীষ্মের শরশয্যা ও কর্ণের রথের চাকা মাটিতে বসে যাওয়ার মতো ছবিগুলো এখনো মনের ক্যানভাসে ভেসে ওঠে মাঝে-মধ্যে। নানারকমের ধাঁধার বই এবং গোপাল ভাঁড় বা বীরবলের মতো হাস্যরসের কাহিনিগুলোও গিলেছি বিপুল উৎসাহে। হাইস্কুলে পড়ার সময়েই শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়, নীহাররঞ্জন গুপ্তসহ কয়েকজনের উপন্যাসের প্রতিও আকৃষ্ট হয়েছিলাম। যখন অষ্টম শ্রেণীতে, হাতে নিয়েছিলাম মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’। কিন্তু ওই নেওয়া পর্যন্তই; তখনো আমার দাঁত ওটা চিবোনোর মতো পোক্ত হয়নি। বছর দেড়েক পরে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দুর্গেশনন্দিনী’ পাঠের সময় অনেক শব্দের অর্থ উদ্ধারের পাশপাশি তৎসম শব্দ ব্যবহারের এক রোমান্সকর অনুভূতি লাভ করি। কলেজে উঠতে না উঠতেই, মগজের আড়ষ্ঠতা ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে আরও বইয়ের রাজ্যের ভ্রমণ করতে শুরু করি। আমার মামার ছিল বইয়ের দোকান।
অবশ্য গত কয়েক বছরে দেশে বিজ্ঞানমনস্কতা ও যুক্তিবাদ যেভাবে আক্রান্ত ও কোণঠাসা হয়েছে, তাতে মাঝে মাঝে সেই প্রেম ও প্রকৃতিস্নিগ্ধ রোম্যান্টিকতার নিরুপদ্রব পথে পুনর্যাত্রা করতে মন চায় মাঝে মাঝে।
শ্যামনগর বাজারের প্রথম এবং বড় দোকান পল্লীমঙ্গল লাইব্রেরিতে আমি তখন প্রায়ই বসে থাকি। যতটা কলেজে ক্লাস করি, তার চাইতেও বেশি ক্লাস করি পল্লীমঙ্গলের বইয়ের পাতায়। বই পেলেই পড়ি; বিশেষত কবিতা-উপন্যাস। দোকানে বসে পড়ি, বাড়িতে নিয়ে এসে পড়ি। পড়ে দোকানে রেখে আবার একটা নেই। বঙ্কিম, শরৎ, ফাল্গুনী, নীহাররঞ্জন, সুনীল, শীর্ষেন্দু, নিমাই, শংকর, যাযাবর, প্রমুখের উপন্যাস আমার শীর্ষ আকর্ষণ; রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জসীমউদ্দীনের কবিতা তখন আমার প্রিয় সহচর। শ্যামনগর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ-এর লাইব্রেরি থেকেও পড়েছিলাম কয়েকটি বই। নির্মলেন্দু গুণের একটি কবিতাসংকলন (সম্ভবত ‘নির্বাচিতা’ কিংবা ‘রাজনৈতিক কবিতা’) এসময় আমার খুব আপন হয়ে ওঠে, বিশেষত রাজনৈতিক ও দ্রোহমূলক কবিতাগুলোকে মনে হয় তারুণ্যের বিস্ফোরণ। ‘কপালকুণ্ডলা’, ‘মৃণালিনী’; ‘দেবদাস’, ‘বিপ্রদাস’, ‘দেনাপাওনা’; ‘চিতা বহ্নিমান’, ‘শাপমোচন’; ‘ধূপশিখা’; ‘দৃষ্টিপাত’; ‘মেমসাহেব’ ইত্যাদি কাহিনিপ্রধান রোম্যান্টিক উপন্যাসগুলো আমার তখনকার মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো অনেক দিন। হুমায়ূন আহমেদের কয়েকটি বইও পড়েছি, তবে ‘নন্দিত নরকে’ আর ‘শঙ্খনীল কারাগার’ কিছুটা টানলেও অন্যগুলো টানেনি। ইমদাদুল হক মিলন কিংবা নিশাত চৌধুরীও হাতে নিয়েছি, কিন্তু বিশেষ আকৃষ্ট হইনি। পড়েছি খ্যাত-অখ্যাত আরও অনেক লেখকের উপন্যাস। কিছু গল্পও। পাঠ্য বইয়ের বাইরের বই পড়ার যথেষ্ট স্বাধীনতা ছিল আমাদের বাড়িতে, তবু রাত্রি জেগে উপন্যাস পড়ছি জানলে বাবা-মা কিংবা ছোটদা বকা দেবেন ভেবে মাঝে-মধ্যে লুকিয়েই রাখতাম পাঠ্যবইয়ের পাতার আড়ালে। মনে পড়ে ফাল্গুনীর ‘চিতা বহ্নিমান’ পড়া শেষ করেছিলাম রাত্রি প্রায় ৪টার দিকে। অবশ্য সুনীলের ‘যুবক যুবতীরা’ উপন্যাসটি নাম এবং ওপরের ছবির কারণে লুকিয়ে না পড়ে কোনো উপায় ছিলো না। এখনকার ছেলেরা অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল বা ট্যাব ছাড়া হাতে অন্য কিছু ভাবতে পারে না, আমি বিকেলে বন্ধুদের সঙ্গে বাইরে বের হলেও হাতে থাকতো একটি বই। আমার একটা নোটবুক ছিল, যাতে লেখা হতো আমার পঠিত বইয়ের নাম এবং তা পড়ে ক্যামন লাগলো তার সংক্ষিপ্তসার। সাহিত্যের পাশাপাশি বিশ্ব ইতিহাসের অসাধারণ ও বিচিত্র সব ঘটনাগুলো এবং খেলাধুলার খবর বরাবরই আলোড়িত করতো আমাকে।
সিলেবাসের বাইরের বইয়ের প্রতি এই যে বিশেষ স্পৃহা, এই অব্যাহত স্পৃহা থেকে বোধকরি নিজেরও কিছু লেখার স্পৃহা তৈরি হয়েছিল।
শরৎচন্দ্রের উপন্যাস পড়তে পড়তে শরৎচন্দ্রের মতো লিখতে চেয়েছি, নজরুলের কবিতা পড়তে পড়তে চেয়েছি নজরুলের মতো দ্রোহের কবিতা লিখতে, আবার যখন নিমাই ভট্টাচার্যের ‘মেমসাহেব’ পড়েছি, শুধু মনেই হয়নি, লিখতেই শুরু করেছি ওরকম পত্রোপন্যাস। তবে এরও আগে, আমি তখন ক্লাস নাইনে, জসীমউদ্দীনের ‘প্রতিদান’ কবিতাটিকে অনুকরণ করে একটি প্যারোডি কবিতা লিখে ফেলি। সেটাই আমার প্রথম লেখার চেষ্টা। এই প্যারোডির ভেতরে কবিতার কিছু ছিলো কি না, জানি না, তবে আমার এক নিকটাত্মীয় (মেশোমহাশয়), যিনি দীর্ঘদিন যাবৎ গল্প-কবিতা লিখতেন, দু’টো উপন্যাসও লিখেছেন, তিনি আমার খাতায় এই লেখাটি পড়ে বলেছিলেন, শুরু যখন করেছিস, লিখতে থাক; তবে অন্যের অনুকরণ করে নয়, নিজের মতো করে যা খুশি লেখ। পরবর্তী সময়ে তিনি আমার অনেক লেখাই পড়েছেন এবং মন্তব্যসহ প্রেরণা দিয়েছেন। মনে পড়ে, আমার পিতৃস্থানীয় এই মানুষটি যখন আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসতেন, কবিতা নিয়ে, সার্বিক সাহিত্য ও সাহিত্যিক নিয়ে কথা বলতেন। রবীন্দ্র-নজরুল সঙ্গীত-ইতিহাস সমাজ-প্রেম কিছুই বাদ থাকতো না তার কথায়। বয়সের বিরাট ব্যবধান যে সংকোচ তৈরি করতে পারতো, তা-তিনি কাটিয়ে দিতেন। বলতেন, শিল্প-সাহিত্যের জগতে যাদের বাস, বয়স বা সম্পর্কের ব্যবধান তাদের কাছে কোনো বাধা নয়। রাতের খাওয়া শেষে অন্যরা যখন ঘুমিয়ে পড়তো, তিনি আমাকে কবিতার রূপ-রসের সন্ধান দিতে চেষ্টা করতেন। মাঝে মাঝে কবিতার একটি লাইন মুখে বলে আমাকে বলতেন, এর পরের লাইনটা তৈরি করে দে। নিজের আগ্রহের পাশপাশি তার প্রশ্রয় ও প্রেরণায় সিক্ত হয়ে বেড়ে উঠতে থাকে আমার কবিতাচিন্তার অঙ্কুরগুলো। ছন্দ-অলঙ্কার-মাত্রা বুঝতাম না, বুঝতাম কবিতা দিয়ে নিজের অনুভূতিগুচ্ছকে সংক্ষেপে ও ইঙ্গিতপূর্ণ ভাষায় ব্যক্ত করা যায়, যা অন্য কোনোভাবে সম্ভব নয়।
এসএসসি পরীক্ষার পরে আমার কবিতাচর্চায় একটা জোয়ার এসে পড়ে। ক্রিকেট, সিনেমা, বই আর কবিতা; এই ছিল সে-সময়কার প্রধান সঙ্গী। কলেজের দু’বছরে লিখেছি প্রচুর কবিতা। সারাদিন খেলাধুলা বা আড্ডা-সিনেমাতে, কিংবা অন্য যেভাবেই কাটুক না ক্যানো, রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে বসে যেতাম কবিতার খাতা নিয়ে। কবিতার পর কবিতা লিখে ফেলতাম! আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি গেলেও এটা করার চেষ্টা করতাম। এই সময়ের অনেকগুলো রাত মামার বাড়িতে কাটতো। আমাদের বাড়িতে বিজলির আলো থাকলেও মামাদের এলাকায় তখনো বিদ্যুতের লাইনই যায়নি। সবাই ঘুমিয়ে পড়লে হেরিকেনের আলোয় বসে লিখতাম কবিতা; কোনো কোনো রাতে ৯-১০টি কবিতাও লিখেছি! ওইগুলো যে সেই অর্থে কোনো কবিতাই নয়, কবিতা লেখার আবেগদীপ্ত প্রয়াসমাত্র, তা পরে জেনেছি। অবশ্য ওই প্রয়াসই যে পরবর্তী সময়ে আমাকে প্রকৃত কবিতাভাবনার দিকে টেনে এনেছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। শুধু কি কবিতা? শরৎচন্দ্র-ফাল্গুনী-নীহাররঞ্জনদের সামনে রেখে চেষ্টা করছি গল্প-উপন্যাস লেখারও। এইসময় থেকেই লেখক হওয়ার বাসনাটা ভেতরে-বাইরে উদ্দীপিত করতে শুরু করে। একাধিক উপন্যাস শুরু করেছি এ-সময়। লিখেছি ছোটগল্পও। এবং কবিতা ও উপন্যাসে যে রোম্যান্টিকতা নিয়ে শুরু করেছিলাম, প্রথম ছোটগল্পে তার লেশমাত্র থাকলো না!
তবে ধীরে ধীরে কবিতাই হয়ে ওঠে প্রধান আশ্রয়। একটি কথা বলে রাখা ভালো, ওপরে উল্লিখিত পাঠকপ্রিয়, রোম্যান্টিক সাহিত্যের সীমানা থেকে খুব দ্রুতই সিরিয়াস সাহিত্যের পাঠক হয়েছি আমি। শিল্প-সাহিত্যের বিচারে ধ্রুপদী এবং জীবন দর্শনের বিচারে গভীরতাস্পর্শী; ইতিহাস, সভ্যতা ও পুরাণাশ্রয়ী বইপত্রের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছি। যুক্তি ও বিজ্ঞানমনস্কতা ব্যাপকভাবে আকৃষ্ট করেছে আমাকে। ফলে নিজের লেখার ঢং ও বিষয়বস্তুতে এসেছে অনেক পরিবর্তন। প্রথাগত ভাবনার বাইরেই প্রতিস্থাপিত হয়েছে আমার লেখক-চেতনা। প্রথম তারুণ্যে শুরু করা প্রেমাবেগ ও হালকা চালের কাহিনিপ্রধান অসমাপ্ত উপন্যাসগুলোর জায়গা হয়েছে পরিত্যক্ত খাতাপত্রের স্তূপে। অবশ্য গত কয়েক বছরে দেশে বিজ্ঞানমনস্কতা ও যুক্তিবাদ যেভাবে আক্রান্ত ও কোণঠাসা হয়েছে, তাতে মাঝে মাঝে সেই প্রেম ও প্রকৃতিস্নিগ্ধ রোম্যান্টিকতার নিরুপদ্রব পথে পুনর্যাত্রা করতে মন চায় মাঝে মাঝে।
গা.
আমি এমন একটি জায়গার (শ্যামনগর, সাতক্ষীরা) ছেলে, যেখানে শিল্প-সাহিত্যের চর্চা ও প্রকাশের সুযোগ প্রায় ছিলোই না। আর যদি কিছু থেকেও থাকে, প্রচণ্ড ভেতরগোঁজা স্বভাবের কারণে তার সন্ধান আমি করিনি বা পাইনি কোনদিন। আমার প্রথম কবিতা ছাপা হয় খুব সম্ভবত ১৯৯৭ সালে, তখন আমি রাজশাহীতে, অনার্স প্রথমবর্ষের ছাত্র। দৈনিক আজকের কাগজের ‘কাগজ পাঠক’ পাতায় ‘প্রতিবেশিনী’ নামের কবিতাটিই সম্ভবত আমার প্রথম প্রকাশিত কবিতা বা কবিতাপ্রচেষ্টা। এরপর রাজশাহীর স্থানীয় দৈনিক বার্তা ও মাসিক লোকপত্র (দুটো পত্রিকাই আমার কবিতার অন্যতম প্রেরণাদানকারী লেখক ফজলুল হক সম্পাদনা করতেন।) দৈনিক শালুক প্রভৃতি পত্রিকায় লিখতে থাকি। লিখি রাজশাহী ও এর বাইরের কয়েকটি ছোটকাগজেও। আজকের কাগজের ‘কাগজ পাঠক’ ও ভোরের কাগজের ‘পাঠক ফোরাম’ পাতা সে-সময় আমার কবিতা, অণুগল্প চর্চার এক উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত হয়। ‘পাঠক ফোরাম’-এ ফিচার লিখেছি অনেক, বেশ কয়েকবার সেরাও নির্বাচিত হয়েছি। অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ার সময় আমাদের ব্যাচের বেশ কয়েকজনের উদ্যোগে এবং প্রিয় শিক্ষক, কবি-অধ্যাপক অনীক মাহমুদের তত্ত্বাবধানে গঠিত হয় ‘কাহ্নপা সাহিত্যচক্র’। কবিতাই ছিলো এর প্রধান আরাধ্য। বন্ধু শামীম সুফিয়ান (ভালো কবিতা লিখতো, বর্তমানে বিভিন্ন সৃজনশীল বিজ্ঞাপন স্ক্রিপ্ট তৈরি ও নির্মাণ এবং অভিনয়কর্মে নিয়োজিত), সোলায়মান সুমন ( গল্প লেখে, আইডিয়াল স্কুল এ্যান্ড কলেজের শিক্ষক), রহমান রাজু (রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক), মনিরা ইসলাম মনি (কবিতাপাগোল মেয়ে), শেখ শফি (তাকে দেখলে মান্নাদে’র সেই বিখ্যাত ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’-এর কবি কবি চেহারার কাঁধে ব্যাগ ঝোলানো অমলের নামটা মনে পড়ে যেতো। আমার কবিতার সমঝদার ও প্রেরণাদাতা ছিলো। শুনেছি, ঢাকার কোনো একটা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সে।), লিপি বিশ্বাস (জ্যোৎস্নালিপি নামে এখন গল্প লেখে, শিশুসাহিত্যে এই মুহূর্তে তাঁর জনপ্রিয়তার ঊর্ধ্বগতি আমাকে আনন্দিত করে।)-সহ আমরা বেশ কয়েকজন মিলে কবিতার টানেই একত্রিত হতাম অনীক স্যারের সাথে সাপ্তাহিক আড্ডায়। শহীদুল্লাহ কলা ভবনের সামনের সবুজ ঘাস পরম মমতায় আমাদেরকে বুকে নিতো। এরপর আমার সাহিত্যজীবনকে সুউচ্ছ্বাসে উশ্কে দিতে ২০০০ সালে আবির্ভূত হলো ‘চিহ্ন’। সৃজনশীল লেখক, কলামিস্ট, গবেষক, অধ্যাপক ড. শহীদ ইকবালের সম্পাদনায় কুড়ি বছর পার করা এই সাহিত্যের কাগজটি আমাদের প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা ছিলো শুরু থেকেই।
যতদিন বাঁচি, হয়ে ওঠার চেষ্টা করতে থাকবো। প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির হিসেব না-করে চলতে থাকবো পথে। আর মনে মনে গাইবো, ‘ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী একা একা করি খেলা…চিরদিন আমি পথের নেশায় পাথেয় করেছি হেলা’।
প্রধান সম্পাদক তখনকার তরুণ শিক্ষক ইকবাল স্যারের বাইরে প্রথম সংখ্যার সম্পাদক ছিলেন নব্বইয়ের কবি শামীম নওরোজ। সঙ্গে ছিলেন তাঁরই বন্ধু গল্পকার শফিক আশরাফ (বর্তমানে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক), কাজল কাপালিক (বর্তমানে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক) সহ আরো কয়েক জন। দ্বিতীয় সংখ্যা থেকেই জুটে যাই আমি, আকতার আরণ্যক (বর্তমানে নটরডেম কলেজের শিক্ষক) এবং সৈকত আরেফিন (বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক), তুহিন ওয়াদুদ(বর্তমানে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক)। এরপর একে একে কান্তি তুষার (বর্তমানে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের শিক্ষক), রহমান রাজু, আতিকুজ্জামান (বর্তমানে খুলনা সরকারি বিএল কলেজ-এর শিক্ষক), সোলায়মান সুমন, ত্রিস্তান আনন্দ (তখনই বিচিত্র পাঠোৎকর্ষের অধিকারী এই মেধাবী এই তরুণটি বর্তমানে ঢাকার কোনো একটা ইংলিশস্কুলে আছে বলে শুনেছি।), নিত্য ঘোষ (রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক)-সহ আরও অনেকে। ‘চিহ্ন’তে অবশ্য আমার প্রথম প্রকাশ কবিতা নয়, কবিতা বিষয়ক গদ্য দিয়ে। কবিতা : এখনও কি সেই আকাশে ওঠে গো চাঁদ হেসে ? শিরোনামে চিহ্ন’র তৃতীয় সংখ্যার প্রধান প্রবন্ধ হিসেবে প্রকাশিত দীর্ঘ গদ্যটি বহুল প্রশংশিত হয়েছিল। আবু হাসান শাহরিয়ার, রহমান হেনরী-সহ অনেকেই, অচেনা আমাকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। এসময় বিভিন্ন ছোটকাগজে কবিতা লিখেছি কম-বেশি। এরপর পুরো বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত অন্যান্য বেশকিছু লেখা লিখলেও কবিতাই আমার নেশা, নৈরাশা ও নান্দনিক প্রত্যাশা পূরণের প্রিয়তম প্রশ্রয়।
মা.
আমি সেই অর্থে প্রতিভাবান কোনো লেখক নই। কেউ কেউ হয়তো ভাবেন, কিছুটা লিখতে পারি। কেউ একটু বেশি ভালোবাসেন, কারো আবার মনে হয়, ধুর, এ-আবার কোনো লেখক না কি! সে যাই হোক, আমি লিখি। লেখা আমার প্রাণের নেশা, হৃদয়ের স্পন্দন। লেখাপড়ার পিছনে যে-সময়টুকু ব্যয় করতে পারি, সেটুকুই জীবনের পরম প্রাপ্তি। বিবিধ রকমের প্রতিকূলতাকে সঙ্গী করে এই লেখার কাজটি ধীর-লয়ে চালিয়ে যেতে পেরেছি বলেই নানান সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও একে একে ৫টি কবিতার বই, ৪টি কবিতার বই ও ২টি গল্পের বই পৃথিবীর আলোয় প্রকাশিত হয়েছে, একাধিক বই আছে বের হওয়ার অপেক্ষায়। লিখি বলেই কিছু কিছু মানুষের ভালোবাসা পাই। তবু মাঝে মাঝে মনে হয়, মফঃস্বলে বসে এই যে লেখালিখির সাধনা, অধিকাংশক্ষেত্রেই এর আমন্ত্রণ পৌঁছায় না মহানগরের দুনিয়ায়। কারণ, আমাদের রাজনীতির মতোই শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিও রাজধানীকেন্দ্রিক।
একজন লেখককে লেখক হিসেবে মূল্যায়িত হতে হলেও রাজধানীতে গিয়েই থাকতে হয়। আমাদের সকল ধরনের গণ-মাধ্যমগুলো পূর্ণতপ্রায় রাজধানীমথিত। আমাদের প্রধান লেখকদের প্রায় সকলেই ঢাকায় থাকেন, তাদের কথা বলি না। কিন্তু কেবলমাত্র ঢাকায় থাকার সুবাদে যেমন পাতি নেতা আর নাতি বুদ্ধিজীবীরা নানা মূল ধারার মাধ্যমগুলোতে হানা দিয়ে দারুণ প্রচারণা ও পরিতৃপ্তি লাভ করেন, তেমনি অনেক ক্ষুদ্র ও অতিক্ষুদ্র মাপের লেখকও এই মহানগরীতে থাকবার সুবিধা নিয়ে বিরাট প্রচার ও প্রসারে নিজেকে ব্রাহ্মণে রূপায়িত করবার সুযোগ পান, এরকম লেখকের সংখ্যা কম নয়। শুধু রাজধানীতে থাকার সুবাদে বড়ো বড়ো মানুষ ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সখ্য গড়ে কয়েক ধাপ এগিয়ে রাখবার সুযোগ পান নিজেদেরকে। দু’-একটা বিরল ব্যাতিক্রম ব্যতীত অন্য বিভাগীয় শহর, জেলা বা আরও প্রান্তিক মানুষের পক্ষে অনেক প্রস্তুতি সত্ত্বেও সফল হওয়া দুর্ঘটপ্রায়।
একটা ভিন্ন দুঃখও আছে। এটা অবশ্য আমার একার নয়, এখনকার অধিকাংশ লেখকের। সাহিত্যের সবচেয়ে বড়ো পৃষ্ঠপোষক হচ্ছেন পাঠক। পাঠক যদি না-পড়েন, লেখকের পক্ষে অনুধাবন করা অনেক সময় সম্ভব হয় না যে, তিনি যা লিখছেন, তা আসলেই কিছু হচ্ছে কি না। আমি জনপ্রিয় সাহিত্যের কথা বলছি না, আমি তথাকথিত জনপ্রিয় সাহিত্যের প্রতি আকর্ষণ হারিয়েছি বহু আগেই; আমি বলছি মানুষের ন্যূনতম পাঠস্পৃহার কথা। এদেশের জনসংখ্যা যেভাবে বেড়েছে, শিক্ষার হার যেভাবে বেড়েছে; সাহিত্যের পাঠক সেভাবে বাড়েনি, বরং কমতে কমতে তা এখন অনেকটা লেখকই পাঠক, পাঠকই লেখকের মতো হয়ে গেছে। কবিতার ক্ষেত্রে তো এই হতাশা আরও বেশি ভয়ঙ্কর, কবিদের বাইরে কবিতার কোনো পাঠক আছেন কি না তা খুঁজতে আদমশুমারির মতো কোনো জরিপ হলে হয়তো বোঝা যেতো। আমার প্রথম কবিতার বই ‘কোথাও কোনো মানুষ নেই’ ২০১০ সালে প্রকাশিত হলে বেশকিছু মানুষ তা-কিনে পড়েছেন। আমি যেখানে থাকি, সেই বাগেরহাট শহরে তো বটেই, আমার পূর্ব-পরিচিত নন, এমন অনেক মানুষ পড়েছেন বইটি। মনে পড়ে, ঝিনাইদহের একটি কলজের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক (তাঁর নামটি এখন আর মনে নেই) আমার ফোন নাম্বার সংগ্রহ করে ৫০কপি বই পাঠাতে বলেন। মানি অর্ডার করে পাঠিয়েছিলেন টাকা। কবি ও কথাশিল্পী আবুবকর সিদ্দিক এই বইটি পড়ে ফোন করে প্রায় তিরিশ মিনিট ধরে এ-নিয়ে কথা বলেছিলেন আমার সাথে। প্রথম বইয়েই এই প্রবীণ কবি ও অধ্যাপকের নিকট থেকে ‘কবি’ স্বীকৃতি পেয়ে আনন্দিত হয়েছিলাম সেদিন। কাগজে রিভিউ হয়েছিল বইটির। কিন্তু তারপর ? যতো দিন যাচ্ছে, ভার্চুয়াল পাঠক হয়তো বাড়ছে, কিন্তু বই কিনে পড়ার মতো পাঠকের সংখ্যা শোচনীয়ভাবে হ্রাস পাচ্ছে। তবু যে লিখি, আসলে না লিখে থাকতে পারি না বলেই। কবিতা লিখতে না পারলে চারদিকের বেদনাগুলো আরও তীব্র হয়ে বুকে আঘাত করে। একটা কবিতা লিখতে পারলে, বুকের একতারায় আনন্দের সুর বেজে ওঠে। ইদানীং গল্প রচনার দিকেও বেশ ঝোঁক ফিরে এসেছে। পরিকল্পনা চলছে উপন্যাস পাড়ায় নতুন করে ঢুঁ মারারও। আমার নাড়িমাটি যেখানে, সেই শ্যামনগরের সুন্দরবন সংলগ্ন মানুষের জীবন ও জীবিকার যে ভয়ঙ্কর সংগ্রাম দেখে আসছি দীর্ঘকাল থেকে, তার উপর ভিত্তি করে একটি উপন্যাসের আয়োজন চলছে ভেতরে ভেতরে। জানি না, সেটা কবে সম্ভব হবে কিংবা আদৌ সম্ভব হবে কি না।
পা.
এই মুহূর্তে যতদূর মনে পড়ছে, প্রাইমারি স্কুলের শেষ কিংবা মাধ্যমিকের শুরুর দিকে কোনো এক ধর্ম বইয়ে গৌতম বুদ্ধের গল্প পড়ে, বুদ্ধের মতো সংসার ত্যাগ করে অরণ্যবাসী হওয়ার বাসনা জেগেছিল কাঁচা মনে। কিন্তু আমার কাল তো প্রাচীন অরণ্য জীবনের নয়, আধুনিক নাগরিক জীবনের, তাই বোধহয় সন্ন্যাস জীবনের বাসনা দ্রুতই মিলিয়ে যায় হৃদয় থেকে। ফলে সন্ন্যাসী না-হয়ে লেখক হয়েছি; গদ্য-পদ্যে মিলিয়ে-মিশিয়ে হৃদয়ের অনুভূতিরাশির কিছুমাত্র প্রকাশের চেষ্টা করে চলেছি। যখন কলেজে পড়ি, তখনই শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল, নেশায় লেখক হওয়ার বাসনা। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে সেই বাসনা আরও সুতীব্র হয়েছিল। সেই হিসেবে আজকের পথটা অনেকটা পরিকল্পিতই বলা যায়। কিন্তু লেখক হওয়ার যে-পথ, সেই পথের তো কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্য নেই। এই পথের যারা পথিক, তাদের কাছে চলাটাই মুখ্য, কোনো স্থির বা নিশ্চিত গন্তব্যে পৌঁছানো নয়। আমারও তেমনি হয়ে ওঠার ব্যাপারটাও সারাজীবনের একটি প্রক্রিয়া। যতদিন বাঁচি, হয়ে ওঠার চেষ্টা করতে থাকবো। প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির হিসেব না-করে চলতে থাকবো পথে। আর মনে মনে গাইবো, ‘ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী একা একা করি খেলা…চিরদিন আমি পথের নেশায় পাথেয় করেছি হেলা’।