এক.
রবীন্দ্রনাথের ‘নৌকাডুবি’ উপন্যাস খুশি করতে পারেনি সমালোচকদের। তারা ধরেই নিয়েছিলেন কালসলিলে ‘নৌকাডুবি’র ভরাডুবি হবে। ‘দেবদাস’ লিখে শেষ করার পর শরৎচন্দ্রের মনে হয়েছিল হালকা লেখা, শুধু সময়ের অপচয়। তাই প্রকাশ করতে দ্বিধা ছিল মনে। অথচ বর্তমানে পাঠকের হাতে রবীন্দ্র-উপন্যাসের যে শর্টলিস্ট আছে, তার মধ্যে ‘নৌকাডুবি’ একটি। শরৎচন্দ্রের নাম বললেই অধিকাংশ পাঠকের মনে পড়ে যে দু’টি উপন্যাসের নাম, নির্দ্বিধায় বলা যায় ‘দেবদাস’ সেগুলোর একটি। এ প্রসঙ্গ টানার হেতু এই, সৃষ্টি সম্পর্কে স্বয়ং লেখক কিংবা সমালোচক কারও বাণীই আপ্তবাক্য নয়। কখনো কখনো তাদের বিপরীত ধারায় প্রবাহিত হয় পাঠকের রুচি। নগদ হিসেবে যাকে অপাঙ্ক্তেয় মনে হয়, কালের বিচারে সে-ই হয়ে ওঠে মহামন্ত্র। সাহিত্যের বাজারে তা আকছার ঘটছে। উপর্যুক্ত কথাগুলো বলার কিছু কারণ আছে। শামসুর রাহমান নিয়ে দু’চারটি কথা বলার গৌরচন্দ্রিকা হিসেবে এই প্রসঙ্গ উত্থাপন করলাম।
শামুসর রাহমান প্রয়াত হয়েছেন প্রায় একযুগ। বিগত শতকের পঞ্চাশ দশকে তিনি বাংলা কাব্যমঞ্চে আবির্ভূত হন এবং প্রায় সাড়ে পাঁচ দশক তিনি কাব্য শস্যের আবাদ করেছেন। এই বিশাল কালপরিসরে বাংলাদেশের ইতিহাস, সংগ্রাম, চাওয়া, পাওয়া, না-পাওয়া, স্বপ্ন, স্বপ্নভঙ্গের বেদনার কাব্যিক দলিল তার কবিতা।
দুই.
স্বাধীনতা দিবসে যদি কোনো কবিতা পাঠের আসরে যান, তবে আমার মতো আপনারও একটি অভিজ্ঞতা হবে আশা করি। সদ্য গোঁফ গজানো বা গোঁফ না গজানো কোনো এক নবীন কবির কবিতার শিরোনাম শুনে আপনি চমকে উঠতে পারেন। চমকাতে পারেন তার কবিতার পঙ্ক্তি শুনে। অবশ্য সে চমক কেটে যাবে সঙ্গে সঙ্গেই পরের পঙ্ক্তি শুনলেই। তবে সেই নবীন কবির কবিতার শিরোনাম ‘স্বাধীনতা তুমি’ কিংবা কবির কাছে স্বাধীনতা কিভাবে প্রতিভাত হয়েছে, তা শুনতে শুনতে আপনার নিশ্চয় মনে পড়বে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রচিত একটি শ্রেষ্ঠ কবিতার নাম। মনে পড়বে এই কবির নাম। হ্যাঁ, তিনি শামসুর রাহমান। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে তিনি ছড়িয়ে পড়ছেন। তিনি আমাদের বাতিঘর। তার দীর্ঘ কাব্যজীবনে তৈরি করে দিয়ে গেছেন আমাদের প্রাণের ভাষা, চেতনার ভাষা, প্রতিবাদের ভাষা, প্রেমের ভাষা।
তিন.
যদি বাঁচি চার দশকের বেশি
লিখব।
যদি বাঁচি দুই দশকের কম
লিখব।
যদি বেঁচে যাই দু’চার বছর
লিখব।
যদি বেঁচে যাই একমাস কাল
লিখব।
যদি বেঁচে যাই একদিন আরো
লিখব।
(ইচ্ছা)
কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে কবি হাসান হাফিজুর রহমান লিখেছিলেন, ‘যে অন্তর্জ্বালা অনির্বাণ আলোর মতো জ্বলতে থাকলে কবি-হৃদয় অনন্ত সৃজনীমুখর থাকে, নজরুলের তা ছিল।’ ঠিক এ কথাটি শামসুর রাহমানের জন্যও প্রযোজ্য। তার প্রমাণ উপরিউক্ত কবিতা, তার প্রমাণ শামসুর রাহমানের কাব্যভূমণ্ডল। শামসুর রাহমানের কবিতাশস্যের দিকে তাকালে আমাদের বিস্মিত হতে হয় তার প্রাচুর্য দেখে। আমৃত্যু তিনি লিখে গেছেন। লেখার জন্য সবসময় এক অস্থিরতা কাজ করতো তার মাঝে। তাকে কাছ থেকে যারা দেখেছেন, অনেকেই স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছেন, তিনি দুই-এক দিন কবিতা না লিখতে পারলেই কেমন অস্থির হয়ে উঠতেন। শামসুর রাহমান তার স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেছেন, কাব্যদেবী কখনো অবহেলা সহ্য করেন না। তাই কাব্যদেবী যখনই তাকে ডেকেছেন, তিনি সাড়া দিয়েছেন।
চার.
এখন রাজতন্ত্র নেই। নেই রাজসভার সভাকবি। কবিগণ এখন কোনো উপাধি পান না রাজাদের কাছ থেকে। যদিও কবিদের নামের পাশে আমরা উপাধির তিলক দেখতে ভালোবাসি। তাই রবীন্দ্রনাথের নামের পাশে বিশ্বকবি, নজরুলের নামের পাশে বিদ্রোহী কবি, জসীমউদ্দীনের নামের পাশে পল্লীকবি উপাধি দেখে আমরা পুলকিত হই। শামসুর রাহমানকে আমরা প্রথমে ‘নাগরিক কবি’র নাগপাশে আবদ্ধ করেছি, তারপর তাকে বরণ করেছি দেশের ‘প্রধান কবি’ রূপে। আমরা স্বীকার করি শামসুর রাহমান এ দুটো উপাধির যথার্থ দাবিদার। যদিও এখন প্রশ্ন উঠেছে, শামসুর রাহমান মৃত্যুর এক দশকের মধ্যেই হারিয়ে যেতে বসেছে কি না?
প্রশ্ন উঠতে পারে। কেউই, কিছুই প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়। শামসুর রাহমান সম্পর্কে উত্থাপিত প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দেওয়ার জন্য ঢাউস আকারে সন্দর্ভ রচনা করলেও প্রশ্নের মীমাংসা হবে কি না, সন্দেহ। তাই আমরা শুধু কয়েকটা দিক আলোচনা করব, এই প্রশ্নের উত্তরের একটি ধারণা পাওয়ার জন্য।
একজন কবি বর্তমান সময়ে কতটুকু প্রাসঙ্গিক বা অপ্রাসঙ্গিক, তা নির্ভর করে তিনি কত বড় কবি, তার ওপর। বড় কবি কাদের বলব? এই প্রশ্নের আগে আমরা কয়েকজন বড় কবির নামোল্লেখ করতে চাই। তিরিশের পাঁচ কবি যাঁরা পঞ্চপাণ্ডব হিসেবে বাংলা সাহিত্যে পরিচিত, বড় কবি হিসেবে তাদের নাম উল্লেখ করলে নিশ্চয় কেউ দ্বিধা কিংবা সংশয় প্রকাশ করবে না। যদিও এই বড় পাঁচ কবিদের মধ্যে জীবনানন্দ ব্যতীত অন্য চারজন বর্তমানে একেবারেই অপঠিত। এই কথা শুনে অনেকেই কানে আঙুল দিতে পারেন, কেউ বা অর্বাচীন বলে গালিও দিতে পারেন। তবে কথা সত্য, তাদের প্রতি এই পাঠবিমুখতা শুরু হয়েছে আরও আগে থেকে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্রছাত্রী ছাড়া মুষ্ঠিমেয় কিছু লোক তাদের কবিতা পড়ে। যাদের অধিকাংশ-ই এই মান্যবর কবিদের শ্রেষ্ঠ কবিতা নামক বইয়ের কয়েক পৃষ্ঠা উল্টিয়ে কবিতা পাঠে ক্ষান্ত হন। এই কথা বলার কারণ অপঠিত হয়ে পড়লেই যে কবি হিসেবে কেউ ছোট হয়ে পড়বে, তা নয়। বরং ক্ষেত্র বিশেষে বলা যায়, কিছু কিছু কবির কবিতা না পড়লে পাঠকের মনের দৈন্য ঘোচে না।
এবার আসি বড় কবি কাদের বলা যেতে পারে। একজন কবি যখন তার কালের অন্য কবিদের চেয়ে উৎকৃষ্ট হন, যখন নতুন বোধের জন্ম দেন, নির্মাণ করেন স্বতন্ত্র স্বর, এমন কিছু তার শিল্পকর্মে তুলে ধরেন, যা আগে কারও রচনায় দেখা যায়নি, সমকালীন অভিজ্ঞতাকে যখন চিরায়ত রূপ দান করেন, তার কবিতা যখন প্রভাব বিস্তার করে পরবর্তী প্রজন্ম বা অন্য কারও ওপর, তখন তাকে বড় কবি বলে চিহ্নিত করা যায়।
প্রশ্ন হতেই পারে শামসুর রাহমানের মাঝে কি এইসব গুণ-ই ছিল? উত্তর হবে, হ্যাঁ, অনেকাংশেই ছিল। শামসুর রাহমান মারা গেলেও তার পরবর্তী প্রজন্মের অনেক কবির চেয়ে পাঠকের কাছে এখনো তিনি বেশ ভালোভাবে জীবিত। তার ‘দুঃখ’, ‘কখনও আমার মাকে’, ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’, ‘আসাদের শার্ট, ‘বারবার ফিরে আসে’, ‘স্বাধীনতা তুমি’, ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’ কিংবা ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’ কবিতার নাম যারা বলতে পারবে, তাদের অনেকই তার উত্তরপ্রজন্মের অনেক কবির এতগুলো কবিতার নাম স্মরণ করে বলতে পারবে না। এই কবিতাগুলো তার সমকালীন অভিজ্ঞতার রসে সিক্ত হয়ে ধ্রুপদী কবিতার মর্যাদা লাভ করেছে। শামসুর রাহমান অক্ষরবৃত্ত ছন্দকে ব্যবহার করেছেন তার নিজস্ব ঢঙে, নিটোল অক্ষরবৃত্ত ছন্দের মধ্যে তিনি গুঁজে দিয়েছেন গদ্যের ব্যঞ্জনা। বাংলা ভাষার অন্যান্য ছন্দ ব্যবহারেও দেখিয়েছে পারঙ্গমতা।
শামসুর রাহমানের কবিতা থেকে সুপ্রচুর উজ্জ্বল পঙ্ক্তি চয়ন করা যাবে, যা পাঠান্তে পাঠকের মনে হবে এই তো আমার এই মুহূর্তের অনুভূতি। এ রকম কয়েকটি কয়েকটি উদাহরণ উদ্ধার করা যাক:
ক.
যখন তোমার সঙ্গে আমার হলো দেখা
. লেকের ধারে সঙ্গোপনে,
বিশ্বে তখন মন্দা ভীষণ, রাজায়-রাজায়
. চলছে লড়াই উলুর বনে।
(প্রেমের কবিতা: নিরালোকে দিব্যরথ)
খ.
আমার নিঃসঙ্গতায় মর্মরিত হয়
দূর শতাব্দীর হাওয়া, বয় নূহের কালের ঢেউ
(এই রক্তধারা যায়: হোমারের স্বপ্নময় হাত)
গ.
ভীষণ অসুস্থ আমি, শ্বাসরোধকারী
আমার ব্যাধির কথা জানে নীলিমা, পাখির ঝাঁক, গাছগাছালি
আর জানে ক্ষয়িষ্ণু স্বপ্নসম্ভব
আমার ঘরের চার দেয়াল। অসুস্থতা নেকড়ের মতো
চিবিয়ে খাচ্ছে আমার মেদমজ্জা।
(রেডক্রসের গাড়ি এবং তুমি: উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ)
ঘ.
উদ্ভট উটের পিছে চলেছে স্বদেশ বিরানায়; মুক্তিযুদ্ধ,
হায়, বৃথা যায়, বৃথা যায়, বৃথা যায়।
(উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ: উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ)
এ রকম আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যাবে শামসুর রাহমানের কবিতা থেকে। কবিতা নিয়ে কথা বলার সময় হয়তো কবিতার পাঠকের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। যদি জরিপ করা হয়, পাঠ্য বইয়ের বাইরে কবিতার পাঠকের সংখ্যা কত? যে ফল পাওয়া যাবে, তা হতাশাব্যঞ্জক না হলেও (কবিতার পাঠক সব সময়ই কম) নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক নয়। তা
রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা কবিতা যেমন এগিয়েছে, তিরিশের কবিদের পর বাংলা কবিতা যেমন থেমে থাকেনি, তেমনি শামসুর রাহমানের পরও বাংলা কবিতা এগিয়ে গেছে, যাচ্ছে, যাবে। এটাই বাস্তবতা। কিন্তু যারা বলেন, বাংলা কবিতার পাঠকের কাছে শামসুর রাহমানের কবিতার উপযোগিতা হারিয়ে গেছে, তারা সত্যের অপলাপ করেন। শামসুর রাহমানের বক্তব্য প্রোজ্জ্বল, উজ্জ্বল চিত্রকল্প, উপমা, রূপক, প্রতীক সংবলিত কবিতা ঘুরেফিরেই আমাদের মাঝে উচ্চারিত হবে, পঠিত হবে। আমাদের স্বাধীনতা উৎসবে, বিজয় দিবসের উৎসবে আমরা তার কবিতা পড়ব। ভাষার মাসে আমরা তার কবিতা পড়ব। প্রেমে যখন উদ্বেল হয়ে পড়ব, তখন তার কবিতা পড়ব। কোনো অত্যাচারীর প্রতি ঘৃণা জানাতে আমরা তার কবিতা পড়ব। তারপরও যদি কেউ বলেন, শামসুর রাহমানের বিপুল কাব্যসম্ভারের মাঝে এ তো বিন্দুবৎ, তখন তাকে মনে করিয়ে দিন, একটি কবিতাও কালের প্রাচীর পেরিয়ে মহাকালের মঞ্চে অধিষ্ঠান করে নেওয়া অনেক বড় বিষয়। কেউ যদি পঠনের নিরিখে তার বড়ত্ব মাপতে চায়, তাকে বিনীতভাবে বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত অমিয় চক্রবর্তী প্রমুখের কথা স্মরণ করিয়ে দেব, যারা ইতোমধ্যে পাঠ-বিরল হয়ে উঠেছেন।