আমি বরাবর উত্তাল সময় পাড়ি দেই। কথায়, কবিতায়, নিঃসঙ্গতায়, প্রেমে, ধ্যানে, নাচে-গানে আমার সময় ব্যপ্ত থাকে সব সময়। সম্ভবত এটি আমার দুর্বলতার বিশেষ একটি দিক। আমি সত্যি সত্যি কবিতার ভেতরে হাঁটি, কবিতায় খাই, কবিতায় ঘুমাই, কবিতায় বেদনার্ত ও আনন্দিত হই। আর আমি লিখতে থাকি প্রকৃতি দেখে, লতাপাতা-গুল্ম দেখে, মানুষের মুখ ও মুখের অভিব্যক্তি দেখে, গাছ ও গাছের শেকড় দেখে, পাতাদের দেখে। আমি ভাবতে থাকি পাহাড় ও পাদদেশ, ডুবতে থাকি ঢেউয়ের উচ্ছ্বাস ও বিচূর্ণ জলের ফেনার ভেতর। আর আমি লিখতে থাকি। আমি জীবন লিখি, জীবনের দর্শন ও রহস্য লিখি, কবিতার আপন বেদনা ও গান লিখি।আপন মানুষের মনে ও মুখোশে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য অভিব্যক্তিকে লিখতে থাকি কবিতায়। ভাবে ও মরমে, মননে, দর্শনে, কল্পনায় ও প্রভায়, চিন্তা ও চেতনায় কবিতা আমাকে আক্রান্ত করে, ঘুমে, জাগরণে, আড্ডায়, নেশায়, এমনকি নেশাহীনতায়। আমার কবিতা জীবনকে ফিরে দেখে বারবার, ঝরাপাতার উড়ে যাওয়া দেখে, বাবুইয়ের বুননের কারুকাজ দেখে, সম্পর্ক ও সম্পর্কহীনতার মাঝে যে বেদনা ও ব্যবধান তাকে দেখে। বিরহে যে বেদনা নামে তার ভেতরে আমার কবিতা এঁকে দেয় উচ্ছ্বাস, আনন্দে যে আত্মহারা তাকে সে করে তোলে বেদনাঘন। লৌকিক ও অলৌকিকতার প্রশ্ন ও মীমাংসাকে টেনে এনে অমীমাংসিত সত্যের সন্ধানে আমার কবিতা হারাতে থাকে। আবার বীজের গর্ভে লুকিয়ে থাকা ফসলের চঞ্চলতার ভেতর নেচে-গেয়ে আমার কবিতা আপন হয়ে ওঠে অন্তরের।
আমি হাঁটতে থাকি একটি রেখার ওপর দিয়ে। আর আমার কবিতা সেই রেখাকে অতিক্রম করতে চায়, আবার অসংখ্য রেখার বুনন করে মিলতে ও মিলাতে চায় একক ও বহুরৈখিক বিন্দুতে। আর বিন্দুর পরিধি ঘিরে কেবলই কবিতার নাচন। সেই নাচনে আপন হয়ে ওঠে মানুষ ও প্রকৃতি, সব সকাল ও বিকাল আপন অধিকারে চলে আসে, আর আমি অবিচল ডানার উত্থানের সঙ্গে উড়তে উড়তে আদি পৃথিবীর গানের ভেতরে উল্লসিত হয়ে আগুন ও সমুদ্রের দিকে চলে যাই। কবিতা তাই আনন্দ, কবিতা আনন্দবাড়ি অথবা রাতের কঙ্কাল হয়ে ঝুলে থাকে, মন ভার করে, কাঁদে, আবার প্রেম, মৃত্যু ও সর্বনামে নিজের ভেতরে নিজে নিঃশেষিত হয়ে জেগে ওঠে।সময়কে আমার কবিতা মুঠোবন্দি করে সময় উতরাতে চায়। ভূখণ্ডে কেঁপে ওঠা মৃত ঘোড়ার কেশরে সে জেগে ওঠে, অনেক উঁচুতে পানশালায় আনন্দের পর আমার কবিতা খামচে ধরে রাজার পোশাক। সমূহ সংকেতের ভাষায় মূর্ত হয়ে আমার কবিতা কলমতালাশ করতে থাকে, ভবিষ্যতমুখী হয়ে। আর দহনদগ্ধ সময়ের পাণ্ডুলিপি হয়ে একেকটি কবিতা দাহকাব্য হয়ে ওঠে আপনাকে পোড়ে, মানুষের গহীন অন্তরে ঢুকে সে দহনে সুবাতাস দেয়।
সময় আমাকে স্তব্ধও করে দেয়। সঙ্গ ও নিঃসঙ্গতার ভিতরে যে আলোক ও অন্ধকার তাকে ঘিরে মর্মের যে বেদনা বাজে ও নিস্তব্ধতায় হারায় আমার কবিতা তার ভিতরে অবগাহন করে জেগে ওঠে। কবিতা আমাকে ঘোরগ্রস্ত করে আর অন্ধ সময়ের গ্রাস থেকে বাঁচিয়ে রাখে। আমি কবিতার ভাব ও বৈভবে, আপন সুরত ও সুন্দরতায় নিজেকে পাই। নিজের ভূখণ্ডের আলো-হাওয়া, ভাব ও মরম খুঁজে ফিরে সন্ধান পাই, যেসব রত্নখণ্ডের সেসব রত্নকে কবিতার চিদাকাশে ধরতে চাই। বাংলার ভাবের ভেতরে হাঁটতে হাঁটতে আলো ঝলমল হয়ে উঠি। ঝিলমিল ঝিলমিল তারার আলো দেখতে না পেয়ে পরের ধনে পোদ্দারি করার যে ধরনের মাদকতা সময়ের কোলে বসে আছে, তার বাইরে গিয়ে আপন স্বভাবে আমার কবিতা গান গাইতে চায়। সময় যখন কোলাহলমুখর, সময় যখন পরশ্রীকাতর ও ইর্ষাপরায়ণ, সময় যখন আপনাকে চিনতে না চায়, আমার কবিতা তখন ভাবে ও মরমে ডুবে গিয়ে শব্দশরমে না ভোগে সহজ ও মুক্ত হয়ে ওঠে রসের ও সৌন্দর্যের গান করে। সময় যখন অনর্থে হাঁটতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, আমার কবিতার তখন বাংলার মাটি ও মানুষের ভাবের মূলার্থের দিকে চোখ ফিরিয়ে আনতে চায়। সে ধ্যান করে, গান করে, শত শত বছরের ঐশ্বর্যের ভিতরে রত্নভাণ্ডার পেয়ে আমার কবিতায় ভবিষ্যতের সলোক সন্ধান দিতে চায়। ভাবে, ভাষায়, শৈলীতে, বিষয়ে-বৈচিত্র্যে, রূপে-গুণে, ঘোর ও মুগ্ধতার ভেতরে যে বাংলা কবিতা অবগাহন করছিল তার স্বরূপ উন্মোচনের ভার নিয়ে আমার কবিতা ভারমুক্ত হতে চায় আপনার বৈভবের স্বভাবে, আপন রূপের জগতে, যেখানে কারও মুখাপেক্ষী হয়ে নয়, বরং কবিতার ঐশ্বর্য ও রত্নভাণ্ডারের ঔজ্জ্বলতায় ঝলমল চোখে সে দেখতে চায় আপন রূপসৌন্দর্য। আমার কবিতার তাই শুরু নেই, শেষও নেই। একটি অনন্ত অশেষ রেখা মাত্র, যা এসে মিলে গেছে প্রকৃতি ও মানুষে, অন্তরে ও গহীনে। কবিতা অনন্ত ও স্থির। মৃত্যুহীন। স্বয়ম্ভু।
যখন কিছুই ছিল না ॥ আহমেদ স্বপন মাহমুদ
১.
ওখানেই নামতে চাই
যেখান থেকে এসেছি।
নাই থেকে
আজব-রঙা অ-জীব
স্বপ্নঘোর শূন্য থেকে
নাই হয়ে যাব
পুনরায়।
বিপুল শূন্য সমারোহে
পূর্ণ পরমে
হরিহরে
লা মোকামে
নীলে, লীলায়
শূন্যতায়
নাই হয়ে যাব।
লা শরিকে।
২.
আমি একা। ঝিলমিল করি।
তুমি আস। ঝিলমিল করো। পরানে।
তোমারে ভালোবাসি। জলে। রূপে। রূপাকারে!
আন্ধারে। কেউ ভালোবাসতে চায় না।
তুমি আস। নাওয়ে চড়ে। ঝিলমিল করে।
কে বানাইছে দেহ, বানাইছে মন, মনের নাও
রংবেরঙের, দেখি নাই তারে
নাওয়ের মেস্তরিরে।
আজব কলের নাও থেকে ঝরে কত গান
পরানের গহিন আহ্বান।
আমি বসে থাকি একা। আপনার ভেতর। আপনায়।
ঝিলমিল, ঝিলমিল করে রে ময়ুরপঙ্খি নায়।
৩.
না মুখ, না পৃষ্ঠদেশ
না আপন সুরত দেখা যায়
না অন্তঃপ্রাণ
আয়না ছাড়া
হেরার গভীরে জাগে
আপনার রূপ
সে-ও সুনসান
পরম্পরা
আয়নার ভিতর ঝিম মেরে আছে
ঝিমঝাম
লক্ষ যোনি
কোথা হতে এসে
তড়পায়
কাঁপে আবে জমজম
কোথা থাকে মনে আজাজিল যম?
আয়নায়
কোন ইশারায় ভেঙে পড়ে
সিনাজুরি, সহসা কাচের নাম
আপনায় জান
সাদাকালো রুহের আসমান!
৪.
আমার কোনো অবলম্বন ছিল না।
আগুন ও হাওয়া ছিল না কোনো।
না স্বপ্ন ও আশ্রয়, না বন্ধুতা।
ছিল না আকাশ ও জমিন, না নিঃস্বতা
না আলো ও অন্ধকার।
আমি ভাসতে ভাসতে ছিলাম
না জীবন ও মৃত্যুর মুখে, না কোথাও।
আমার কোনো অবলম্বন ছিল না।
না স্বপ্ন ও স্বপ্নহীনতা।
না সূর্য ও সম্ভাবনা।
না বিষ ও বিবাহ, না বেদনা।
না তুমি ও ঘৃণা, না রক্ত।
না আঙুল ও প্রেম, না যৌনতা।
না রাত্রি ও দিন, না বিনাশ।
না জিঘাংসা ও ক্ষয়, না ইতিহাস।
আমি ভাসতে ভাসতে ছিলাম
ভাসতেই ছিলাম
ভাসতেই আছি
আমার কোনো স্বপ্ন ও অবলম্বন নাই!
৫.
মানুষ মরে যাবার আগে তার নাক বাঁকা হয়ে যায়।
বাঁকা নাকে চুমু খেতে খেতে আমি পড়ে থাকি। কোথাও না।
আপনার মাঝে। তোমার মাঝে। রূপে। অরূপে। কিছু পাই না।
না পাওয়ার কতকিছু মানুষ কেমনে যে কী জানে
মাথায় কুলায় না! ভাবনা আসে। ভাবনা যায়।
আর চুমু খায় বাঁকা মরণের বিষাদের নাকে।
আমি প্রতিদিন নাক দেখতে দেখতে ঘুম যাই।
ঘুম যাবার আগে তোমার কথা ভাবতে থাকি।
আর শূন্যে উড়ায়ে দিয়ে হাওয়া খেয়ে বাঁচি।
তুমিও হাওয়ার দেশে চলে যাও অবলীলায়।
মরে যাবার আগে তোমার নাক কতখানি বাঁকা বাঁশি হয়েছিল
তার সুর জানতে গিয়ে আমি এখন সুদূরের নাক হয়ে গেছি; অদ্ভুত!
আমি কি তোমার মরণ বাঁকা নাকের শূন্যতা, আহমেদ স্বপন মাহমুদ!