এবার কলকাতায় জোড়াসাঁকোয় গিয়ে বেশ কিছু অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম। এর মধ্যে ঠাকুর বাড়ির ছাদে মাতঙ্গিনী গঙ্গোপাধ্যায় অর্থাৎ কাদম্বরী দেবীর রহস্যাবৃত আত্মহত্যার বিষয়টিও রয়েছে। ১৩৫ বছর পরেও সেই ছাদে এখনো প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। মনটা হু হু করে উঠলো। পুরো বাড়ি দেখার পর যখন সিঁড়ি দিয়ে নামছিলাম, কার যেন নীরব কান্না শুনতে পাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল, কে যেন ডাকছে!
এরপর থেকেই বিষয়টা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। যদিও উইকিপিডিয়া থেকে শুরু করে রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায় কাদম্বরীর কষ্টের কথা উল্লেখ আছে। যদিও রঞ্জন বাবু অতিরঞ্জিত এবং নাটকীয় করে লিখেছেন, তার ‘কাদম্বরী দেবীর সুইসাইড-নোট’।
হ্যাঁ, কাদম্বরী দেবী অনেক পারিবারিক জটিলতা মধ্যে ছিলেন। যেমন, স্বামী থেকেও না থাকা বা সংসার থেকেও না থাকার মতো।
১। স্বামী জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ডুবে ছিলেন স্টার থিয়েটারের নটিনী বিনোদনী আর বড় ভাই সতেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী অর্থাৎ বৌদি জ্ঞানদা নন্দিনীর ঘোরে। এটা একটা বেদনা ছিল তার।
২। তাকে নানাভাবে নির্যাতন করা হতো। ঠাকুর বাড়ির কর্মচারীর মেয়ে হিসেবে শুনতে হতো নানান গঞ্জনাও। সইতে হতো অবহেলা।
৩। বাচ্চা হতো না বলে তিরস্কার করা হতো। অসতী বলেও খোঁটা দেওয়া হতো।
৪। ননদ স্বর্ণ কুমারীর মেয়ে উর্মিলা সিঁড়ি থেকে পড়ে মারা যাওয়ার জন্যও তাকে দোষারোপ করা হতো।
৫। দেবর বরি ঠাকুরের সঙ্গে গভীর-নিবিড় সম্পর্ক, রবি ঠাকুরের বিয়ে, এসব থেকে অভিমান-বিরহ তীব্র আকার ধারণ করে।
রবি ঠাকুরই বুঝেছিলেন তার দহন। বুঝেও কিছু করার ছিল না তার। একা, নিঃসঙ্গ, অবহেলিত, বিরহিনী কাদম্বরী দেবী তাই আত্মহননের পথ বেছে নেন।
হতভাগা কাদম্বরীকে বেঁচে থাকার আগে এবং পরেও অবহেলিত হয়েছে। এটাকে কি নারী নির্যাতন বলা যায়না?
আত্মহত্যাচেষ্টার পরও দুই দিন জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করেছেন। কিন্তু সুচিকিৎসা, তদন্ত, সৎকার, সঠিক সংবাদ পরিবেশন অর্থাৎ কিছুই যথার্থ হয়নি। ঠাকুর বাড়ির মর্যাদায় দাহ করা হয় সত্যকে। ধামাচাপা দেওয়া হয়েছিল অনেক কিছু। জমিদারদের ক্ষমতার বলে বাহান্ন টাকা বারো আনা দিয়ে আদালত বাড়িতে বসানো, কোর্ট রিপোর্ট গোপন, সুইসাইড নোট পোড়ানো এ সবই প্রশ্নবিদ্ধ! ২০১৩ সালের ২১ জানুয়ারি দৈনিক আলোতে সুচিকিৎসা সম্পর্কে রোবায়েত ফেরদৌস লিখেছেন, ‘মরে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় কাদম্বরীর আফিম খাওয়ার আবছা দুই দিন তাঁর শেষ চিকিৎসার জন্য সাহেব ডাক্তার ডি বি স্মিথকে আনা হয়েছিল ৪০০ টাকা খরচ করে, ওষুধ কেনা হয়েছিল ২৫ টাকায়, ডাক্তারকে টাকা দেওয়া হয়েছিল চেকে; … তেতলার ঘরে রাখা হয়েছিল তাঁকে, যে ঘরে কেউ থাকতেন না; অন্ধকার সেই ঘরে দেড় টাকা খরচ করে আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল; কিন্তু বাতির আলোয় নিসাড় পড়ে ছিলেন কাদম্বরী, তাঁর শরীর থেকে প্রাণের আলো ক্রমেই চলে যাচ্ছিল’।
আমাদের বেশ ক’জন নারী কবি সিলভিয়া প্লাথ হয়ে গেছেন। বাংলার প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতী থেকে শুরু করে বাশিরা ইসলাম শান্তি, আলফা পারভীন, মনিরা চৌধুরী, মেরুনা আত্মহনন করে বিদায় নিয়েছেন। এই অপমৃত্যুগুলো আমাকে নাড়া দেয়। কাদম্বরী দেবী কবি নন; তারপরও তাঁর অপমৃত্যুও আমাকে আপন করে কাছে টানে।
কবিরা এইসব নারীকে নিয়ে অদ্ভূত কবিতা লেখেন। যেমন, মাসুদার রহমান লিখেছেন, ‘আমি আর সিলভিয়া মিলে / মাছ-আরতের পাশে বাসা ভাড়া নিয়ে আছি/…আশে-পাশে অনেক বরফকল। আমরা প্রস্তুত আছি/ আমাদের সম্পর্কের/ কখনও পচন এলে; শস্তা বরফ কিনে পচন ঠেকাব’।
আবার কাদম্বরীকে নিয়ে সাইয়েদ জামিল ভিন্নভাবে লিখেছেন, ‘‘স্বেচ্ছায় শাড়ি খুলে শ্রীমতি কাদম্বরী আমার মুখের ভেতর/ পুরে দিলো তাঁর অহঙ্কারি দুধের বোঁটা। দু-পা ফাঁক ক’রে/ ঊরুসন্ধি দেখিয়ে বললো, ‘ও নব্য ঠাকুর পো, এ শরীর/ তোমারও।’…/ আমি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বাবু/ না কি রবীন্দ্রনাথ— কার কাছে ক্ষমা চাইবো?’’
বন্ধু সুবোধ সরকারের ‘কাদম্বরী দেবী আপনাকে’ কবিতাটিও মন ছুঁয়ে যায়, ‘মৃত্যু কি আপনার চুলে হাত রেখেছিল?/ মৃত্যু বলেছে, তোমাকে আমার প্রয়োজন!’
আমিও লিখলাম। তবে এই কবিদের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে নয়। অনেকটা বেদনাবোধ থেকে, মানবিক দিক থেকে, কাদম্বরীর প্রতি চরম অবহেলা আর অবিচার থেকে।
রবীন্দ্রনাথ যে কবিতা লিখেননি ॥ সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল
কবিরা কি আত্মহত্যাকারীদের পক্ষ নেয়; সাক্ষ্য দেয়!
তাহলে টেড হিউজ বাদ। কাঠগড়ায় রবীন্দ্রনাথ-
মাতঙ্গিনীর কথা কাউকে নাহি জানায়; বাহান্ন টাকা বারো আনায়
আদালত কিনে আনলেন ঠাকুর বাড়িতে ঘরে ঘরোয়া কোর্ট রিপোর্ট, সুইসাইড নোট
হয়েছে পুড়ানো, করেছে গোপন, গায়েব! এসব জানতেন নায়েব।
আলো আঁধারীর ছায়ায় কাঁদে মায়া; আন্ডার দ্য টেবিল, ঘুষ। নির্দোষ?
দীর্ঘ দুই দিন কেন হয়নি চিকিৎসা, জীবনের হিস্যা!
কেন পাঠানো হয়নি মর্গে। স্বর্গে!
মিডিয়া, সাংবাদিক, সমাজ চুপ। দিয়েছে ডুব।
অভিমানী আফিমের গন্ধ গন্ধমের মতো, কে কাঁদে অবিরত
জোড়াসাঁকোর চিলেকোটায় একুশে এপ্রিলের বেদনা, কাদম্বরী কেঁদোনা।
আমরা থাকবো এক সাথে; রাতে-
দিনে। অনেক ক্ষোভ হয়েছে জমা, করব না ক্ষমা।
জেগেছে নারীবাদী, জেগেছে মানবাধিকার। স্বাধিকার।
রহস্যাবৃত হরণের হবে বিচার, মরণোত্তর, সত্বর।আকঁবো আফিমের ছবি। যে কবিতা লিখেনি রবি; আমি লিখবো সে সবই।