মরণ চিরপ্রিয়তমের মতো জীবনের গভীরে ব্যপ্ত হয়ে বসেছিল আমার প্রাণের ঠাকুরের কাছে। তাই তাঁর কাব্যরচনার ধারেকাছে মরণের ছিল অবিরত বাস। ঠেকাতে পারেননি তিনি তাকে। কিংবা ঠেকাতে চাননি। আজ আমিও লিখতে বসলে কিভাবে যেন সেই মরণ এসে গড়াগড়ি যায় পায়ের কাছে। আমি নিত্যই ভাবি, আসলে কি এ আমার আজীবন ঠাকুর পাঠের সজ্ঞান? না কি জীবনের অনেক বেলা পার হয়ে ক্রমশ ধাবিত হচ্ছি যেদিকে তার প্রতি গভীর দৃকপাত! নিশ্চিত হয়ে গেছে যার অবস্থান অবিরত জীবনের পরতে পরতে তাকেই আদরে-সাদরে-সম্ভাষণে জীবনের আনন্দে-বিষাদের সঙ্গে নিয়ে এক অদ্ভুত রস আস্বাদনের অপচেষ্টা! অপচেষ্টা এজন্য যে, তাঁরই মতো করে এমন ভাষায় বর্ণমালায় কে পারে মরণকে জীবনেরও আরও আরও উঁচুতে দিতে অবস্থান? তবু পড়ি। শুরু করি এক নতুন বই, নতুন কবিতা। নিঃশেষে আগাই আরও এক অসাধারণ পাঠের দিকে। তার শুরুই হলো সেই চির পরিচিত মরণকে সঙ্গে লয়ে। মুগ্ধ বিস্ময়ে অসাধারণ সব শব্দ উপমা আর দারুন মাত্রাবৃত্ত ছন্দের দুর্দান্ত কম্পোজিশন এ দেখি মরণের আর এক রূপ।যা মাটির সঙ্গে শেকড়ের সঙ্গে চিরকালের প্রবহমান জীবনের সঙ্গে জীবনেরও অধিক সম্ভাষণে বিরাজে বিষাদে আনন্দে:
এখানে মরণ অস্থির গায়ে দনকলসের পাতা
বাকল খুলেছে মহাকাল ঋষি, ভেষজের নীল ছাতা
মাটির ডেরায় ডিমের আদল, ঘুমাও পরম গুরু
তোমাকে ফোটাই দাদাজান পাখি এখানে তাবৎ শুরু।
(পরম্পরা: লখিন্দরের গান)
এই মহাকাল, ঋষি, এই দাদাজান পাখি; শব্দগুলো আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে চলে। আমি কোথায় হারাই। আমার সুগভীর চৈতন্যেরও সীমারেখা ভেদ করে কতদূর ক-ত-দূ-র্ বহুদূর। আর কোথায় বা ব্যপ্ত হয় আমার ভাবনা। শুধু টের পাই চলে যাচ্ছি কোনো এক নিশ্চিত নির্দিষ্ট শেকড়ের কাছাকাছি। যেখান থেকে শুরু আর যেখানে গিয়ে শেষ।
‘পরম্পরা’ কাবিতাটির নাম। অর্থাৎ জীবন-জীবন বংশানুক্রম। সাহিত্যে রিসেপশন থিওরি বলে একটা কথা আছে। আমি এক অকালপক্ক রিসেপ্টর। কিছুটা বা নির্বোধও। আমি দেখি এখানে এক হতে আর এক বংশানুক্রমিক চিরপ্রবহমানতা। মানুষের বোধের, চিন্তার, ভাবনার প্রাত্যহিক জীবনের কাজের শ্রেণিগত বিভেদ আর সাজুয্যের এক অসাধারণ পরম্পরা। সেই মনু সংহিতা থেকে শুরু হয়েছিল যার কাল, চর্যাপদ বেয়ে যুগে-যুগে বদলে গেছে সে আত্মা। কতনা রূপে প্রকাশিত হয়েছে তার কর্মযজ্ঞ। আবার কখনোবা পরিণত হয়েছে আরও এক দারুণ অরূপে। সঙ্গে আঠারো মাত্রার অক্ষরবৃত্তের দারুণ ছন্দোবদ্ধ বাঁধন এক নিপুণ অপরূপে বেঁধেছে তাকে; অন্তত আমার পাঠের আনন্দে যোগ করেছে এক আনন্দপ্রদ অসাধারণ মাত্রা:
আপন দীক্ষার মাছি করো, কিংবা ওড়ার সাধক
সুফলা অনার্যা কবি চেটেপুটে অমৃতের ত্বক
কাহ্নপার জিভ হই। সান্ধ্যবোলে ভন-ভন ভন।
সাতপুরুষের জমি নেই; চামে এখানে লুণ্ঠন
চর্যার ভিটায় বসে গুম হই গীতল ভুসুক
মরমে পরমটুকু গানে গানে আঠালো থাকুক
(পরম্পরা: লখিন্দরের গান)
এই ‘পরম্পরা’য় যে কী নেই!জায়গায়-জায়গায় অসাধারণ ছন্দোবদ্ধ পঙ্ক্তির বাঁধন। পুঁজিবাদ নিষ্পেশন থেকে গণতন্ত্র, শোষণ-নিপীড়ন থেকে বিশ্বায়ন। অসহায় মানবমন। যাঁতাকলে পিষ্ট মানবের সুকোমল মানবিক বোধ। আর সেই মানবিক বোধের ক্রমাগত স্খলন, লুন্ঠন, প্রতারণা আর প্রত্যাবর্তন। কবিতাটির পরতে-পরতে মানবিক বিকার আর তার স্বীকার এর অ্যাবাস্ট্রাক্ট সব চিত্র্র আঁকা। আঁকা রয়েছে পুঁজিবাদের যাবতীয় নৃশংস হুঙ্কার আর কান্নার বীভৎস ও করুণ শব্দ, লালসা আর তার চরিতার্থতার বিচিত্র বিকৃত বিশদছায়া আর তার ছবি। শক্তিমানের চিরায়ত লোভ, পরের সম্পদ লুণ্ঠন আর আত্মগত করার ক্রমপ্রক্রিয়ার ফল। লোভীর অত্যাচারীর মুখোশ আর তার আড়ালের নিষ্ঠুতার প্রকাশ পদে-পদে হয়েছে ব্যক্ত। জটিল সাম্রাজ্যবাদ প্রজাশাসন ধর্মের মাকাল বাক্যবাণীর আস্ফালন। তার যাঁতাকলে অসহায় মানুষের দীর্ঘশ্বাস আর আর্তনাদ। কী যেন এক অসাধারণ রূপ পেয়ে গেছে এখানে এসে। ‘দাদাজান’ এখানে সিম্বলাইজ হয়েছেন এক আদি আর চির-প্রকৃত স্বজাত্যবোধ এর ধারক হিসেবে:
ডিমের আদলে ঘুম যাও দাদা; ফাটাবো না এই যাপনের ঘুম
মৃত্যু টানেনা তোমাকে অপার; এখানে হাড়ের নয়া মওসুম
তামাম দুনিয়া মণ্ডু খুঁজেছি, ধুনুচি পুড়িয়ে চেতনার দম
বর্গীবাজার আড়ৎ ডিঙিয়ে গোড়ালি চিনুক তোমার খড়ম
কিংবা
পশ্চিমে সুড়ঙ্গ আছে- উন্মুক্ত বাজার
পুবালি সুষমা ঢেলে এত যে বিভোর ডাকো আয় আয়
ধনের পচনতন্ত্রে আজ
মন্ত্র দিয়ে ফুঁক
কিছু দাও সম্পৃক্ত পাঠক
বহতার রক্তে ফিরে অটুট বিদ্যায় লিখি
ক্রম নদী, হালচাষ।
বাঁকফেরা জলের শাসনে
সাঁকোর দহন লিখি জলধির সমান সমান।
আর অবশেষে প্রত্যাশার সুর বের হয়ে এসেছে কোন একদিন হয়তো মানুষ চিনবে তার প্রকৃত শেকড় আর ধাবিত হবে তারেই পানে।
শুধু যে বিষয়ের গভীরতা কিংবা আন্তর্জাতিক বোধের জটিল টানাপড়েনে সমৃদ্ধ ‘পরম্পরা’র বিশাল শরীরতাই নয় পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে অসাধারণ সব জটিল ও সরল-উপমা রূপক উৎপ্রেক্ষার দারুন সুসংহত আর সংযত প্রকাশ এখানে। তাঁর কবিতা পড়তে-পড়তে আমার এমনই মনে হয়, উপমা যেন প্রস্তুত হয়ে থাকে কখন বসবে তার কবিতার শরীরে শরীরে। আর অলঙ্কৃত হয়ে উঠবে নিজেই। দারুণ সব ভিজ্যুয়ালাইজেশন তৈরি হয় যা পড়ার সঙ্গে-সঙ্গে মনের কিনারে।
একটু দৃশ্যান্তর প্রয়োজন। একটি দীর্ঘ-দারুণ-সুখপাঠ্য-দুর্বোধ্য-জটিল কিন্তু অসাধারণ কবিতা পাঠের পর আমি একটু রিক্রিয়েশন খুঁজি। একের পর এক পড়তে থাকি না। কবিতার নাম ধরে খুঁজি কোনো পলকা সুখপাঠ্য কিছু। নামে পেয়েও যাই এমন এক। পড়তে শুরু করি। কিন্তু না। তাতেও জীবনের জটিল কিন্তু ধ্রুব কিছু সত্যের আবছায়া দেখি। নদী আর নিজের ঘর যেন এক করে ভাবি এই আহ্বানে শুরু করি:
নদীকে নিজের বাড়ি মনে করো তখন ভাবতে হবে না যে তুমিও ভাসছ স্রোতের সমান।
যদিও আবাস তার-পৃথীবির নিরত ঘুর্ণনবুঝতে পারে না কেউ
তাই তো অটল থাকে বিবর্ণ বিষাদে সফল ক্ষমায়।
(ফেরার ইচ্ছে: লখিন্দরের গান)
মন। এই এক তামশাজীবনে মন আর তার কত-কত যে রূপ-অপরূপ হয়ে উঠেছে যুগে-যুগে কাব্যে আর কবি ভাবনায়। বিপরীত রূপেও কি তা পায়নি অন্য আর এক অবয়ব? অধরা চিরায়ত রাধার যাতনায় কি কৃষ্ণের ছলাকলায়! পেয়েছে–লেখা হয়েছে একের পর এক সব কবিতা মহাকবিতা। মানবমনে প্রেম আর তার প্রত্যাহৃত যাতনা কি দারুণ বিষাদে রূপান্তরিত হয় এক সবিশেষ আবেদনে, তারই মূর্ত রূপ যেন এই কয়টি পঙ্ক্তি:
তার মনে এক নেই
বহুতত্ত্ব মাটির শেরেক
কটাশ কটাশ কাটে বাঁশকাটা পাখি
ঠোঁটে তার মনের পেরেক….
(কটাশ কটাশ কাটে বাঁশকাটা পা্খি: লখিন্দরের গান)
দারুন এক ইমেজ তৈরি করে দেয় এই ক’টি পঙ্ক্তি আমার মনে। দেখি সেই শৈশবের চেনা পাখি কাঠ ঠোকরার ছবি। তখন লালমাইয়ের পায়ের কাছে আমার বাস। ওপরে পাহাড়। নিত্যই ভোরে নীল আকাশ ডানা মেলে ছায়া হয়ে থাকে জীবনের গভীরে। সবকিছুতেই কি দারুণ সুন্দর! ঝোলানো বেলকনিতে দাঁড়ালেই দূরে লালামাইয়ের ঘনচূড়া, গভীর বন, চোখের সামনে ছোট বড় শিশু গাছ আর বৃক্ষের ঘনসবুজ পাতা গায়ে আদরের পরশ বুলায়। তেমনি প্রদোষে কোন কোণে মধ্যদুপুরে আমি দেখেছি কাঠঠোকরার একাগ্র সাধনা। নিজের ঠোঁটৈ ঘণ্টা-মিনিটের হিসাববিহীন কেটে চলেছে গাছ কেটে চলেছে কাঠ-আমার অপলক চেয়ে থাকাও তেমনি পার হয়ে গেছে তারে দেখে দেখে। কি মধ্যাহ্নে, কি অপরাহ্নে, বিরামহীন সেই কাঠঠোকরাই আজ সেই সুদূর শৈশব থেকে চোখের সামনে উড়ে আসে ঠো্ঁটে এক নির্মম পেরেক নিয়ে নাম তার ‘মন’। মন থেকে মনান্তর-এই ব্যাখ্যার অতীত কর্মক্রিয়া মানবজীবনে বোধে কর্মে কি প্রাত্যহিক দিনযাপনে যে ক্লেশ যে প্রগাঢ় যাতনার বিষ রেখে চলে যায় তার দারুণ দারুণ সব প্রকাশ নানা উপমায়, নানা ইমেজে জটিল কিন্তু অসাধারণ সব রূপকে প্রকাশিত হয়েছে কবিতাটির ভাঁজে ভাঁজে:
জল পড়ে।
পাতা নড়ে
কবিতার সৌধ ভেঙে রোজ পাথরে খোদাই চিঠি ডাকবাক্সে পড়েনা এমন।
আজন্ম ক্ষরণ–তবু লিপির অঙ্কনে শোক ভালো, ধন্য তবু হৃদয় জখম।
শূদ্র ভালো, বৈশ্য ভালো, রক্তে ভালো ক্ষত্রিয় ব্রাহ্মণ;
যবনের আল্লা ভালো, নমঃ নমঃ একক ব্রহ্মায়।
(কটাশ কটাশ কাটে বাঁশকাটা পাখি: লখিন্দরের গান)
ঠিক তেমনি আর এক শাশ্বত যাতনার বোধ আঁকা হয়ে থাকে দারুণ শব্দে দারুণ রূপকল্পে। আমার কাছে এ যেন ব্যক্তিকেন্দ্রিক এক অসাধারণ স্যাটায়ারের উদাহরণ:
শুনেছি তোমার মনে পরাণগঞ্জের মধুর কিরিচ
রক্তে ফুলের মৌতাত।
গন্ধের বিস্ময়ে তবু খুনের পাপড়ি
হোক প্রেম, আজ দোষ নেই।
ডাগর দুনিয়া ফেটে যাচ্ছে যাক; আত্মার দু’হাত বাঁধা–পরী, শপথবেলুন উড়িয়ে দিলাম
ফিরে যাবনা অক্ষয় ক্ষতিবিতণ্ডা পাড়ায়।
(পাণিপ্রার্থনা: লখিন্দরের গান)
আবার ঠিক তারই বিপরীতে একই যাতনার বোধে ঋদ্ধ কবিতাটির শরীরে নারীর যাতনা। পুরুষের পলিগ্যামি বিভাজিত মনে শরীরের কালিমাখা রূপ। আর ভালোবাসার ক্লাসিক রূপে নারীর প্রত্যাশিতের জন্য সাধনার এক দারুন প্রকাশ কবিতাটির দু’জায়গায়:
ঔরসের রক্তের মতো যে ছিল আপন,
জান্তব পুরুষের টানে ছেড়ে গেছে বহুদিনকিংবা
আবুল কালাম!
মানুষের কলিজা নিয়ে ধাপ্পা খেলে যে নিষ্ঠুর,
অন্তহীন অঙ্কের অকূলপাথার নিয়ে উদ্ধত যৌবনে তারও পড়ন্ত বিকেল নামে।
প্রেমের বিনয়ী জল হাতে পরিপূর্ণ মাটির বাসন-
অপেক্ষা করে সে।প্রাণের কুকুরী, আহা, আপন মানুষ যদি ফিরে আসে…
(কুকুরীর জন্য সংবেদনা: লখিন্দরের গান)
সত্যি যদি বলি, কবিতাটির নাম শুনে আমি একদম বাদ দিয়ে রাখি পড়বো না বলে। কী ভেবে যে আবার কোনো এক ফাঁকে পড়ে ফেলি আর মুগ্ধ-বিস্ময়ে আবিষ্কার করি তার অন্তর্গত গভীর বেদনার এক শাশ্বত রূপ।
অবশেষে আসি পুরো কাব্যের নামাঙ্কিক কবিতাটির কাছে। ইচ্ছে করেই রেখে দেই তারে সর্বশেষ পাঠের জন্য। ছোটবেলায় আমার মাকে দেখেছি যেকোন গল্প বা উপন্যাসেরপ্রথমে দুই-এক চ্যাপ্টার পড়লেন। তারপরই শেষের পাতা পড়ে জেনে নিলেন কী পরিণতি। এবার শুরু হলো তার আসল পাঠ। চুলায় রান্না পুড়ে যায়, বেলা পার হয়ে দুপুর বিকেল, টেবিলে তার ভাতের থালা পড়ে রয়, মধ্যরাতেও তার ঘরে আলো জ্বলে আজও জীবনের শেষ বেলাতেও। রাত তিনটে কি চারটে দু’চোখে ফ্যাকোর কাটাচেরা। তবু বই শেষ না করা অবধি তার নিস্তার নেই। আমি সে রকম হতে পারিনি বলে খুব দুঃখবোধ কাজ করে মাঝে-মাঝেই। আর এ কারণেই শেষ কবিতাটি আগে আগে পড়া হয় না। আমি চাই শেষটুকু রস নিঙ্ড়ে আস্বাদন করতে। সেই রসে মুগ্ধ হয়ে রই, সিক্ত থাকি উঠে যা্ই উর্ধ্বতর আরও আরও এক অনির্বচনীয় সত্তায়। যতক্ষণ না আসে নতুন আরও এক অসাধারণ কিছু হাতের নাগালে। শুরু হলো ‘লখিন্দরের গান’। হায় খোদা! ঈশ্বর, ভগবান!! তারও কি ছিল জানা একদিন তিনিই হবেন বেহুলা কোনো এক কাব্য স্রষ্টার কাছে আর যাপিতজীবনে তার সৃষ্টিরই সব তারই হাতে নাকাল এক একটি লখিন্দরের আত্মা। আবার তারই সঙ্গে মিলনে পরম প্রত্যাশা নিয়ে দিনরাতের আরাধনা মানবজনমের! ১০টি পর্বে লেখা কবিতাটির প্রথম অংশটি পড়ি:
বোধিরা মরেছে আজ কেউটেছোবল খাচ্ছি বর-
সাঁই তুমি কথা কও, জলে ভাসি এই লখিন্দর।
নীলকণ্ঠ হয়েছি দেখো, উদোম শরীর দেখো লাশ
আমাকে করেছ পর? কেন শুধু এই পরিহাস?
সুফিবাদী ভাবনায় বেহুলা লখিন্দরের মিথকে মোল্ড করেছেন দারুণ এক কম্পোজিশনে। ভাবনা প্রকাশে কবিতাটি এক অসাধারণ মাত্রা পেয়েছে আমার কাছে। জীবাত্মা পরমাত্মার মিলনের যে আকাঙ্ক্ষা, যে হাহাকার বৈষ্ণব পদাবলি থেকে শুরু হয়ে সুফি সাধকদের মধ্যে যা চিরকাল প্রবহমান, তারই দারুণ সব ধ্বনি-প্রতিধ্বনি কবিতাটির পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে এঁকে চলেছে অসাধারণ সব ছবি। যাপিতজীবনের যাবতীয় সরল আর জটিল সবকিছু পাওয়া যায় এখানে। চাষি বর্গা চাষে ফসল ফলায় আর জমিদার ভোগ করে, ঠকায় চাষিকে। স্বার্থ উদ্ধার হয়ে গেলে মানুষ ভুলে যায় সব। পরের সম্পদে চিরকাল লোভ। সবল চিরকাল দুর্বলকে করেছে লুট। দুঃসহ তার শাসন, শোষণ। পুঁজিবাদের করালগ্রাসে ধীরে ধীরে মৃত্যুর মুখে অসহায়-করুণ মানুষ আর সভ্যতা। মানুষ ভুলছে তার অতীত। সোনালি অতীতের সব কর্ম আর শেকড়ের কথা ভুলে চলেছে কোথায় কোনো এক অসাঢ় অনামা পৃথিবীর দিকে। সেই সংশয় কি নেই এখানে? লখিন্দরের চিরায়ত প্রতীকে নির্যাতিত মানুষ সভ্যতা ও তার নিষ্পেষণের চিত্রকল্প কবিতাটির আদ্যোপান্তে:
আমার নিয়েছে সব; তবু বৃষ্টি বয়ে যায়
টিয়ার ঠোঁটের কাছে লাল ভোর সূযের প্রাণের গান গাইবে না,
এমনতর পাপের নিশানা দেখিনি।
সানকির বয়াতি ঢোলক
ভাতের বাজনা খেয়ে ক্ষুধাতুর-এখন দীক্ষিত
বানর নাচার খেলাঘর
বৃষ্টিতে শরীর ধুয়ে নেয়..
(লখিন্দরের গান: লখিন্দরের গান)
কিংবা
পিণ্ড মনে খয়রাতি মন আজ ষণ্ডা লখিন্দর
কলার ভেলাতে সোনা, পালঙ্কে সন্ন্যাসী, দেহে চট।
সেচের প্রকল্পে খরা, নাকি ঝড়? দোটানা চম্পট।
সকালে বৈকালি তারা মুখ টিপে বেহুলার শর
হাসি হাসি বাসি ভাতে কেরানির জোড়ালো থাপড়।
অঙ্কৃশে জীবন টানে লোহা লোহা শনির হোঁচট।
রাজার নৈতিক বলে খুলবেনা মরণের জট-
এমন ভরসা এলেবেদখল! স্বপ্নে যাবে চর।
এত এত সব জটিল রাজনৈতিক পতন কিংবা উত্থান উচ্ছৃঙ্খল জীবন। যৌবনের অবাধ-অগাধ ছলাকলা নিষ্পেষণ। বহুমাত্রিক আর বহুধাবিভক্ত মন, মনের জটিল পরিবর্তন। দুর্বলের ওপর সবলের মাত্রাবোধবিহীন ক্রম অত্যাচার কেবলই কি নিরাশা জাগিয়ে তোলে? না, তা নয়। কবি বলবেন আশার কথা। কবি ভাঙবেন মিথ্যের জটিলতা। পূর্ণ করার পথ দেখাবেন ষোলোকলা স্বপ্নের। ছিঁড়বেন জটাজাল আর আঁকবেন স্বপ্নের স্বদেশ। গড়বেন মনোরম পৃথিবী, সেই সুরে শেষ হয়, রুখে দাঁড়ায় নির্যাতিত মন। শুভ আর সুন্দরের আজন্ম প্রত্যাশায় আমি পৌঁছে যাই এক দুর্দান্ত সাবলিমিশনে ’লখিন্দরের গান’ পাঠ শেষে। শেষ কথা ক’টির রেশ নিয়ে কাটাই বেশ কিছু দিন।
ক্রন্দসী বেহুলা ঘুমে
সোনার রেকাবে তার এসেছি নোলক
মাছে ভাতে স্বপ্নমোড়া গুপ্ত পুলসেরাত
আমাকে দাঁড়াতে হবে।
কেরামান-কাতেবিন, দ্রাবিড় কিতাবে লিখ প্রত্ন-ইতিহাস।
অ-হল্য জীবনচরে এইখানে দাঁড়ালাম ধৃষ্ট লাঠিয়াল:
আমার দখল নেবে কে আছে এমন?
(লখিন্দরের গান: লখিন্দরের গান)
তারপর ক-ত-দি-ন কতদিন আমি আর কিছুই পড়ি না। অলস-বিবশ দিনযাপন। একেবারে সত্যি সত্যিই এমন। এভাবে একটি একটি দারুণ বই দারুণ কবিতা আমাকে মোহমুগ্ধ করে রাখে, নেশার রেশ কেটে উঠতে আমার ‘সময় নষ্ট’ হয়ে যায়। কিন্তু আমি তা অনুভব করি না। আমি রসে সিক্ত থাকি, উপভোগ করি, কাঁদি নয়ন ভরে, হাসি আনন্দে। বিষাদে পরিপূর্ণ হয়ে উঠি। এক জনমেই যেন ভোগ করি আর এক জন্মের সাধ।
তারপর শুরু হয় আর এক নতুন বিষয়। কাজী নাসির মামুনের দ্বিতীয় কবিতা বই ‘অশ্রুপার্বণ’।
আমি সেই গান, সেই অধিকলহের নৃত্য জ্বেলে রেখে
খুব এক সঙ্গত নারীকে বলি, এবার আমাকে ছাড়ো।
অনন্য প্রেমের নামে সাত পাক ঘুরে আসি পৃথিবী আমার
…
যাপনের ধুলো মেখে দাঁড়াও ঘনিষ্ঠ তুমি, আমূল সংস্রব।
দেখবে, যৌবন জুড়ে অজস্র গীতল প্রজাপতি বার বার উড়ে আসে
আমিও অধীর ছুটি পিছু পিছু
(গৃহবাউল: অশ্রুপার্বণ)
গৃহবন্দী উদাসী বাউল মনের চিত্রকল্প এত সুন্দর এত সুন্দর করে প্রকাশিত যে কবিতায়, তা তো কবিতা নয় যেন, যেন মানবের নিষিদ্ধ প্রেম। অনুসিন্ধিৎসা কাম সুশৃঙ্খল মনকে অবদমনের অনন্ত সৌন্দর্য বহনকারী এক গোপন ইশতেহার। সেখানে দারুণ দারুণ সব উপমা-রূপকের ব্যবহার। এসব আমাকে মোহমুগ্ধ করে। ঠিক বিপরীতে কিংবা সাধারণত উপমান কিংবা উপমেয় হিসেবে ব্যবহৃত হয় না এমন শব্দ আর শব্দের পর শব্দের সমাবেশ জটিল করেছে কবিতাটিকে। কিন্তু রূপের মধুরতা নষ্ট করেছে বলাই যাবে না। বরং যেন সোনার চেয়ে জুড়ে দিয়েছে কণ্ঠে হীরের দ্যুতি। আমি এইটুকুই বলতে চাই। সবুজ স্বাস্থ, শান্তির পশুদল, গোলাপমুখর হয়ে আছে, মানুষের বিষ, ঘাসমেলা গাছ, মোরগ রঙের কিছু পাখি, সদানন্দ ঘন প্রাণ, দুধেল সঙ্গীত, নৃত্য জ্বেলে রেখে, ধুলো হয় পায়ের ঘুঙুর, গীতল প্রজাপতি…ঠিক এমনই কিছু উপমা-রূপক ধারণ করে আছে।
পথের সঙ্গে জীবনের গভীর সাদৃশ্য। পরম ভালোবাসায় জীবনার্পণ আর যাতনায় তার প্রত্যাঘাতে-হতাশার এক অন্তর্ভেদী রূপ। কবির কিংবা লেখকের সূক্ষ্ম জীবনবাসনায় জীবন এবং বোধে ক্রমাগতই হতাশা দেখা দেয়। সুন্দরের পাশে অসুন্দরের অবস্থান তাকে হতাশ করে, প্রচলিত জীবনের বাঁকে-বাঁকে মনন্তর তাকে হতাশ করে, সোজা পথে বাঁকা চলন তাকে উদাস করে। এঁকে চলে পদে-পদে তুমুল অভিমান। লেখকের তো এমন হওয়ারই কথা। স্পর্শকাতরতা তারই তো স্বভাব, যে সব অনুভব করতে পারে একাগ্রতায়। আর যখন হয় আহত তার প্রকাশও তেমনি প্রতুল:
হাতে ছিল নিরেট বিকেল। সঙ্গে হাওয়া সহচর।
আজ ভালোবাসা নয়-উপেক্ষা শিখেছি মানুষ অপর করে চলে আসি
(পথ: অশ্রুপার্বণ)
যতটা সময় ধরে পড়েছি তার কবিতা, যাপন করেছি তার সময়, ততটা সময় ধরে কবিতায় এক অসাধারণ বিষয় আমাকে ভাবিয়েছে খুব। যেকোনো জায়গায়, যেকোনো অবস্থানে, যে কোনো বেদনার কিংবা বিষণ্ন যাপনের আঁকা ছবিতে কিংবা রোষে-বিদ্রোহে-প্রতিবাদে কিংবা ভর্ৎসনায় বরাবর অসাধারণ করে আশ্রয় নিয়েছে প্রকৃতিতে। তার কবিতার পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে গাছ-পাতা, ফুল-চাঁদ, নদী-হাওয়া-আকাশ কিংবা বাতাস রং, রূপ আর অনুষঙ্গ মিশে গেছে, চর্যাপদ থেকে শুরু করে রাধাকৃষ্ণ পদাবলি অবধি, প্রণয় থেকে ঘৃণা পর্যন্ত, আল্লাহ থেকে ভগবান, প্রেম থেকে স্খলন ছাড়িয়ে দমন কিংবা অবদমন নিপীড়ন শোষণ অথবা প্রজাপালনের মতো জটিল কঠিন কাঠখোট্টা বিষয়ও হয়ে তার কবিতার অনুষঙ্গ। দেখি তার একটি রূপ এই শেষ চুমুক কবিতায়:
হে বাতাসদেহ, রসনিকুঞ্জের পরপারে বেদন-বৃষ্টির পরিচারিকা,
তুমি কি ভাববে, আমিও জীবনের বিফলে উত্তাপে অপারগ
লাটিম ঘুরাচ্ছি শুধু শুধু?
যেন আমি কাঁদাখোচা পাখি;
সোনাবউ খুঁজছি কাঁদায়?
কিংবা
বোধি ও প্রেমের মধুনারায়ণ, দেখো, কবরের কাছে এলে
আমাকে জড়িয়ে ধরে পলাতক প্রফুল্ল নিশীথ;
দেখো, ঝোপঝাড় বাতাসে নির্ভার জেগে থাকে;
সারারাত কেটে যায় জোনাকির পেটভরা আগুনের হল্লা দেখে দেখে।
অসাধারণ ক্ষিপ্রতায় তিনি জন্মের আনন্দ কিংবা মৃত্যু অথবা মৃত্যু দিনের আসঙ্গ লিপ্সা কিংবা যাতনার রূপকে অসীম প্রাণবান করে তোলেন প্রকৃতির নানা উপাদানের সমাবেশে। বলেন:
‘দাদীর মৃত্যু দিনে আমিযে-গান গেয়েছিলাম;…
সকল সংক্রান্তি ব্যর্থ হয়ে গেলে
তাকেই আলোর মতো ধরে রাখি;বলি:মায়ানারী
বিপুল বয়সী তুমি সোনার কাছিম।
(জলাঞ্জলি: অশ্রুপার্বণ)
প্রাত্যহিক জীবনে পরিবার থেকে রাষ্ট্রে, ঘর থেকে পথে, সংসার থেকে রাজনীতিতে, প্রেম থেকে ঘৃণায়, কোথায় না তিনি প্রকৃতির খুব ছোট আর সাধারণ উপাদানগুলোকে ব্যবহার করেননি। বলেছেন:
আমাদের ঘরে ঘরে হিড়িম্বা, রাবণ
প্রলম্ব নির্জনে বসে মহাজাগতিক,
সংকল্প হানছে রোজ; যেন কান্না প্রকল্পিত উলঙ্গ লিপ্সায়
ওরা খুব স্বপ্ন ভেঙে দেয়।
তবে কি আমিও অলীক খাঁচার ভরকেন্দ্রে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মৌচাক দেখছি শুধু?
কখনো অনেক লাল পিঁপড়ের বাসাবাড়ি, নিম লেবু আর চড়ুইয়ের বাসা?
(কথাসৌধমালা: অশ্রুপার্বণ)
জানি না, কেন? বারবারই আমার পাঠের দীনতা স্বীকার করি। তবু এক দারুণ অনুভব আমার মধ্যে কাজ করতে থাকে কাজি নাসির মামুন পড়তে পড়তে। পাঠের দীনতাটুকু স্বীকার করে নিয়েই বলি, বিভূতিভূষণের প্রকৃতি প্রেম আর তার লেখনী আমাকে নিয়ে চলে প্রকৃতির কাছে। সবুজ আর স্নিগ্ধ হয়ে উঠি তাঁর কবিতা কিংবা গল্প পড়তে পড়তে। কাজি নাসির মামুনেও প্রকৃতির ব্যবহার শুধু যে কবিতায় সীমাবদ্ধ, তা বললে কম বলা হবে। প্রকৃতিঘনিষ্ঠ উপমা-রূপক তার কবিতার পরতে পরতে। যেন এক কবিতা বেয়ে উপচে পড়ে যায় অন্য কবিতায়। কিন্তু সেখানে আমার অনুভব বিপরীতে অবস্থান করে বিভূতিভূষণের লেখা থেকে। এখানে মনে হয় প্রকৃতি আমাকে তার স্নিগ্ধ কোলে টেনে না নিয়ে নিজেই উঠে এসেছে এই জটিল কঠিন বীভৎস নিপীড়ক শোষিত ডাকাত জীবনে। প্রেমে-বিদ্রোহে-বেদনায়-কামে-বিবাদে-বিভাসে বিবিধে। কখনো হয়ে উঠেছে দারুণ স্বেচ্ছাচারী তার অমরতায় কখনো উদ্ধত তার বিক্ষুব্ধতায়। কখনো প্রেমময় তার স্নিগ্ধতায় কখনো রুদ্র তার সংক্ষুব্ধতায়। কখনো উত্তাল তার মত্ততায়। আবার কখনো নিরীহ- নীরব ধ্যানমৌন তার গভীরতায়। পাঠে তৈরি করেছে আমার মধ্যে এক নীরব উন্মার্গ অধিরম্য আবাস।