তাকে বলা হতো বাংলা গানের প্লেব্যাক সম্রাট। দর্শক-স্রোতা তাকে প্লেব্যাক সম্রাট উপাধি দিলেও তিনি নিজেকে আজীবন কণ্ঠ শ্রমিক বলেই দাবি করতেন। হাতে রেডিও নিয়ে অবসন্ন দুপুরে কৃষক ভাতের লোকমা মুখে নিতেন আর এন্ড্রু কিশোরের গান শুনতেন কিংবা বাসের ড্রাইভার বাস চালাচ্ছেন আর শুনছেন তার গান ‘জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প।’
পোশাক শিল্পের শ্রমিকেরা সকাল সাতটায় তার গান শুনতে শুনতে মনটাকে চাঙ্গা করে কারখানার উদ্দেশে বের হতেন। তিনি ছিলেন শ্রমজীবী মানুষের শিল্পী। তার গানের আবেদনের বিস্তার ঘটেছিল কৃষক থেকে শুরু করে সব পেশার মানুষের ভেতরে। বাংলা গানকে সোনালি সময় উপহার দিয়েছেন তিনি। বাংলা চলচ্চিত্রে অনেক কালজয়ী গান তার স্বর্ণকণ্ঠের ছোঁয়া পেয়েছে।
দীর্ঘ একবছর ক্যান্সারের সঙ্গে লডাই করে অবশেষে ঈশ্বরের ডাকে সাড়া দিলেন তিনি। কাঁদিয়ে গেলেন বাংলার কোটি ভক্তকে।
নন-হজকিন লিম্ফোমা নামক ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন তিনি সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা করেও ক্যান্সার নির্মূল হয়নি তার। চিকিৎসকরা হাল ছেড়ে দেওয়ায় ক্যান্সার নিয়েই ৯ মাস পর ২০২০ সালের ১১ জুন দেশে ফেরেন তিনি। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি রাজশাহীতে ছিলেন।
এন্ড্রু কিশোরের চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক যাত্রা শুরু হয় ১৯৭৭ সালে আলম খান সুরারোপিত মেইল ট্রেন চলচ্চিত্রের ‘অচিনপুরের রাজকুমারী নেই যে তাঁর কেউ’ গানের মধ্য দিয়ে। তার রেকর্ড করা দ্বিতীয় গান বাদল রহমান পরিচালিত এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী চলচ্চিত্রের ‘ধুমধাড়াক্কা’। তবে এ জে মিন্টু পরিচালিত ১৯৭৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত প্রতীজ্ঞা চলচ্চিত্রের ‘এক চোর যায় চলে’ গানে প্রথম দর্শক তার গান শোনে। গানটিও বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে।
এন্ড্রু কিশোরকে বিশ্লেষণ করতে হলে তার গানের চিরন্তন আবেদন ও গভীর ভাবকে বুঝতে হবে। যে ভাব সব শ্রেণীর মানুষের হৃদয়কে আন্দোলিত করতে পেরেছে। যতদিন বাংলা ভাষা ও বাংলা গান থাকবে, ততদিন কোটি মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন এন্ড্রু কিশোর।
চলচ্চিত্রে অসংখ্য গানে তিনি কণ্ঠ দিয়েছেন। তার ভরাট কণ্ঠের আবেদন শুধু বাংলাদেশেই নয়, বাংলা ভাষাভাষী পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের মন জয় তরেছে। এক সময় তার গান না হলে চলচ্চিত্র জমতো না। বাংলা চলচ্চিত্র মানেই এন্ড্রু কিশোরের গান।
ব্যক্তি এন্ড্রু কিশোর ছিলেন গায়ক এন্ড্রু কিশোর থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। অসম্ভব রকমের ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ছিলেন তিনি। তার চলন যেমন সূর্যের মতো প্রখর ছিল, বলন ছিল তটিনীর মতোই অমায়িক ও মোলায়েম। তাকে যারা কাছ থেকে দেখেছেন, তাদের কাছ থেকেই শোনা। তিনি মানুষ হিসেবে ছিলেন সৎ ও চাপা স্বভাবের। নিজের দুঃখ কাউকে বুঝতে দিতেন না। সবসময় থাকতেন হাসিখুশি। তবে এ হাসিখুশিতে কখনোই ছিল না হাল্কা চাল কিংবা রসিকতা। সরাসরি কিছু বলতেন না। যেচে মানুষের সঙ্গে কথা বলা কিংবা মেলামেশা করা পছন্দ করতেন না। তবে সাধারণ শ্রোতাদের প্রতি ছিলেন শ্রদ্ধাশীল। মাকে খুব ভালোবাসতেন। তাই মৃত্যুর পর যেন তার কবর মায়ের পাশে হয় সবাইকে সেই অনুরোধ করে গেছেন।
এন্ড্রু কিশোর শুধু চলচ্চিত্রের গান গেয়েই সমাদৃত হননি। এই উপমহাদেশে কণ্ঠের জাদুতে এক আলাদা সংগীত ভুবনও তৈরি করতে সমর্থ হয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গেরও বেশ কিছু সিনেমায় গান গেয়েছেন। তার কণ্ঠে যেন মানুষের চিরন্তন বেদনার কথাই বলে ওঠে সবসময়। তাই তিনি হতে পেরেছিলেন আপামর জনসাধারণের শিল্পী। বাংলাদেশ ও ভারতে বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় ছিলেন।
মানুষ বেঁচে তাকে তার কর্মে। এন্ড্রু কিশোরকে বিশ্লেষণ করতে হলে তার গানের চিরন্তন আবেদন ও গভীর ভাবকে বুঝতে হবে। যে ভাব সব শ্রেণীর মানুষের হৃদয়কে আন্দোলিত করতে পেরেছে। যতদিন বাংলা ভাষা ও বাংলা গান থাকবে, ততদিন কোটি মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন এন্ড্রু কিশোর।