পুরস্কার শব্দটিই কি বিতর্কিত? অধিকাংশ পুরস্কারের পেছনেই জড়িয়ে যাচ্ছে নানা কথা ও কাহিনী। পুরস্কার বিতর্কিত না হলেও তা দেওয়ার-প্রক্রিয়া অথবা প্রাপকের সূত্র ধরে তৈরি হচ্ছে বিতর্ক। যা বিতর্কিত করে তুলছে পুরো প্রক্রিয়াটিকেই। ফলে পুরস্কার ঘোষণার আগে যেমন, তেমনি দেওয়ার পরও এসব কথা ও কাহিনী তার ডালপালা মেলতে থাকে। তাতে বিতর্কের সঙ্গে সঙ্গে পুরস্কার শব্দটিও প্রশ্নবিদ্ধ হতে শুরু করে।
তামাম দুনিয়ায় যেসব পুরস্কারের নাম ছড়িয়ে আছে, সেগুলোর সঙ্গেও জড়িয়ে যাচ্ছে বিতর্ক। নীতি ও নৈতিকতার প্রশ্নে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে হাজারও প্রশ্ন। ফলে যিনি পুরস্কার পান, তার দিকে পুরস্কারবঞ্চিতরা ঈর্ষান্বিত দৃষ্টিতে তাকান। এমনকী আড়ালে-প্রকাশ্যে তাকে নানা তির্যক বাক্যেও মুড়ে দেওয়া হয়। আর এভাবেই মূল পুরস্কারটিই হয়ে ওঠে বিতকির্ত। অনেক সময়ে পুরস্কারবঞ্চিতরা আঙুর ফল টক প্রবাদটিকেই এসব ক্ষেত্রে উপযুক্ত করে তোলার চেষ্টা করেন।
পুরস্কার কে পাবেন, কী তার যোগ্যতা—তা নির্ধারণের মানদণ্ড রয়েছে, রয়েছে পুরস্কার দেওয়ার কমিটিও। এরপরও যদি যোগ্য কেউ পুরস্কার না পান, তখন তৈরি হয় বিতর্ক। কিন্তু সেই বিতর্ক কারা তৈরি করেন? যারা পুরস্কার দেন, তাদের নির্ধারিত মানদণ্ডের বাইরে যারা বিতর্ক তোলেন, তাদের মানদণ্ডের পার্থক্য কোথায়? একজন যাকে যোগ্য মনে করছেন, তাকে আরেকজন যোগ্য মনে নাও করতে পারেন। একজনের চোখে যিনি সাহিত্য পুরস্কারের যোগ্য, আরেকজনের দৃষ্টিতে তাকে ভালো নাও লাগতে পারে। সাহিত্যে ভালোলাগার ব্যাপারটিই তো আপেক্ষিক। অবশ্য মহৎ সাহিত্য সম্পর্কে সবার মুগ্ধতা থাকে। বিতর্কের পরেও, সেই মুগ্ধতার পরিসর বড়। ফলে সেখানে বিতর্ক ধোপে টেকে না। মহৎ সাহিত্যের গুণই এই।
আবার অনেক সময় যোগ্যতার বিচারের চেয়ে অন্যান্য আপেক্ষিক বিষয়কে যদি প্রাধান্য দেওয়া হয়, তখন যোগ্যরা বাদ পড়ে যেতে পারেন। তবে তেমন উদাহরণের সংখ্যা খুব বেশি নয় হয়তো। প্রকাশ্যে অনেকেই পুরস্কারকে অস্বীকার করেন। পুরস্কার ফিরিয়ে দেওয়া অথবা প্রত্যাখ্যানের তালিকা খুব দীর্ঘ নয়। আবার চেয়ে পুরস্কার নেওয়ার মতো উদাহরণও আমাদের সামনে রয়েছে। নামি পুরস্কারের ক্ষেত্রে যেমন প্রশ্ন তোলার অবকাশ থাকে, তেমনি অনামি পুরস্কারের বেলাতে রয়েছে নানা পরিহাসও। নানাভাবে-নানাজনের যেনতেনপ্রকারেণ একটি পুরস্কার বাগিয়ে নেওয়ারও খবর চাউর হয় মাঝে মাঝে। যা একদিকে যেমন হাস্যরসের জন্ম দেয়, তেমনি কৌতুকেরও।
পুরস্কারেরর ক্ষেত্রে সাহিত্য পুরস্কারের দিকে নজর সাধারণত আগে থাকে। এই একটি বিষয়েই পুরস্কার প্রাপক ও দাতা—উভয়ের সংখ্যাই বেশি। যদিও উভয়ের মানদণ্ডেই সেই সংখ্যাকে হাতের আঙুলে গুনে ফেলা যাবে। পুরস্কার বিষয়ে এই যে এতটা নেতিবাচক প্রচারণা, তাতে মনে হতে পারে অনেক ক্ষেত্রেই হয়তো স্বমহিমা হারিয়ে ফেলছে পুরস্কার। তবু দিল্লি কা লাড্ডুর মতোই পুরস্কারের প্রতি আমাদের আগ্রহ অপার-অসীম।
বাংলাদেশে উপজেলা পর্যায় থেকে শুরু করে রাজধানী পর্যন্ত বিভিন্ন নামে বিভিন্ন পরিচয়ে দেওয়া হয় সাহিত্য পুরস্কার। সেসব পুরস্কারের মধ্যে ব্যক্তি বা সংগঠন পর্যায়ে হাতে গোনা কয়েকটি পুরস্কার সুধী সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও অন্যগুলো আলোচনায় আসে না সাধারণত। আর একুশে ও স্বাধীনতা—রাষ্ট্রীয় এই দুটি পুরস্কারের বাইরে সাহিত্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কার এখনো স্বমহিমায় উজ্জ্বল।
বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫৫ সালে। এই একাডেমির নানা কার্যক্রমের মধ্যে বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার দেওয়ার সিদ্ধান্তের পর ১৯৬০ সাল থেকে এই পুরস্কার দেওয়া শুরু হয়। এই ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনায় রাখা হয়—কবিতা, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ-গবেষণা, ছোটগল্প, শিশুসাহিত্য, আত্মজীবনী, স্মৃতিকথা-ভ্রমণকাহিনী, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি-পরিবেশ ও অনুবাদ সাহিত্য। পুরস্কার শুরুর পর থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন শাখায় বছরে ৯ জনকে দেওয়া হয় এই পুরস্কার। এরপর বছরে দুই জনকে এই পুরস্কার দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় ১৯৮৬ সাল থেকে। ২০০৯ সালে এসে আবার সিদ্ধান্ত পাল্টে শুরু হয় সাহিত্যের চারটি শাখায় পুরস্কার দেওয়া।
প্রথম বার কবিতায় অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছিলেন কবি ফররুখ আহমদ। এরপর একে একে আহসান হাবিব, সুফিয়া কামাল, আবুল হোসেন, সানাউল হক, বে-নজীর আহমদ, তালিম হোসেন, মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা, সৈয়দ আলী আহসান, আল মাহমুদ, শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, সুফী মোতাহার হোসেন, আবুল হাসান, মতিউল ইসলাম, আবদুর রশীদ খান, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ্, কে. এম. শমশের আলী, ইমাউল হক, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, দিলওয়ার, ওমর আলী, রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, বেলাল চৌধুরী, কায়সুল হক, জাহিদুল হক, আবদুল হাই শিকদার, রেজাউদ্দিন স্টালিন, শামসুল ইসলাম, মনজুরে মওলা, ড. মাহবুব সাদিক, অরুণাভ সরকার, রবিউল হুসাইন, রুবী রহমান, নাসির আহমেদ, কামাল চৌধুরী, অসীম সাহা, আবিদ আনোয়ার, সানাউল হক খান, হেলাল হাফিজ, শিহাব সরকার, আলতাফ হোসেন ও আবু হাসান শাহরিয়ার কবিতায় বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন। আর কবিদের মাঝে সাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য মোহাম্মদ রফিক, হুমায়ূন আজাদ, আসাদ চৌধুরী, আবুবকর সিদ্দিক, মুহম্মদ নুরুল হুদা, আজীজুল হক, হাবীবুল্লাহ সিরাজী ও সিকদার আমিনুল হক পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার। মাঝে ১৯৮৫, ১৯৯৭ এবং ২০০০ সাল—এই তিনবার এই পুরস্কার দেওয়া হয়নি। আবার কয়েক বছর কবিতার জন্য কেউ বিবেচিতই হননি।
তর্ক-বিতর্ক যাই থাকুক, এখনো সাহিত্যকরা তো বটেই সাহিত্যমোদীরাও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন বাংলা একাডেমি কবিতা পুরস্কারে কার নাম ঘোষণা করে। জানুয়ারি মাসে বাংলা একাডেমি পুরস্কার ঘোষণা করে। স্বাভাবিকভাবেই এবারও কবিতায় পুরস্কার কে পেতে পারেন, তা নিয়ে আগ্রহ-গুঞ্জন—দুই-ই রয়েছে। চিন্তাসূত্রের প্রাথমিক জরিপে সম্ভাব্য পুরস্কারজয়ীরা হলেন—ময়ূখ চৌধুরী, আসাদ মান্নান, সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল, বিমল গুহ, মাসুদ খান, ফরিদ কবির ও খালেদ হোসাইন।
ময়ূখ চৌধুরী
ময়ূখ চৌধুরী—দশক বিবেচনায় সত্তরের কবি। রাজধানীর বাইরে থাকা কবিরা সাধারণত দৃষ্টির আড়ালেই থাকেন। সেই দৃষ্টি সাধারণের না হলেও মিডিয়ার। প্রচারের আলোয় না থাকলে, কারও নামই সাধারণের কাছে পৌঁছয় না। সেই হিসেবে প্রচার মাধ্যমের যথাযথ আনুকূল্য না পেয়ে যদি সাধারণ পাঠকের কাছে অনালোচিত-অনাবিষ্কৃত থেকে যান কবি ময়ূখ চৌধুরী, তবু কাব্যবোদ্ধাদের আগ্রহের তালিকায় তিনি প্রথম সারিতেই রয়েছেন। ১৯৫০ সালে জন্ম নেওয়া ময়ূখ চৌধুরী প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৮৯ সালে। অথচ তার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৫ সালে। প্রায় বিশ বছর লেখার পর, তিনি নিজের প্রথম বই প্রকাশের পথে হেঁটেছেন। স্বাধীনতার আগে ষাটের দশকে তিনি সম্পাদনা করেছেন ‘প্রতীতি’ নামের সাহিত্যের কাগজ। ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত এই কাগজের প্রচ্ছদশিল্পীও ছিলেন তিনি। সত্তর ও ষাটের দশকের সাহিত্যচর্চা শুরু করলেও তিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন আশির দশকে প্রথম কবিতার বই প্রকাশের পর। প্রথম কবিতার বই ছিল ‘কালো বরফের প্রতিবেশী’। আবার প্রথম বই প্রকাশের পরেও তিনি অপেক্ষা করেছেন প্রায় এক দশক। ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত তার দ্বিতীয় কবিতার বই ‘অর্ধেক রয়েছি জলে অর্ধেক জালে’। ময়ূখ চৌধুরীর প্রায় ছয় দশকের লেখলেখির ভেতরে প্রকাশিত কবিতার বই মাত্র সাতটি। এই সাতটি কবিতার বই দিয়েই তিনি চিনিয়েছেন নিজের স্বাতন্ত্র্য। তার অন্যান্য কবিতার বইয়ের মধ্যে রয়েছে—‘তোমার জানলায় আমি জেগে আছি চন্দ্রমল্লিকা’; ‘প্যারিসের নীলরুটি’; ‘আমার আসতে একটু দেরি হতে পারে’; ‘পলাতক পেণ্ডুলাম’; ‘ক্যাঙ্গারুর বুকপকেট’; ‘পিরামিড সংসার’; ‘চরণেরা হেঁটে যাচ্ছে মুণ্ডুহীন’। তিনি কবিতায় বলেন,
নিজের আগুনে পুড়ে রয়ে গেছি অবুজ সবুজ।
তোমাকে রচনা করি এ রকম সাধ্য বলো কই!
দ্বিদল দরজা খোলো, আমাকে রচনা করো, কবিতাকুমারী।
(কবিতা, তোমার দরজায়: অর্ধেক রয়েছি জলে অর্ধেক জালে)
ময়ূখ চৌধুরী কবিতার দরজা খোলার সাধনায় রত। সেই সাধনার পথে তিনি ব্যক্তি আমিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। আর ব্যক্তি আমিকে ফুটিয়ে তুলতে তার কবিতায় ভর করেছে ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার। উপমা, চিত্রকল্প ও ছন্দের নানামুখী ব্যবহারের মধ্য দিয়ে ময়ূখ চৌধুরী নিজের জন্য যে পথ খুঁজেছেন, সেই পথে হেঁটেই তিনি বাংলা কাবিতাকে দিতে চেয়েছেন নতুন স্বর। যেখানে খুঁজে পাওয়া যায় চিরকালীন বাংলাদেশ। ময়ূখ চৌধুরী তার কবিতায় একইসঙ্গে ধরে রাখেন যুক্তি ও সত্যের সেতু। যা পাঠককে উৎসাহিত করে তোলে তাকে বহুবার বহুভাবে পাঠ করতে। উৎসাহিত করে তোলেন। খুব অল্প লিখেও ময়ূখ চৌধুরী তৈরি করেছেন আলাদা পথ; যে পথে পৌঁছার জন্য তিনি সতত চেষ্টা করেছেন—‘আমি বুক ঘষে-ঘষে তোমার দরজায় পৌঁছুতে চাই।’ যদিও তিনি মনে করেছেন, ‘আমার অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে, অনেক দেরি করে ফেলেছি আমি’ (হে কবিতা, অপেক্ষা করো); তবে সেই দেরি প্রকৃত শিল্পের কাছে, প্রকৃত কবিতার কাছে তাকে পৌঁছে দিয়েছে, বাংলা কবিতার ইতিহাস তা ধরে রাখবে। কারণ, ‘একটা পাণ্ডুলিপি আমি রেখে যাবো মনের মতন’ বলে যে প্রত্যয় ঘোষণা করেছেন, তা প্রকৃত কবির আস্থা, রয়ে যাওয়ার বাসনা। সৎ ও প্রকৃত শিল্পীই এমন উচ্চারণে নিজেকে ব্যক্ত করেন। কবিতার পাশাপাশি ময়ূখ চৌধুরী গবেষণা প্রবন্ধ, উপন্যাস, গল্প লিখেও পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন।
আসাদ মান্নান
বাংলা একাডেমি পুরস্কারের আরেক দাবিদার কবি আসাদ মান্নান। ১৯৫৭ সালে সমুদ্র তীরের সন্দ্বীপে বেড়ে ওঠা আসাদ মান্নানের প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময়ে। প্রথম কবিতার বই ‘সূর্যাস্তের উল্টোদিকে’ প্রকাশিত হয় ১৯৮১ সালে। ঠিক দুই বছর পর বের হয় দ্বিতীয় কবিতার বই ‘সৈয়দ বংশের ফুল’। এই বই চিনিয়ে দেয় কবির স্বরূপ। সৈয়দ বংশের ফুলের মধ্য দিয়েই পাঠক একজন সম্পূর্ণ প্রস্তুত কবির দেখা পান। তার আগমন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তার শব্দ, কল্পনা ও ভাষার দক্ষতার সঙ্গে পাঠকের সেতু তৈরি হয়। এরপর ‘তুমি মৃত অজগর কোথায় পালাবে’, ‘দ্বিতীয় জন্মের দিকে’, ‘ভালোবাসার আগুনের নদী’, ‘সুন্দর দক্ষিণে থাকে’, ‘কাফনের ছায়ালিপি’, ‘যে-পারে পার নেই সে-পারে ফিরবে নদী’, ‘হে অন্ধ জলের রাজা’ প্রভূতি কবিতার বইয়ের ভেতর দিয়ে আসাদ মান্নান বাংলা কবিতার ভাণ্ডারে নিজের অবস্থানকেই শুধু শক্ত করেননি, একইসঙ্গে তিনি পরের প্রজন্মকে স্বপ্নও দেখিয়েছেন নতুন পথ নির্মাণের। ছন্দের ব্যবহার ও মুসলিম পারিবারিক জীবনের নানান অনুষঙ্গ তার কবিতাকে দিয়েছে আলাদা দ্যোতনা। সমাজ ও রাজনীতিকে বাদ দিয়ে তিনি শিল্পচর্চা করেননি, ফলে তার কবিতা এড়িয়ে যায়নি রাজনৈতিক প্রসঙ্গ। তার কবিতায় যেমন জড়িয়ে আছে যাপিত জীবন তেমনি আমাদের রাজনৈতিক জীবনকেও তিনি শিল্পের চাদরে মুড়ে উপস্থাপন করেছেন। ফলে একদিকে যেমন তিনি অসুন্দরের প্রতি তীব্র আক্রমণ ছুড়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন, তেমনিভাবে সুন্দরের প্রতি তার মুগ্ধতাও প্রকাশ করেছেন দ্বিধাহীনভাবে। আর এই দুইয়ের সমন্বয়েই আলাদা সৌন্দর্যের আধার হয়ে উঠেছে তার কবিতা:
যদি নামে ঘুমরাত রাত্রিহীন জ্যোৎস্নার চূড়ায়
যদি আসে ফুলভোর সূর্যহীন দিনের কবরে
যদি ডাকে প্রেমঝড় বোশেখের বটের মুড়ায়
তবে কি আগুন জ্বলবে নষ্টভ্রষ্ট পতিতানগরে?
(যদি নামে ঘুমরাত: আসাদ মান্নান)
জীবন ও প্রকৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আসাদ মান্নান কবিতায় খুঁজে ফেরেন নিজস্বতা। সেখানে জড়াজড়ি করে উপস্থিত থাকে স্বদেশ, মুক্তিযুদ্ধ আর মানুষ। এসবের সমন্বয়ে আসাদ মান্নান যে স্বর নির্মাণ করেন—তার স্বাতন্ত্র্যই তাকে পুনঃপুনঃ পাঠ করতে বাধ্য করে। তার সম্পর্কে কৌতূহল জাগিয়ে রাখে।
মাসুদ খান
১৯৫৯ সালে জয়পুরহাট জেলার ক্ষেতলালে জন্মগ্রহণকারী মাসুদ খান আশির দশকের কবি হিসেবে স্বীকৃত। ১৯৯৩ সালের প্রথম কবিতার বই প্রকাশ। সেই ‘পাখি তীর্থ দিনে’ দিয়েই পাঠক-সমালোচকদের দৃষ্টি কাড়েন। যদিও প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৯ সালে। প্রথম কবিতার বইয়ে যেমন, তেমনি দ্বিতীয় কবিতার বই ‘নদী কূলে করি বাস’-এও তিনি পাঠকের মনোযোগ ধরে রাখতে সক্ষম হন। সেই ধারাবাহিকতা থেকে যায় তার ‘সরাইখানা ও হারানো মানুষ’, ‘আঁধারতমা আলোকরূপে তোমায় আমি জানি’, ‘এই ধীর কমলাপ্রবণ সন্ধ্যায়’ এবং ‘দেহ-অতিরিক্ত জ্বর’-এও। কবিতার পরীক্ষা-নিরীক্ষা, স্বতন্ত্র সুর নির্মাণ এবং কাব্যভাষায় বিজ্ঞানগন্ধী শব্দ প্রয়োগের কুশলতায় মাসুদ খানের নাম গত কয়েক বছর ধরেই আলোচিত। কবিতায় অধিবাস্তবতা, রোমান্টিকতা, ফ্যান্টাসি-ফিকশন নির্মাণের ঝোঁক ও প্রবণতার ভেতর দিয়ে মাসুদ খানের কবিতা হয়ে উঠেছে এক অনন্য মহাদেশ।
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল
সত্তর দশকের কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালের জন্ম ১৯৫৮ সালে। অর্ধশতাধিক বইয়ের লেখক সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল কবিতার পাশাপাশি সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি শাখাতেই নিজের সুদৃঢ় অবস্থান জানান দিয়েছেন।
রক্তমাখা ছুরি কোথায় ধুবে? কোন
পানিজলে?
ইহুদি-নদীতেও রক্তজল!
জবাইযন্ত্রণা থেকে ছিটকানো—
মাংস-মগজ দিয়ে বারবিকিউ বানাও।
খাও রক্তস্যুপ!গাজার লোভে জেরুজালেমের জালেম—
শিশুদের কল্লা নিয়ে ছকার খেলে,
মেলে ঈগলের ডানা
তাঁদের জন্য কেউ কেউ তৈরি করে
রুটি ও রুটিন!রক্তমাখা অস্থির অক্ষর দিয়ে আবারো
কি লেখা হবে:
(অল কান্ট্রিস অব দ্য ওয়ার্ল্ড এক্সেপ্ট ইসরাইল: সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল)
শিল্পের জন্য শিল্পের ধারণার বিপরীতে জীবনের জন্য শিল্পকেই সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল তার কবিতার উপজীব্য করে তুলেছেন। তার কবিতায় একইসঙ্গে উঠে এসেছে নাগরিক মনের সঙ্গে বাংলার গ্রামীণ আবহ। তিনি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াকেও শিল্পের তুলিতে আঁচড় দিয়ে ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলেছেন।
ফরিদ কবির
ফরিদ কবিরের জন্ম ১৯৫৯ সালে। আশির দশকের এই কবির প্রথম কবিতার বই— ‘হৃদপিণ্ডে রক্তপাত’। এরপর ‘ওড়ে ঘুম ওড়ে গাঙচিল’, ‘অনন্ত দরোজাগুচ্ছ’, ‘মন্ত্র’, ‘ওঁ প্রকৃতি ওঁ প্রেম’ শিরোনামে তার আর মাত্র চারটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে।
ট্রেন আমাদের নামিয়ে দিয়ে গেল
মাঝপথে, অচেনা স্টেশনে
মানুষ যেখানে যেতে চায় সেটাই কি গন্তব্য?
নাকি, তারা যেখানে নামে?
নাকি, গন্তব্যই খুঁজে নেয় তার নিজস্ব মানুষ!বিহ্বল স্টেশনে নেমে আমরাও ভাবি—
এখানেই কি নামতে চেয়েছি
নাকি, ট্রেনই নামিয়ে দিয়ে গেছে আমাদের
এই ঘন কুয়াশারাত্রিতে!যেখানে নেমেছি, কিংবা যেখানে যাওয়ার কথা ছিল
কিছুই আসলে সত্য নয়আমাদের চোখের সামনে শুধু ছবি হয়ে থাকে
ট্রেনের জানালা
আর, খুব দ্রুত ছুটে চলা যমুনা ব্রিজ…
(ট্রেন: ফরিদ কবির)
মাত্র পাঁচটি কবিতার বইয়ে প্রায় দুইশত কবিতা লিখেই ফরিদ কবির আশির দশকের কাব্যভাষায় যে নতুন সুর শুনিয়েছেন, বাংলা কবিতাকে তার পূর্বতন দশকের ধারা থেকে বের করে এনে নতুন গন্তব্য খুঁজে দিয়েছেন, সেই সুর নতুন এবং তা বিস্ময়ের জন্ম দেয়।
খালেদ হোসাইন
খালেদ হোসাইনের জন্ম ১৯৬৪ সালে। প্রথম কবিতার বই ‘ইলামিত্র ও অন্যান্য কবিতা’। আশির দশকের এই কবির প্রকাশিত কবিতার বই আটটি।
শেষোক্ত এই তিন কবি—সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল, ফরিদ কবির, খালেদ হোসাইনের পরিচয় শুধু কবি পরিচয়েই সীমাবদ্ধ নন। তারা একইসঙ্গে সাহিত্যের অন্যান্য শাখাতেও নিজেদের অবস্থান জানান দিয়েছেন। পাঠক কবি পরিচয়ের বাইরে এসেও তাদের গল্প, প্রবন্ধ, ভ্রমণ অথবা আত্মজৈবনিক রচনার রস আস্বাদন করে তৃপ্ত হয়েছেন। এর বাইরে আরও একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি রয়েছেন, তিনি বিমল গুহ।
আলোচনায় থাকা এই কবিদের কারও হাতেই হয়তো শোভা পাবে এবারের বাংলা একাডেমি পুরস্কার। হয়তো অন্য কারও হাতে। হয়তো সম্পূর্ণ অনালোচিত কারও হাতে। হয়তো তালিকার বাইরে থাকা প্রান্তিকের অন্য কোনো কবি, যিনি কবিতার দ্যুতিতে আলোকিত হলেও, আধুনিক প্রচারযন্ত্রের আলোর আনুকূল্য পাননি, হয়তো তিনিই হাতে তুলে নেবেন বাংলা একাডেমি কবিতা পুরস্কারের সম্মান। এটা জানার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতেই হবে।