একদিন এক খাঁ-খাঁ দুপুরে ঢাকা থেকে গাড়িতে করে জয়দেবপুর পার হয়ে শালজঙ্গলের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলাম। প্রখর দুপুরের জনমানবহীন বন। বনের ধারে হঠাৎ দেখি ছিমছাম পরিপাটি নতুন একটি কুঁড়েঘর। আর একঝলক দেখলাম, শাড়িপরা একটি মেয়ে ঢুকল সেই ঘরের ভেতর। ব্যস, ওইটুকুই, আর কিছু না। আশেপাশে আর কোথাও কোনো বসতি বা লোকজন কিছুই দেখতে পেলাম না। গাড়ি চলছে। অনেকক্ষণ চললাম, কিন্তু নাহ্, কেউ নেই, কিছুই নেই। কোনো ঘরবাড়ি, বাংলো বা জনমানুষ কোথাও কিছুই নেই। শুধু জঙ্গল আর জঙ্গল। এলোমেলো শালজঙ্গলের ভেতর হঠাৎ কুঁড়েটিকে মনে হলো যেন ইতস্তত ছড়ানো-ছিটানো প্রচুর ক্যাকটাস ও কাঁটাগুল্মের ভেতর হঠাৎ সযত্নচর্চিত, পরিপাটি এক গোলাপ কেয়ারি। ব্যাপারটা কি সত্যি, নাকি কোনো দৃষ্টিবিভ্রম! অবিশ্বাস্য ঠেকল, আর কেমন অদ্ভুত এক অনুভূতি! সুনসান নির্জন ঘুমগুমসুম দুপুরে কখনো-কখনো এরকম হয় না যে, আচমকা কে যেন নাম ধরে ডাকল, স্পষ্ট এবং দু-দুবার, কিন্তু ফিরে দেখি কেউ নেই, কিংবা ধোঁয়া-ধোঁয়া কাউকে একটু দেখলাম মনে হলো, কিংবা কেউ কি একটা খামচি দিল পিঠে!? সেরকম এক অদ্ভুত অনুভূতি।
দৃশ্যটা এখনো মুদ্রিত হয়ে আছে চোখের তারায়। অনুভূতিটাও সেরকমই অটুট, এই এতদিন পরেও। ভাবছিলাম ফেরার পথে হয়তো দেখব, কুঁড়েঘরটা আর নেই ওখানে। কিন্তু না, আছে। তবে মেয়েটিকে আর দেখলাম না। হয়তো সে তখন ঘরের ভেতর, হয়তো বনের পথে পথে। একবার ভেবেছিলাম, গাড়ি থামিয়ে যাই, দেখি গিয়ে ব্যাপারটা কী? পরে ভাবলাম, নাহ্, থাক। থাকুক না রহস্যটা ওরকমই, যেমনটা অনুভব করলাম। কাছে যাওয়া হলো না আর।
ওই বাস্তব-অধিবাস্তব-মেশামেশি দৃশ্যটা আর ওই অনুভূতিটুকু স্ফুলিঙ্গ আকারে কাজ করে এই কবিতাটি লেখার ব্যাপারে। তা ছাড়া, কবিতা ও আখ্যানের মধ্যে ভেদরেখাগুলি কীরূপ, কবিতার ভেতরে আখ্যান আর আখ্যানের ভেতরে কবিতা কীভাবে জড়িয়ে-পেঁচিয়ে থাকে, অর্থাৎ যে-অভিন্ন শিল্পবস্তু সাহিত্যের এই উভয় আঙ্গিক (কবিতা ও কথাসাহিত্য)-এর ভেতর সঞ্চার করে সৌন্দর্য, দীপ্তি ও প্রাণ, তার স্বরূপটা কেমন, সেসবের একটা বোঝাবুঝি, একটা পরীক্ষানীরিক্ষার চেষ্টা রয়েছে আমার আগাগোড়াই। আমার অনেক কবিতাতেই রয়েছে চূর্ণ-চূর্ণ কাহিনি কিংবা কাহিনির আভাস। আর, একটা কথা আমার কেন যেন মনে হয়, পাঠক হিসাবে আমরা বোধহয় এরকম চাই-ও যে, কবিতায় হঠাৎ-হঠাৎ ঝিলকে উঠুক কাহিনিচূর্ণ বা আখ্যানের ইশারা।
একজন বর্ণদাসী ও একজন বিপিনবিহারী সমাচার
বনের কিনারে বাস, এক ছিল রূপবর্ণদাসী
আর ছিল, বনে বনে একা ঘোরে, সেই এক বিপিনবিহারী।
কন্যা তো সে নয় যেন বন্য মোম, নিশাদল-মাখা, বন্য আলোর বিদ্রূপ
রাতে মধ্যসমুদ্রে আগুন-লাগা জাহাজের রূপ
অঙ্গে অঙ্গে জ্বলে-
দূর থেকে তা-ই দেখে কত রঙ্গে, কতরূপ ছলে ও কৌশলে
মূর্ছা যায়-যায়-প্রায় কত যে বামন গিরিধারী
আর যত অন্য-অন্য অর্বাচীন বিপিনবিহারী।
কন্যা তো সে নয়, বুনো সুর, বুনো তান, আর উপমান, অরণ্যশোভার।
আঁচলে কূজন আঁকা তার, আমাদের সেই বহুবল্লভার।
বনের কিনারে বাস, ছিল এক রূপবর্ণদাসী
আর ছিল বনে বনে একা ঘোরে সেই এক বিপিনবিহারী।
অসবর্ণ তারা, অসমান, অসবংশের জাতক
একসঙ্গে তবু দোঁহে একই বুনো বাদলে স্নাতক।
তবু সেতু গড়ে ওঠে সন্ধ্যাকালে দূর দুই তটে
সেতু, দেহকথনের গোধূলিভাষ্যে তা ফুটে ওঠে।