কমল ঠাকুর
দেশের সরকারি-বেসরকারি-করপোরেট প্রতিষ্ঠানের দেওয়া অনেক পুরস্কার-সম্মাননার সঙ্গে এবার যুক্ত হলে ‘মৃদঙ্গ সম্মাননা’। আগামী ২২ সেপ্টেম্বর কবি কামরুল বাহার সম্পাদিত ছোটকাগজ ‘মৃদঙ্গ’-এর উদ্যোগে সম্মাননা দেওয়া হচ্ছে। তিন ক্যাটাগরিতে দেওয়া হচ্ছে এই সম্মাননা। এগুলো হলো কবিতা, কথাসাহিত্য ও সাংবাদিকতা। কিন্তু প্রথমবারের এই সম্মাননা কারা পাচ্ছেন?
ইতোমধ্যে মৃদঙ্গ সম্মাননা নিয়ে সাহিত্য-সাংবাদিকতা-সংশ্লিষ্টদের মধ্যে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়ে গেছে। সাহিত্যপ্রেমীরা কবিতায় মৃদঙ্গ সম্মাননার জন্য প্রাথমিকভাবে তিনজনেক এগিয়ে রাখছেন। তারা হলেন গোলাম কিবরিয়া পিনু, মাসুদার রহমান ও জাকির জাফরান।
এর মধ্যে গোলাম কিবরিয়া পিনু বয়সে সবার অগ্রজ। লিখেছেনও প্রচুর। মূলত কবি হলেও লিখেছেন প্রবন্ধ ও ছড়াও। এছাড়া করেছেন গবেষণা। তার জন্ম ১৯৫৬ সালের ৩০মার্চ, গাইবান্ধায়। সমালোচকরেদ মতে, তার কবিতায় জীবন আছে, সমাজ আছে, প্রকৃতি আছে, মানুষ আছে, দেশ-সময়কাল আছে। আছে প্রতীকের ব্যঞ্জনা, রূপক ও ছন্দের বিভিন্নমুখী ব্যবহার। সঙ্গে আছে অনুপ্রাসের নতুনমাত্রা, মিলবিন্যাসের নীরিক্ষা ও অন্যান্য সূক্ষ্ কারুকাজ। একেক কাব্যগ্রন্থ একেক বৈশিষ্ট্য নিয়ে উজ্জ্বল । তাঁর উল্লেখযোগ্য কবিতাগ্রন্থ হলো: এখন সাইরেন বাজানোর সময়, সোনামুখ স্বাধীনতা, পোট্রেট কবিতা, সূর্য পুড়ে গেলো, কে কাকে পৌঁছে দেবে দিনাজপুরে, আমরা জোংরাখোটা, সুধাসমুদ্র, আমি আমার পতাকাবাহী, ও বৃষ্টিধারা ও বারিপাত, ফসিলফুয়েল হয়ে জ্বলি, মুক্তিযুদ্ধের কবিতা, ফুসলানো অন্ধকার, উদরপূর্তিতে নদীও মরে যাচ্ছে, ঝুলনপূর্ণিমা থেকে নেমে এলো এবং নির্বাচিত কবিতা।
সাহিত্যচর্চার স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন রংপুর তথ্য কেন্দ্র পুরস্কার (প্রবন্ধ, ১৯৭৪); বাংলাদেশ পরিষদ-রাজশাহী বিভাগীয় পুরস্কার (বক্তৃতা, ১৯৭৪); গাইবান্ধা কলেজ ছাত্র সংসদ পুরস্কার ( প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা, ১৯৭৪); আমরা ক’জনা বিদ্রোহী সূর্যকণা পুরস্কার (১৯৭৫); গাইবান্ধা তথ্যকেন্দ্র পুরস্কার (প্রবন্ধ, ১৯৭৬ ও ১৯৭৭); জাতীয় শিল্প, সাহিত্য, সাংস্কৃতিক উৎসব-গাইবান্ধা পুরস্কার (কবিতা ও অন্যান্য ১৯৭৭); বিতর্ক অঙ্গন-রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পুরস্কার (১৯৭৮); মাদার বখশ ছাত্রাবাস-রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পুরস্কার (প্রবন্ধ,১৯৮১); বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন সম্মাননা-কবিতা, ১৯৮৫; বাংলা কবিতা উৎসব সম্মাননা কোলকাতা, হলদিয়া, ভারত, ১৯৮৮; ‘বাংলার মুখ’ সাহিত্য-সাংস্কৃতিক উৎসব সম্মাননা, বালুরঘাট, পশ্চিমবঙ্গ, ১৯৯৭; সৌহার্দ্য-৭০ সম্মাননা, কোলকাতা, ২০০৩; অনিরুদ্ধ’৮০ সম্মাননা, কোলকাতা, ২০০৩; বিন্দুবিসর্গ সম্মাননা, ২০০৩; দীপালোক বিজয় দিবস সম্মাননা পদক, কবিতা-২০০৬; লোকসখা ওয়েলফেয়ার সোসাইটি, কোলকাতা কর্তৃক লোকসখা সম্মাননা ২০০৮; উইমেন ডেলিভার আমেরিকা-এর ফেলোশিপ অর্জন ২০১০; বন্ধু পরিষদ গাইবান্ধা সম্মাননা ২০১০; এম নুরুল কাদের শিশুসাহিত্য পুরস্কার-২০১০; বগুড়া লেখক চক্র সম্মাননা ২০১৬; কবি বিষ্ণু দে পুরস্কার (ভারত) ২০১৬; এবং মানুষ সম্মাননা ২০১৮; চাড়ু–নীড়ম ইনস্টিটিউট পুরস্কার ২০১৯; সাতক্ষীরা কবিতা পরিষদ পুরস্কার ২০১৯।
কর্ম ও স্বীকৃতির বিচারে তার অর্জনের ঝুলি বেশ ভারী। ফলে মৃদঙ্গ সম্মাননার জন্য তাকে নির্বাচিত করলে যথার্থ লোককে নির্বাচন করা হবে বলে মনে করছেন সাহিত্যমোদীরা।
গোলাম কিবরিয়া পিনুর পর যার নাম আলোচনায় এসেছে তিনি মাসুদার রহমান। তার জন্ম ১৯৭০ সালের ১ সেপ্টেম্বর। তার উল্লেখযোগ্য কবিতার বই হলো ভ্যান গঘের চশমা, হরপ্পা, শ্রেষ্ঠ কবিতা, চাঁদের বই, মাসুদার রহমানের কবিতা, হাটের কবিতা প্রভৃতি। কবিতাপ্রেমীদের কেউ কেউ মনে করছেন, এবারের মৃদঙ্গ সম্মাননা তার পাওয়া উচিত।
তৃতীয় নম্বরে যার নাম উচ্চারিত হচ্ছে তিনি কবি জাকির জাফরান। এই কবির জন্ম ১৯৭৫ সালের ৪ আগস্ট সিলেটে। ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। পেশায় সরকারি কর্মকর্তা। জাকির জাফরানের কবিতায় রয়েছে প্রচুর জীবনাভিজ্ঞতার ছাপ, কল্পনার স্ফুরণ। শব্দে, বিষয়ে, ছন্দে, অলঙ্কারে, প্রকাশশৈলীতে তিনি হয়ে উঠেছেন তার সময়ের অন্য দশ কবির চেয়ে আলাদা। প্রকাশিত কবিতার বই: সমুদ্রপৃষ্ঠা (২০০৭), নদী এক জন্মান্ধ আয়না (২০১৪), অপহৃত সূর্যাস্তমণ্ডলী (২০১৫)। অনুবাদ: আক্রায় পাওয়া পাণ্ডুলিপি। সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ইতোমধ্যে পেয়েছেন ‘বগুড়া লেখকচক্র পুরস্কার’ ও ‘কবিতা আশ্রম পুরস্কার’। সাহিত্যপ্রেমীদের মতে, তার নিজস্ব স্বর তৈরি হয়েছে। মৃদঙ্গ সম্মাননা পাওয়ার যোগ্য তিনিও।
এবার আসি কথাসাহিত্য প্রসঙ্গে। এই শাখায়ও তিনজনের নাম আলোচিত হচ্ছে। তারা হলেন আকিমুন রহমান, সেলিম মোরশেদ, দিলারা মেসবাহ। এর মধ্যে আকিমুন রহমানের নাম বিশেষভাবে উচ্চারিত হচ্ছে। তার কথাসাহিত্যে উনিশ শতকের ইউরোপীয় গল্পগাথা ও এমিল জোলার কথা-বৈভব প্রচ্ছন্নভাবে ছায়া ফেলেছে। তার কথাসাহিত্যে নিজস্ব একটি স্বরও স্পষ্ট। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলে: সোনার খড়কুটো, বিবি থেকে বেগম, পুরুষের পৃথিবীতে এক মেয়ে, রক্তপুঁজে গেঁথে যাওয়া মাছি, এইসব নিভৃত কুহক, জীবনের রৌদ্রে উড়েছিলো কয়েকটি ধূলিকণা, পাশে শুধু ছায়া ছিলো, জীবনের পুরোনো বৃত্তান্ত, যখন ঘাসেরা আমার চেয়ে বড়, অচিন আলোকুমার ও নগণ্য মানবী, একদিন একটি বুনোপ্রেম ফুটেছিলো, জলের সংসারের এই ভুল বুদবুদ, এবং নিরুদ্দেশের লুপ্তগন্ধা নদী। বিষয়বৈচিত্র্য ও গভীরতার বিচারে তার রচনা অনন্য। ফলে মৃদঙ্গ সম্মাননার জন্য তাকে নির্বাচন করলে উপযুক্ত হাতেই সম্মাননা পৌঁছাবে বলে মনে করছেন সাহিত্যপ্রেমীরা।
আলোচনা দ্বিতীয় স্থানে রয়েছেন সেলিম মোরশেদ। তার জন্ম ১৯৬২ সালের ২২ মার্চ যশোরে। তার আলোচিত গল্পগ্রন্থগুলো হলো: কাটা সাপের মুণ্ডু, নীল চুলের মেয়েটি যেভাবে তার চোখ দুটি বাঁচিয়েছিল, রাতে অপরাজিতা গাছে ফুল, সখিচান, কান্নাঘর, বাঘের ঘরে ঘোগ, সুব্রত সেনগুপ্ত, পার্ভার্টেড ম্যান, চেনাজানা। সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন, ‘লোক সাহিত্য পুরস্কার-২০১৯’।
কথাসাহিত্যে আলোচনার তৃতীয় স্থানে রয়েছেন দিলারা মেসবাহ। তার জন্ম ১৯৫০ সালের ২৮ আগস্ট, পাবনায়। ১৯৬৫ সালে ‘সবুজ পাতা’য় কবিতা প্রকাশিত হওয়ার মধ্য দিয়ে তার লেখালেখি শুরু। বর্তমানে ছোটগল্প, নিবন্ধ, শিশুতোষ রচনায় তিনি নিরন্তরভাবে মগ্ন। পাশাপাশি বাংলাদেশ লেখিকা সংঘের সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১৬ সালে ‘রত্নগর্ভা মা’ সম্মাননা অর্জন করেন। দিলারা মেসবাহর সৃষ্টিকর্মের মধ্যে রয়েছে কবিতা, গল্প, উপন্যাস, শিশুসাহিত্য মিলে ৩৮টি গ্রন্থ। উল্লেখযোগ্য উপন্যাস, স্বপ্নলোকের চাবি (২০০০) নাগরদোলার দিন (১৯৯৩); ছোটগল্পগ্রন্থ: পলাতকা ছায়াগুলো (১৯৯০), অন্ধকার ও অপরূপ ডানা (১৯৯৩), ভাতের গল্প (১৯৯৭), বায়োস্কোপ (২০০৫), এক জোড়া পয়মন্ত ইলিশ (২০২০)। তার কথাসাহিত্যের বিষয় আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, বাঙালিত্ব, আমাদের সংস্কৃতি, চিরায়ত জীবনযাপনের চিত্র। সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতি স্বরূপ ইতোমধ্যে পেয়েছেন আশরাফ সিদ্দিকী সাহিত্য পদক, লেখিকা সংঘ সাহিত্য পদক, জসীমউদ্দীন স্বর্ণ পদক, নন্দিনী সাহিত্য পদকসহ ১০টির মতো বেসরকারি সাহিত্য পুরস্কার। সাহিত্যমোদীদের মতে এবার মৃদঙ্গ সম্মাননা তারই প্রাপ্য।
সবশেষে রয়েছে সাংবাদিকতা বিভাগ। এই শাখায় আলোচিত তিন নাম হলো: আবুল কালাম আজাদ, আনু মোস্তফা, শিবলী নোমান। তারা তিনজনই স্ব-স্ব নামে খ্যাত। খ্যাতিমান তাদের পেশাগত সততা ও দক্ষতার জন্য। সচেতন মহলের মতে তারা তিনজনই যোগ্য। তবে কর্তৃপক্ষকে তো একজনকেই বেছে নিতে হবে।
সবশেষে বলা যায়, এখানে যাদের নাম উঠে এসেছে, তারা প্রত্যেকেই সম্মানিত হওয়ার দাবি রাখেন। কাকে রেখে কাকে দেওয়া হবে এই সম্মাননা; তা নিয়ে অবশ্যই ভাবতে হবে আয়োজকদের। কবিতায় যাদের নাম আলোচিত হচ্ছে, তারা কেউ কারও থেকে পিছিয়ে নেই। ফলে একজনকে নির্বাচন করা জটিল হয়ে পড়বে। এরপরও বিচারক তথা নির্বাচকদের নির্মোহভাবে যেকোনো একজনকেই বেছে নিতে হবে।
কথাসাহিত্যে কাকে দেওয়া যায়, এ নিয়ে গলদঘর্ম হতে হবে নিশ্চয়ই। যাদের নাম আলোচিত হচ্ছে, তারা সবাই সমান যোগ্য। তবে কে পাবেন কথাসাহিত্যে মৃদঙ্গ সম্মানানা, তা সময়ই বলে দেবে।
আর সাংবাদিকতায় যাদের নাম এসেছে, তারাও সবাই সমান যোগ্য। তাহলে এখন? এখন শুধু অপেক্ষার পালা, কারা পাবেন মৃদঙ্গ সম্মাননা?