কাজুও ইশিগুরো। জাপানি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ কথাসাহিত্যিক। ২০১৭ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
এখানে প্রথমেই বলে রাখি, কাজুও ইশিগুরোকে এই প্রজন্মের কাছে অপরিচিত লেখক হিসেবে জানতাম। কিন্তু নোবেল বিজয়ের পর অনেক নতুন পাঠক তাকে নতুন করে জানেন। এসব পাঠকের টেবিলে যুক্ত হয় তার গল্প, উপন্যাস। আর পড়ার পর পাঠকরা উপলব্ধি করার চেষ্টা করেন, তার গদ্যের সরলতা, সহজ ভাষা। তার গল্পের নির্মাণশৈলী। শুধু তাই নয়, কাজুও ইশিগুরোর সমসাময়িক লেখক সালমান রুশদি, জুলিয়ান বার্নস, মার্টিন আমিস ও জন বানভিলের সঙ্গে ইশিগুরোর সাহিত্য নিয়ে তুলনামূলক মূল্যায়ন করতে পারবেন পাঠকরা।
তবে বলা যায়, কাজুও ইশিগুরোর উপন্যাসের ভাষা, চিত্রায়ণ, সময়কাল তাদের সঙ্গে মিলবে না।
ইশিগুরোর লেখায় রয়েছে চতুর শব্দ খেলা বা একটি বাক্য, যা পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। যেমন তিনি লিখেছেনম ‘চায়ের ঘর থেকে বাগান স্পষ্ট দেখা যায়। আমি যেখানে বসেছি, সেখানে থেকে পুরনো আমলের পানির কুয়া ঠাহর করতে পারছি। ছেলেবেলায় এই কুয়াটা আমার কাছে ভুতুড়ে লাগতো। ওটা এখন গাছপালার ঝোঁপের আড়ালে সামান্য দেখা যায়। ইতোমধ্যে সূর্য অনেকটা পশ্চিমাকাশের নিচে নেমে গেছে। বাগানের অনেকটা অংশ ছায়ায় ঢাকা। আমি খুবই খুশি হয়েছি যে, তুমি ফিরে আসার জন্য মনস্থির করেছ, বাবা বললেন। একটু থেমে তিনি আরও বললেন, আশা করি, নিশ্চয় অল্প কয়েকদিনের জন্য আসোনি। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে আমি এখনো সঠিক কিছু জানি না।’(কাজুও ইশিগুরোর গল্প, পারিবারিক ভোজ ॥ অনুবাদ: ফজল হাসান)।
ইশিগুরোর সাহিত্যের ভাষা সহজেই পাঠককে বিমোহিত করে। তার শব্দের মনোনয়ন অপ্রচলিত, কিন্তু পাঠককে ছুঁয়ে যায় গল্পের চরিত্রগুলোকে। পরাবাস্তবতা, জাদুবাস্তবতা কিংবা তার অন্য লেখা-সব মিলিয়ে তিনি সৃষ্টি করেন অন্যরকম ভুবন। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে। যেমন তিনি লিখেছেন, ‘একটা রোগা পটকা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ি। দরজার ওপরের কড়িকাঠ খুব নিচু; ঢুকতে গেলে আমাকে অবশ্যই একদম কুঁজো হতে হবে। দরজার প্রান্তের নিচ দিয়ে ক্ষীণ আলো জিভ বের করে দিয়েছে বাইরের দিকে। ভেতরে লোকজন আছে; তাদের কথা ও হাসির শব্দ শুনতে পাচ্ছি। আমি খুব জোরে কড়া নাড়ি, যেন তাদের কথা বলার ভেতর দিয়েই আমার শব্দ শুনতে পায় তারা। কিন্তু ঠিক ওই মুহূর্তেই আমার পেছনের দিক থেকে একজন বলে ওঠে, হ্যালো। তাকিয়ে দেখতে পাই বছর বিশেক বয়সী একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে ছেঁড়া জিন্স ও ন্যাতানো জাম্পার। আমার থেকে একটু দূরে অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে সে। মেয়েটা বলে, একটু আগে আপনি আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে এসেছেন। আমি আপনাকে ডাক দিয়েছিলাম। আপনি শুনতে পাননি মনে হয়।’ (কাজুও ইশিগুরোর গল্প সাঁঝের পরের গ্রাম ॥ অনুবাদ: দুলাল আল মনসুর)।
নাগাসাকিতে জন্ম এই লেখকের। তবে আণবিক বোমার ধ্বংসযজ্ঞের ইতিহাস ইশিগুরো প্রথম জানতে পারেন যুক্তরাজ্যে পাঠ্যবইয়ে। নিজের পিতৃভূমিতে আবার তার পা পড়েছিল প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর।
কাজুও ইশিগুরো গল্পের কাহিনি ও চরিত্র নির্মাণে সবসময় নতুনত্ব দেখিয়েছেন। পুরনো কাঠামো ভেঙে নতুন ধারার একজন আধুনিক লেখক তিনি। গল্প, উপন্যাসে তৈরি করেছেন ভাষার নিজস্বতা। তার তৃতীয় উপন্যাসের কথা এখানে উল্লেখ করছি। ১৯৮৯ সালে তৃতীয় উপন্যাস ‘দ্য রিমেইন অব দ্য ডে’ প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাসটি তিনি মাত্র চার সপ্তাহে লিখেছিলেন। এ উপন্যাসের জন্য তিনি সম্মানজনক ম্যান বুকার প্রাইজ বিজয়ী হন।
৬২ বছর বয়সী কাজুও ইশিগুরোর বহু সৃষ্টিই সমাদার পেয়েছে বিশ্বসাহিত্যে। প্রথম উপন্যাসেই নিজেকে নিয়ে গেছেন এক অনন্য উচ্চতায়। ১৯৮২ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম উপন্যাস ‘এ পেল ভিউ অব হিলস’৷ বিশ্বের ৪০টিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে তার উপন্যাস। ‘দ্য বারিড জায়ান্ট’উপন্যাসে তিনি খুব সুন্দরভাবে স্মৃতির সঙ্গে বিস্মৃতি, অতীতের সঙ্গে বর্তমান এবং কল্পনার সঙ্গে বাস্তবের মেলবন্ধন ঘটান৷ ইশিগুরোর লেখার ধরন, চিন্তা-ভাবনা এবং তার গল্পের বিষয়-আশয় সমসাময়িক অনেক লেখকের তুলনায় ব্যতিক্রমী। ২০১৬ সালে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘উদারনৈতিক গণতন্ত্রে সব মানুষ এক নৌকার যাত্রী। তাদের মধ্যে কোনো উঁচু-নিচু নেই। কিন্তু, আমরা এমন একটি সময়ের দিকে এগিয়ে চলেছি, যখন অন্যদের তুলনায় কিছুটা উচ্চতর মানুষ তৈরি হবে। সেদিন সাম্য বলে আর কিছু থাকবে না।’
মানবজীবনের রহস্যময় দিকগুলো নিয়ে গল্পের এক সাগর সম্ভার তৈরি করেছেন ইশিগুরো। ‘অ্যান আর্টিস্ট অব দ্য ফ্লোটিং ওয়ার্ল্ড’, ‘দ্য আনকনসোলড’, ‘দ্য বেরিড জায়ান্ট’—এসব উপন্যাসই তার নিদর্শন বহন করে। নোবেল পুরস্কারের ঘোষণায় বলা হয়েছে, ‘তার উপন্যাসের শক্তিশালী আবেগী শক্তি বিশ্বের সঙ্গে আমাদের সম্মোহিত সত্তার উন্মোচন করেছে। এই লেখক নিজের আদর্শ ঠিক রেখে, আবেগপ্রবণ শক্তি দিয়ে বিশ্বের সঙ্গে আমাদের সংযোগ ঘটিয়েছেন।’
২০১৭ সালে সুইডিশ একাডেমির স্থায়ী সেক্রেটারি সারা দানিউস জানান, তার কাছে ইশিগুরোর লেখা সবচেয়ে পছন্দের উপন্যাসটা হলো ‘দ্য বেরিড জায়ান্ট’। তবে, ‘রিমেইন্স অব দ্য ডে’কে সত্যিকারের ‘মাস্টারপিস’বলে আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ‘তীব্র আবেগমথিত উপন্যাসগুলোর মধ্যে দিয়ে কাজুও ইশিগুরো উন্মোচন করেছেন বাস্তব দুনিয়ার মায়ার আড়ালের গভীর শূন্যতাকে।’
নোবেল জয়ের খবর প্রকাশের পর কাজুও ইশিগুরো অনুভূতি প্রকাশ করে বলেন, ‘আমি অবাক হয়েছি, হতবিহ্বল হয়ে পড়েছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘এটা অবশ্যই দারুণ সম্মানের বিষয়, এমন পুরস্কার জয় করা মানে বড় বড় লেখকদের পাশে আমাকে দাঁড় করানো। যারা বিশ্বজুড়ে দামি লেখক, তাদের কাতারে আমাকে রাখা হচ্ছে-এটা অবশ্যই অনেক প্রশংসনীয়।’
কাজুও ইশিগুরো বলেন, ‘পৃথিবী আজ উপস্থিত হয়েছে অনিশ্চিত এক সময়ে। এই পরিস্থিতিতে সব নোবেল পুরস্কার পৃথিবীর মঙ্গলের জন্য শক্তি জোগাবে, এটাই আশা।’
ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম গার্ডিয়ান থেকে জানা গেছে, নাগাসাকিতে জন্ম এই লেখকের। তবে আণবিক বোমার ধ্বংসযজ্ঞের ইতিহাস ইশিগুরো প্রথম জানতে পারেন যুক্তরাজ্যে পাঠ্যবইয়ে। নিজের পিতৃভূমিতে আবার তার পা পড়েছিল প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর। ইংরেজিতে লেখেন বলে তার লেখার সঙ্গে সাধারণ জাপানি পাঠকের খুব বেশি পরিচয় নেই।
সমসাময়িক ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম প্রধান ঔপন্যাসিক হিসেবে সমাদৃত তিনি। ২০০৮ সালে ‘দ্য টাইমস’-এর এক জরিপ মতে, ১৯৪৫ সালের পর ইংরেজি সাহিত্যের প্রভাবশালী ৫০ জনের মধ্যে তিনি অন্যতম।