লিখছি চার দশকের অধিককাল। কবিতার বইও বের হয়েছে ১৫টি। কবিতা তো কম লেখা হলো না! আরও অনেক কবিতা গ্রন্থভুক্ত হওয়ার পথে। লিখছি এখনো নিয়মিত। এর মধ্যে কোন্ কবিতাটি ‘সেরা’, কোন্ কবিতাটি ‘সেরা’ নয়—এই বিবেচনা আমার জন্যে যেমন কৌতূহলোদ্দীপক, তেমনই আমি এ বিষয়ে দ্বিধামুক্ত নই! দ্বিধা নিয়ে আমি আমার দুই-এক বছরের মধ্যে লেখা তিনটি ‘সেরা’ কবিতা নির্বাচিত করেছি এবং কবিতা তিনটির রচনার পটভূমি নিয়ে কিছু বাক্যস্ফুরণ এখানে করেছি। তা নিচে সবিনয়ে উল্লেখ করছি।
কতভাবে যে আমার কবিতা রচনার পটভূমি সূচিত হয়েছে—তার সীমা নেই! কখনো একটি ঘটনা, কখনো একটি ছবি, কখনো একটি সংবাদ, কখনো একটি অনুচিন্তা, কখনো একটি কল্পনা, কখনো কারও অভিব্যক্তি, কখনো কোনো সাময়িক ঘটনা, কখনো কোনো অবলোকন, কখনো কোনো ইন্দ্রিয়ানুভূতি, কখনো কোনো দৃশ্য, কখনো কোনো ইশারা, কখনো কোনো কৌতূহল, কখনো কোনো প্রজ্ঞান, কখনো কোনো ভাবুকতা, কখনো কোনো জিজ্ঞাসা, কখনো চৈতন্যের কোনো এক অনুরণন, কখনো কোনো কিছুর ব্যবচ্ছেদ ও সুলুকসন্ধানসহ আরও বহুবিধ সংকেত কবিতা রচনায় ঘোর তৈরি করে—যা থেকে আমার কবিতার অস্তিত্ব রচিত হয়, কবিতা পরিব্যাপ্ত হয়।
‘ড্রয়ারজীবন’ নামক কবিতাটির পটভূমি একেবারে আমার ঘরের পরিবেশ থেকে পেয়ে যাই! আমাদের বাসার যে ঘরে আমি শুই, সেই ঘরে একটি বড় আলমারি আছে। আলমারির বড় অংশটি আমার জীবনসঙ্গী ব্যবহার করে থাকে, সেই অংশে কয়েকটি ড্রয়ার তো আছে, আরও কাপড়-চোপড় রাখার জায়গা ও তাক আছে সেটায়। আলমারির আর একটি অংশে আমারও জামা-কাপড় রাখার তাক আছে। আমার জীবনসঙ্গী যখন কর্মস্থলে যায়, তখন এই আলমারি থেকে কাপড়, ব্যাগ ও গহনাও নিয়ে থাকে। তাকে এই আলমারি প্রায় নিয়মিত খুলতে হয়, আলমারির বিভিন্ন ড্রয়ারও খুলতে হয়। এই এক রিয়ালিটি আমার ভেতর দৃশ্যমান হতে থাকে নিয়মিত, তা থেকে হঠাৎ একদিন আমার ইন্দ্রিয়গ্রামে এক ধরনের জোরালো সংবেদ তৈরি হতে থাকে, আমিও চঞ্চল হয়ে উঠি, ‘ড্রয়ার’ নামক শব্দটি তখন আমার চৈতন্যের বিভিন্ন স্তরে আসে আর যায়, আর এ থেকে উৎপন্ন বিভিন্ন অভিঘাতে পেয়ে যাই—বিভিন্ন উদ্ভাস। আর এসব উদ্ভাস নিয়ে আমার এতদিনে গড়ে ওঠা কবিত্বশক্তির সাহায্যে ‘ড্রয়ারজীবন’ কবিতাটি লিখে ফেলি। মনে আছে—একনাগাড়ে বেশ ক’ঘণ্টা নিমগ্ন থেকে বিছানায় লেপ্টে থেকে কবিতাটি লিখে প্রাথমিকভাবে শেষ করে ফেলি। পরবর্তী সময়ে আরও মনোযোগী হয়ে কবিতাটির নির্মাণ শেষ করি।
আর একটি কবিতা ‘সুন্দরবনকে একা থাকতে দাও’। সুন্দরবনে বিদ্যুৎ-প্লান্ট তৈরির বিরুদ্ধে কিছুদিন আগে মিছিল ও প্রতিবাদে তেল-গ্যাস ও বন্দর রক্ষা কমিটি বেশ সোচ্চার হয়েছিল, তখন তারা ঘন ঘন মিছিল, এমনকি লংমার্চও করেছিলেন। আর এসবের খবর ও স্ট্যাটাস তখন ফেসবুকে আসছিল। মনে আছে, সেই সময়ে পেশাগতভাবে রাত-দিন ব্যস্তও ছিলাম। রাত বারোটার পর ফেসবুকে এসে দেখি সুন্দরবন বাঁচানোর আহ্বান বেশ উচ্চকিত হচ্ছে। সমসাময়িক অনেক ইস্যু নিয়ে আমি এর আগেও অনেক কবিতা লিখেছি। আমি মনে করি কবিতা সমকালের হয়েও—আগামীকালের হতে পারে, চিরকালের হতে পারে। ‘সুন্দরবন’ ইস্যুটি আমার বিবেচনাবোধে বেশ অনুরণিত হতে থাকলো। আমার মস্তিষ্কের ভেতরে তখন ‘সুন্দরবন’ এক অভিজ্ঞানের বোধভাষ্য তৈরি করতে লাগল, আমি তখন ‘সুন্দরবন’-এর সিলমোহর নিয়ে ঘুমহীন অস্থিরতায় একা একা এক ঘরে গভীর রাতে ছটফট করছি আর আমার ভেতর স্তব্দতা ভাঙছি, আর এভাবে এক এক করে কবিতাটির শ্লোক তৈরি হতে থাকলো। ভোর হয়ে আসলো, আর কবিতাটিও লেখা শেষ হলো। তার পর এক ধরনের অস্থিরতার পর শান্ত হই, ঘুমিয়ে পড়ি।
আমার আলোচনায় আর একটি কবিতা টেনে আনছি। কবিতাটির নাম ‘পাতিল’। দু-একদিন আমিও বাসায় রান্না করি। থালা-বাসন ও পাতিলও পরিষ্কার করি। জীবনের শুরু থেকেই রান্না, রান্নাঘর, বাসন-কোসন, হাঁড়ি-পাতিল আমাদের নিত্যদিনের বাস্তবিকতায় উপস্থিত থাকে। কিন্তু একদিন হঠাৎ কিছু পাতিল পুরনো ও পরিত্যক্ত হওয়ায়—তা রান্নাঘরের পাশে স্টোররুমে রেখে দেওয়া হচ্ছেছিল। এমন অবস্থায় ‘পাতিল’ শব্দটি আমার ভেতর বেশ বাজতে লাগল, এক ধরনের রিদম তৈরি হতে থাকল এবং বোধ ও প্রতিবোধ নিয়ে এক ধরনের ব্যঞ্জনা তৈরি হতে থাকল। ‘পাতিল বাতিল’—অনুপ্রাস যেন আমাকে এক বিস্ময়ঘোরের মধ্যে নিয়ে গেল। অনেক ধরনের ইশারা-সংকেত দূরবর্তী অবস্থান থেকে এসে আমাকে যেন মন্ময় করে তুললো, আমিও বাস্তববিম্বের পরস্পরা নিয়ে কবিতাটি লেখায় আত্মমগ্ন হয়ে পড়লাম। কবিতাটিতে আমার দৃষ্টিভঙ্গি ও অভিনবত্ব যুক্ত হয়ে প্রতীকী ব্যঞ্জনায় অবলোকনের এক একটি দরোজা খুলতে থাকলো। এই পরিস্থিতে কবিতটি রচিত হলো।
ড্রয়ারজীবন
আমি এক ড্রয়ারে ছিলাম
এখন অন্যবাড়ির ড্রয়ারে এলাম
. পুরনো আলমারি থেকে নতুন আলমারিতে!
নতুন আলমারি চকচকে
. সৌষ্ঠব আলাদা—
. সুনির্মিত—আয়তন বড়
বেশ ক’টি পাল্লা—ড্রয়ার অনেক
. বার্নিশ ও রঙ ভালো;
একদিন এক ড্রয়ারে তো অন্যদিন অন্য ড্রয়ারে
কখন যে কোন্ ড্রয়ারে থাকবো
তা তো আগে থেকে জানা যায় না—
. গহনাগাটির সাথে ঢুকে যাই
. জামাকাপড়ের সাথে ঢুকে যাই
. ভ্যানিটিব্যাগের সাথে ঢুকে যাই
. পয়সাপাতির সাথে ঢুকে যাই
. শ্যাম্পেনের সাথে ঢুকে যাই
এখানে এসেও স্বস্তি-স্ফূর্তি কই?
রৌদ্রস্নান নেই—
. তন্দ্রা আসে—গাঢ়ঘুম আসে না আমার!
. বিষমও লাগে—ক্লান্তি চলে আসে
. অবসন্ন লাগে—
. একটি সবুজ পাতা মুহূর্তে বিবর্ণ হয়ে যায়
. বুকে কফ জমে—
. মনে হয় বেদনার গিরিমাটি পাথর হয়েছে!
ড্রয়ারও নদী হয়ে যায়
তবে, সে নদীর জলে পড়ে
. বড় মাছের ঝাপটা খাই!
ড্রয়ারও খাঁচা হয়ে যায়—পোষাপাখি হয়ে উঠি
ড্রয়ারও জেলখানা হয়ে ওঠে—মনে হয় কারাদণ্ড নিয়ে
অতিকষ্টে জেলজীবনধারণ করি!
যখন ড্রয়ার হতে বের হই—
. গর্দানে লাগে
. থুতনিতে লাগে
. মস্তকে লাগে!
বের হওয়ার পরও সরষে ও তিল হয়ে যাই
পিষে পিষে আমা হতে তেল বের করা হয়!
ভয় করলেও—
. শক্ত হতে হয়—ধৈর্য ধরতে হয়
. হতবুদ্ধি হওয়া চলবে না—
. মা শিখিয়ে দিয়েছে!
. কণ্ঠস্বর নিচু করি!
মুখে কুলুপ এঁটে কুলরক্ষা করি!
যতক্ষণ আমি খইয়ের মত পুরোপুরি ফুটি না
ততক্ষণ খোলায় ভাজা হতে থাকি!
. গগনবিহারী কবে হবো?
ড্রয়ারজীবনে—
. কাঁটা বেঁধার অনুভূতিব্যঞ্জক শব্দ
. আমারই মূলশব্দ হয়!
সম্মান ও মর্যাদার জন্য ঢিলেঢালা
. পোশাকও পরেছি কতক
তবুও তো মুক্ত হয়ে খেয়া পার হতে পারিনি!
মাঝে মাঝে ফাঁক গলিয়ে বের হতে গিয়ে
লবণপানিতে আরও দ্রবীভূত হয়ে যাই!
অনুকম্পা ছাড়া
ড্রয়ারেও জায়গা হয় না—
পিপাসাকুল হয়ে জল স্পর্শ করতে পারি না!
আমার জন্যই—
কোনো খোলা জায়গা নেই—সেখানে গজিয়ে উঠবে ঘাস
. ঘাসের সবুজ ছেয়ে ফেলবে মনের উঠোন!
আমারই চেরাই করানো বুক শুধু সেলাই হয় না—
শুধুই রক্ত ঝরে—শুধুই রক্ত ঝরে!
সুন্দরবনকে একা থাকতে দাও
সুন্দরবনকে একা থাকতে দাও
. ওর নিঝুমতা নিয়ে একা থাকতে দাও
. ওর পাখির কিচিরমিচির নিয়ে
. ওর ডেঁয়োপিঁপড়ে নিয়ে
. ওর ঝুলনপূর্ণিমা নিয়ে
ওর নদীর জলশব্দ নিয়ে একা থাকতে দাও!
ওর গরান-হেতাল
. ওর গোলপাতা
ওর বাঘ-হরিণ নিয়ে একা থাকতে দাও!
. ওর বাওয়ালী-মৌয়ালী নিয়ে
. রৌদ্রতাপে একা থাকতে দাও!
ওর কচিপাতা
. পঞ্চমুখী জবা
স্বর্ণলতা নিয়ে একা থাকতে দাও!
ও তো কারো অনিষ্ট ডেকে আনেনি
. মরণকালও না!
তবে কেন তার শবাধার তৈরি করা হচ্ছে!
ওর নাভিশ্বাস উঠলে
. তোমারও হবে ওষ্ঠাগত প্রাণ!
ওকে যমে টানলে
. তোমাকেও যেতে হবে লাশকাটা ঘরে!
পাতিল
পাতিল বাতিল করার সময় হয়েছে এখন
তারপরও বাতিল করছো না কেন?
এ পাতিলে তরকারি পুড়ে যায়
. সিদ্ধ হয় না আলু—
জ্বাল দেওয়া যায় না দুধ
এমনকি পানি ফুটানো যায় না
জল-তেল মিলমেশ করে রাখা যায় না!
এর এনামেল নষ্ট হয়ে গেছে—
. মরচে ধরেছে
সে এখন তাপমাত্রা ধরে রাখতে পারে না!
সে এখন তাপশক্তি সহ্য করতে পারে না!
অ্যালুমিনিয়ামের পাতিল
. লৌহমিশ্রিত পাতিল
ইস্পাতমিশ্রিত পাতিল
. রূপোর পাতিল
এমনকি সোনার পাতিল
সে-ও বাতিল হয়ে যেতে পারে—
যদি তা দিয়ে তাপানো না যায়
যদি তা দিয়ে তাতানো না যায়
যদি তা দিয়ে ভাপানো না যায়
রসুইঘরে এ পাতিল রেখে কার কী লাভ?