ঢাকায় আসার পর উত্তরায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে ছিলাম প্রায় আড়াইমাস। এরপর কাঁঠাল বাগানে এসে ওঠার পর এই এলাকা আর ছাড়া হয়নি। রাজধানীর মধ্যস্থল হলেও এলাকাটা একেবারে ঘিঞ্জি। বাজারের জন্য নির্দিষ্ট জায়গা থাকলেও সারা রাস্তায়ই বাজার বসে। এছাড়া, চারিদিকে হাসপাতাল, মার্কেট; সবই আছে। তাই, আর্থিক কষ্ট হলেও এই এলাকা ছাড়া হয়নি।
গত ১৪ বছরের অভিজ্ঞতা হচ্ছে, প্রায় রাত ১টা পর্যন্ত এই এলাকা সরব থাকে। আর ফজরের আজানের সঙ্গেই কোলাহল শুরু হয়। অথচ গত ২৬ মার্চ থেকে এই এলাকা অনেক সুনসান। অনেক বলছি এ কারণে, বাজার আর প্রয়োজনীয় কিছু দোকান চালু থাকায় দিনে কিছু মানুষের দেখা মেলে।
আমি চুপচাপ ভিড় এড়িয়ে চলা মানুষ। তাই মানুষ কম এমন কোথাও যেতে বা থাকতে খুব ভাল লাগে। কতবার ভেবেছি, এই ঘিঞ্জি দেশটাতেই কেন জন্ম হলো আমার? কিন্তু এখন মানুষ না থাকাটাই নিজের কাছে এত বাড়াবাড়ি লাগছে। বারবার মনে হচ্ছে, নাহ, এটা কোনোদিন চাইনি।
বাড়িতে বয়স্ক বাবা-মা। লকডাউনের আগে আমার যাওয়া বা আম্মার আসার কথা ছিল। কোনোটাই হয়নি। কিছু হলে দ্রুত বের হয়ে যাব সে উপায়ও নেই। ছোট বোন চাকরির কারণে আটকে আছে কক্সবাজার। একটা মুহূর্ত টেনশন ছাড়া নেই। আমার আব্বা মেডিক্যাল অ্যাসিসটেন্ট। তাই, জরুরি সেবক হিসেবে তিনিও বাইরে থাকেন। একজন ডাক্তার হলেও তার মধ্যে কিছু জেদ আছেই। রাগারাগি করেও মসজিদ থেকে আটকানো যেতো না। যাই হোক, পরিস্থিতি মানুষকে বদলাতে সাহায্য করে।
ছোট বোনটা বারবার তাগাদা দিয়ে বলে একবারে বেশি বাজার করো, বারবার নেমো না। ওর পীড়াপীড়িতে বেশ কয়েকদিন পর বাজারের জন্য নিচে নেমে মনে হলো, চারপাশটা একটু হেঁটে আসি। স্বাভাবিক সময়ে রিকশা, সিএনজি, গাড়ি বা মানুষের চাপে ১০ হাত দূরেও দেখা যেতো না। এখন এক জায়গায় দাঁড়ালে অবলীলায় এক-দেড় কিলোমিটার এমনি দেখা যায়। জনশূন্য রাস্তা আর পাশের স্থাপনাগুলোকে অপরিচিত মনে হয়। মনে হয়, হাড্ডিসার ভবনগুলো আকুতি নিয়ে বলছে, প্লিজ স্বাভাবিক করো আমাদের!
বিশ্বব্যাংক কিন্তু এরইমধ্যে প্রাথমিক পূর্বাভাস দিয়ে জানিয়েছে, এ বছর জিডিপি কমতে পারে ২ থেকে ৩ শতাংশে।
বাংলামোটর হয়ে বসুন্ধরা সিটির সামনে দিয়ে হাঁটছিলাম। হঠাৎ আইল্যান্ডের ওপর হলুদ রঙের ফুল চোখে পড়লো। (নাম বলতে পারছি না, দেখলে অনেকেই চিনবেন) মনে করার চেষ্টা করলাম এই রাস্তা দিয়ে অনেক যাওয়া আসা করি, কই আগে কি দেখেছি? আগের রাতে প্রচুর ঝড় বৃষ্টি হয়েছে, তাই গাছের পাতাগুলো পরিস্কার কি না জানি না। তবে, লক ডাউনের তিনদিনের মাথায় আকু ওয়েদার জানিয়েছে যে ঢাকার বাতাস মডারেট হয়েছে। প্রকৃতির এই পরিবর্তনে আমি খুব খুশি। অন্তত কিছুদিন নিজের মতো করে বাঁচুক ওরা।
গ্রিন রোড ধরে হাঁটছি। রাস্তার পাশে কয়েকটি সুপারস্টোর খোলা, দ্রুত কেউ এসে প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে কোনো সময় নষ্ট না করেই চলে যাচ্ছেন, একটা বিরিয়ানির দোকান খোলা। অর্ডার পান কি না বা লোকজন এসে নিয়ে যায় কিনা সেটা তাৎক্ষণিক বোঝার উপায় নেই। সেখানেই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে মনে হলো করোনার আগের দিনগুলোর কথা, মোটামুটি মানের রোজগার হলেই তিনি ১৫ দিন হলেও একদিন বিরিয়ানি, তেহারি বা পোলাও খান। কিন্তু এখন অনেক মানুষের কাজ নেই। কাজ নেই কারণ মানুষ এখন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কাজ করতে পারছে না। ফলে উৎপাদন বন্ধ। আর উৎপাদন হলেও তা কেনার মানুষ কোথায়? উৎপাদন থেকে ভোক্তা পর্যন্ত ক্ষতির শুরু এভাবেই।
গণমাধ্যমগুলো জানাচ্ছে, এরইমধ্যে কোম্পানি, প্রতিষ্ঠান থেকে কর্মী ছাঁটাই শুরু হয়েছে। শ্রমিক শ্রেনী তো পুরো চেয়ে আছে ত্রাণের দিকে। পরিস্থিতি ভয়াবহতার দিকে যাচ্ছে এটা নতুন নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, কতটা ভয়াবহ হলে এটা অর্থনীতিকে বড় ধাক্কায় ফেলবে? সেটা সামলানো যাবে কিভাবে? বিশ্বব্যাংক কিন্তু এরইমধ্যে প্রাথমিক পূর্বাভাস দিয়ে জানিয়েছে, এ বছর জিডিপি কমতে পারে ২ থেকে ৩ শতাংশে।।
করোনার পরে কর্মসংস্থানে কতটা নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে তা নিয়ে কি ভাবছে সরকার? কোথায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে? এই ডাটা কি তৈরি হচ্ছে? ৮০’র দশক থেকে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠলেও সবচেয়ে বড় কর্মসংস্থান দাবি করা দেশের তৈরি পোশাক খাতকে এখনো সাহায্য দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হচ্ছে কেন? মাঝে মাঝে সরকার প্রণোদনা না দিলে তারা শ্রমিকদের মজুরি দিতে পারেন না?
সামনে বিষম অন্ধকার। সেই অন্ধকারে আকাশের তারা বা জোনাকিরাও আলো দেখানোর জন্য পাশে নেই
আজ তবু, কিনতে পারছি কয়েকদিন পর মনে হয় আমরাও না খেয়ে মরে যাব। হঠাৎ এ কথায় ফিরে দেখি দোকানিকে বলছেন এক বয়স্ক ভদ্রলোক। হ্যাঁ, ঠিক তাই। আজই একটি খবরে দেখলাম, লাখ লাখ মুরগির বাচ্চা, ডিম, দুধ ফেলে দিচ্ছেন ব্যবসায়ী, খামারিরা। এত কেনার, খাওয়ার মানুষ কোথায়?
এত ভাবতে ভাল লাগে না। ক্লান্তি আসে, শরীরটা যেন নড়তে চায় না। কিন্তু বসে থাকলে কেমনে হবে? বিকেলে অনলাইনে মিটিং করতে হবে কলিগদের সঙ্গে। নতুন অফিসে কাজ করতে এসে বুঝতে পারছি, ইন্টারনেট কেন্দ্রিক কতকিছু তৈরি হয়েছে দেশে। আমাদের নতুন প্রজন্ম এসবের সঙ্গে অনেক প্রতিনিয়ত খাপ খাইয়ে নিচ্ছে, এগিয়ে যাচ্ছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশের ভিশনকে সামনে রেখে তরুণ উদ্যোক্তারা সামান্য পুঁজি, বাবা-মার পেনশনের টাকা নিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশের অংশ হওয়ার জন্য লড়ে যাচ্ছে। গত ১২ বছরে অনেকগুলো স্টার্টআপ তৈরিও হয়েছে দেশে। করোনার ধাক্কায় সেসব এখন নড়বড়ে হওয়ার অপেক্ষায়। ৪০ বছর ধরে যে শিল্প নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখলো না। তো ভর্তুকি দিয়ে তাকে আর না চালিয়ে অন্যদিকে মনোযোগ দেওয়ার সময় কি এখনো হয়নি সরকারের?
কী হবে এসব ভেবে? করোনার এই ভয়ংকর বিপদেও ত্রাণের নামে রেপড হচ্ছে, ত্রাণের চাল চুরি করছে জনপ্রতিনিধিরা, ক্ষুধার জ্বালা সইতে না পেলে ছোট্ট মেয়েটা আত্মহত্যা করছে, কেউ চক্ষু লজ্জায় বলতেও পারছেন না ক্ষুধার কথা। কোনো সন্তান বাবাকে নিয়ে পাগলের মতো হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরেও ভর্তি করাতে পারছেন না। আবার কোনো সন্তান অসুস্থ বাবাকে ফেলে রেখে যাচ্ছেন রাস্তায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবার বুঝি মানুষের বোধোদয় ঘটবে। মানুষ এবার মানুষ হবে। হায় এই কি তার নমুনা?
সামনে বিষম অন্ধকার। সেই অন্ধকারে আকাশের তারা বা জোনাকিরাও আলো দেখানোর জন্য পাশে নেই। আর সৃষ্টিকর্তা তো দুয়ার এঁটে দিয়েছেন মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডায়।
লেখক: সাংবাদিক ও উন্নয়ন কর্মী।