জন্মিলে মরিতে হইবে, অমর কে কোথা কবে? কিন্তু তাই বলে এ ভাবে ? স্বাভাবিক মৃত্যুই আমরা সবাই প্রত্যাশা করি। সেখানে আমার এই সোনার বাংলায় বার বার মানুষ মরছে অপঘাতে। রাজনৈতিক হিংসায়। ভালোবাসার দেশটি দিন দিন মৃত্যু উপত্যকা হয়ে উঠছে।
এই বাংলার লোক সংখ্যা ১৭ কোটির বেশি। একসময় সেটা ছিল ৭ কোটি। সেটা ১৯৭১ সালের কথা। তারও আগে মানে ১৯৫২ সাল। ভাষার জন্য প্রাণ দিতে হলো এই দেশের কিছু অকুতোভয় মানুষকে। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনতার জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারালো- পাকিস্তানি সৈন্য, দেশীয় রাজাকার-আলবদর আর আল শামসদের হাতে। দেশ স্বাধীন হওয়ার দুদিন আগে ১৪ ডিসেম্বর বেছে বেছে খুন করা হয় ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, সাংবাদিক, সাহিত্যিকসহ নানা পেশার মানুষকে। যে মহান মানুষটির নেতৃত্বে আমাদের দেশটা স্বাধীন হলো, যাকে আমরা ’জাতির পিতা’ বললাম- সে মানুষটিকে পরিবার পরিজনসহ মেরে ফেললাম। এমনি অকৃতজ্ঞ জাতি আমরা !
শুধু মানুষের হাতে নয়, প্রকৃতিও যেন আমাদের ওপর চরম প্রতিশোধ নেওয়া শুরু করল। উড়িরচরে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে মারা গেল হাজার হাজার মানুষ। তারপর আইলা, সিডর হয়ে প্রকৃতি আবার কেড়ে নিল কত শত প্রাণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল। কেবল আমাদের প্রসাশনের অবহেলায় সে হলের ছাদ ধসে মারা গেল বহু ছাত্র।
স্বৈরাচার সরকার তার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে গিয়ে মারল বহু ছাত্র আর জনতাকে। আমরা প্রতিবাদ করলাম। তারপর একসময় ভুলে গেলাম আসাদ, দেলোয়ার বা নুর হোসেনদের।
সারাদেশে একসাথে সিনেমা হলে সিরিজ বোমা হামলা চালালো- মৌলবাদী গোষ্ঠী। তাতে মরল কয়েক শত মানুষ। বিশ্ব অবাক বিস্ময়ে দেখলো আমাদের। তারপর, রমনা বটমূলে বোমা হামলা। আমাদের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার চক্রান্ত। এই হামলায় যারা মারা গেল তারা বেঁচে গেল। যারা শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হারিয়ে আজও বেঁচে আছে, কেবল তারাই জানে কী দুঃসহ সেই বেঁচে থাকা। যার যায় সেই কেবল জানে।
কেবল গুরুত্ব না দেওয়া, সঠিকভাবে খোঁজ খবর না নেওয়া, দায়িত্বে অবহেলার কারণে একসময় জঙ্গিবাদ প্রবলভাবে মাথা চাড়া দেয়। সারাদেশে। বিশেষ করে রাজশাহী অঞ্চলে। আনসার উল্লাহ-বাংলা ভাইদের হাতে খুন হয় অনেক মানুষ।
সাভারের পোশাককারখানা ধসে পড়ে প্রাণ হারান সহস্রাধিক পোশাক কর্মী। তারপরও আমাদের প্রশাসনের টনক নড়ে না। রানাপ্লাজা ধসের ঘটনায় অনেকে চিরদিনের জন্য হাত-পা ও শরীরের অন্য অঙ্গ হারিয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন।
প্রতিবছর জাকাতের কাপড় সংগ্রহ করতে গিয়ে পায়ের নিচে পড়ে মারা যায় বহু লোক। হায়রে মানুষ। একটা কাপড়, না একটা জীবন! কোনটার মূল্য যে তাদের কাছে বেশি? অভাব আর অনটনের কাছে তারা এতটাই পর্যুদস্ত যে, একটা ২/৩ শ টাকার কাপড়ের জন্য অন্যের পায়ের নিচে পড়ে মরতেও তাদের এতটুকু চিন্তা নেই। প্রাণ যায় যাক, কাপড় আমার চাই-ই। সম্প্রতি মানুষের পায়ের নিচে চাপা পড়ে সৌদি আরবে হজ করতে গিয়ে মারা গেলেন প্রায় শখানেক বাংলাদেশি। অনেকে এখনো নিখোঁজ রয়েছেন।
এত এত কারণে (!) মানুষ মৃত্যুর পরও আমরা নতুন নতুন বিষয় উদ্ভাবন করি প্রতিনিয়ত। মানুষ মরছে মরুক, আমার কী? ক্ষমতা আমার চাই। হায়রে আমাদের রাজনীতি। শুধু রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে পেট্রোল বোমার আগুনে পুড়ে মারা হলো শয়ে শয়ে মানুষ। তাতেও কী আমাদের বোধ হলো? বিন্দুমাত্র অনুশোচনা? হলো না। দেশের, মানুষের, অর্থনীতির, শিক্ষার কতটা কী ক্ষতি হলো- সেটা নয়। যে করেই হোক আমাকে, আমার দলকে ক্ষমতায় যেতে হবে। এটাই আসল কথা।
একসময় জানতাম, ব্যক্তির চেয়ে দল বড়ো। দলের চেয়ে দেশ বড়ো। আর এখন? ঠিক এর উল্টোটি।
সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনার দিকে নজর দেওয়া যাক। অস্ট্রেলিয়া টিম বাংলাদেশে ক্রিকেট খেলতে আসবে কি আসবে না, এই নিয়ে যখন অস্ট্রেলিয়ান পরিদর্শক দল আমাদের দেশে অবস্থান করছে- ঠিক তখনই একজন ইতালির নাগরিক খুন হলেন। এখানে ইতালির ভদ্রলোক হচ্ছেন, বলির পাঁঠা। তার জায়গায় যে কোনো দেশের নাগরিক হতে পারতেন। মোদ্দা কথা, একজন বিদেশিকে খুন করে বোঝাতে হবে- এদেশে কোনো বিদেশির জানের নিরাপত্তা নেই। এরপরও যদি আসতে চাও বাপু, নিজ দায়িত্বে আসো। নিরাপত্তার অজুহাতে অস্ট্রেলিয়া টিম আমাদের দেশে খেলতে আসলো না। যে উদ্দেশ্যে ইতালিয়ান খুন হলেন, সেটা সফল হলো। বাহবা দিতেই হয়। জি না, খুনিকে না। যারা খুনের প্ল্যানটা করেছেন, তাদের।
চীন ও জাপান বরাবরই আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র। আমাদের বিপদে-আপদে এগিয়ে আসে তারা। এদেশে প্রচুর বিনিয়োগও করেছে রাষ্ট্র দুটি। নতুন করে বিনিয়োগের জন্য এসেছে একটা প্রতিনিধি দল। ঠিক এই সময়ই জাপানের একজন নিরীহ নাগরিক খুন হলো। মোটিভ কী? মোটিভতো একটাই। এদেশে বিনিয়োগ করার মতো পরিবেশ নেই। এদেশে সকাল-বিকাল মানুষ খুন হয়। এবার ভাবো, বিনিয়োগ করবা না কি জান বাঁচাবা! বাহারে সোনার বাংলা। বাহারে আমার দেশের রাজনীতি।
একটা গল্প দিয়ে শেষ করি। দুই ভাইয়ের মধ্যে সম্পত্তি নিয়ে খুব বিরোধ। কথা বলা বন্ধ। এমনকি মুখ দেখাদেখিও। একজন অন্যজনকে পেলে খুন করে ফেলে-অবস্থা। তো, একদিন এক ভাইয়ের ঘর থেকে কান্নার আওয়াজ ভেসে এলো। কী হলো? জানা গেল, সেই ভাইয়ের ৪ বছরের ছেলেটা হঠাৎ করে অসুখে মারা গেছে। সকাল গড়িয়ে বিকাল হলো। ছোট ছেলেটির মরদেহ সৎকারের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হলো। সন্ধ্যার আগেই ছেলেটির সৎকার হলো। অন্য ভাইটির আশা ছিল, যত ঝগড়াই হোক- নিজের ছেলের মৃত্যুর খবর নিয়ে ভাইটি তার কাছে আসবে। সারাদিন সে অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু নিজে বা নিজের পরিবারের কেউ ভাইটির এই দুঃসময়ে তাকে সান্ত্বনা দিতেও গেলো না।
রাগে-দুঃখে-অপমানে একসময় সে অন্য ভাইয়ের (যার ছেলে মারা গেছে) উদ্দেশে চিৎকার দিয়ে বলল- ’তোর ছেলে মারা গেছে, আমাকে বলিসনি। ঠিক আছে, মনে রাখিস ছেলে আমারও আছে…’