এমরান কবির—দুহাতে লিখছেন। কবিতা দিয়ে শুরু। তারপর গল্প, প্রবন্ধ, সমালোচনা, উপন্যাসও লিখলেন। সাহিত্যের সব শাখায় তাঁর কমবেশি বিচরণ চোখে পড়ার মতো। ২০১১ সালে প্রকাশিত ‘কী সুন্দর মিথ্যাগুলো’ কাব্যগ্রন্থ তাঁকে কবি হিসেবে এনে দেয় বিপুল পাঠকপ্রিয়তা। কবি হিসেবে পরিচিতি পেয়ে যান এমরান কবির। বইটি নিয়ে দৈনিকের সাহিত্য পাতাগুলো করেছিল বিশেষ আয়োজনও। কয়েকজন অগ্রজও করেছিলেন মূল্যায়ন। ২০১২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর গল্পগ্রন্থ ‘নিদ্রাগহন মহাশূন্যে’। এই পাণ্ডুলিপির জন্য তিনি পান জেমকন তরুণ কথাসাহিত্য পুরস্কার। গল্পকার হিসেবে পেয়ে যান পরিচিতি। পরিচিত হয়ে ওঠেন কথাকার হিসেবেও। ২০১৩ সালে বের হয় তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘পালকভরা সূর্যাস্ত’। এরপর ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয় গদ্যগ্রন্থ ‘আমি লিখেছি এইসব, আমি লিখি নাই’। ২০১৬ সালে প্রকাশিত হয় উপন্যাস নীল বোতাম। মুক্তিযুদ্ধের সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র ভাষা সৈনিক গাজীউল হক। কোথায় নেই কবি এমরান কবির? বাংলা সাহিত্যে যেখানে অনেক কবি, গল্প প্রকাশ করেন না; গল্পকারের তকমা লেগে যাবে এই ভয়ে! যদি কবিতার চেয়ে গল্প পাঠকের কাছে বেশি আদর পেয়ে বসে তাহলে সমূহ বিপদ সংকেত! কিন্তু এমরান কবির সে সব কানে শাহাদাৎ আঙুল ঢুকিয়ে প্রকাশ করছেন একের পর এক গ্রন্থ।
ব্যক্তি এমরান কবিরকে আমি ভালো চিনি না। কিন্তু যে কবি ও গদ্যশিল্পী এমরান কবিরকে চিনি, তাকে নিয়ে দুকলম লেখা। নতুন করে তার কবিতার বই ‘কী সুন্দর মিথ্যাগুলো’ নিয়ে আর কিছু লিখতে চাই না। লিখতে চাই না তার গল্প নিয়েও। ‘আমি লিখেছি এইসব আমি লিখি নাই’ এই প্রবন্ধ গ্রন্থে মোট ৭টি প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছে।
‘আত্মপক্ষ’-এ তিনি লেখেন, ‘‘তবু এত কিছুর পরও ভেতরের কোনও এক ‘আমি’ স্বচ্ছ-অস্বচ্ছ পথ পেরিয়ে মস্তিষ্কে উঠে আসে। রক্তে ঝড় তোলে, চেতনায় ভূমিকম্প ছড়িয়ে দেয়। তখনো ‘আমি’ কে নিয়ে বসে পড়ি। ছোট ছোট হরফে নিজের আত্মজাকে স্নেহসিক্ত কালিতে ভরিয়ে তুলবার চেষ্টা করি।’’
‘পবিত্র মাতালের স্বীকারোক্তি’ প্রবন্ধে তিনি একজন কবি হিসেবে নিজেকে পবিত্র মাতাল দাবি করে লিখেছেন—‘কোনও শান্তিই কবির জন্য চিরস্থায়ী নয়। শান্তি অন্বেষণের মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে নিরন্তর লিপ্ত হতে হয় কবিকে। কাঙ্ক্ষিত শব্দটি তার কাছে চিরকালই ধরা-অধরার মাঝামাঝিতে দোল খায়। মরীচিকা আর মরুজ্যোতিতে কবির দৃষ্টিভ্রম ও শুদ্ধতায় বিকিরিত হয়। কাজেই তার প্রাথমিক অন্বেষণই আঘাতকারী। তাহলে কি কাঙ্ক্ষিত শব্দটির আঘাতে কবি নিরন্তর আহত ও বিপর্যস্ত! শব্দ কি সত্যি সত্যি কবিকে আঘাত করে?’ তিনি আরও বলেন—‘এভাবেই এক সময়ের আহ্লাদ অন্য সময়ে প্রতারক হয়ে যায়। শুরু হয় শিল্পের অতৃপ্তি। এই অতৃপ্তি কবিকে আবার তৃষ্ণার্থ করে তোলে। একজন কবির জন্য এ ধরনের অভিজ্ঞতাও দরকার। পানিকে ফোটালে এর ভেতরের ডিজলভ অক্সিজেনগুলো নষ্ট হয়ে যায়। ফলে পানি হয়ে যায় স্বাদহীন কিন্তু জীবাণুমুক্ত। জীবনকে তাই শৈল্পিক ও কলুষমুক্ত করতে চাই প্রতারণার দহন। এ দহনও এক প্রকার জ্বালানি।’
এভাবে নিজের অভিজ্ঞতাজাত ফসল তুলে তিনি পাঠকের সামনে নিজের দহনকে প্রকাশ করেন। কবির আশা-হতাশা, স্বপ্ন-দুঃস্বপ্ন, প্রেম-বিরহ, জীবন ও যাপনের বিরুদ্ধচারণসহ দ্বিধা ও দ্বন্দ্বের একটা ফলক রচনা করেন। মজার বিষয় হলো তিনি এই গদ্যের শেষে কিছু সুন্দর সুন্দর পরিশিষ্ট যোগ করে দিয়েছেন। সেগুলো আবার প্রশ্ন আকারে! যেমন—‘এক কবির ভেতর থেকে জন্ম নেওয়া অসংখ্য ‘আমি’ কে বা কারা? মাতালরা কখনো পবিত্র হয়?’ এ রকম আরও কয়েকটি প্রশ্ন।
‘যুবক যুবতীর গল্প অথবা হলুদ বিকেলের হাতছানি’ প্রবন্ধ শুরু হয়েছে শামীর রেজার কবিতা দিয়ে। এই গদ্যে কবিতার বিভিন্ন রকমের চরিত্র আর রঙ প্রকাশের চেষ্টা করেছেন তিনি। এখানে যুবক কবি আর যুবতী কবিতা রূপে উপস্থাপিত হয়েছে। আর এই যুবতী কবিতার শরীর আর মন কেটে কেটে করেছেন অভিজ্ঞ ডাক্তারের মতো ব্যবচ্ছেদ। কবি ও কবিতার পরিণাম ও পরিণতিসহ টোটাল একটা উপলব্ধি নিজের ফুল বাগানের মতো সাজিয়ে তোলেন। তিনি লেখেন, ‘যুবক জানে এইসবের মধ্যেই সে হারিয়ে ফেলেছিল শৈশবের নামতা। নামতার খাতা। খাতার গন্ধ ও নিশ্বাস।’ আবার বলেন—‘যুবকটি যুবতীর হাত ধরে না।’ কারণ সে জানে, ‘আমাদের সংস্কৃতির অবয়ব থেকে এখনো খসে পড়েনি রক্ষণশীলতার ছাপ।’
আবার কবিতা সম্বন্ধে দিয়েছেন নিজস্ব বয়ান। ‘কবিতার স্বাদ একই সাথে পঠন-ধ্যান-অনুভবের ফসল। নৈঃশব্দতা ব্যতীত এই ফসল ঘরে তোলা অসম্ভব। শব্দময় আধুনিক পৃথিবীতে কে আজ নৈঃশব্দময় হতে চায়? কে হতে চায় ধ্যানী? কে আজ সুখ চায় আত্মার অনুভবে? নৈঃশব্দের পরিবর্তে অধিক শব্দময় হয়ে, ধ্যানীর পরিবর্তে কোলাহলসর্বস্ব হয়ে, আত্মার পরিবর্তে শরীরী অনুভবের কাছে গিয়ে আজ আমরা নতজানু হয়েছি।’
কবি ও কবিতা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বহুকথা বলেছেন বহু কবি ও সমালোচক। কিন্তু এমরান কবির তার নিজের কথাগুলো আপন করেই তুলেছেন পরম মমতায়। সে কথাগুলো নুতন না হোক কিন্তু অন্যের কথার ধার না ধেরেই বলেছেন নিজস্ব ঢঙে। বলেছেন—‘যুবক কী চায় যুবক জানে না। যুবকের কী করা উচিত, যুবক জানে না। কে এই যুবক? সময়ের বাঁকে বাঁকে জন্ম নেওয়া নতুন কবি! কে এই বালিকা? কবিতা!’
‘অর্থহীনতার অর্থহীন গদ্য’ প্রবন্ধে তিনি বলেন— ‘একবার মনে হয়েছে আমি লিখছি এইসব। আরেকবার মনে হয়েছে আমি লিখি নাই।’ তিনি বলেন- ‘কবিতার অর্থময়তা হয়তো বা এ রকমই। জীবনের মতো। জীবন কী? এক গোলক ধাঁধাঁ। গন্তব্য এক। পরিণতি ভিন্ন।’ এবং এখানে তিনি অমা আলাইনা ইল্লাল বালা বলেই শেষ করেন। এই প্রবন্ধে তিনি শোনান ভাস্কর্য কারিগর পিগম্যালিয়ানের গল্প। যিনি পাথরের ভাস্কর্যের প্রেমে পড়ে যান এবং বিভিন্ন প্রেমের দেবীদের কাছে ধর্ণা দিতে থাকেন। এক সময় ব্যর্থ মনোরথে ফিরে আসেন। এসে দেখেন সেই পাথরের প্রাণ ফিরেছে! তবে সত্যিকারের প্রেমে পাথরেও প্রাণ ফিরে পায়!
‘আত্মপ্রক্ষেপ’ প্রবন্ধে তিনি সরাসরি সরলতা যেমন কবিতা নয়, তেমনি শব্দের জটিলতাও কবিতা নয় বলে ঘোষণা দেন। তাঁর মতে, কবিতা হলো এই দুইয়ের মাঝে বসবাস করা পালকির মতো। যার দুই পাশের নিকটে বেহারা তাকে কাঁধে করে বহন করে কিন্তু ভেতরের নতুন বউয়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে না। যত কৌতূহল সেখানে পথের লোকের, যা দূর থেকে দেখা বউয়ের মতো! কবিতা হবে রহস্যে মোড়ানো। রস মাধুরিতে গা ভাসিয়ে দেওয়া অন্য কোনও ঘাসফুল।
‘কবিতার ভাষা: অভিনব নিরক্ষরতা’ প্রবন্ধে তিনি গণিতের মতো একটা ফরমেট দাঁড় করিয়েছেন। কখনো কখনো জ্যামিতির মতো রেখা ও কোণের সামঞ্জস্য বিধানে প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। মাইকেল, রবীন্দ্র-নজরুল ও পঞ্চপাণ্ডবসহ অনেক কবির সরস আলোচনা টেনেছেন। দেখিয়েছেন মাইকেলের মধ্যযুগের ভাব ধারা থেকে রবীন্দ্রনাথ কিভাবে নিজেকে আলাদা করে তুললেন। আবার রবীন্দ্রকালে কিভাবে নজরুল ও সত্যেন্দ্রনাথ ভিন্ন আঙ্গিক নিয়ে হাজির হলেন। কিভাবে পঞ্চপাণ্ডবের জীবননান্দ ও সুধীনদত্ত আলাদা আলপথে হেঁটেছেন অভিন্ন রঙিন জামা পরে। এই তুলনামূলক আলোচনা বেশ সুখপাঠ্য।
‘নব্বইয়ের কবিতা: মহাজাগতিক ব্যাপ্তির পর’ নামে একটি কবিতাবিষয়ক বিশ্লেষণী প্রবন্ধ রয়েছে তাঁর। এতে তিনি ৯ জন কবির কবিতার ওপর দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। আলফ্রেড খোকনের কবিতার গীতলতা ও গদ্যময়তা। মজনু শাহ’র কবিতার রহস্যভরা আঙুরক্ষেত! সরকার আমিনের চমৎকারিত্বময় প্রবাদতুল্য কবিতার দারুণসব উপমা। মিতুল দত্তের নারীবাদী কবিতার মধুর যন্ত্রণাকে চিহ্নিত করেন তিনি। শামীম রেজার কবিতায় গ্রামীণ মুখের ও চলতি কথাগুলো কীভাবে কবিতায় খইয়ের মতো ফুটে ওঠে। মাহবুব কবিরের ঝরঝরে ন্যাকামোহীন কবিতার অন্য রকম কদর করতে ভুলে যাননি এমরান কবির। হেনরী স্বপনের কবিতায় উপমা ও বৈচিত্রের কথাও বলেছেন অকপটে।
তাঁর শিল্প-সাহিত্য বিষয়ক গদ্য-প্রবন্ধগুলোয় তিনি মূলত নিজের ব্যক্তিগত অভিমত ব্যক্ত করেছেন। পাশাপাশি বিশ্লেষণ করেছেন বিভিন্ন লেখক-কবির সাহিত্যকর্মের। তাঁর এই শিল্পচিন্তায় ফুটে উঠেছে ব্যক্তিগত জীবনদর্শন, চিত্রিত হয়েছে পাঠলব্ধ ধারণা ও অভিজ্ঞতার নির্যাস। গত পনের-বিশ বছর ধরে যে ক’জন কবি-প্রাবন্ধিক গদ্যচর্চায় নিরন্তর নিয়োজিত রয়েছেন, এমরান কবির তাদের মধ্যে উল্লেখ্য।
আজ ৫ এপ্রিল, আজ এই কবি-প্রাবন্ধিক-কথাকারের জন্মদিন। শুভ জন্মদিন।